কালজয়ী সাংবাদিক by রেহানা সালাম
আমার
বাবার নাম আবদুস সালাম। অবিভক্ত পাকিস্তানের তিন বাঙালি মহাসম্পাদকের
অন্যতম, সাংবাদিক আবদুস সালাম। বহুদিন পর্যন্ত আমার কাছে তার এ পরিচয়টি ছিল
অজানা। আমার কাছে তিনি ছিলেন আমার আব্বু, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, আমার
শিক্ষক।
আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন ভোরে চা খেতে আসতেন মানিক চাচা (তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া)। হয়তো অনেক বিষয়ে মতের যথেষ্ট অমিল থাকত তাদের, কিন্তু বন্ধুত্ব গভীর ও দৃঢ় ছিল। 'জীবন থেকে নেয়া' ছবিটি ছিল একটি সাহসী চলচ্চিত্র। কিন্তু তৎকালীন সেন্সর বোর্ড এ ছবিটি প্রদর্শনের অনুমতি দিচ্ছিল না। যে সময় একদিন জহির রায়হান আর শহীদুল্লা কায়সার আমাদের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে এসেছিলেন। ছবিটির মুক্তির জন্য তাকে খুব আন্তরিকভাবে কথা বলতে শুনেছি।
আমার মায়ের মুখে শুনেছি, ভাষা আন্দোলনের সময় আমাদের বাড়িতে তৎকালীন অনেক ছাত্রনেতা আসতেন। ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্পাদক হওয়ার পরও আমার বাবা মনেপ্রাণে এবং কলমে অত্যন্ত জোরালোভাবে ভাষা আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করছিলেন। এর মূল্য তাকে দিতে হয়েছিল। তাকে কারাগারে যেতে হয়। পরেও তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন।
১৯৭১-এর ডিসেম্বরে আমরা বাবাসহ তোপখানা রোডে আমার মেজ বোনের বাসায় আত্মগোপন করি। সেখানে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন একদিন বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তার কাছেই আমরা জানতে পারি, বিভিন্ন স্থান থেকে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাদের ধানমণ্ডির বাড়ির দায়িত্বে ছিলেন বাবার ব্যক্তিগত সহকারী লাতু মিয়া এবং আমার ফুপাতো ভাই ড. মোস্তফা। তারা তোপখানা রোডে গোপনে এসে খবর দেন_ এরই মধ্যে দু'বার আলবদর বাহিনী (পরে নাম জানতে পারি) বাবার খোঁজ নিয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পর অবজারভারের নাম পরিবর্তন হলো। আবদুস সালামের বিরুদ্ধে দানা বাঁধল নতুন ষড়যন্ত্র। ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমসের প্রকাশনা উদ্যোগকে সফল করার জন্য প্রথমে সম্পাদক পদে আমন্ত্রণ জানানো হলো তাকে। কিন্তু তিনি সম্মত হলেন না। এর মধ্যে অবজারভারে প্রকাশিত হলো কালজয়ী সম্পাদকীয় 'দি সুপ্রিম টেস্ট'। (গণতান্ত্রিক চেতনার এক অমূল্য দলিল) সে লেখার ভুল ব্যাখ্যা হলো। সরকার আবদুস সালামকে অবজারভারের সম্পাদকের পদ থেকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করল। আবদুস সালামের ২২ বছরের সম্পাদক জীবনের অবসান হলো। নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন আবদুস সালাম। প্রেস ক্লাব আর বাসা_ এর ভেতরেই কেটে গেল চার-চারটি বছর। ১৯৭৬ সালে আবদুস সালাম একুশে পদক পেলেন। একই বছর তিনি লন্ডন গেলেন এবং লন্ডনে প্রেস ইনস্টিটিউটের কাজ দেখলেন। ফিরে এসে সরকারকে পিআইবির রূপরেখা দিলেন।
১৯৭৭-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি পিআইবির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন তিনি। যত সহজে এ দিনগুলোর কথা লিখেছি, তত সহজ ছিল না দিনগুলো। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে লড়তে হয়েছে আবদুস সালাম এবং তার পরিবারকে প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে। রাজনীতি না করেও বারবার নির্যাতিত হতে হয়েছে আবদুস সালামকে তার সত্য লিখন আর গণতন্ত্রের প্রতি সীমাহীন আগ্রহের কারণে। অনেক কাছের মানুষও সবসময় তার সঙ্গে ভালো আচরণ করেনি। ভেতরে-বাইরে নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে তাকে বারবার, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তিনি সত্যচ্যুত হননি। কোনো লোভ-লালসাই তাকে আপসকামী করে তুলতে পারেনি। একজন স্নেহময় পিতা ও একজন প্রেমময় স্বামী ছিলেন আবদুস সালাম। কিন্তু সবার আগে তিনি ছিলেন সেই বিরল সাংবাদিকদের একজন, যার কাছে প্রথম ও শেষ কথাই ছিল সৎ সাংবাদিকতা এবং দেশ।
সাংবাদিক আবদুস সালামের কন্যা
আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন ভোরে চা খেতে আসতেন মানিক চাচা (তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া)। হয়তো অনেক বিষয়ে মতের যথেষ্ট অমিল থাকত তাদের, কিন্তু বন্ধুত্ব গভীর ও দৃঢ় ছিল। 'জীবন থেকে নেয়া' ছবিটি ছিল একটি সাহসী চলচ্চিত্র। কিন্তু তৎকালীন সেন্সর বোর্ড এ ছবিটি প্রদর্শনের অনুমতি দিচ্ছিল না। যে সময় একদিন জহির রায়হান আর শহীদুল্লা কায়সার আমাদের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে এসেছিলেন। ছবিটির মুক্তির জন্য তাকে খুব আন্তরিকভাবে কথা বলতে শুনেছি।
আমার মায়ের মুখে শুনেছি, ভাষা আন্দোলনের সময় আমাদের বাড়িতে তৎকালীন অনেক ছাত্রনেতা আসতেন। ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্পাদক হওয়ার পরও আমার বাবা মনেপ্রাণে এবং কলমে অত্যন্ত জোরালোভাবে ভাষা আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করছিলেন। এর মূল্য তাকে দিতে হয়েছিল। তাকে কারাগারে যেতে হয়। পরেও তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন।
১৯৭১-এর ডিসেম্বরে আমরা বাবাসহ তোপখানা রোডে আমার মেজ বোনের বাসায় আত্মগোপন করি। সেখানে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন একদিন বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তার কাছেই আমরা জানতে পারি, বিভিন্ন স্থান থেকে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাদের ধানমণ্ডির বাড়ির দায়িত্বে ছিলেন বাবার ব্যক্তিগত সহকারী লাতু মিয়া এবং আমার ফুপাতো ভাই ড. মোস্তফা। তারা তোপখানা রোডে গোপনে এসে খবর দেন_ এরই মধ্যে দু'বার আলবদর বাহিনী (পরে নাম জানতে পারি) বাবার খোঁজ নিয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পর অবজারভারের নাম পরিবর্তন হলো। আবদুস সালামের বিরুদ্ধে দানা বাঁধল নতুন ষড়যন্ত্র। ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমসের প্রকাশনা উদ্যোগকে সফল করার জন্য প্রথমে সম্পাদক পদে আমন্ত্রণ জানানো হলো তাকে। কিন্তু তিনি সম্মত হলেন না। এর মধ্যে অবজারভারে প্রকাশিত হলো কালজয়ী সম্পাদকীয় 'দি সুপ্রিম টেস্ট'। (গণতান্ত্রিক চেতনার এক অমূল্য দলিল) সে লেখার ভুল ব্যাখ্যা হলো। সরকার আবদুস সালামকে অবজারভারের সম্পাদকের পদ থেকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করল। আবদুস সালামের ২২ বছরের সম্পাদক জীবনের অবসান হলো। নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন আবদুস সালাম। প্রেস ক্লাব আর বাসা_ এর ভেতরেই কেটে গেল চার-চারটি বছর। ১৯৭৬ সালে আবদুস সালাম একুশে পদক পেলেন। একই বছর তিনি লন্ডন গেলেন এবং লন্ডনে প্রেস ইনস্টিটিউটের কাজ দেখলেন। ফিরে এসে সরকারকে পিআইবির রূপরেখা দিলেন।
১৯৭৭-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি পিআইবির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন তিনি। যত সহজে এ দিনগুলোর কথা লিখেছি, তত সহজ ছিল না দিনগুলো। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে লড়তে হয়েছে আবদুস সালাম এবং তার পরিবারকে প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে। রাজনীতি না করেও বারবার নির্যাতিত হতে হয়েছে আবদুস সালামকে তার সত্য লিখন আর গণতন্ত্রের প্রতি সীমাহীন আগ্রহের কারণে। অনেক কাছের মানুষও সবসময় তার সঙ্গে ভালো আচরণ করেনি। ভেতরে-বাইরে নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে তাকে বারবার, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তিনি সত্যচ্যুত হননি। কোনো লোভ-লালসাই তাকে আপসকামী করে তুলতে পারেনি। একজন স্নেহময় পিতা ও একজন প্রেমময় স্বামী ছিলেন আবদুস সালাম। কিন্তু সবার আগে তিনি ছিলেন সেই বিরল সাংবাদিকদের একজন, যার কাছে প্রথম ও শেষ কথাই ছিল সৎ সাংবাদিকতা এবং দেশ।
সাংবাদিক আবদুস সালামের কন্যা
No comments