অভিজ্ঞানশকুন্তলম থেকে শুক্লা শকুন্তলা by মোস্তফা তোফায়েল

মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’ নাটকের কাহিনী অবলম্বনে একটি পুর্নসৃষ্টিকর্ম মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘শুক্লা শকুন্তলা’। ‘শুক্লা শকুন্তলা’ কাব্যটি বত্রিশটি সনেট আঙ্গিকে চতুর্দশপদী কবিতার সংকলন, যে সনেটগুলোর প্রতিটির শেষ দুই পঙ্ক্তি শেকস্পিয়রীয় পয়ারবদ্ধ যুগল এবং নীতিবাক্যমূলক। তবে সনেট আঙ্গিকের চতুর্দশপদীসমূহ বিচ্ছিন্ন সত্তাবিশিষ্ট কবিতা নয়, কাব্যনাটকীয় চরিত্রায়নের সমষ্টি এবং সব ক’টি সনেটের সমাহার একটি পূর্ণাঙ্গ কাব্য। মহাকবি কালিদাসের শকুন্তলাকাহিনীর উৎস মহাভারত। মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘শুক্লা শকুন্তলা’র উৎস ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অনূদিত কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’। যেমন মার্লোর নাটক ‘ডক্টর ফস্টাস’-এর উৎস গ্যোটের ফস্ট কিংবা শেকস্পিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’-এর উৎস প্লুটার্কের রোমান ইতিহাস। মুহম্মদ নূরুল হুদা রচিত ‘শুক্লা শকুন্তলা’ কাব্যনাটকে সনেট এক একটি প্রস্তাবনা বা এপিলগ, যা আহ্বান আঙ্গিকে উচ্চারিত। কবি এই সনেট কবিতায় উপস্থাপন করেন কাব্যনাটকের নায়ক দুষ্মন্ত ও নায়িকা শকুন্তলাকে; ক্ষণিক পরিচয়ে উন্মোচন করেন তপোবন ও তপোবনের অধিবাসী মুনি-ঋষিবৃন্দ এবং কণ্বমুনিকে, সেই সঙ্গে উপস্থাপিত হয় রজনীগন্ধা, পূজা-উপচার, কন্তলারমণি শকুন্তলার রহস্যাবৃত জীবন-যৌবন এবং সেই উদ্ভিন্নযৌবনাকুল রমণীর হৃদয়রাজ্যে হস্তিনাপুরের রাজা দুষ্মন্তের মদনসুলভ শরনিক্ষেপণ। অমর্ত্যলোকের দেবতা দৃষ্টিবান নিক্ষেপ করে মর্ত্যকুটিরবাসী রমণীর প্রতি। মিলন ঘটে অমর্ত্যরে সঙ্গে মর্ত্যরে।
শুক্লা শকুন্তলা কাব্যনাটকটির ঘটনা ক্রমশ অগ্রগতি ও উন্নতি লাভ করতে থাকে চরিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে। নাটকীয়তায় অংশগ্রহণ থাকে দুষ্মন্তের ও নায়িকা শকুন্তলার (সনেট ৫); দুর্বাশা মুনির (সনেট ১২); ইডেনরূপে স্বর্গের (সনেট ১৬); কোরাসের (সনেট ২৫, ২৮, ২৯); ভাষ্যকার ও দার্শনিকের (সনেট ১৫, ৩০, ৩১)। উৎকর্ষ অর্জিত হয় ভাষ্যকারের আলোক প্রক্ষেপণীয় ভাষ্যে (সনেট ১৫)। যেখানে শুনি-
স্বর্গের সাথে মর্ত্য যখন মেলে
প্রাক-অনুমতি করে না তো প্রয়োজন।
মিলন মধুর মিলনেই উপাসনা
মিলিত মানুষে অমিত সম্ভাবনা।
কাব্যনাটক শুক্লা শকুন্তলার কাঠামো বিন্যাসে এভাবে শুরু বা সূচনাপর্ব, উন্নতি, উৎকর্ষ, অভিকর্ষ ও মোক্ষম অবস্থার সৃষ্টি হয়। নাট্যপরিকল্পনায় কবি তার কাহিনীকে একটি সুনির্দিষ্ট অভীষ্টে এগিয়ে নিয়ে যান- নিজস্ব শৈলী, স্বকীয়তা ও সৃজন প্রতিভায় বলীয়ান হয়ে।
মূল নাটকেও জৈবিক তাড়না আছে, তা শুধু দৃশ্যকল্পের ইঙ্গিতময় প্রকাশভঙ্গিতে। বৃক্ষবল্কল পরিহিত শকুন্তলার নবযৌবন, দৃঢ়পিনদ্ধ থাকতে অনিচ্ছুক হয়ে, তার বুকের চারদিকে ধাক্কা মেরে মেরে বহিঃপ্রকাশে অস্থির। বনের মধ্যে শিকারীর বেশে প্রবেশকারী দুষ্মন্ত অন্তরাল থেকে সেই জাজ্বল্যমান যৌবদৃশ্য উপভোগ করেন আর তাকান বনের নবমল্লিকাঋদ্ধ পল্লব দলের প্রতি, যে পল্লব দল আলিঙ্গন করছিল অন্য বৃক্ষের কাণ্ডগুলোকে। মুহম্মদ নূরুল হুদা বহির্লোকের এই দৃশ্যকল্পকে তার কাব্যে রূপায়ণ করেন অন্তর্লোকের আবেগানুভূতিতে। কালিদাসের চক্ষুষ্মানতা এক ধাপ এগিয়ে প্রকাশ লাভ করে মানব-আকাক্সক্ষার জৈবিক ও মানসিক অভিজ্ঞতাপুষ্ট উচ্চারণে-
দেবতারা সদাশয়; তাদের চরণে
দেবে যত হৃষ্টপুষ্ট উষ্ণ বলিদান
তুষ্ট তত দেবগণ, তত পুণ্যবান
হে শীর্ণ মানব তুমি অনন্ত অঙ্গনে।
(৫)
পক্ষান্তরে, দুষ্মন্তও বিগলিত শকুন্তলার রূপের অনলে-
যে রূপে আগুন জ্বলে কামারশালায়
লৌহপিণ্ড গলে যায়; যে রূপে জ্বালায়,
যে রূপে পুরুষমাত্র হয় অন্ধকূপ।
মাধব্য দেখিনি শুধু এমন প্রতিমা,
স্পর্শে যার খানখান রাজার মহিমা। (সনেট-৬)
শুধু সন্তান কামনা করেই অপার মানবিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে ক্ষান্ত নন শুক্লা শকুন্তলার রাজা দুষ্মন্ত, তিনি তার দীর্ঘ ও প্রশস্ত বক্ষ অধিকতর প্রসারিত করেন তার প্রজাদের জন্য। সে বক্ষ কালক্রমে হস্তিনাপুর রাজ্যের সমগ্র ভূখণ্ডের সমপরিমাণ হয়ে যায়; রাজা তার উদার বক্ষতলে সমমর্যাদায় উপলব্ধি করেন প্রজাদের সার্বিক অস্তিত্ব। রাজা হয়ে পড়েন প্রজাদের সমকক্ষ মানব-
ধর্মরাজ্যে ডর ভয় নেই কোনদিন
রাজা-প্রজা একপক্ষ, ভেদাভেদহীন। (সনেট ৮)
শুক্লপক্ষ আলোকউদ্ভাসিত শকুন্তলার চৌম্ব্যকস্পর্শেই রাজা দুষ্মন্তের এই মানবিক বিবর্তন, ‘শুক্লা শকুন্তলা’ কাব্যনাট্যে। পৌরাণিক কাহিনী এখানে পুনর্সৃজন ভূমিতে বিবর্তিত পরিবর্তিত। মানবসৌন্দর্যের অগ্নিপ্রভায় রাজহৃদয় স্বর্ণে পরিণত।
শুক্লা শকুন্তলার রাজা নিশ্চিত যে, তপোবনের প্রভাবেই তিনি আজ সাম্যজ্ঞানে দীক্ষিত। রাজা উচ্চারণ করেন যে, শকুন্তলার রূপচ্ছটাদীপ্ত শুভ্র তপোবনই সেই স্বর্গ বা ইডেন যে স্বর্গে উচ্চ-নিচ ভেদাভেদ অনুপস্থিত-
অতিথীপ্রবণ এই বন; যারা আছে
রাজাপ্রজা উচ্চাবচ ঋষি বা সন্ন্যাসী
সবাই স্বনিষ্ট মনে শোনে সেই বাঁশি,
উদার তরুর শীর্ষে শকুন্তেরা হাসে।
এই বনে আগন্তুক আসেন নির্ভয়ে
সৎকারের প্রশ্ন নিয়ে নেই কোনো তর্ক। (সনেট ১০)
শকুন্তলার শাস্তিভোগ, তার ত্যাগ ও তিতীক্ষা, তার একাগ্রতা, সততা ও সাধনা তাকে মোক্ষলাভ ও নির্বাণের পথে নিয়ে যায়। শকুন্তলা সে মুহূর্তে শুক্লা শকুন্তলায় পরিণত হয়-
এই গৃহ ছেড়ে আমি অন্য গৃহে যাই,
এসেছেন সম্মানিত দিব্যজ্যোতির্ময়;
প্রেমের প্রাসাদ তাও ছেড়ে চলে যাই;
এসেছেন সম্মানিত দিব্যজ্যোতির্ময়; (সনেট ২১)
সনেট ২৫-এ পাই গ্রিক নাটকের আদলে কোরাস চরিত্র। সংশয়াকুল দর্শক-পাঠকের উৎকণ্ঠা উপশমের উদ্দেশে কোরাস উচ্চারণ করে প্রোটাগোনিস্টের বর্তমান অবস্থা-
একটি চাবুক শুধু করে ফেরে তাড়া;
বাহু আছে, কিন্তু নেই বাহুর বাঁধন।
প্রতিক্ষণে জন্ম তার, মৃত্যু প্রতিক্ষণ
দুষ্মন্ত নিজেই আজ নিজের দুষ্মন। (সনেট- ২৫)
শকুন্তলা সান্ত্বনায় এগিয়ে আসে তার পিতা কণ্বমুনি। শকুন্তলার হারিয়ে ফেলা অঙ্গুরীয় উদ্ধার হয় মৎস্যশিকারীদের মাধ্যমে। দুষ্মন্তের বিস্মৃতি অতিক্রান্ত হলে তার হৃদয়ের দর্পণে ভেসে ওঠে তারই ঔরসজাত নিষ্পাপ-নির্দোষ সন্তানের কান্নার দৃশ্য-
অথচ মোহান্ত আমি, আমার অন্তর,
মাধব্য, হৃদয় জুড়ে কাঁদে কে মাসুম? (সনেট ২৭)
অতঃপর রাজা দুষ্মন্তকে কোরাস শোনায় জীবনের রূঢ় অভিজ্ঞতার কথা, উত্থান ও পতনের কথা এবং বিপর্যয় ও জয়ের কথা-
দাঁড়াতে দাঁড়াতে কেউ দাঁড়াবে না আর
কেবলি পিছলে যাবে, পিছলে কেবলি
কামক্রোধ হিংসাদ্বেষ মত্ত দলাদলি,
পথে পথে ভাঙা সেতু আর পারাপার। (সনেট ২৯)
অশেষ কান্নার শেষে অতঃপর আসে মিলন মুহূর্ত, কিন্তু তা একই সঙ্গে রচনা করে জীবনেরও অন্তিম লগ্নের শয়ন-শয্যা:
বিরহ বিব্রত করে বিরহীর মন
শুকায় মাংসপেশী শুকায় হৃদয়
কৃশকায় হয়ে ওঠে প্রফুল্ল সময়-
না, হয় না শেষ কখনও মিলন।
রবীন্দ্রনাথও বোধ করি এমনই এক মানব-পরিণতির বাণী উচ্চারণ করে গেছেন তার এক ভক্তিমূলক গানে-
“দিনের শেষে রৌদ্র জ্বালায়,
শুকায় মালা ফুলের মালায়
সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, প্রভু।”
কোনো কাব্যনাটকে যখন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যরসসমূহ উপভোগ্যরূপে প্রয়োগ হয় এবং গ্রন্থটির কাব্যদেহে অলংকারের সজ্জা হয়ে তার শোভা বর্ধন করে, তখন সে কাব্যনাটকের সাহিত্যসুধা সভামঞ্চ আমোদিত করে তোলে। পৌরা৭ণিক কাহিনীর শক্তি সম্পর্কে সচেতন কবি যখন মহাভারতের শকুন্তলা কাহিনীকে আধুনিক সাহিত্যের চারিত্র্য গুণে নবসৃজন করেন, তখন উপভোগ্য সেই সাহিত্যরসগুলো সিঞ্চন করতে থাকে নবজলধারা। শুক্লা শকুন্তলা কাব্যনাটকে আমরা উপভোগ করি অনেকগুলো সাহিত্যরস, যথা- শৃঙ্গাররস, করুণরস, বীররস, ভয়ানকরস, বাৎসল্যরস প্রভৃতি।
শুক্লা শকুন্তলা কাব্যনাটকের চরিত্র চিত্রায়নে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা কালিদাসের নাটক অভিজ্ঞানশকুন্তলার কাহিনী টুকুই শুধু গ্রহণ করেছেন, কিন্তু উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ঘটিয়েছেন রূপান্তর ও পুনঃসৃজন। সর্বশেষ সনেট এপিলগে কবি বাঙালি জাতিসত্তাজনিত ঐতিহ্যবিপন্নতার প্রতি ইঙ্গিত করে বিরূপ প্রভাবের প্রতি অঙ্গুলিসংকেত দান করেছেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিক নর-নারী সম্পর্ক গৌণ বিষয়। মুখ্য ও শাশ্বত বিষয় হচ্ছে হৃদয়জারিত প্রেম ও প্রেমের স্মারকচিহ্ন সন্তান, যা অতীত ও বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন রচনা করবে-
মিলন মুহূর্ত এলে কাঁপে তবু বাহু
নারী সত্য, সত্য নয় রমণীর রাহু (সনেট ২৭)
নাগরিক জীবনের ব্যক্তিক স্বার্থমগ্নতা ও শেকড়শূন্যতা কবিহৃদয়কে পীড়িত করেছে বলে তিনি এপিলগে এ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। শ্রমহীন উপার্জন ও সাধনাহীন বিদ্যাবাগীশদের উপপ্লব তাকে ব্যথিত করেছে। উম্মূল নগরজীবনের এই অভিশাপের বিপরীতে বর্তমান কবি যে শাশ্বত প্রেম, শাশ্বত মানুষ সন্ধান করেছেন, শুক্লা শকুন্তলা কাব্যনাট্যে, তা বৃহত্তর পাঠক সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করবে, প্রত্যাশা রইল।

No comments

Powered by Blogger.