ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিলে বিপর্যয় ঘটে by সিরাজুর রহমান
ঘরে-বরে
মন ওঠেনি মহিলার। তিক্তজীবনে আনন্দ শুধু টেলিভিশন দেখা। বিদেশী চ্যানেলে
বলতে গেলে স্বপ্নকে জ্যান্ত করে দেখায়, নাচে-গানে স্বপ্ন বিক্রি করে।
রাতজেগে তাই দেখেন তিনি। অতএব, ভোরে ওঠা হয়ে ওঠে না। ঘুম ভেঙে শিশু
পাড়া-জাগানো কান্না শুরু করে। কচি শিশু কথা বলতে পারে না। তার ক্ষুধা
পেয়েছে। মাকে নিয়ে টানাটানি করে। মা ঘুমের ঘোরেই দুটো চড়-চাপড় বসিয়ে দিলেন।
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে শিশু। কিন্তু শিশুর ক্ষুধা যুক্তি মানে না।
আবার তার ঘুম ভেঙে যায়। আবার কাঁদে। এবার আরো জোরে থাপ্পড় দিলেন মা। পাড়া
জাগিয়ে আরো জোরে কেঁদে উঠল শিশু। প্রতিবেশীদের ঘুম ভেঙে যায় রোজ ভোরে।
মেজাজ খারাপ হয়। আবার মায়াও হয় শিশুটির জন্য। কোনো দিন হয়তো প্রাণেই মেরে
ফেলবে শিশুটিকে।
পাড়ার মহিলারা একদিন বিকেলে সময় করে দেখা করতে আসেন। কুশলাদির পর জানতে চাইলেন, শিশুটির অসুখ নাকি? রোজ ভোরে এত কাঁদে কেন? মুখ বাঁকিয়ে মা বললেন, কী জানি? হয়তো ক্ষুধা পায়। সব সময় কেবল খেতে চায় রাক্ষসের মতো। ওই ছেলে মরলে বাঁচি। প্রতিবেশীরা ছি ছি করেন। অমন অলক্ষুণে কথা বলতে নেই। তা শিশুর তো ক্ষুধা পাবেই, ক্ষুধা পেলে খেতে দিলেই শিশু চুপ করে যাবে। এবারে চটে গেলেন মা। ওর কান্নায় আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। স্তনে দুধ আসে না। চুপ করে না কেন শিশু? চুপ করলেই তো দুধ দিতে পারি। সারা রাত জিটিভি দেখে মায়ের কি এত ভোরে ঘুম ভাঙবে? আর শিশু না কাঁদলে মা কী করে বুঝবেন তার ক্ষুধা পেয়েছে? এসব প্রশ্ন অনুক্ত রেখেই প্রতিবেশীদের মানে মানে চলে যেতে হয়। কী জানি, আবার কোনো হিতে বিপরীত হয়?
পরিচিত ঠেকছে কি আপনাদের এ কাহিনী? বাংলাদেশের কথা মনে পড়ছে? গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশ প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের কয়েকজন দুই নম্বর সারির নেতাকে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ভোজনটা আসলে ছিল উপলক্ষ। ওপরের কাহিনীর দরদি প্রতিবেশিনীদের মতো তিনিও এই দেশটার বুকফাটা কান্নায় উদ্বিগ্ন, চিন্তিত। দেশটার জন্য মায়া হয় তাদের। কোনো মতে থামানোর চেষ্টা তার একটা উদ্দেশ্য ছিল। সেটা উদ্দেশ্য না হলে নৈশভোজে তিনি আরো কয়েকজন বিদেশী রাষ্ট্রদূতকে নিমন্ত্রণ করবেন কেন?
পাগলে শুধুই পাগল দেখে
বিশ্বসমাজের প্রতিবেশীদের এটা নতুন প্রয়াস নয়। এই ইউরোপীয় ইউনিয়নও বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে বহুবার বিবৃতি দিয়েছে, প্রস্তাব পাস করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের সংসদ ও সরকার বহু প্রস্তাব পাস করেছে, বহু অনুরোধ করেছে। বিশ্বের বরেণ্য নেতারা সবাই বিবৃতি দিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব দীর্ঘ টেলিফোন সংলাপে অনুরোধ করেছেন বহুবার। সবারই এক কথা, এক উপদেশ : বিরোধীদের সাথে সংলাপ করুন, সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কিভাবে করতে হবে সমঝোতায় আসুন, তারপর সে সমঝোতা অনুযায়ী নির্বাচন দিন। তাহলে বাংলাদেশে শান্তি আসবে, জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ চব্বিশ ঘণ্টা উদ্বিগ্ন থাকবে না। ছেলেমেয়েরা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে, পরীক্ষা দেবে, পাস করবে, জীবিকার সন্ধানে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। সবাই নিজ নিজ কাজ করবে, দেশের উন্নতি হবে, মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। এসব পরামর্শ বলতে গেলে গোটা বিশ্বই দিয়ে আসছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? আমার ছোটবেলা আমিশাপাড়া বাজারে দেখা পাগলটার মতো আচরণ করে চলেছে ঢাকার অবৈধ সরকার। সবার দিকে আঙুল তুলে তুলে বলছে, ‘তুই পাগল, তুই পাগল।’
সম্মতির কাছাকাছি এসেছিলেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ প্রতিনিধি। আওয়ামী লীগ সরকারও সংলাপে রাজি হয়েছিল। স্থির হয়েছিল স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের মহাসচিব সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে চিঠি লিখে সংলাপ বৈঠকের আয়োজন পাকা করবেন। কিন্তু বান কি মুনের প্রতিনিধির বিমান ঢাকা বিমানবন্দর ছেড়ে যাওয়ার পরপরই সরকারের দিক থেকে ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল, ‘কিসের সংলাপ? কেন সংলাপ?’ সংলাপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মাঝারি ও অন্যান্য মন্ত্রীরা এবং আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল নেতারা এযাবৎ কত গুলো এবং কত রকমের পরস্পরবিরোধী বিবৃতি দিয়েছেন হিসাব করার সাহস আছে কারো? সকালে একজন যদি বলেন, সংলাপ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে, দুপুরে আরেকজন বলবেন, যত্তসব বাজে কথা, আগে খালেদা জিয়া হাসিনার পায়ে পড়ে মাফ চাক, তারপর দেখা যাবে। মাঝরাতে আরেকজন হয়তো নেশার ঘোরে বলে উঠলেন, বিএনপি ভেঙে দিক, খালেদা জিয়া আত্মহত্যা করুক, তার পরে দেখা যাবে। সৈয়দ আশরাফ চিঠি লেখেননি, সংলাপ এখনো হয়নি, ঝানু কূটনীতিক বান কি মুন গালে চপেটাঘাতের জ্বালা মুছতে মুছতে মৃদু হাসি হাসলেন।
ঘোড়া আগে না গাড়ি আগে
সুতরাং মন্ত্রীদের কেউ কেউ মুখে সংলাপের কথা বলেন, পরমুহূর্তে অন্যরা সেটা নাকচ করে দেন। তাদের অজুহাত অমুকে মুখ ভেঙচি দিয়েছে, তমুকে জিহ্বা কিংবা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। আওয়ামী লীগের পাতিনেতাদের কেউ কেউ নাকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের নৈশভোজে বলে এসেছেন, বিএনপি যদি অবরোধ আর হরতাল বন্ধ করে তবে তারা সংলাপে রাজি হতেও পারেন। কিন্তু সেই যে গল্পটি দিয়ে শুরু করেছিলাম, শিশু যদি কান্না বন্ধ করে তাহলেই শুধু মা দুধ খেতে দেবেন। কিন্তু শিশুটি যে গোড়াতেই কাঁদতে শুরু করেছিল তার কারণটি যেন আদপেই বিবেচ্য নয়। কয়েক ঘণ্টা না যেতেই সরকারের ‘উল্টে গেল মতটা’। প্রধানমন্ত্রীর লড়াকু মার্কিন নাগরিক পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ঘোষণা করলেন, সংলাপ নয়, অস্ত্র দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বললেন ‘জিরো টলারেন্সের’ কথা। আর তার উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বললেন, অবরোধ-হরতাল বন্ধ হলেও সংলাপ হবে না।
সরকারের মন্ত্রীরা এবং আওয়ামী লীগের নেতারা শিশুর কান্নাকেই সঙ্কটের মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরতে চান, মায়ের দুপুর পর্যন্ত ঘুমোনোর বদ অভ্যাস কিংবা উপেক্ষা-অবহেলাকে নয়। তারা বলছেন, অবরোধ-হরতালই হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা। হরতাল-অবরোধ কেন শুরু হয়েছিল তার কারণটা থেকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ তারা আড়াল করে রাখতে চান। বিএনপি এবং সব বিরোধী দল নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং সে নির্বাচনের লক্ষ্যে সংলাপ চেয়েছিল। সরকার তাতে রাজি হয়নি, পাঁচ বছর ধরে ধাপ্পাবাজি করেছে। অবরোধ আর হরতাল দিতে বিরোধীরা বাধ্য হয়েছে সেজন্যই। সুতরাং এই অবরোধ আর হরতালের সব দায়দায়িত্ব সরকারের, খালেদা জিয়া কিংবা ২০ দলীয় জোটের নয়।
দেশ হাতছাড়া
মন্ত্রীরা নতুন কোনো যুক্তি, নতুন অজুহাত খুঁজে পাচ্ছেন না। নতুন কোনো পথের সন্ধানও নেই তাদের। দেশ তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন এরা দখলদারের মতোÑ একাত্তরের পাকিস্তানিদের মতো। অবরুদ্ধ ঢাকা দুর্গে বসে সেটা তারা বুঝতে পারছেন না, যদিও ‘স্টুপিড’ বলায় অভ্যস্ত। মন্ত্রী আবদুল মুহিত বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হয়। মুহিত অন্তত স্বীকার করেছেন যে, ঢাকার বাইরে পরিস্থিতি ‘মারাত্মক।’ উল্টোপাল্টা অনর্গল বাজে বকছেন মন্ত্রীরা। আর পুরনো খেলাগুলো নতুন করে খেলতে চাইছেন। আপনাদের মনে থাকার কথা, দিল্লির ও ওয়াশিংটনের সমর্থন পাওয়ার আশায় এরা ‘ইসলামি সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা করেছিল। এখন এরা আলকায়েদা আর ‘ইসলামিক স্টেট’ আবিষ্কার করছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আন্দোলনের মধ্যে। এবং হঠাৎ করে ২০০৪ সালের ৪ জুন শেরাটন মোড়ে বাসে আগুন লাগিয়ে ১১ জন যাত্রী দাহ করার মতো ঘটনার আধিক্য দেখা দিয়েছে।
একই সাথে সাথে সরকারের মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতির আধিক্য সাংঘাতিক রকম বেড়ে গেছে। হরতাল, অবরোধ, পরিবহনে বাধা দেয়া, বাস ও ট্রাকে আগুন লাগিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার অন্যায় সম্বন্ধে এরা সকাল-সন্ধ্যা উপদেশ দিচ্ছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটকে সরকারের প্রোপাগান্ডার মূল পুঁজি করা হয়েছে। মন্ত্রীরা এত বেশি কথা বলেন যে, সেসব ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেজন্যই একেক সময় একেক কথা বলেন এরা। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ অনেক ভুগেছে, অনেক সহ্য করেছে। লাগাতার ১৭৩ দিনের হরতাল, ১৯৯৬ সালের লাগাতার হরতাল, অবরোধ, রেললাইন উপড়ানো, বন্দর ও সড়ক অবরোধ এবং অনেক প্রাণহানি; ২০০৬ সালের লগি-লাঠি-বৈঠার আন্দোলন, দিনদুপুরে রাজপথে মানুষ পিটিয়ে মারা, বঙ্গভবনের ফোন, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং সর্বোপরি ২০০৪ সালের জুন মানে শেরাটন মোড়ে বাসে আগুন লাগিয়ে ১১ জন যাত্রীকে পুড়িয়ে মারার বিভীষিকা বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিন ভুলবে না।
দেশে এখন সেসব ঘটনা আবার ঘটছে। কিন্তু ঘটনাগুলোর পেছনে আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের হাতের ছাপ এমন অভিযোগও উঠেছে। মন্ত্রীরা তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বের সামনে খালেদা জিয়াকে ‘হুকুমের আসামি’ সাব্যস্তÍ করতে চাইছেন। কিন্তু বাস্তবে কী দেখছি আমরা? আমরা দেখছি, প্রায় ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ দলীয় পুলিশ বোমাবাজি আর বাস পোড়ানোতে যাদের গ্রেফতার করছে তারা ছাত্রলীগ আর যুবলীগের লোক। বহু স্থানে পেট্রলবোমা ও ‘ককটেল’ বোমাগুলো পাওয়া যাচ্ছে তাদের অফিসে, ১০টি পেট্রলবোমা পাওয়া গেছে চাটগাঁয় আওয়ামী লীগের অফিসেই। বোমা ফেটে আগুন ধরছে তাদের অফিসে, চৌদ্দগ্রামে বাসে বোমা মেরে আগুন লাগানোর পরপরই পুলিশ পেট্রলবোমাসহ যাদের গ্রেফতার করেছে তারা ছাত্রলীগের লোক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়ের হত্যার দায়ে যে পাঁচজনকে আদালত মৃত্যুদণ্ড আর যে ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন, তারাও সবাই ছাত্রলীগেরই সদস্য। এসব ঘটনার জন্য কাকে হুকুমের আসামি করার কথা আপনার প্রথমেই মনে পড়বে?
মন্ত্রীরা আতঙ্কিত, বেপরোয়া
বহুবার আমি লিখেছি, বাংলাদেশের প্রায় সব চিন্তাবিদ বলেছেন, গদি হারানোর আর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনিশ্চয়তার কারণে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা আতঙ্কিত এবং বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের বিভীষিকার আরো কিছু কারণ দিল্লিতে তাদের পৃষ্ঠপোষক কংগ্রেস সরকারের তিরোধান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে নতুন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অপ্রত্যাশিত ধরনের সুসম্পর্ক, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করা সম্পর্কে দুই বিশ্বনেতার মতৈক্য ইত্যাদি। মোদি সরকার হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না, সময় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। বাংলাদেশের মন্ত্রীদের ধৈর্যের বাঁধ আর বুঝি টেকে না। নরেন্দ্র মোদির সিদ্ধান্ত তাদের বিরুদ্ধে গেলে দেশ-বিদেশে কোথাও তাদের অস্তিত্ব নিরাপদ হবে না।
শেখ হাসিনা ও তার সরকার অনেক চুক্তির ভিত্তিতে ভারতকে অনেক কিছু দিয়ে দিয়েছে। এত দিয়েছে যে ভারতবাসীও এতটা আশা করেনি। স্বভাবতই ভারতে এ সরকারের বহু কৃতজ্ঞ সমর্থক ও শুভকামী আছে। পরাজিত কংগ্রেস পুরনো রাজনৈতিক দল। নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক নীতিকে প্রভাবিত করা, পথভ্রষ্ট করার চেষ্টার বহু কলকাঠি তাদের হাতে আছে। এ ছাড়া এক শ্রেণীর ভারতীয় মিডিয়ার ‘মিসচিফ-মেকিংয়ের’ প্রতিভা বলতে গেলে প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপার। এদের অনেকে কংগ্রেস সরকারগুলোর অনেক নুনও খেয়েছেন। বিচিত্র নয় যে, তারা মোদি সরকারকে বেকায়দায় ফেলার, বিব্রত করার যেকোনো চেষ্টা করবেন। এ রকম একটা চেষ্টার মুখোমুখি হলাম আমার ৩৪ বছরের কর্মক্ষেত্র বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠান থেকে।
বিবিসি বাংলা গত সপ্তাহে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘বাংলাদেশে গত এক মাস ধরে যে প্রায় নজিরবিহীন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা চলছে, সেই সঙ্কটে ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্ব ঢাকার শেখ হাসিনা সরকারের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত বলেই ইঙ্গিত মিলেছে।’ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গত বছরের ৫ জানুয়ারির যে বিতর্কিত নির্বাচনের বর্ষপূর্তি থেকে সে দেশে বর্তমান সঙ্কটের শুরু, সে নির্বাচনকে বলিষ্ঠভাবে সমর্থন করেছিল প্রতিবেশী ভারত। তার কয়েক মাসের মধ্যে খোদ ভারতেই ক্ষমতার পালাবদল হয়েছেÑ কিন্তু কংগ্রেসকে হটিয়ে যারা দিল্লির ক্ষমতায় এসেছে সেই বিজেপি নেতৃত্বও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর পুরোপুরি ভরসা রাখতে রাজি বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বিবিসি লন্ডন আর বিবিসি ঢাকা- ব্যবধান কত দুস্তর?
বিবিসির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থ নাথ সিং, যিনি বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সাথেও যোগাযোগ রাখেনÑ তিনি সেটা এক রকম স্বীকারও করে নিলেন। মি. সিং বিবিসিকে বলছিলেন, ভারতের সম্পর্কটা যদিও বাংলাদেশের সাথে, তারপরও কোন দল সেখানে ক্ষমতায়, সেটাও কিন্তু একটা ফ্যাক্টর। আর সে দিক থেকে বলতে হবে, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থের প্রতি, আমাদের উদ্বেগের প্রতি দারুণ বিবেচনা দেখিয়েছেন। আর বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় ভারত যে জাতীয় স্বার্থকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেবে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।’
অনেক প্রশ্ন উঠছে এখানে। আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থের প্রতি ‘দারুণ বিবেচনা দেখিয়েছেন’ বলেই ক্রুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ। এরা মনে করে, তাদের সম্মতি ছাড়া এবং বাংলদেশের সার্বভৌমত্বের বিরোধী বহু কিছু ভারতকে দেয়া হয়েছে গায়ের জোরে। গায়ের জোরে যা দেয়া হয়েছে, সময় এলে বাংলাদেশের মানুষ আবার গায়ের জোরে সেটা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করবে। তাতে বিপর্যয়ের বীজ নিহিত আছে এবং সে ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক বরাবরের জন্য তিক্ত হয়ে থাকবে। গত মে মাসের নির্বাচনের পর বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল, মোদি সরকার সাময়িক সুবিধার চেয়ে দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। সেজন্যই মোদি সরকারের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট নীতি ঘোষণার প্রত্যাশায় আছে বাংলাদেশের মানুষ। ইতোমধ্যে প্রাদেশিক একজন বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির সরকারের হয়ে কথা বলার কর্তৃত্ব রাখেন কি না এবং সংশ্লিষ্ট সংবাদদাতা কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বে সিদ্ধার্থ নাথ সিংয়ের প্রভাব যাচাই করে দেখেছেন কি না সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। এখন দেখা যাচ্ছে, সে সন্দেহ বাস্তবও বটে। মাত্র গত সোমবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনে বাংলাদেশের ব্যাপারে পক্ষপাতী না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অবশ্যই তার এ অর্থ করতে হবে যে, বাংলাদেশ নীতি নিয়ে মোদি সরকার এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি।
আমি বিবিসি বাংলা বিভাগ ছেড়েছি ২১ বছর আগে। এরপর থেকে বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান শোনার সুযোগ কমই পাই। বিবিসিতেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এককালে যেটা ছিল বিবিসি লন্ডন, সেটা এখন বিবিসি ঢাকা, বিবিসি দিল্লি কিংবা বিবিসি ইসলামাবাদ। লন্ডনের দিনে সংবাদদাতাদের সংবাদ ও প্রতিবেদন ইত্যাদি একাধিক স্তরে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনার পরই শুধু প্রচার করা হতো। হালকা ওজনের রাজনীতিকের উক্তির ওপর ভরসা করে আমরা কখনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধে খবর প্রচার কিংবা মন্তব্য করিনি। বিবিসির পুরনো শ্রোতাদের কেউ কেউ যোগাযোগ রাখেন। এরা বলেন, বিবিসি লন্ডন আর বিবিসি ঢাকা কিংবা বিবিসি দিল্লির মধ্যে ব্যবধান মাঝে মাঝে দুস্তর মনে হয়। কিন্তু কত দুস্তর, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
(লন্ডন, ১০.০২.১৫)
serajurrahman34@gmail.com
পাড়ার মহিলারা একদিন বিকেলে সময় করে দেখা করতে আসেন। কুশলাদির পর জানতে চাইলেন, শিশুটির অসুখ নাকি? রোজ ভোরে এত কাঁদে কেন? মুখ বাঁকিয়ে মা বললেন, কী জানি? হয়তো ক্ষুধা পায়। সব সময় কেবল খেতে চায় রাক্ষসের মতো। ওই ছেলে মরলে বাঁচি। প্রতিবেশীরা ছি ছি করেন। অমন অলক্ষুণে কথা বলতে নেই। তা শিশুর তো ক্ষুধা পাবেই, ক্ষুধা পেলে খেতে দিলেই শিশু চুপ করে যাবে। এবারে চটে গেলেন মা। ওর কান্নায় আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। স্তনে দুধ আসে না। চুপ করে না কেন শিশু? চুপ করলেই তো দুধ দিতে পারি। সারা রাত জিটিভি দেখে মায়ের কি এত ভোরে ঘুম ভাঙবে? আর শিশু না কাঁদলে মা কী করে বুঝবেন তার ক্ষুধা পেয়েছে? এসব প্রশ্ন অনুক্ত রেখেই প্রতিবেশীদের মানে মানে চলে যেতে হয়। কী জানি, আবার কোনো হিতে বিপরীত হয়?
পরিচিত ঠেকছে কি আপনাদের এ কাহিনী? বাংলাদেশের কথা মনে পড়ছে? গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশ প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের কয়েকজন দুই নম্বর সারির নেতাকে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ভোজনটা আসলে ছিল উপলক্ষ। ওপরের কাহিনীর দরদি প্রতিবেশিনীদের মতো তিনিও এই দেশটার বুকফাটা কান্নায় উদ্বিগ্ন, চিন্তিত। দেশটার জন্য মায়া হয় তাদের। কোনো মতে থামানোর চেষ্টা তার একটা উদ্দেশ্য ছিল। সেটা উদ্দেশ্য না হলে নৈশভোজে তিনি আরো কয়েকজন বিদেশী রাষ্ট্রদূতকে নিমন্ত্রণ করবেন কেন?
পাগলে শুধুই পাগল দেখে
বিশ্বসমাজের প্রতিবেশীদের এটা নতুন প্রয়াস নয়। এই ইউরোপীয় ইউনিয়নও বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে বহুবার বিবৃতি দিয়েছে, প্রস্তাব পাস করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের সংসদ ও সরকার বহু প্রস্তাব পাস করেছে, বহু অনুরোধ করেছে। বিশ্বের বরেণ্য নেতারা সবাই বিবৃতি দিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব দীর্ঘ টেলিফোন সংলাপে অনুরোধ করেছেন বহুবার। সবারই এক কথা, এক উপদেশ : বিরোধীদের সাথে সংলাপ করুন, সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কিভাবে করতে হবে সমঝোতায় আসুন, তারপর সে সমঝোতা অনুযায়ী নির্বাচন দিন। তাহলে বাংলাদেশে শান্তি আসবে, জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ চব্বিশ ঘণ্টা উদ্বিগ্ন থাকবে না। ছেলেমেয়েরা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে, পরীক্ষা দেবে, পাস করবে, জীবিকার সন্ধানে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। সবাই নিজ নিজ কাজ করবে, দেশের উন্নতি হবে, মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। এসব পরামর্শ বলতে গেলে গোটা বিশ্বই দিয়ে আসছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? আমার ছোটবেলা আমিশাপাড়া বাজারে দেখা পাগলটার মতো আচরণ করে চলেছে ঢাকার অবৈধ সরকার। সবার দিকে আঙুল তুলে তুলে বলছে, ‘তুই পাগল, তুই পাগল।’
সম্মতির কাছাকাছি এসেছিলেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ প্রতিনিধি। আওয়ামী লীগ সরকারও সংলাপে রাজি হয়েছিল। স্থির হয়েছিল স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের মহাসচিব সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে চিঠি লিখে সংলাপ বৈঠকের আয়োজন পাকা করবেন। কিন্তু বান কি মুনের প্রতিনিধির বিমান ঢাকা বিমানবন্দর ছেড়ে যাওয়ার পরপরই সরকারের দিক থেকে ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল, ‘কিসের সংলাপ? কেন সংলাপ?’ সংলাপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মাঝারি ও অন্যান্য মন্ত্রীরা এবং আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল নেতারা এযাবৎ কত গুলো এবং কত রকমের পরস্পরবিরোধী বিবৃতি দিয়েছেন হিসাব করার সাহস আছে কারো? সকালে একজন যদি বলেন, সংলাপ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে, দুপুরে আরেকজন বলবেন, যত্তসব বাজে কথা, আগে খালেদা জিয়া হাসিনার পায়ে পড়ে মাফ চাক, তারপর দেখা যাবে। মাঝরাতে আরেকজন হয়তো নেশার ঘোরে বলে উঠলেন, বিএনপি ভেঙে দিক, খালেদা জিয়া আত্মহত্যা করুক, তার পরে দেখা যাবে। সৈয়দ আশরাফ চিঠি লেখেননি, সংলাপ এখনো হয়নি, ঝানু কূটনীতিক বান কি মুন গালে চপেটাঘাতের জ্বালা মুছতে মুছতে মৃদু হাসি হাসলেন।
ঘোড়া আগে না গাড়ি আগে
সুতরাং মন্ত্রীদের কেউ কেউ মুখে সংলাপের কথা বলেন, পরমুহূর্তে অন্যরা সেটা নাকচ করে দেন। তাদের অজুহাত অমুকে মুখ ভেঙচি দিয়েছে, তমুকে জিহ্বা কিংবা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। আওয়ামী লীগের পাতিনেতাদের কেউ কেউ নাকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের নৈশভোজে বলে এসেছেন, বিএনপি যদি অবরোধ আর হরতাল বন্ধ করে তবে তারা সংলাপে রাজি হতেও পারেন। কিন্তু সেই যে গল্পটি দিয়ে শুরু করেছিলাম, শিশু যদি কান্না বন্ধ করে তাহলেই শুধু মা দুধ খেতে দেবেন। কিন্তু শিশুটি যে গোড়াতেই কাঁদতে শুরু করেছিল তার কারণটি যেন আদপেই বিবেচ্য নয়। কয়েক ঘণ্টা না যেতেই সরকারের ‘উল্টে গেল মতটা’। প্রধানমন্ত্রীর লড়াকু মার্কিন নাগরিক পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ঘোষণা করলেন, সংলাপ নয়, অস্ত্র দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বললেন ‘জিরো টলারেন্সের’ কথা। আর তার উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বললেন, অবরোধ-হরতাল বন্ধ হলেও সংলাপ হবে না।
সরকারের মন্ত্রীরা এবং আওয়ামী লীগের নেতারা শিশুর কান্নাকেই সঙ্কটের মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরতে চান, মায়ের দুপুর পর্যন্ত ঘুমোনোর বদ অভ্যাস কিংবা উপেক্ষা-অবহেলাকে নয়। তারা বলছেন, অবরোধ-হরতালই হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা। হরতাল-অবরোধ কেন শুরু হয়েছিল তার কারণটা থেকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ তারা আড়াল করে রাখতে চান। বিএনপি এবং সব বিরোধী দল নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং সে নির্বাচনের লক্ষ্যে সংলাপ চেয়েছিল। সরকার তাতে রাজি হয়নি, পাঁচ বছর ধরে ধাপ্পাবাজি করেছে। অবরোধ আর হরতাল দিতে বিরোধীরা বাধ্য হয়েছে সেজন্যই। সুতরাং এই অবরোধ আর হরতালের সব দায়দায়িত্ব সরকারের, খালেদা জিয়া কিংবা ২০ দলীয় জোটের নয়।
দেশ হাতছাড়া
মন্ত্রীরা নতুন কোনো যুক্তি, নতুন অজুহাত খুঁজে পাচ্ছেন না। নতুন কোনো পথের সন্ধানও নেই তাদের। দেশ তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন এরা দখলদারের মতোÑ একাত্তরের পাকিস্তানিদের মতো। অবরুদ্ধ ঢাকা দুর্গে বসে সেটা তারা বুঝতে পারছেন না, যদিও ‘স্টুপিড’ বলায় অভ্যস্ত। মন্ত্রী আবদুল মুহিত বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হয়। মুহিত অন্তত স্বীকার করেছেন যে, ঢাকার বাইরে পরিস্থিতি ‘মারাত্মক।’ উল্টোপাল্টা অনর্গল বাজে বকছেন মন্ত্রীরা। আর পুরনো খেলাগুলো নতুন করে খেলতে চাইছেন। আপনাদের মনে থাকার কথা, দিল্লির ও ওয়াশিংটনের সমর্থন পাওয়ার আশায় এরা ‘ইসলামি সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা করেছিল। এখন এরা আলকায়েদা আর ‘ইসলামিক স্টেট’ আবিষ্কার করছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আন্দোলনের মধ্যে। এবং হঠাৎ করে ২০০৪ সালের ৪ জুন শেরাটন মোড়ে বাসে আগুন লাগিয়ে ১১ জন যাত্রী দাহ করার মতো ঘটনার আধিক্য দেখা দিয়েছে।
একই সাথে সাথে সরকারের মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতির আধিক্য সাংঘাতিক রকম বেড়ে গেছে। হরতাল, অবরোধ, পরিবহনে বাধা দেয়া, বাস ও ট্রাকে আগুন লাগিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার অন্যায় সম্বন্ধে এরা সকাল-সন্ধ্যা উপদেশ দিচ্ছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটকে সরকারের প্রোপাগান্ডার মূল পুঁজি করা হয়েছে। মন্ত্রীরা এত বেশি কথা বলেন যে, সেসব ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেজন্যই একেক সময় একেক কথা বলেন এরা। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ অনেক ভুগেছে, অনেক সহ্য করেছে। লাগাতার ১৭৩ দিনের হরতাল, ১৯৯৬ সালের লাগাতার হরতাল, অবরোধ, রেললাইন উপড়ানো, বন্দর ও সড়ক অবরোধ এবং অনেক প্রাণহানি; ২০০৬ সালের লগি-লাঠি-বৈঠার আন্দোলন, দিনদুপুরে রাজপথে মানুষ পিটিয়ে মারা, বঙ্গভবনের ফোন, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং সর্বোপরি ২০০৪ সালের জুন মানে শেরাটন মোড়ে বাসে আগুন লাগিয়ে ১১ জন যাত্রীকে পুড়িয়ে মারার বিভীষিকা বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিন ভুলবে না।
দেশে এখন সেসব ঘটনা আবার ঘটছে। কিন্তু ঘটনাগুলোর পেছনে আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের হাতের ছাপ এমন অভিযোগও উঠেছে। মন্ত্রীরা তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বের সামনে খালেদা জিয়াকে ‘হুকুমের আসামি’ সাব্যস্তÍ করতে চাইছেন। কিন্তু বাস্তবে কী দেখছি আমরা? আমরা দেখছি, প্রায় ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ দলীয় পুলিশ বোমাবাজি আর বাস পোড়ানোতে যাদের গ্রেফতার করছে তারা ছাত্রলীগ আর যুবলীগের লোক। বহু স্থানে পেট্রলবোমা ও ‘ককটেল’ বোমাগুলো পাওয়া যাচ্ছে তাদের অফিসে, ১০টি পেট্রলবোমা পাওয়া গেছে চাটগাঁয় আওয়ামী লীগের অফিসেই। বোমা ফেটে আগুন ধরছে তাদের অফিসে, চৌদ্দগ্রামে বাসে বোমা মেরে আগুন লাগানোর পরপরই পুলিশ পেট্রলবোমাসহ যাদের গ্রেফতার করেছে তারা ছাত্রলীগের লোক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়ের হত্যার দায়ে যে পাঁচজনকে আদালত মৃত্যুদণ্ড আর যে ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন, তারাও সবাই ছাত্রলীগেরই সদস্য। এসব ঘটনার জন্য কাকে হুকুমের আসামি করার কথা আপনার প্রথমেই মনে পড়বে?
মন্ত্রীরা আতঙ্কিত, বেপরোয়া
বহুবার আমি লিখেছি, বাংলাদেশের প্রায় সব চিন্তাবিদ বলেছেন, গদি হারানোর আর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনিশ্চয়তার কারণে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা আতঙ্কিত এবং বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের বিভীষিকার আরো কিছু কারণ দিল্লিতে তাদের পৃষ্ঠপোষক কংগ্রেস সরকারের তিরোধান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে নতুন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অপ্রত্যাশিত ধরনের সুসম্পর্ক, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করা সম্পর্কে দুই বিশ্বনেতার মতৈক্য ইত্যাদি। মোদি সরকার হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না, সময় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। বাংলাদেশের মন্ত্রীদের ধৈর্যের বাঁধ আর বুঝি টেকে না। নরেন্দ্র মোদির সিদ্ধান্ত তাদের বিরুদ্ধে গেলে দেশ-বিদেশে কোথাও তাদের অস্তিত্ব নিরাপদ হবে না।
শেখ হাসিনা ও তার সরকার অনেক চুক্তির ভিত্তিতে ভারতকে অনেক কিছু দিয়ে দিয়েছে। এত দিয়েছে যে ভারতবাসীও এতটা আশা করেনি। স্বভাবতই ভারতে এ সরকারের বহু কৃতজ্ঞ সমর্থক ও শুভকামী আছে। পরাজিত কংগ্রেস পুরনো রাজনৈতিক দল। নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক নীতিকে প্রভাবিত করা, পথভ্রষ্ট করার চেষ্টার বহু কলকাঠি তাদের হাতে আছে। এ ছাড়া এক শ্রেণীর ভারতীয় মিডিয়ার ‘মিসচিফ-মেকিংয়ের’ প্রতিভা বলতে গেলে প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপার। এদের অনেকে কংগ্রেস সরকারগুলোর অনেক নুনও খেয়েছেন। বিচিত্র নয় যে, তারা মোদি সরকারকে বেকায়দায় ফেলার, বিব্রত করার যেকোনো চেষ্টা করবেন। এ রকম একটা চেষ্টার মুখোমুখি হলাম আমার ৩৪ বছরের কর্মক্ষেত্র বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠান থেকে।
বিবিসি বাংলা গত সপ্তাহে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘বাংলাদেশে গত এক মাস ধরে যে প্রায় নজিরবিহীন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা চলছে, সেই সঙ্কটে ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্ব ঢাকার শেখ হাসিনা সরকারের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত বলেই ইঙ্গিত মিলেছে।’ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গত বছরের ৫ জানুয়ারির যে বিতর্কিত নির্বাচনের বর্ষপূর্তি থেকে সে দেশে বর্তমান সঙ্কটের শুরু, সে নির্বাচনকে বলিষ্ঠভাবে সমর্থন করেছিল প্রতিবেশী ভারত। তার কয়েক মাসের মধ্যে খোদ ভারতেই ক্ষমতার পালাবদল হয়েছেÑ কিন্তু কংগ্রেসকে হটিয়ে যারা দিল্লির ক্ষমতায় এসেছে সেই বিজেপি নেতৃত্বও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর পুরোপুরি ভরসা রাখতে রাজি বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বিবিসি লন্ডন আর বিবিসি ঢাকা- ব্যবধান কত দুস্তর?
বিবিসির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থ নাথ সিং, যিনি বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সাথেও যোগাযোগ রাখেনÑ তিনি সেটা এক রকম স্বীকারও করে নিলেন। মি. সিং বিবিসিকে বলছিলেন, ভারতের সম্পর্কটা যদিও বাংলাদেশের সাথে, তারপরও কোন দল সেখানে ক্ষমতায়, সেটাও কিন্তু একটা ফ্যাক্টর। আর সে দিক থেকে বলতে হবে, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থের প্রতি, আমাদের উদ্বেগের প্রতি দারুণ বিবেচনা দেখিয়েছেন। আর বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় ভারত যে জাতীয় স্বার্থকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেবে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।’
অনেক প্রশ্ন উঠছে এখানে। আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থের প্রতি ‘দারুণ বিবেচনা দেখিয়েছেন’ বলেই ক্রুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ। এরা মনে করে, তাদের সম্মতি ছাড়া এবং বাংলদেশের সার্বভৌমত্বের বিরোধী বহু কিছু ভারতকে দেয়া হয়েছে গায়ের জোরে। গায়ের জোরে যা দেয়া হয়েছে, সময় এলে বাংলাদেশের মানুষ আবার গায়ের জোরে সেটা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করবে। তাতে বিপর্যয়ের বীজ নিহিত আছে এবং সে ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক বরাবরের জন্য তিক্ত হয়ে থাকবে। গত মে মাসের নির্বাচনের পর বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল, মোদি সরকার সাময়িক সুবিধার চেয়ে দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। সেজন্যই মোদি সরকারের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট নীতি ঘোষণার প্রত্যাশায় আছে বাংলাদেশের মানুষ। ইতোমধ্যে প্রাদেশিক একজন বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির সরকারের হয়ে কথা বলার কর্তৃত্ব রাখেন কি না এবং সংশ্লিষ্ট সংবাদদাতা কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বে সিদ্ধার্থ নাথ সিংয়ের প্রভাব যাচাই করে দেখেছেন কি না সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। এখন দেখা যাচ্ছে, সে সন্দেহ বাস্তবও বটে। মাত্র গত সোমবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনে বাংলাদেশের ব্যাপারে পক্ষপাতী না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অবশ্যই তার এ অর্থ করতে হবে যে, বাংলাদেশ নীতি নিয়ে মোদি সরকার এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি।
আমি বিবিসি বাংলা বিভাগ ছেড়েছি ২১ বছর আগে। এরপর থেকে বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান শোনার সুযোগ কমই পাই। বিবিসিতেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এককালে যেটা ছিল বিবিসি লন্ডন, সেটা এখন বিবিসি ঢাকা, বিবিসি দিল্লি কিংবা বিবিসি ইসলামাবাদ। লন্ডনের দিনে সংবাদদাতাদের সংবাদ ও প্রতিবেদন ইত্যাদি একাধিক স্তরে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনার পরই শুধু প্রচার করা হতো। হালকা ওজনের রাজনীতিকের উক্তির ওপর ভরসা করে আমরা কখনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধে খবর প্রচার কিংবা মন্তব্য করিনি। বিবিসির পুরনো শ্রোতাদের কেউ কেউ যোগাযোগ রাখেন। এরা বলেন, বিবিসি লন্ডন আর বিবিসি ঢাকা কিংবা বিবিসি দিল্লির মধ্যে ব্যবধান মাঝে মাঝে দুস্তর মনে হয়। কিন্তু কত দুস্তর, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
(লন্ডন, ১০.০২.১৫)
serajurrahman34@gmail.com
No comments