হাবাগোবা সেই ছেলেটি এখন দিল্লির শিরোমণি
হিসারের বারা মহল্লায়, বাড়ির আঙিনায় শীতের রোদ পোহানো বয়স্ক মানুষগুলো আজ দারুণ খুশি। হরিয়ানার এই জিন্দাল কলোনিতে ৪৭ বছর আগে জন্ম নেয়া এক শিশু দিল্লির মুুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছে। ১৯৬৮ সালের ১৬ আগস্ট গীতা দেবী ও গোবিন্দ রামের কোল আলো করে নেমে এসেছিল এক চাঁদের টুকরো। এখন তা ধূমকেতু হয়ে আবির্ভূত হয়েছে ভারতের রাজনীতিতে। ধর্মীয় প্রভাব, গোত্রীয় সমর্থন কিংবা ক্যাডার বাহিনী ছাড়াই অবিশ্বাস্য বিপ্লব এনেছেন দিল্লির রাজক্ষমতায়। জন্মাষ্টমীতে জন্ম হওয়ায় দাদা-দাদি যাকে কৃষ্ণ বলে ডাকতেন। সেই কৃষ্ণদ্যুতিতেই ম্লান হয়ে গেছে নরেন্দ্র মোদির ‘সন্ন্যাস রশ্মি’। কেজরিওয়ালের বাবা ছিলেন একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। দরিদ্র পরিবারের মালিকানায় ছিল একটি স্কুটার। ছোটবেলার স্মৃতি খুব বেশি মনে নেই কেজরিওয়ালের। শনিপাত ও গাজিয়াবাদে ইংরেজি মাধ্যম মিশনারি স্কুলের পর হিসারের ক্যাম্পাস স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। তার সেসময়ের বন্ধুরা জানান, হাবাগোবা টাইপের ছেলে ছিল ও। ক্লাসের সামনের সারিতে চুপচাপ বসে থাকত। ঘন কালো চুলের ছেলেটিকে বেশ দুর্বল লাগত। ক্রিকেট, ফুটবলের পরিবর্তে বইপড়া ও দাবার ঘুটি খেলা পছন্দ করত। ১১ বছর বয়সে তার হাতে সবসময় পেন্সিল ও স্কেচ বক্স থাকত। গাছ-প্রাণী-ভবন যা কিছু দেখত খাতায় আঁকতে পারত সে। গ্রীষ্মের ছুটিতে নয়-দশ জন চাচাতো-মামাতো ভাইদের একটি দল এদিক-সেদিক হৈ হুল্লোড় করতে বেরিয়ে পড়ত। সেই ক্ষুদ্র দলের প্রধান কুসুম গয়াল (বর্তমানে চার্টার্ড অ্যাকাউট্যান্ট) বলেন, ‘আজকের মতো নেতৃত্বের গুণাবলী তখন কেজরিওয়ালের মধ্যে দেখিনি।’ শিশু বয়স থেকে ধর্মের প্রতি অনুরাগী ছিলেন কেজরিওয়াল। চার্চ স্কুলে নিয়মিত বাণী শ্রবণ ও বাড়িতে হিন্দুধর্মের নৈতিক শিক্ষায় প্রভাবিত ছিলেন তিনি। ঘুম থেকে উঠে, রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে নিয়মিত পূজা করতেন। তখন থেকেই কেজরিওয়ালের মধ্যে প্রবল দায়িত্ববোধ জন্ম নিয়েছিল। একবার আন্তঃস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নিজ স্কুলের দলপ্রধান ছিলেন তিনি। কিন্তু প্রতিযোগিতার আগের রাতে প্রচণ্ড জ্বর উঠেছিল তার। অথচ পরদিন গায়ে কম্বল পেঁচিয়ে বাবার স্কুটারে উঠে ঠিকই সেই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। ছোট বোন রঞ্জনা অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে কেজরিওয়াল সরারাত জেগে বোনকে বই পড়ে মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিলেন। খড়গপুরের আইআইটিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ই মূলত কেজরিওয়ালের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার বীজ বপন হয়। নিজের তুলনায় যারা হতভাগ্য, তাদের জন্য কিছু করার আকর্ষণ বোধ করতেন তিনি। নেহেরু হল হোস্টেলে চার বছর কেজরিওয়ালের সঙ্গে থেকেছেন নমিত অরোরা। তিনি বলেন, ‘কেজরিওয়াল অত্যন্ত স্পষ্টভাষী,
আÍবিশ্বাসী ও ভাবুক ছিলেন।’ আরেক ব্যাচমেট জর্জ লোবো (এখন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী) বলেন, ‘সবাই যখন ক্যারিয়ার নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকত, কেজরিওয়াল প্রায়ই বলতেন, এমন কিছু করা দরকার যাতে ভারতে পরিবর্তন আসবে।’ ১৯৯২ সালে বিজেপির রামমন্দির আন্দোলন ও বাবরি মসজিদ ভাঙার ব্যাপক বিরোধিতা করেছিলেন কেজরিওয়াল। টাটা স্টিলে কাজ করার সময় কোম্পানির ‘সমাজকল্যাণ’ বিভাগে দায়িত্ব চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার কেজরিওয়ালকে তার অনুমতি দেয়া হয়নি। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মাদার তেরেসার সঙ্গে দেখা করতে যান তিনি। কেজরিওয়াল বলেন, ‘ওটা আমার জীবনের স্বর্গীয় মুহূর্ত।’ দু’মাস তেরেসার সঙ্গেই থাকেন তিনি। পরবর্তী সময়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে প্রথমবারেই রাজস্ব কর্মকর্তা হন। কিন্তু কেজরিওয়ালের লক্ষ্য ছিল জনসেবা করার জন্য গোয়েন্দা পুলিশ হওয়ার। দ্বিতীয়বারও সেই রাজস্ব কর্মকর্তা। ১৯৯৩ সালের সরকারি ট্রেনিংয়ের সময় আরেক রাজস্ব কর্মকর্তা সুনিতার সঙ্গে পরিচয়। ৬২ সপ্তাহের ট্রেনিংকালে সুনিতার প্রতি মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন কেজরিওয়াল। বিয়ের পর সরকারি ফ্ল্যাটে ওঠেন তারা। জনগণের ‘তথ্য অধিকার’ আইন বাস্তবায়নের জন্য অবদান রাখেন তিনি। এর স্বীকৃতি স্বরূপ ম্যাগসাইসাই পুরস্কার লাভ করেন। আয়কর বিভাগে কাজ করে জনগণের দুর্দশা দূর করা সম্ভব নয় ভেবে চাকরি ছেড়ে ‘পরিবর্তন’ নামের এনজিও গড়েন তিনি। পরবর্তী সময়ে আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি অনুভব করেন, রাজনীতি ছাড়া দেশে পরিবর্তন সম্ভব নয়। ২০১২ সালে গঠন করেন আম আদমি পার্টি। ২০১৩ সালে কংগ্রেসের সহায়তায় সরকার গঠন করেন। লোকপাল বিল পাস করাতে ব্যর্থ হয়ে ৪৯ দিনের মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। এবার একচেটিয়া জনসমর্থন নিয়ে দিল্লির মসনদে ফিরলেন জনগণের বন্ধু কেজরিওয়াল। ইন্ডিয়া টুডে।
No comments