সাড়ে তিন হাত ভূমি
মুক্তিযুদ্ধ
চলছে। আগরতলায় ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় অপারেশন শুরু করবে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি
দল। এই দলে আছেন রবি। কমান্ডার খালেদ মোশাররফের অনুমতি নিয়ে তিনি এসেছেন
নিজেদের গ্রামে। বাড়িতে ঢুকে দেখেন উঠোনে পড়ে আছে বাবার লাশ, বসার ঘরে
মায়ের লাশ, বোনের লাশ তার ঘরে, সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর লাশ পেছন দিককার
উঠানে। এ দেখে অনুভূতিহীন হয়ে যান তিনি। একসময় উঠোনেই কবর খুঁড়তে শুরু
করেন। যখন যার কবর খুঁড়ছেন ঢুকে যাচ্ছেন তার স্মৃতির ভেতর। কথাশিল্পী
ইমদাদুল হক মিলনের ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’ উপন্যাসের প্রথম পর্বের আখ্যান
এরকম। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত উপন্যাসের একটা বড় ঘাটতি হল একটা নিখুঁত
চরিত্র। যার নাম শুনলেই মানসলোকে একজন মুক্তিযোদ্ধার পূর্ণাঙ্গ চারিত্র
ভেসে উঠবে। বাংলা সাহিত্যের নায়কদের যদি একটা তালিকা করতে বলা হয় তা করা
যাবে খুব সহজেই। নায়িকা বা খলনায়ক বা খলনায়িকা- সবার তালিকাই করা সম্ভব।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের এমন একটি চরিত্রের কথা কেউ কি বলতে
পারবে যার নাম শুনলেই একজন মুক্তিযোদ্ধার রূপ যার যার নিজস্ব কল্পনায় ভেসে
উঠবে? (বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ইভেন্ট এ মুক্তিযুদ্ধ। পরিতাপের বিষয় তা
নিয়ে আশানুরূপ সাহিত্য রচিত হয়নি।) কাজটা কঠিন। কারণ মুক্তিযুদ্ধের
বহুমাত্রিকতা। এ বহুমাত্রিকতাকে আঁকতে গেলে, এ বহুমাত্রিকতাকে ধারণ করতে
হলে এমন একজন শক্তিশালী লেখকের দরকার যিনি চরিত্রের ভেতরে প্রবেশ করে, তার
চরিত্রকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করে ভেতরের সবকিছু উপলব্ধির আওতায় আনতে পারবেন।
দৃশ্যে, বাস্তবে, চেতনায় চূড়ান্তবাবে একাত্ম না হলে যেটা আঁকা অসম্ভব।
মুক্তিযুদ্ধের এতদিন পর সম্ভবত কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলনের হাতেই অংকিত হল সেই চরিত্রের। যার কথা মনে হলেই মানসলোকে ভেসে উঠবে এমন এক মানুষের ছবি যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে স্বাধীনতার কাক্সক্ষায় জীবনকে বাজি রেখেছেন। যিনি দেশের মাটিকে মায়ের মতোই পবিত্র মনে করেন। যিনি যে কোনো পীড়নের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদী। যিনি কাঁদতে জানেন। যিনি কাঁদতে কাঁদতেই বুকের ভেতরে অগ্ন্যুৎপাতের মতো বিস্ফোরণ জমা করেন। সাড়ে তিন হাত ভূমির প্রথম পর্ব পড়ার পর মনে হয়েছে ইমদাদুল হক মিলনের হাতে রচিত হল মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে ভিন্নমাত্রার উপন্যাস।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত উপন্যাসের কতিপয় কমন বিষয় হল গোলাগুলি, গেরিলা অপারেশনের বর্ণনা, ব্রিজ ভেঙে ফেলা, ক্লাউন সদৃশ কতিপয় রাজাকারদের খুচরা কর্মকাণ্ড ইত্যাদি। এ উপন্যাসে আমরা যেটা খুব সতর্কতার সঙ্গে লঙ্গ করি সেটা হল এখানে স্পষ্ট করা হয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধ কেবল গোলাগুলির বিষয় নয়। পাকিস্তানিদের বোকা বানিয়ে ব্রিজ ভেঙে ফেলে কৌতুকানন্দ লাভ করাও নয়। যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ একটা চেতনার নাম। এ চেতনার সঙ্গে জড়িত আছে দেশাত্মবোধ। রয়েছে আত্ম-অধিকারের মর্যাদাকাক্সক্ষা। রয়েছে প্রতিবাদ। রয়েছে দ্রোহ। মুক্তিযোদ্ধা রবি এসব কিছুই ধারণ করে। তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায় তার শৈশব-কৈশরের যৌবনের বর্ণনা। পাওয়া যায় তার পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা। এভাবে তার মানসলোকের সন্ধানও পাওয়া যায়। চেতনা ধারনের সঙ্গে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কবর খুঁড়তে খুঁড়তে তার মনে পড়ছে কত কথা! এ কথার হাত ধরে ধরে কতসব চরিত্র এসে পড়ে! কিন্তু কোনো চরিত্রকেই উপন্যাসের চরিত্র মনে হয় না। মনে হয় জ্যান্ত মানুষ। ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে চোখের সামনেই। ইমদাদুল হক মিলন এমন এক কৌশল অবলম্বন করেছেন যেন টাইম মেশিনের মাধ্যমে পাঠককে পেছনে নিয়ে যাচ্ছেন। দেখাচ্ছেন সেই সময়ের চিত্র। কথক একজনই। তার দৃষ্টি তার অনুভব তার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দেখা হচ্ছে সবাইকে সবকিছুকে। কিন্তু কী অবলীলায় তা হয়ে যাচ্ছ অন্যদেরর নিঁখুত মনোস্তত্ত্ব। হয়ে যাচ্ছে পাঠকেরও। চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে ভেসে উঠছে সেই সময় সেই পরিবেশ, দেখা যাচ্ছে আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে সংস্কৃতি। সবকিছু মিলিয়ে চিত্রিত হচ্ছে বাঙালির জীবনের সবচেয়ে নাজুক সময়ের। যে সময়ে দেশের প্রতিটি ধূলিকণা ছিল অনিরাপদ।
সেই অনিরাপদ ধূলিকণার প্রতিটি প্রহর আঁকতে গিয়ে লেখক বেছে নিয়েছেন রবিকে। যে সাড়ে তিন হাত ভূমি খুঁড়তে খুঁড়তে হারিয়ে যাচ্ছেন বাবার ভেতরে, দাদার ভেতরে, মায়ের ভেতরে, বোনের ভেতরে, তার স্ত্রীর ভেতরে, তার অনাগত সন্তানের ভেতরে। এ স্মৃতিচারণার ভেতর দিয়েই রচিত হচ্ছে বাংলার মানুসের মুক্তির আকাক্সক্ষার পর্যায়, বাংলার মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস, বাংলার মানুষের ওপর অত্যাচারের বিভৎস্য রূপ, সর্বোপরি বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাস। ইতিহাসের চেতনা।
নিরন্নের কাল, অধিবাস, পরাধীনতা, কালো ঘোড়া, নুরজাহানের পর কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলনের আরেক সাহিত্যকর্ম যা তার প্রবল শক্তিমত্তার পরিচয় বহন করে। এ প্রতিভার সচল ব্যবহার আমরা আশা করি আর পিপাসার্ত হয়ে প্রতীক্ষা করি সাড়ে তিন হাত ভূমি’র পরবতী পর্বের।
সাড়ে তিন হাত ভূমি : ইমদাদুল হক মিলন
মুক্তিযুদ্ধের এতদিন পর সম্ভবত কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলনের হাতেই অংকিত হল সেই চরিত্রের। যার কথা মনে হলেই মানসলোকে ভেসে উঠবে এমন এক মানুষের ছবি যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে স্বাধীনতার কাক্সক্ষায় জীবনকে বাজি রেখেছেন। যিনি দেশের মাটিকে মায়ের মতোই পবিত্র মনে করেন। যিনি যে কোনো পীড়নের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদী। যিনি কাঁদতে জানেন। যিনি কাঁদতে কাঁদতেই বুকের ভেতরে অগ্ন্যুৎপাতের মতো বিস্ফোরণ জমা করেন। সাড়ে তিন হাত ভূমির প্রথম পর্ব পড়ার পর মনে হয়েছে ইমদাদুল হক মিলনের হাতে রচিত হল মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে ভিন্নমাত্রার উপন্যাস।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত উপন্যাসের কতিপয় কমন বিষয় হল গোলাগুলি, গেরিলা অপারেশনের বর্ণনা, ব্রিজ ভেঙে ফেলা, ক্লাউন সদৃশ কতিপয় রাজাকারদের খুচরা কর্মকাণ্ড ইত্যাদি। এ উপন্যাসে আমরা যেটা খুব সতর্কতার সঙ্গে লঙ্গ করি সেটা হল এখানে স্পষ্ট করা হয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধ কেবল গোলাগুলির বিষয় নয়। পাকিস্তানিদের বোকা বানিয়ে ব্রিজ ভেঙে ফেলে কৌতুকানন্দ লাভ করাও নয়। যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ একটা চেতনার নাম। এ চেতনার সঙ্গে জড়িত আছে দেশাত্মবোধ। রয়েছে আত্ম-অধিকারের মর্যাদাকাক্সক্ষা। রয়েছে প্রতিবাদ। রয়েছে দ্রোহ। মুক্তিযোদ্ধা রবি এসব কিছুই ধারণ করে। তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায় তার শৈশব-কৈশরের যৌবনের বর্ণনা। পাওয়া যায় তার পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা। এভাবে তার মানসলোকের সন্ধানও পাওয়া যায়। চেতনা ধারনের সঙ্গে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কবর খুঁড়তে খুঁড়তে তার মনে পড়ছে কত কথা! এ কথার হাত ধরে ধরে কতসব চরিত্র এসে পড়ে! কিন্তু কোনো চরিত্রকেই উপন্যাসের চরিত্র মনে হয় না। মনে হয় জ্যান্ত মানুষ। ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে চোখের সামনেই। ইমদাদুল হক মিলন এমন এক কৌশল অবলম্বন করেছেন যেন টাইম মেশিনের মাধ্যমে পাঠককে পেছনে নিয়ে যাচ্ছেন। দেখাচ্ছেন সেই সময়ের চিত্র। কথক একজনই। তার দৃষ্টি তার অনুভব তার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দেখা হচ্ছে সবাইকে সবকিছুকে। কিন্তু কী অবলীলায় তা হয়ে যাচ্ছ অন্যদেরর নিঁখুত মনোস্তত্ত্ব। হয়ে যাচ্ছে পাঠকেরও। চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে ভেসে উঠছে সেই সময় সেই পরিবেশ, দেখা যাচ্ছে আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে সংস্কৃতি। সবকিছু মিলিয়ে চিত্রিত হচ্ছে বাঙালির জীবনের সবচেয়ে নাজুক সময়ের। যে সময়ে দেশের প্রতিটি ধূলিকণা ছিল অনিরাপদ।
সেই অনিরাপদ ধূলিকণার প্রতিটি প্রহর আঁকতে গিয়ে লেখক বেছে নিয়েছেন রবিকে। যে সাড়ে তিন হাত ভূমি খুঁড়তে খুঁড়তে হারিয়ে যাচ্ছেন বাবার ভেতরে, দাদার ভেতরে, মায়ের ভেতরে, বোনের ভেতরে, তার স্ত্রীর ভেতরে, তার অনাগত সন্তানের ভেতরে। এ স্মৃতিচারণার ভেতর দিয়েই রচিত হচ্ছে বাংলার মানুসের মুক্তির আকাক্সক্ষার পর্যায়, বাংলার মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস, বাংলার মানুষের ওপর অত্যাচারের বিভৎস্য রূপ, সর্বোপরি বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাস। ইতিহাসের চেতনা।
নিরন্নের কাল, অধিবাস, পরাধীনতা, কালো ঘোড়া, নুরজাহানের পর কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলনের আরেক সাহিত্যকর্ম যা তার প্রবল শক্তিমত্তার পরিচয় বহন করে। এ প্রতিভার সচল ব্যবহার আমরা আশা করি আর পিপাসার্ত হয়ে প্রতীক্ষা করি সাড়ে তিন হাত ভূমি’র পরবতী পর্বের।
সাড়ে তিন হাত ভূমি : ইমদাদুল হক মিলন
No comments