ত্বকীর জন্মদিনে শুভকামনা by রওনক রেহানা
আ জ ত্ব কী র জ ন্ম দি ন
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি’ ত্বকী ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন অকালপ্রয়াত কিশোর কবি সুকান্তের মতো এ অঙ্গীকার আমিও করেছিলাম। কিন্তু না, আমি আমার এ জনপদকে শিশুর বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারিনি। সুকান্তের মৃত্যু হয়েছে যক্ষ্মা রোগে আর ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে। হায়, আমি চলে যাইনি! ত্বকীর মতো, বিশ্বজিতের মতো সন্তানদের জন্য কোনো সৎ, কার্যকর প্রশাসনিক নিরাপত্তায় বা দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন হয় এমন স্বদেশ, জনপদের নাগরিকও আমি নই! এখানে প্রতিনিয়ত শিষ্টের দমন আর দুষ্টের পালনই চলছে। নয়তো ত্বকীর মৃত্যুর দেড় বছর অতিবাহিত হলো, অপরাধীরা চিহ্নিত হলো, তার পরেও অপরাধীরা ধরা পড়ল না, অভিযোগপত্র দেওয়া হলো না! সবকিছু জানার পরেও সরকার অপরাধীদের পক্ষ নেয়; এটা কী করে সম্ভব? আমরা কি এমনই রাষ্ট্র চেয়েছিলাম? এটাই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ?
আজ তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর জন্মদিন। ১৯তম জন্মদিন। জন্মদিন হয় আনন্দের; ফুল, কেক, বিভিন্ন বিষয় এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু না, ত্বকীর জন্মদিন আমাদের জন্য কোনো আনন্দের বার্তা বয়ে আনেনি; একরাশ বেদনা আমাদের নিমজ্জিত করে।
ত্বকী বেঁচে থাকতে একটা ছড়া প্রায়ই শুনতে চাইত, ‘মন্দরা ছিল মন্দরা আছে, থাকবেও চিরকাল। তবুও ভালোর ছোঁয়া লেগে শুভ হোক আগামীকাল।’ এখন আমার কণ্ঠ থেকে কোনো ছড়া, কবিতা বা গান বেরোতে চায় না, কণ্ঠ যেন রুদ্ধ হয়ে আসে। কিন্তু আমার চোখের জলে কোনো স্মৃতি মুছে যায়নি। ত্বকীর সঙ্গের প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি মুহূর্ত থেকে আমি ফিরে পেতে চাই বর্তমান ও ভবিষ্যতে ত্বকীর সঙ্গে আমার জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষায়, অথচ যা আর কোনো দিন হওয়ার নয়।
এখন পরবর্তী প্রজন্মের অবস্থা এমন হয়েছে যে ‘বালক জানে না কতটা হেঁটে এলে ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।’ ঠিক এ কারণেই ত্বকীর আর পথ হাঁটা হলো না। ত্বকী ডেইলি স্টার পুরস্কার নিতে গিয়ে পরিচিতি প্রকাশে জীবনের লক্ষ্য জানাতে গিয়ে লিখেছিল, ‘সততাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লালন করব।’ যে জীবনের পরিসীমা এতই ছোট যে আঠারোর আগেই পথ ছেড়ে চলে যেতে হয়, সেখানে লক্ষ্য মুখ থুবড়ে পড়ে।
আমি যখনই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘মানুষ’ কবিতা থেকে আবৃত্তি করতাম—‘মানুষ বড় কাঁদছে তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’—তখন প্রতিবারই আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার শিশুসন্তান আপন মনেই বলে চলত, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, তোমাকে দাঁড়াতেই হবে’। এই ছোট ছোট সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্নার জীবন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম রক্ষার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের, সমাজের। ত্বকী তার একটি কবিতায় লিখেছিল, ‘সমগ্র মানবজাতি আজ এক কাতারে দাঁড়াবে,/ হিংসা-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে,/ জলাঞ্জলি দিয়ে হিসেব কষা,/ ছড়িয়ে দেবে ভালোবাসার গান—/ বলবে মানুষ চাই সমানে সমান।’ একটি সমতার সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল ত্বকী। কিন্তু কতটা বিরুদ্ধ সমাজে বসে সে এ স্বপ্ন দেখছে, এ ধারণা হয়তো তার ছিল না।
মহাভারতে সন্তানহারা দ্রৌপদী বলে, ‘ধর্ম তার সন্তানকে যতই সুরক্ষা প্রদান করুক, মানুষের নিজের পাপ তার দুর্বলতা হয়েই পড়ে, মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ অবশ্যই মানুষের দুর্বলতা’। কোনো শিশুই খুনি বা কারও শত্রু হয়ে জন্মায় না। সন্তানকে সত্য-অসত্য, শুভ-অশুভ, ভালো-মন্দ শিক্ষার মধ্য দিয়েই তাকে সমাজের, দেশের ও মানুষের করে তুলতে হয়। আর তা না হলে সমাজ ও দেশ মানুষের হয়ে ওঠে না, পশুতে ছেয়ে থাকে।
না, আজ ত্বকীর এ জন্মদিনে কোনো সরকারের কাছে, কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমি কোনো আবেদন জানাব না; শুধু এ সত্যই উচ্চারণ করব যে কোনো অন্যায়, অবিচারই শেষ কথা নয়, ন্যায় আর সত্যই শেষ কথা। ক্ষমতার মোহে আজ যারা অন্ধ; যঁারা পিতা, পুত্র, ভাই, নিজস্ব পরিজন ছাড়া অন্য কাউকেই আপন ভাবতে কুণ্ঠা বোধ করেন, যাঁরা আইন-প্রশাসন-রাষ্ট্র—সবকিছুকে নিজেদের প্রয়োজনে মনে করেন আমাদের কাছে আর যা-ই হোক সুবিচার আশা করা যায় না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, আল্লাহ তাঁদের সুমতি দিন, সত্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা দিন।
কোনো অবিচারই শেষ কথা নয়। সব মানুষের ভেতরেই অন্তর্যামী বিবেক আর চেতনা রয়েছে। আমাদের আগামী দিনের সন্তানেরা সে চেতনাকে ধারণ করেই নদী বা বৃক্ষের মতো মহৎ ব্রত নিয়ে এই দেশকে শিশুর বাসযোগ্য করে তুলবে, এ আমার বিশ্বাস। এ বিশ্বাস একদিন অবশ্যই সূর্যের মুখ দেখবে।
রওনক রেহানা: নিহত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর মা।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি’ ত্বকী ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন অকালপ্রয়াত কিশোর কবি সুকান্তের মতো এ অঙ্গীকার আমিও করেছিলাম। কিন্তু না, আমি আমার এ জনপদকে শিশুর বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারিনি। সুকান্তের মৃত্যু হয়েছে যক্ষ্মা রোগে আর ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে। হায়, আমি চলে যাইনি! ত্বকীর মতো, বিশ্বজিতের মতো সন্তানদের জন্য কোনো সৎ, কার্যকর প্রশাসনিক নিরাপত্তায় বা দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন হয় এমন স্বদেশ, জনপদের নাগরিকও আমি নই! এখানে প্রতিনিয়ত শিষ্টের দমন আর দুষ্টের পালনই চলছে। নয়তো ত্বকীর মৃত্যুর দেড় বছর অতিবাহিত হলো, অপরাধীরা চিহ্নিত হলো, তার পরেও অপরাধীরা ধরা পড়ল না, অভিযোগপত্র দেওয়া হলো না! সবকিছু জানার পরেও সরকার অপরাধীদের পক্ষ নেয়; এটা কী করে সম্ভব? আমরা কি এমনই রাষ্ট্র চেয়েছিলাম? এটাই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ?
আজ তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর জন্মদিন। ১৯তম জন্মদিন। জন্মদিন হয় আনন্দের; ফুল, কেক, বিভিন্ন বিষয় এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু না, ত্বকীর জন্মদিন আমাদের জন্য কোনো আনন্দের বার্তা বয়ে আনেনি; একরাশ বেদনা আমাদের নিমজ্জিত করে।
ত্বকী বেঁচে থাকতে একটা ছড়া প্রায়ই শুনতে চাইত, ‘মন্দরা ছিল মন্দরা আছে, থাকবেও চিরকাল। তবুও ভালোর ছোঁয়া লেগে শুভ হোক আগামীকাল।’ এখন আমার কণ্ঠ থেকে কোনো ছড়া, কবিতা বা গান বেরোতে চায় না, কণ্ঠ যেন রুদ্ধ হয়ে আসে। কিন্তু আমার চোখের জলে কোনো স্মৃতি মুছে যায়নি। ত্বকীর সঙ্গের প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি মুহূর্ত থেকে আমি ফিরে পেতে চাই বর্তমান ও ভবিষ্যতে ত্বকীর সঙ্গে আমার জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষায়, অথচ যা আর কোনো দিন হওয়ার নয়।
এখন পরবর্তী প্রজন্মের অবস্থা এমন হয়েছে যে ‘বালক জানে না কতটা হেঁটে এলে ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।’ ঠিক এ কারণেই ত্বকীর আর পথ হাঁটা হলো না। ত্বকী ডেইলি স্টার পুরস্কার নিতে গিয়ে পরিচিতি প্রকাশে জীবনের লক্ষ্য জানাতে গিয়ে লিখেছিল, ‘সততাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লালন করব।’ যে জীবনের পরিসীমা এতই ছোট যে আঠারোর আগেই পথ ছেড়ে চলে যেতে হয়, সেখানে লক্ষ্য মুখ থুবড়ে পড়ে।
আমি যখনই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘মানুষ’ কবিতা থেকে আবৃত্তি করতাম—‘মানুষ বড় কাঁদছে তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’—তখন প্রতিবারই আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার শিশুসন্তান আপন মনেই বলে চলত, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, তোমাকে দাঁড়াতেই হবে’। এই ছোট ছোট সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্নার জীবন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম রক্ষার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের, সমাজের। ত্বকী তার একটি কবিতায় লিখেছিল, ‘সমগ্র মানবজাতি আজ এক কাতারে দাঁড়াবে,/ হিংসা-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে,/ জলাঞ্জলি দিয়ে হিসেব কষা,/ ছড়িয়ে দেবে ভালোবাসার গান—/ বলবে মানুষ চাই সমানে সমান।’ একটি সমতার সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল ত্বকী। কিন্তু কতটা বিরুদ্ধ সমাজে বসে সে এ স্বপ্ন দেখছে, এ ধারণা হয়তো তার ছিল না।
মহাভারতে সন্তানহারা দ্রৌপদী বলে, ‘ধর্ম তার সন্তানকে যতই সুরক্ষা প্রদান করুক, মানুষের নিজের পাপ তার দুর্বলতা হয়েই পড়ে, মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ অবশ্যই মানুষের দুর্বলতা’। কোনো শিশুই খুনি বা কারও শত্রু হয়ে জন্মায় না। সন্তানকে সত্য-অসত্য, শুভ-অশুভ, ভালো-মন্দ শিক্ষার মধ্য দিয়েই তাকে সমাজের, দেশের ও মানুষের করে তুলতে হয়। আর তা না হলে সমাজ ও দেশ মানুষের হয়ে ওঠে না, পশুতে ছেয়ে থাকে।
না, আজ ত্বকীর এ জন্মদিনে কোনো সরকারের কাছে, কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমি কোনো আবেদন জানাব না; শুধু এ সত্যই উচ্চারণ করব যে কোনো অন্যায়, অবিচারই শেষ কথা নয়, ন্যায় আর সত্যই শেষ কথা। ক্ষমতার মোহে আজ যারা অন্ধ; যঁারা পিতা, পুত্র, ভাই, নিজস্ব পরিজন ছাড়া অন্য কাউকেই আপন ভাবতে কুণ্ঠা বোধ করেন, যাঁরা আইন-প্রশাসন-রাষ্ট্র—সবকিছুকে নিজেদের প্রয়োজনে মনে করেন আমাদের কাছে আর যা-ই হোক সুবিচার আশা করা যায় না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, আল্লাহ তাঁদের সুমতি দিন, সত্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা দিন।
কোনো অবিচারই শেষ কথা নয়। সব মানুষের ভেতরেই অন্তর্যামী বিবেক আর চেতনা রয়েছে। আমাদের আগামী দিনের সন্তানেরা সে চেতনাকে ধারণ করেই নদী বা বৃক্ষের মতো মহৎ ব্রত নিয়ে এই দেশকে শিশুর বাসযোগ্য করে তুলবে, এ আমার বিশ্বাস। এ বিশ্বাস একদিন অবশ্যই সূর্যের মুখ দেখবে।
রওনক রেহানা: নিহত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর মা।
No comments