ঢাকা বিমানবন্দরের এতিম দশা by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
যোগাযোগ
বিশ্বে এ রকম একটি কথা চালু আছে যে একটি বিমানবন্দরে পা রাখলেই সেই দেশ
সম্বন্ধে ভালো ধারণা হয়ে যায়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কথা বাদ দিলাম,
কাছের দেশ ভুটান অথবা শ্রীলঙ্কার কথাই ধরুন। ভুটানের পারো বিমানবন্দরে
নামলে আপনি ঠিক বুঝবেন, দেশটিতে কোনো কোলাহল নেই, হুড়োহুড়ি নেই, অকারণ
উত্তেজনা নেই। বিমানবন্দরটি অন্তরঙ্গ, একটা সুন্দর হাসি দিয়ে যেন আপনাকে
স্বাগত জানাচ্ছে। কলম্বোতে নামুন, দেখবেন বিমানবন্দরটি কী পরিচ্ছন্ন,
ছিমছাম। টয়লেটগুলো পরিষ্কার, নিয়ম-শৃঙ্খলামতো চলছে সবকিছু। প্রি-পেইড
ট্যাক্সিতে চড়ে রাত একটায়ও আপনি যেকোনো গন্তব্যে যেতে পারবেন নিরাপদে,
একটি টাকা অতিরিক্ত খরচ না করে। দেশটি যে উন্নতির পথে এগোচ্ছে—শিক্ষায়,
খেলাধুলায়, সামাজিক সব সূচকে—বিমানবন্দরে আধা ঘণ্টা কাটিয়েই আপনার তা
জানা হয়ে যাবে। এই যে কলকাতার নেতাজি বিমানবন্দর, একসময় যা ছিল লিভিং,
ভিড়াক্রান্ত, ঠ্যাসাঠেসি; এখন তো একটি বিশাল স্থাপনা—প্রচুর জায়গা, সব
চলে ঘড়ির কাঁটার মতো। ইমিগ্রেশন শেষ করে মালসামানের খোঁজে নেমে দেখবেন, সব
পৌঁছে গেছে।
এবার
একটু শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে তাকান, ভীতিকর সব চিত্র ধরা
পড়বে আপনার চোখে। আর যদি যাত্রী হয়ে আপনি কখনো এটিকে ব্যবহার করেন, আপনার
অভিজ্ঞতা হবে এমনি যে তা ভুলে যেতে পারলেই আপনি স্বস্তি পাবেন।
বিমানবন্দরের বাইরে যে প্রাণান্তকর ভিড় হয়, যা দেখে মনে হবে যেন ছুটির
দিনের কোনো বিনোদনকেন্দ্র (যদিও মানুষের মধ্যে নির্ভার আনন্দের পরিবর্তে
থাকে উদ্বেগ আর উত্তেজনা)—তার কথা নাহয় না-ই বলা হলো। যেহেতু এটি যখন চালু
হয়, সেই ৩০-৩৫ বছর আগে, সেই সময়ের তুলনায় এখন এর ওপর চাপ বেড়েছে কয়েক
গুণ বেশি। কিন্তু এর ভেতরে চলে যে অব্যবস্থা, তা দেখে মনে হবে ব্যবস্থাপনা
বলে যে একটি বিষয় আছে, পেশাদারি ও যাত্রীসেবা বলে যে কিছু বিষয় আছে,
সেগুলোর সঙ্গে আমাদের যেন চিরকালের আড়ি। বিমানবন্দরের টয়লেটগুলো
অপরিচ্ছন্ন, দুর্গন্ধময়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অব্যবহারযোগ্য। একটি তিনতলা
পার্কিং লট আছে; সেখানে চলে পরিবহন সিন্ডিকেটের প্রতাপ। আপনি একটি গাড়ি
চালিয়ে সেটিতে ঢুকে স্বচ্ছন্দে জায়গা পাবেন গাড়িটি রাখার, সেটি—বিশেষ
করে দিনের বেলায়—হবে অবাস্তব চিন্তা। আপনি যদি বাইরে থেকে আসেন এবং আপনাকে
নিয়ে যেতে বাহনসহ কেউ না আসে, তাহলে কোনো ট্যাক্সি বা সিএনজিচালিত
অটোরিকশা পাওয়াটা হবে লটারিতে টাকা পাওয়ার মতো। যদি ভাগ্যগুণে পেয়েও
যান, যে পথ পাড়ি দিতে এমনিতে আপনার লাগবে ৪০০ টাকা, সেই বাহনওয়ালাকে দিতে
হবে এর কয়েক গুণ বেশি।
যে পার্কিং দালানটির কথা বললাম, তার ভেতরে একবার পা ফেলুন। ময়লা-আবর্জনা সর্বত্র। সেখান থেকে টার্মিনালে যাওয়ার পথে ডানে-বাঁয়ে দেখা যাবে আবর্জনার স্তূপ, দেয়ালে কালিঝুলি। এই বিমানবন্দর যাঁরা চালান, তাঁদের কাছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কথাটার গুরুত্ব নেই। একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কেন এ রকম হবে? শীতের সময় এখানে দেখা যায় মশার প্রকোপ। দুই বছর আগে এক যাত্রীকে নিতে এসে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে আমি ওই সময়ের বিমান ও পর্যটনসচিবকে একটি চিঠি লিখেছিলাম। এর পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বিমানবন্দর যেহেতু, ওতে ওড়াউড়িটা হয়তো মশাদের অধিকারে পড়ে, কে জানে!
গত ২৭ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে রাত ১০টা ২০ মিনিটে এসে বিমানবন্দরে নামলাম। এখন কম্পিউটার যথাযথ কাজ করলে ইমিগ্রেশনে তেমন সময় লাগে না, এটি একটি বড় অর্জন। যদিও যাত্রীপ্রতি খরচ করা সময় আরও কমানো যায় (সিঙ্গাপুরে গড়ে তা এক মিনিট), তার পরও ব্যাপারটা স্বস্তির। কিন্তু মালসামান আসার বেল্টের সামনে গিয়ে চোখ কপালে উঠল। পাশের বেল্টের ধারে-কাছে বাক্স-পেঁটরা-পোঁটলার একটা পাহাড়! খোঁজ নিয়ে জানা গেল, একটি ফ্লাইটে যাত্রীরা আসার কয়েক ঘণ্টা পর এসব মালসামান খালাস হয়েছে। যাত্রীরা অপেক্ষা করে করে চলে গেছেন। আমাদের মালসামান আসতে শুরু করল আধা ঘণ্টা পর। শেষ বাক্সটি যখন পেলাম, ততক্ষণে দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। ওই যে মালসামান পেতে দু-তিন ঘণ্টা দেরি হয়, এটি এখন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগের দিন কলকাতা থেকে বিমানে ৪০ মিনিটে উড়ে এসে যাত্রীরা দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাক্সটাক্স পেলেন। মাস খানেক আগে সকালে এমিরেটসে চড়ে আসা স্ত্রীকে আনতে গিয়ে আমাকে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। দয়ালু এক পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে তাঁর অফিসে নিয়ে বসতে না দিলে আরও আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। মালসামান পেতে দেরি হওয়া যদি একটা বিপর্যয় হয় (কর্তাদের জন্য না, যাত্রীদের জন্য), আরও বড় বিপর্যয় ট্রলি জোগাড় করা। ২৭ তারিখে ট্রলির জন্য আমাকে বিমানবন্দরের বাইরে দৌঁড়াতে হয়েছিল।
একবার মনে হয়েছিল, বাসায় চলে যাই, বেরিয়েই যখন এসেছি। এ রকম অনেকেই ভাবছিলেন, আমাকে জানালেন।
একটা যুক্তি শোনা যায় এই অব্যবস্থার পক্ষে: একসঙ্গে চার-পাঁচটা ফ্লাইট নামলে চাপ পড়ে, তাতে দেরি তো হতেই পারে। এটি কোনো যুক্তি তো নয়ই, খোঁড়া যুক্তিও নয়। এটি স্রেফ অযুক্তি। বিমানবন্দরটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক কথাটা তাহলে জুড়ে দেওয়া কেন? এটি কি সৈয়দপুর যে সপ্তাহে দুটি উড়াল চলবে এ দিয়ে? কলম্বোতেও তো দেখেছি; একসঙ্গে পাঁচটি বিমান নামলেও বাক্স-পেঁটরা নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হতে আধা ঘণ্টার বেশি লাগে না। তাহলে? ঢাকা বিমানবন্দরে কাস্টমস কর্মকর্তাদের দেখলাম যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন যাত্রীদের বেরোনোটা সহজ করতে। তাঁরা জানালেন, মালপত্র পেতে দেরি হওয়ায় ক্ষুব্ধ যাত্রীরা তাঁদের কাছে কারণ জানতে চান, কখনো কখনো রাগ দেখান। স্বাভাবিক। কারণ, অভিযোগ জানানোর কোনো জায়গা বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোথাও চোখে পড়বে না। রাত ১২টায় কোনো কর্তাব্যক্তি অভিযোগ শোনা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বসে আছেন—এমনটি ভাবাও অসম্ভব।
শোনা গেল, ‘লাগেজ হ্যান্ডলিং’, অর্থাৎ বিমান থেকে মালপত্র নামিয়ে বেল্টে তোলার কাজ করে বিমান কর্তৃপক্ষ। যদি তা-ই হয়, তাহলে তো প্রমাদ গোনা ছাড়া যাত্রীদের কিছু করার নেই। ৩০ সেপ্টেম্বর একটি দৈনিক প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান খবর হিসেবে বিমানের অব্যাহত লোকসানের বিষয়টি তুলে ধরেছে। ‘শান্তির নীড় বিমান এখন ডানাভাঙা বলাকা’—এ হচ্ছে খবরের শিরোনাম। বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠার ৪২ বছরে লোকসান হয়েছে ৩৫ বছরই। কাগজটি এই ডানাভাঙার পেছনে যেসব কারণ আছে, সেগুলোর মধ্যে ‘সীমাহীন দুর্নীতি ও রাজনৈতিকীকরণ’ ও ‘অদক্ষ ব্যবস্থাপনা’কে চিহ্নিত করেছে। বিমানে জাহাজপ্রতি কর্মচারীদের অনুপাত বিশ্বের ছোট-বড় যেকোনো বিমান সংস্থা থেকে বেশি। তার পরও অব্যবস্থাপনা।
বিমান যদি ‘লাগেজ হ্যান্ডেলিং’-এ ব্যর্থ হয় এত লোকবল নিয়ে, তাহলে এই কাজ এর হাত থেকে নিয়ে নিলেই তো হয়। কিন্তু কাজটি কোনো প্রাইভেট সংস্থাকে দিতে গেলে ইউনিয়ন যে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে, এক অভিজ্ঞ যাত্রী আমাকে তা-ই বললেন। কিন্তু একজন যাত্রীকে (এবং তাঁকে নিতে আসা আত্মীয়স্বজনকে) ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দেওয়ার অধিকার এই লাগেজ-হ্যান্ডলারদের কে দিল? তারা যে-ই হোক। এবং এই অব্যবস্থাপনা যখন নিয়মে পরিণত হয়, তখন? একটা ঝাঁকি লাগানো পরিবর্তন কি এখনই আনা উচিত নয়?
আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে মার্কিন ব্যবসায়ীদের বলেছেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে। বাণিজ্যমন্ত্রীও এশিয়ার ব্যবসায়ীদের এ রকম আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু বিনিয়োগ করার আগে তাঁরা যখন ঢাকায় নামবেন এবং তাঁদের বাক্স-পেঁটরা যখন আসবে দু-তিন ঘণ্টা তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকার পর, তখন বিনিয়োগ মাথায় থাক, রাগ সামলে ফেরতযাত্রার টিকিটটা তাঁরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়বেন।
২৭ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের যাত্রী হিসেবে সে দেশের কিছু নাগরিকও এসেছিলেন। একজনকে দেখলাম ঘণ্টা দেড়েক দাঁড়িয়ে থেকে লোকজনকে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে তাঁর এক সহযাত্রীকে প্রশ্ন করছেন, ‘হু রানস দিস এয়ারপোর্ট?’ তাঁর প্রশ্নটা হতাশার, ক্ষোভের। তিনি রাস্তায় বেরিয়ে হয়তো আরও বড় কোনো প্রশ্ন করে বসবেন, ঢাকা কে চালায় অথবা দেশটা কে চালায়?
স্বাভাবিক। ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে, সেখানে দু-তিন ঘণ্টা কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে ভয়াবহ ভিড়-চেঁচামেচি, ঠেলাঠেলির অভিজ্ঞতা সহ্য করার পর কেউ ভুলেও বলবে না, দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ আছে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
যে পার্কিং দালানটির কথা বললাম, তার ভেতরে একবার পা ফেলুন। ময়লা-আবর্জনা সর্বত্র। সেখান থেকে টার্মিনালে যাওয়ার পথে ডানে-বাঁয়ে দেখা যাবে আবর্জনার স্তূপ, দেয়ালে কালিঝুলি। এই বিমানবন্দর যাঁরা চালান, তাঁদের কাছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কথাটার গুরুত্ব নেই। একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কেন এ রকম হবে? শীতের সময় এখানে দেখা যায় মশার প্রকোপ। দুই বছর আগে এক যাত্রীকে নিতে এসে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে আমি ওই সময়ের বিমান ও পর্যটনসচিবকে একটি চিঠি লিখেছিলাম। এর পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বিমানবন্দর যেহেতু, ওতে ওড়াউড়িটা হয়তো মশাদের অধিকারে পড়ে, কে জানে!
গত ২৭ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে রাত ১০টা ২০ মিনিটে এসে বিমানবন্দরে নামলাম। এখন কম্পিউটার যথাযথ কাজ করলে ইমিগ্রেশনে তেমন সময় লাগে না, এটি একটি বড় অর্জন। যদিও যাত্রীপ্রতি খরচ করা সময় আরও কমানো যায় (সিঙ্গাপুরে গড়ে তা এক মিনিট), তার পরও ব্যাপারটা স্বস্তির। কিন্তু মালসামান আসার বেল্টের সামনে গিয়ে চোখ কপালে উঠল। পাশের বেল্টের ধারে-কাছে বাক্স-পেঁটরা-পোঁটলার একটা পাহাড়! খোঁজ নিয়ে জানা গেল, একটি ফ্লাইটে যাত্রীরা আসার কয়েক ঘণ্টা পর এসব মালসামান খালাস হয়েছে। যাত্রীরা অপেক্ষা করে করে চলে গেছেন। আমাদের মালসামান আসতে শুরু করল আধা ঘণ্টা পর। শেষ বাক্সটি যখন পেলাম, ততক্ষণে দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। ওই যে মালসামান পেতে দু-তিন ঘণ্টা দেরি হয়, এটি এখন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগের দিন কলকাতা থেকে বিমানে ৪০ মিনিটে উড়ে এসে যাত্রীরা দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাক্সটাক্স পেলেন। মাস খানেক আগে সকালে এমিরেটসে চড়ে আসা স্ত্রীকে আনতে গিয়ে আমাকে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। দয়ালু এক পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে তাঁর অফিসে নিয়ে বসতে না দিলে আরও আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। মালসামান পেতে দেরি হওয়া যদি একটা বিপর্যয় হয় (কর্তাদের জন্য না, যাত্রীদের জন্য), আরও বড় বিপর্যয় ট্রলি জোগাড় করা। ২৭ তারিখে ট্রলির জন্য আমাকে বিমানবন্দরের বাইরে দৌঁড়াতে হয়েছিল।
একবার মনে হয়েছিল, বাসায় চলে যাই, বেরিয়েই যখন এসেছি। এ রকম অনেকেই ভাবছিলেন, আমাকে জানালেন।
একটা যুক্তি শোনা যায় এই অব্যবস্থার পক্ষে: একসঙ্গে চার-পাঁচটা ফ্লাইট নামলে চাপ পড়ে, তাতে দেরি তো হতেই পারে। এটি কোনো যুক্তি তো নয়ই, খোঁড়া যুক্তিও নয়। এটি স্রেফ অযুক্তি। বিমানবন্দরটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক কথাটা তাহলে জুড়ে দেওয়া কেন? এটি কি সৈয়দপুর যে সপ্তাহে দুটি উড়াল চলবে এ দিয়ে? কলম্বোতেও তো দেখেছি; একসঙ্গে পাঁচটি বিমান নামলেও বাক্স-পেঁটরা নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হতে আধা ঘণ্টার বেশি লাগে না। তাহলে? ঢাকা বিমানবন্দরে কাস্টমস কর্মকর্তাদের দেখলাম যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন যাত্রীদের বেরোনোটা সহজ করতে। তাঁরা জানালেন, মালপত্র পেতে দেরি হওয়ায় ক্ষুব্ধ যাত্রীরা তাঁদের কাছে কারণ জানতে চান, কখনো কখনো রাগ দেখান। স্বাভাবিক। কারণ, অভিযোগ জানানোর কোনো জায়গা বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোথাও চোখে পড়বে না। রাত ১২টায় কোনো কর্তাব্যক্তি অভিযোগ শোনা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বসে আছেন—এমনটি ভাবাও অসম্ভব।
শোনা গেল, ‘লাগেজ হ্যান্ডলিং’, অর্থাৎ বিমান থেকে মালপত্র নামিয়ে বেল্টে তোলার কাজ করে বিমান কর্তৃপক্ষ। যদি তা-ই হয়, তাহলে তো প্রমাদ গোনা ছাড়া যাত্রীদের কিছু করার নেই। ৩০ সেপ্টেম্বর একটি দৈনিক প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান খবর হিসেবে বিমানের অব্যাহত লোকসানের বিষয়টি তুলে ধরেছে। ‘শান্তির নীড় বিমান এখন ডানাভাঙা বলাকা’—এ হচ্ছে খবরের শিরোনাম। বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠার ৪২ বছরে লোকসান হয়েছে ৩৫ বছরই। কাগজটি এই ডানাভাঙার পেছনে যেসব কারণ আছে, সেগুলোর মধ্যে ‘সীমাহীন দুর্নীতি ও রাজনৈতিকীকরণ’ ও ‘অদক্ষ ব্যবস্থাপনা’কে চিহ্নিত করেছে। বিমানে জাহাজপ্রতি কর্মচারীদের অনুপাত বিশ্বের ছোট-বড় যেকোনো বিমান সংস্থা থেকে বেশি। তার পরও অব্যবস্থাপনা।
বিমান যদি ‘লাগেজ হ্যান্ডেলিং’-এ ব্যর্থ হয় এত লোকবল নিয়ে, তাহলে এই কাজ এর হাত থেকে নিয়ে নিলেই তো হয়। কিন্তু কাজটি কোনো প্রাইভেট সংস্থাকে দিতে গেলে ইউনিয়ন যে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে, এক অভিজ্ঞ যাত্রী আমাকে তা-ই বললেন। কিন্তু একজন যাত্রীকে (এবং তাঁকে নিতে আসা আত্মীয়স্বজনকে) ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দেওয়ার অধিকার এই লাগেজ-হ্যান্ডলারদের কে দিল? তারা যে-ই হোক। এবং এই অব্যবস্থাপনা যখন নিয়মে পরিণত হয়, তখন? একটা ঝাঁকি লাগানো পরিবর্তন কি এখনই আনা উচিত নয়?
আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে মার্কিন ব্যবসায়ীদের বলেছেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে। বাণিজ্যমন্ত্রীও এশিয়ার ব্যবসায়ীদের এ রকম আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু বিনিয়োগ করার আগে তাঁরা যখন ঢাকায় নামবেন এবং তাঁদের বাক্স-পেঁটরা যখন আসবে দু-তিন ঘণ্টা তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকার পর, তখন বিনিয়োগ মাথায় থাক, রাগ সামলে ফেরতযাত্রার টিকিটটা তাঁরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়বেন।
২৭ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের যাত্রী হিসেবে সে দেশের কিছু নাগরিকও এসেছিলেন। একজনকে দেখলাম ঘণ্টা দেড়েক দাঁড়িয়ে থেকে লোকজনকে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে তাঁর এক সহযাত্রীকে প্রশ্ন করছেন, ‘হু রানস দিস এয়ারপোর্ট?’ তাঁর প্রশ্নটা হতাশার, ক্ষোভের। তিনি রাস্তায় বেরিয়ে হয়তো আরও বড় কোনো প্রশ্ন করে বসবেন, ঢাকা কে চালায় অথবা দেশটা কে চালায়?
স্বাভাবিক। ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে, সেখানে দু-তিন ঘণ্টা কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে ভয়াবহ ভিড়-চেঁচামেচি, ঠেলাঠেলির অভিজ্ঞতা সহ্য করার পর কেউ ভুলেও বলবে না, দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ আছে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments