মুক্তিযুদ্ধের সম্প্রসারিত লড়াই by সাদেক হোসেন খোকা
বাংলাদেশের
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দেশের সবাই বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত। মহান
মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের জীবন, অগণিত মা-বোনের ইজ্জত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের
রক্তের বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় বাংলাদেশ আজ এক ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে। গত বছরের ৫
জানুয়ারি ইতিহাসের নজিরবিহীন এক প্রতারণামূলক ভোট-নাটকের মধ্য দিয়ে
রাষ্ট্রমতা জবরদখলকারী অবৈধ সরকার তাদের মতা-ুধা মেটানোর জন্য দেশবাসীকে এই
বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকার অবৈধ মতার দাপটে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় গত দেড়মাস যাবত তালাবদ্ধ করে রেখেছে। একইভাবে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সেখানে সাংবাদিকদেরও ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। ওই দফতরের বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ এমনকি মোবাইল নেটওয়ার্কও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জাতীয় প্রেস কাব থেকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। বিএনপির নেতাদের দেখামাত্রই গ্রেফতার অথবা গুলি করা হচ্ছে। সাধারণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন দূরের কথা, এমনকি সাংবাদিকদের ব্রিফিং করার সুযোগও পাচ্ছেন না নেতারা। শুধু প্রেস ব্রিফিং এবং প্রেস বিজ্ঞপ্তি ইস্যু করার অপরাধে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি জানাতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন সাবেক দুই সংসদ সদস্য আশরাফউদ্দিন নিজান ও নাজিমউদ্দিন আহমদ। চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর গ্রেফতার করা হয়েছে তার উপদেষ্টা ও টিভি চ্যানেল মালিক সমিতির প্রেসিডেন্ট মোসাদ্দেক আলী ফালুকে। আরেক উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু ও ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিজ নিজ বাড়ি থেকে। তাদের প্রত্যেককেই দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। আরেক উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানকে চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পরপরই গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দীনের মতো নিরীহ মানুষকে গাড়ি পোড়ানোর মামলার আসামি বানিয়ে তার বাড়িতে গুলি করা হয়েছে। নির্বিচারে গুলি, ক্রসফায়ার, পেট্রলবোমার সন্ত্রাস ও গণগ্রেফতারের মাধ্যমে দেশজুড়ে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে সরকার।
অবৈধ মতাকে দীর্ঘায়িত করার অপচেষ্টা বাস্তবায়ন করার জন্য চলমান আন্দোলন-লড়াইয়ের মুখে তারা গণদাবি মেনে মতা ছাড়ার পরিবর্তে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করার এক ভয়াবহ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে উদ্যত হয়েছে। এ জন্য তারা প্রয়োজনে দেশকে সিরিয়া বা ইরাক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়ার হুমকিও প্রকাশ্যেই দিয়ে চলেছে। বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সরকার এক দিকে দলীয় ক্যাডার ও দলবাজ এজেন্টদের দিয়ে পেট্রলবোমা মেরে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে, অন্য দিকে বিরোধী দলের নিরীহ নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে ধরে নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে সরাসরি গুলি চালিয়ে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করছে। বর্বরোচিত এসব হত্যাকাণ্ড ও হামলার প্রকৃত হোতাদের অচিরেই গ্রেফতারের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং প্রত্যেক অপরাধীই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে। এ ছাড়া জুলুমবাজ অবৈধ সরকারের বিদায়ের পর জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত তিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।
এ কথা নতুন করে বলার অপো রাখে না যে, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে যে অশান্তির আগুন জ্বলছে, তার জন্য দায়ী আজকের প্রধানমন্ত্রী। তিনি সম্পূর্ণ একক সিদ্ধান্তে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দিয়ে এই আগুন জ্বেলেছেন। দেশের সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, বিশিষ্টজনেরা এমনকি শেখ হাসিনার নিজের দল আওয়ামী লীগও এই পদ্ধতি বহাল রাখার পে অভিমত দিয়েছিল। কিন্তু সবার মত উপো করে তিনি একক সিদ্ধান্তে একটি মীমাংসিত ব্যবস্থা ধ্বংস করার মাধ্যমে দেশকে দীর্ঘস্থায়ী বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। এরপর তিনি সম্পূর্ণ একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমের নীলনকশা অনুযায়ী গত বছরের ৫ জানুয়ারি দেশে এমন একটি ভোট-প্রতারণার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন, সভ্য দুনিয়ায় যার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নেই। আওয়ামী জোটের বাইরের সব রাজনৈতিক দল, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি, এলডিপি, গণফোরাম, বিকল্পধারা, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম আব্দুর রবের জাসদসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল এই সাজানো নির্বাচন বর্জন করে। জনগণের সর্বাত্মক প্রত্যাখ্যানের মুখে আওয়ামী জোট ১৫৪ আসনে তাদের প্রার্থীদের নির্বাচন ছাড়াই নির্বাচিত ঘোষণা করে। জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার ঘোরতর আপত্তি উপো করে তথাকথিত ওই নির্বাচনী নাটকের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবৈধ সরকার কার্যতপে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশকেই ডাকাতি করে নেয়। দেশজুড়ে বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা করার পাশাপাশি হাজার হাজার নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারের পর কারাগারে নিপে করা হয়। এমন অব্যাহত জুলুম-নিপীড়ন সত্ত্বেও একটি শান্তিপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তার জোটভুক্ত দলগুলোকে সাথে নিয়ে গত এক বছর বড় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে না গিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এই শান্তিপূর্ণ আহ্বানকে আমল না দিয়ে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্নপর্যায়ের নেতা ও পাতি নেতারা বিরোধী দলের আন্দোলন-সমতা নিয়ে প্রায় নিয়মিতভাবে ঠাট্টা-মশকারা করে বক্তব্য দিয়েছে। সেই সাথে দমন-পীড়নের স্টিমরোলার চালিয়ে বিরোধী মতকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার দানবীয় উন্মাদনায় লিপ্ত থেকেছে।
এই পটভূমিতেই গত ৫ জানুয়ারি বিরোধী জোট রাজধানী ঢাকায় গণতন্ত্র হত্যা দিবস উপলে সমাবেশের কর্মসূচি দেয়। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের ভয়ে সদা তটস্থ সরকার জনগণের মুখোমুখি হওয়ার সাহস দেখাতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। দুনিয়ার ঘৃণিত স্বৈরশাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণে তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের পথ রুদ্ধ করার পাশাপাশি বিরোধী দলের ওপর নজিরবিহীন জুলুম-নির্যাতন শুরু করে। সরকারই বস্তুত বিরোধী জোটকে টানা আন্দোলন-লড়াইয়ের পথে ঠেলে দেয়। এরপর গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সরকারের সীমাহীন দমন-পীড়ন ও বর্বরোচিত হত্যা-নির্যাতন উপো করে দেশবাসী এই জুলমবাজ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সফল গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এ অবস্থায় সরকার এখনো পর্যন্ত মতা আঁকড়ে থাকার সুযোগ পেয়েছে কেবল বিভিন্ন বাহিনীর কিছু উগ্র দলবাজ কর্মকর্তার প্রত্য সহায়তায়। শাসক জোটের নেতারা প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের বুকে গুলি চালানোর উসকানি দিচ্ছেন। তাদের নির্দেশে প্রতিদিনই নিরপরাধ তরুণ ও যুবকদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। নৃশংস কায়দায় গুলি চালিয়ে ঝাঁজরা করে দেয়া হচ্ছে তাদের বুক। এরপর সেই ছবি আবার গণমাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে। যৌথবাহিনীর অভিযানের নামে বিরোধী দল সমর্থকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, কোথাওবা বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। এমনকি মহিলাদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো পৈশাচিক ঘটনাও সংঘটিত হচ্ছে। এসব ঘটনা কেবল মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভাবতে হবে তারা কার বুকে গুলি চালাচ্ছে? গণতন্ত্রের পে অবস্থান নেয়াটাই তাদের অপরাধ? এভাবে নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে তাদের কী লাভ? তারা তো কোনো দখলদার বাহিনীর সদস্য নয়। দেশে গণতন্ত্র ফিরে এলে তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরাই উপকৃত হবে। নৃশংসতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে নিবৃত্ত হওয়া উচিত আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের।
দেশে জনগণের চলমান আন্দোলন-লড়াইকে জঙ্গি তৎপরতা হিসেবে প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নিরীহ জনসাধারণের ওপর চালানো হচ্ছে বর্বরোচিত পেট্রলবোমা হামলা। ইতোমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়েছে যে, মূলত আওয়ামী লীগের ক্যাডাররাই এসব হামলা চালাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ হাতেনাতে ধরাও পড়েছে। দেশে আন্দোলনের নামে নিরীহ জনগণের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর সংস্কৃতির জন্মদাতা আওয়ামী লীগ এবং মতায় বসেও তারা এই সংস্কৃতি লালন করছে। ১৯৯৬ সালে আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগ কিভাবে ঢাকার শনির আখড়ায় বাসে পেট্রলবোমা হামলা চালিয়ে ১৭ জন নিরীহ যাত্রীকে পুড়িয়ে মেরেছিল সেটি কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এরপর ২০০৪ সালে শেরাটন হোটেলের পাশে বিআরটিসির বাসে গান পাউডার হামলা চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করা হয়। সে সময় তারা আন্দোলনের নামে বোমা-সন্ত্রাস চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হতাহত করেছিল।
এ কথা আজ দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, বর্তমান অবৈধ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে প্রকৃতপে প্রতিমুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস এবং মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনকেই পদদলিত করে চলেছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ল্য ছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের নিগড়মুক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তারা গণতন্ত্র হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম ভাঙিয়ে বাস্তবে কি চায়, তা আজ দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার। সুতরাং এই ধরনের প্রতারক সরকারের দ্রুত প্রস্থানই এখন দেশবাসীর প্রধান আকাক্সা। জনগণের নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া এই কঠিন সময়ে নিজের স্বাভাবিক জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। কার্যালয়ের ছোট্ট একটি কে কার্যত তিনি বন্দী জীবন যাপন করছেন, যেখানে খাওয়া কিংবা ঘুমোনোর কোনো স্বাভাবিক বন্দোবস্ত নেই। এ অবস্থায়ও দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় তাকে আসামি করা হচ্ছে। অতীতে স্বৈরাচার এরশাদকে হটিয়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তিনি ছিলেন আপসহীন প্রধান কাণ্ডারি এবং তার নেতৃত্বেই সে দিন গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ খুঁজে পেয়েছিল বাংলাদেশ। এ কারণে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণারে লেখা থাকবে।
এই নিপীড়ক শাসকচক্রের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন-লড়াই মোটেই বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের মতায় যাওয়ার লড়াই নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে পরিচালিত এই লড়াই মুক্তিযুদ্ধেরই একটি সম্প্রসারিত অংশ, যা জনগণের কাছে দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার জন্যই করা হচ্ছে। আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। কিন্তু বর্তমান অবৈধ সরকার অস্ত্রের জোরে সেই মালিকানা হাইজ্যাক করে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে জনগণের সব গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার। এ পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত লড়াইয়ের মাধ্যমে গণধিকৃত এই অবৈধ শাসকচক্রকে বিদায়ের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ছাড়া জনগণের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। এই ভূখণ্ডের জনগণ কখনো এ ধরনের জুলুমবাজির স্বৈরশাসন মেনে নেয়নি। সে কারণে কেবল ২০ দলীয় জোট নয়, আওয়ামী জোটের বাইরের সব রাজনৈতিক শক্তি আজ চলমান আন্দোলন-লড়াইয়ে একাত্ম। সরকারের নির্বিচার গুলি, কথিত ক্রসফায়ার ও পেট্রলবোমা সন্ত্রাসের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেসব নেতাকর্মী এই আন্দোলনকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছেন, তাদের ভূমিকা জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে।
বর্তমান অবৈধ শাসক গোষ্ঠী মতায় টিকে থাকার জন্য দেশের সব রকম গণমাধ্যমকে অদৃশ্য খাঁচায় বন্দী করেছে। মুক্ত গণমাধ্যম আর মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা। কিন্তু অবৈধ শাসনের জাঁতাকলে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনাও আজ নিদারুণভাবে পদদলিত। সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, টেলিভিশন ও বেতারের কার্যক্রমের ওপর আরোপ করা হয়েছে নানামুখী নিয়ন্ত্রণ। কেবল একতরফাভাবে সরকারের প্রশংসা প্রচার এবং চলমান আন্দোলন-লড়াইয়ের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে বাধ্য করা হচ্ছে মিডিয়াকে। অবৈধ সরকারের এমন নিয়ন্ত্রণমূলক কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে জনগণের আন্দোলন সম্পর্কে সত্য ও নিরপে ভূমিকা পালন করতে হবে সব গণমাধ্যম উদ্যোক্তা ও গণমাধ্যম কর্মীকে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক মন্ত্রী ও ঢাকা সিটি মেয়র
শেখ হাসিনার সরকার অবৈধ মতার দাপটে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় গত দেড়মাস যাবত তালাবদ্ধ করে রেখেছে। একইভাবে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সেখানে সাংবাদিকদেরও ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। ওই দফতরের বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ এমনকি মোবাইল নেটওয়ার্কও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জাতীয় প্রেস কাব থেকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। বিএনপির নেতাদের দেখামাত্রই গ্রেফতার অথবা গুলি করা হচ্ছে। সাধারণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন দূরের কথা, এমনকি সাংবাদিকদের ব্রিফিং করার সুযোগও পাচ্ছেন না নেতারা। শুধু প্রেস ব্রিফিং এবং প্রেস বিজ্ঞপ্তি ইস্যু করার অপরাধে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি জানাতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন সাবেক দুই সংসদ সদস্য আশরাফউদ্দিন নিজান ও নাজিমউদ্দিন আহমদ। চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর গ্রেফতার করা হয়েছে তার উপদেষ্টা ও টিভি চ্যানেল মালিক সমিতির প্রেসিডেন্ট মোসাদ্দেক আলী ফালুকে। আরেক উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু ও ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিজ নিজ বাড়ি থেকে। তাদের প্রত্যেককেই দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। আরেক উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানকে চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পরপরই গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দীনের মতো নিরীহ মানুষকে গাড়ি পোড়ানোর মামলার আসামি বানিয়ে তার বাড়িতে গুলি করা হয়েছে। নির্বিচারে গুলি, ক্রসফায়ার, পেট্রলবোমার সন্ত্রাস ও গণগ্রেফতারের মাধ্যমে দেশজুড়ে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে সরকার।
অবৈধ মতাকে দীর্ঘায়িত করার অপচেষ্টা বাস্তবায়ন করার জন্য চলমান আন্দোলন-লড়াইয়ের মুখে তারা গণদাবি মেনে মতা ছাড়ার পরিবর্তে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করার এক ভয়াবহ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে উদ্যত হয়েছে। এ জন্য তারা প্রয়োজনে দেশকে সিরিয়া বা ইরাক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়ার হুমকিও প্রকাশ্যেই দিয়ে চলেছে। বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সরকার এক দিকে দলীয় ক্যাডার ও দলবাজ এজেন্টদের দিয়ে পেট্রলবোমা মেরে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে, অন্য দিকে বিরোধী দলের নিরীহ নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে ধরে নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে সরাসরি গুলি চালিয়ে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করছে। বর্বরোচিত এসব হত্যাকাণ্ড ও হামলার প্রকৃত হোতাদের অচিরেই গ্রেফতারের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং প্রত্যেক অপরাধীই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে। এ ছাড়া জুলুমবাজ অবৈধ সরকারের বিদায়ের পর জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত তিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।
এ কথা নতুন করে বলার অপো রাখে না যে, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে যে অশান্তির আগুন জ্বলছে, তার জন্য দায়ী আজকের প্রধানমন্ত্রী। তিনি সম্পূর্ণ একক সিদ্ধান্তে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দিয়ে এই আগুন জ্বেলেছেন। দেশের সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, বিশিষ্টজনেরা এমনকি শেখ হাসিনার নিজের দল আওয়ামী লীগও এই পদ্ধতি বহাল রাখার পে অভিমত দিয়েছিল। কিন্তু সবার মত উপো করে তিনি একক সিদ্ধান্তে একটি মীমাংসিত ব্যবস্থা ধ্বংস করার মাধ্যমে দেশকে দীর্ঘস্থায়ী বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। এরপর তিনি সম্পূর্ণ একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমের নীলনকশা অনুযায়ী গত বছরের ৫ জানুয়ারি দেশে এমন একটি ভোট-প্রতারণার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন, সভ্য দুনিয়ায় যার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নেই। আওয়ামী জোটের বাইরের সব রাজনৈতিক দল, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি, এলডিপি, গণফোরাম, বিকল্পধারা, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম আব্দুর রবের জাসদসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল এই সাজানো নির্বাচন বর্জন করে। জনগণের সর্বাত্মক প্রত্যাখ্যানের মুখে আওয়ামী জোট ১৫৪ আসনে তাদের প্রার্থীদের নির্বাচন ছাড়াই নির্বাচিত ঘোষণা করে। জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার ঘোরতর আপত্তি উপো করে তথাকথিত ওই নির্বাচনী নাটকের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবৈধ সরকার কার্যতপে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশকেই ডাকাতি করে নেয়। দেশজুড়ে বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা করার পাশাপাশি হাজার হাজার নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারের পর কারাগারে নিপে করা হয়। এমন অব্যাহত জুলুম-নিপীড়ন সত্ত্বেও একটি শান্তিপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তার জোটভুক্ত দলগুলোকে সাথে নিয়ে গত এক বছর বড় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে না গিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এই শান্তিপূর্ণ আহ্বানকে আমল না দিয়ে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্নপর্যায়ের নেতা ও পাতি নেতারা বিরোধী দলের আন্দোলন-সমতা নিয়ে প্রায় নিয়মিতভাবে ঠাট্টা-মশকারা করে বক্তব্য দিয়েছে। সেই সাথে দমন-পীড়নের স্টিমরোলার চালিয়ে বিরোধী মতকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার দানবীয় উন্মাদনায় লিপ্ত থেকেছে।
এই পটভূমিতেই গত ৫ জানুয়ারি বিরোধী জোট রাজধানী ঢাকায় গণতন্ত্র হত্যা দিবস উপলে সমাবেশের কর্মসূচি দেয়। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের ভয়ে সদা তটস্থ সরকার জনগণের মুখোমুখি হওয়ার সাহস দেখাতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। দুনিয়ার ঘৃণিত স্বৈরশাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণে তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের পথ রুদ্ধ করার পাশাপাশি বিরোধী দলের ওপর নজিরবিহীন জুলুম-নির্যাতন শুরু করে। সরকারই বস্তুত বিরোধী জোটকে টানা আন্দোলন-লড়াইয়ের পথে ঠেলে দেয়। এরপর গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সরকারের সীমাহীন দমন-পীড়ন ও বর্বরোচিত হত্যা-নির্যাতন উপো করে দেশবাসী এই জুলমবাজ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সফল গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এ অবস্থায় সরকার এখনো পর্যন্ত মতা আঁকড়ে থাকার সুযোগ পেয়েছে কেবল বিভিন্ন বাহিনীর কিছু উগ্র দলবাজ কর্মকর্তার প্রত্য সহায়তায়। শাসক জোটের নেতারা প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের বুকে গুলি চালানোর উসকানি দিচ্ছেন। তাদের নির্দেশে প্রতিদিনই নিরপরাধ তরুণ ও যুবকদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। নৃশংস কায়দায় গুলি চালিয়ে ঝাঁজরা করে দেয়া হচ্ছে তাদের বুক। এরপর সেই ছবি আবার গণমাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে। যৌথবাহিনীর অভিযানের নামে বিরোধী দল সমর্থকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, কোথাওবা বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। এমনকি মহিলাদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো পৈশাচিক ঘটনাও সংঘটিত হচ্ছে। এসব ঘটনা কেবল মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভাবতে হবে তারা কার বুকে গুলি চালাচ্ছে? গণতন্ত্রের পে অবস্থান নেয়াটাই তাদের অপরাধ? এভাবে নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে তাদের কী লাভ? তারা তো কোনো দখলদার বাহিনীর সদস্য নয়। দেশে গণতন্ত্র ফিরে এলে তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরাই উপকৃত হবে। নৃশংসতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে নিবৃত্ত হওয়া উচিত আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের।
দেশে জনগণের চলমান আন্দোলন-লড়াইকে জঙ্গি তৎপরতা হিসেবে প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নিরীহ জনসাধারণের ওপর চালানো হচ্ছে বর্বরোচিত পেট্রলবোমা হামলা। ইতোমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়েছে যে, মূলত আওয়ামী লীগের ক্যাডাররাই এসব হামলা চালাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ হাতেনাতে ধরাও পড়েছে। দেশে আন্দোলনের নামে নিরীহ জনগণের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর সংস্কৃতির জন্মদাতা আওয়ামী লীগ এবং মতায় বসেও তারা এই সংস্কৃতি লালন করছে। ১৯৯৬ সালে আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগ কিভাবে ঢাকার শনির আখড়ায় বাসে পেট্রলবোমা হামলা চালিয়ে ১৭ জন নিরীহ যাত্রীকে পুড়িয়ে মেরেছিল সেটি কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এরপর ২০০৪ সালে শেরাটন হোটেলের পাশে বিআরটিসির বাসে গান পাউডার হামলা চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করা হয়। সে সময় তারা আন্দোলনের নামে বোমা-সন্ত্রাস চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হতাহত করেছিল।
এ কথা আজ দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, বর্তমান অবৈধ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে প্রকৃতপে প্রতিমুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস এবং মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনকেই পদদলিত করে চলেছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ল্য ছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের নিগড়মুক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তারা গণতন্ত্র হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম ভাঙিয়ে বাস্তবে কি চায়, তা আজ দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার। সুতরাং এই ধরনের প্রতারক সরকারের দ্রুত প্রস্থানই এখন দেশবাসীর প্রধান আকাক্সা। জনগণের নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া এই কঠিন সময়ে নিজের স্বাভাবিক জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। কার্যালয়ের ছোট্ট একটি কে কার্যত তিনি বন্দী জীবন যাপন করছেন, যেখানে খাওয়া কিংবা ঘুমোনোর কোনো স্বাভাবিক বন্দোবস্ত নেই। এ অবস্থায়ও দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় তাকে আসামি করা হচ্ছে। অতীতে স্বৈরাচার এরশাদকে হটিয়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তিনি ছিলেন আপসহীন প্রধান কাণ্ডারি এবং তার নেতৃত্বেই সে দিন গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ খুঁজে পেয়েছিল বাংলাদেশ। এ কারণে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণারে লেখা থাকবে।
এই নিপীড়ক শাসকচক্রের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন-লড়াই মোটেই বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের মতায় যাওয়ার লড়াই নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে পরিচালিত এই লড়াই মুক্তিযুদ্ধেরই একটি সম্প্রসারিত অংশ, যা জনগণের কাছে দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার জন্যই করা হচ্ছে। আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। কিন্তু বর্তমান অবৈধ সরকার অস্ত্রের জোরে সেই মালিকানা হাইজ্যাক করে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে জনগণের সব গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার। এ পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত লড়াইয়ের মাধ্যমে গণধিকৃত এই অবৈধ শাসকচক্রকে বিদায়ের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ছাড়া জনগণের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। এই ভূখণ্ডের জনগণ কখনো এ ধরনের জুলুমবাজির স্বৈরশাসন মেনে নেয়নি। সে কারণে কেবল ২০ দলীয় জোট নয়, আওয়ামী জোটের বাইরের সব রাজনৈতিক শক্তি আজ চলমান আন্দোলন-লড়াইয়ে একাত্ম। সরকারের নির্বিচার গুলি, কথিত ক্রসফায়ার ও পেট্রলবোমা সন্ত্রাসের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেসব নেতাকর্মী এই আন্দোলনকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছেন, তাদের ভূমিকা জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে।
বর্তমান অবৈধ শাসক গোষ্ঠী মতায় টিকে থাকার জন্য দেশের সব রকম গণমাধ্যমকে অদৃশ্য খাঁচায় বন্দী করেছে। মুক্ত গণমাধ্যম আর মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা। কিন্তু অবৈধ শাসনের জাঁতাকলে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনাও আজ নিদারুণভাবে পদদলিত। সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, টেলিভিশন ও বেতারের কার্যক্রমের ওপর আরোপ করা হয়েছে নানামুখী নিয়ন্ত্রণ। কেবল একতরফাভাবে সরকারের প্রশংসা প্রচার এবং চলমান আন্দোলন-লড়াইয়ের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে বাধ্য করা হচ্ছে মিডিয়াকে। অবৈধ সরকারের এমন নিয়ন্ত্রণমূলক কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে জনগণের আন্দোলন সম্পর্কে সত্য ও নিরপে ভূমিকা পালন করতে হবে সব গণমাধ্যম উদ্যোক্তা ও গণমাধ্যম কর্মীকে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক মন্ত্রী ও ঢাকা সিটি মেয়র
No comments