সীমাহীন দুর্ভোগ তবুও নাড়ির টানে ছুটছে মানুষ
কাল পবিত্র ঈদুল আজহা। ঘরমুখো মানুষের
স্রোতে প্রায় ফাঁকা রাজধানী ঢাকা। ঈদ উপলক্ষে কয়েক দিন ধরেই রাজধানী ছাড়ছেন
মানুষ। মহাসড়কের অনেক স্থানের বেহাল অবস্থা, টিকিটের অতিরিক্ত মূল্য,
যানজটসহ নানা দুর্ভোগ সঙ্গী করেই মানুষের ঘরমুখো যাত্রা। ঈদের আনন্দ
স্বজনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতেই হাসিমুখে এ দুর্ভোগ সহ্য করছেন তারা। গতকাল
রাজধানীর বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড, কমলাপুর রেলস্টেশন ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল
ঘুরে দেখা গেছে ঘরমুখো মানুষের আনন্দযাত্রা। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এসব
স্টেশনে ছিল উপচে পড়া মানুষের ভিড়। তবে দুপুরের পর ভিড় কিছুটা কমতে থাকে।
মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে সকাল থেকে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও বগুড়াগামী বাসগুলোর কাউন্টারে ভিড় ছিল যাত্রীদের। এ বাস্ট্যান্ড থেকে দেশের ১৬ জেলার বাস যাতায়াত করে। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের ‘নিরালা সুপার’ নামক বাসের কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন ধরে টিকিট কিনেছেন যাত্রীরা। অন্যদিকে সকালে টিকিটি কিনেছেন অনেকে। কিন্তু নির্দিষ্ট বাস মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছায়নি। যাত্রীরা অপেক্ষায়। কেউ বসে আছেন, কেউ আশপাশে হাঁটাহাঁটি করছেন। স্কুলপড়ুয়া দুই সন্তানসহ বাসের অপেক্ষায় ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা মাহি জিননূর। টাঙ্গাইলগামী একটি বাসের টিকিট কিনেছেন তিনি। জানান, সকাল ৯টায় টিকিট কিনেছেন। কিন্তু দুপুর ১২টা পর্যন্ত ওই বাসটি স্টেশনে এসে পৌঁছায়নি।
বাসস্ট্যান্ডে বাস না থাকার কারণ সম্পর্কে ওই পরিবহনের শ্রমিক কামরুল ইসলাম জানান, ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের দূরত্ব ৯৬ কিলোমিটার। এর প্রায় পুরোটার অবস্থাই খারাপ। এ কারণে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যেতে সময় লাগে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। অথচ সড়ক ভাল হলে ৩ ঘণ্টার বেশি সময় লাগতো না। রাজধানীর আবদুল্লাহপুরের পরেই সড়কের বিভিন্ন স্থান ভেঙে গেছে। আবার ভাঙা সড়কে যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করা হয়। এসব কারণে দীর্ঘ যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট লেগেই থাকে। গতকালও ওই স্থানের ৩৫ কিলোমিটারব্যাপী যানজট ছিল দীর্ঘ সময়।
যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের এনা পরিবহনের কাউন্টারেও। টিকিট সংগ্রহের দীর্ঘলাইন ছিল সেখানে। টিকিট সংগ্রহ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রীরা বাসের অপেক্ষায়। কিন্তু বাস আসছে না। যাত্রী আশিকুল ইসলাম বলেন, বাড়িতে ছেলেমেয়ে অপেক্ষা করছে। মনটা ছটফট করছে। দুর্ভোগ সম্পর্কে বলেন, সড়ক সংস্কার হলে এত দুর্ভোগ হতো না। চৌরাস্তার পর থেকে রাস্তা ভয়াবহ। তবুও ঈদের আনন্দ হলো বড় কথা। বাড়িতে যেতে পারলেই হলো।
বাড়ি যাওয়ার জন্য ঝুঁকি নিচ্ছেন অনেকে। দূরপাল্লার বিভিন্ন বাসের ছাদে করে অনেককে বাড়ি যেতে দেখা গেছে। ময়মনসিংহগামী বাসের ছাদে উঠেছেন ইয়াসিন মিয়াসহ কয়েকজন। ইয়াসিন যাবেন ময়মনসিংহের ভালুকায়। ছাদে উঠেছেন কেন, জানতে চাইলে ইয়াসিন বলেন, কি করুম ডাবল ভাড়া চায়। তাই ছাদে উঠলাম। তিনি জানান, স্বাভাবিক ভাড়া ১০০ টাকা। কিন্তু কাউন্টার থেকে নিচ্ছে ২০০ টাকা করে।
দুপুরে নেত্রকোনা, মোহনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জগামী হযরত শাহজালাল (র.) এক্সপ্রেসের কাউন্টারে ১০-১৫ জন যাত্রী টিকিট সংগ্রহ করছিলেন। জানা গেছে, ঢাকা থেকে নেত্রকোনার দূরত্ব ১৭২ কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৪৫ পয়সা হলেও যাত্রীদের কাছ থেকে রাখা হচ্ছে টিকিটপ্রতি ৫০০ টাকা। যাত্রীরা জানান, কয়েক সপ্তাহ আগেও এ টিকিটের মূল্য ছিল ২৫০ টাকা। বাড়তি ভাড়া সম্পর্কে ওই পরিবহনের কর্মকর্তারা জানান, বাস ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ফেরার সময় যাত্রীশূন্য। এ জন্য ভাড়া বেশি। এ ছাড়া যাত্রী বেশি হওয়ায় বাস সঙ্কট রয়েছে বলে জানান তারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)’র সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ হান্নান বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু বেশি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ লিখিতভাবে অভিযোগ করেননি।
দেশের কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন কমলাপুরে গতকাল ঘরমুখো যাত্রীদের ভিড় ছিল বেশি। ট্রেনের শিডিউলে বিপর্যয়ের কারণে দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন যাত্রীরা। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকা থেকে বিভিন্ন ট্রেন নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা পরে ছেড়েছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী এক্সপ্রেস সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও তা ছেড়েছে সকাল সাড়ে ১০টায়। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস সকাল ৬টায় ছাড়ার কথা থাকলেও এটি ছেড়েছে ৯টা ২০ মিনিটে। লালমনিরহাটগামী রংপুর এক্সপ্রেস সকাল সাড়ে ৮টায় ছাড়ার কথা থাকলেও দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এটি কমলাপুর স্টেশনেই পৌঁছায়নি। সকাল ৬টার ঢাকা-দিনাজপুর রুটে চলাচলকারী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ছেড়েছে সাড়ে ৯টায়। রাজশাহীগামী ধুমকেতু সকাল ৬টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও এটি ছেড়েছে সকাল ৯টায়। শিডিউল বিপর্যয় সম্পর্কে কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার খায়রুল বশীর বলেন, যাত্রীদের চাপ বেশি। যাত্রীদের ওঠা-নামার জন্য বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন থামছে। এতে সময় বেশি লাগছে। এটি শিডিউল বিপর্যয় না। তবে অপেক্ষার পর নির্ধারীত ট্রেন স্টেশনে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের চোখে-মুখে আনন্দ প্রকাশ পায়। ধুমকেতু ট্রেন স্টেশনে পৌঁছলে ব্যাগ টেনে স্বামী ইজাজ আহমেদের সঙ্গে ছুটছিলেন যাত্রী সাদিয়া ইসলাম ও শিশু সন্তান মিম। মিম বলে, দাদুর বাড়ি যাচ্ছি। খুব মজা হবে। বাড়িতেই কোরবানি দেন তারা। পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্যই বাড়িতে যাচ্ছেন জানিয়ে মিমের মা সাদিয়া বলেন, যেতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তবুও ঈদের আনন্দ সবাইকে নিয়ে উপভোগ করতে চাই। গতকালও ট্রেনে যাত্রী ছিল বেশি। যে কারণে ট্রেনের ছাদে উঠে যাত্রা করেছেন অনেকে। একইভাবে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়েই গতকাল সদরঘাট থেকে যাত্রা করেছে লঞ্চগুলো। প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে লঞ্চের ছাদে ছিল শ’ শ’ যাত্রী। সিট না পেয়ে ঝুঁকি নিয়েই লঞ্চে উঠছেন যাত্রীরা। যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়াও নেয়া হচ্ছে বেশি। বাকেরগঞ্জের যাত্রী আলম হোসেন মণ্ডল জানান, আগের চেয়ে ১০০ টাকা ভাড়া বেশি নিয়েছে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। অন্যান্য সময় ডেকে যেতেন ২০০ টাকায় কিন্তু এখন ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৩০০ টাকা। তবে বেশি টাকা নিলেও তিনি বাড়িতে যেতে পারছেন এ জন্য আনন্দিত বলে জানান তিনি। ফিরোজপুরের যাত্রী সোহাগ জানান, ফজরের নামাজ পড়েই লঞ্চে এসেছেন। কিন্তু সিট পাননি। তবুও ঝুঁকি নিয়েই উঠছেন। কষ্ট হলেও বাড়ি যেতে পারছেন এ জন্য ভাল লাগছে বলে জানান তিনি। ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষ নানা দুর্ভোগের শিকার হলেও বাড়ি যাচ্ছেন এ জন্য আনন্দিত তারা। স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার এ পথে কোন দুর্ভোগই যেন তাদের হাসি কেড়ে নিতে পারেনি।
No comments