কৈলাশে ফিরে গেলেন দেবী দুর্গতিনাশিনী
মহাময়ী-মমতাময়ী মা দুর্গা তার স্বামীগৃহ
কৈলাশে ফিরে গেলেন। মহালয়ার মধ্য দিয়ে দশ দিন আগে যে উৎসবের শুরু হয়েছিল,
ঢাকের বাদ্যে আর সিঁদুর খেলায় তা শেষ হলো গতকাল। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য
দিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাঙালির সবচেয়ে বড় এ ধর্মীয় উৎসবের সমাপ্তি ঘটলো।
দেবীকে বিদায় জানাতে গিয়ে চোখের জলে ভাসলেন ভক্তরা। এবার তিনিএসেছিলেন
নৌকায় চড়ে, ফিরে গেলেন দোলায়। সঙ্গে নিয়ে গেলেন ভক্তদের আরাধনা আর দিয়ে
গেলেন আশীর্বাদ। এক বছর পর আবার পিতৃগৃহে অর্থাৎ মর্ত্যলোকে আসবেন দেবী।
ঢাকা মহানগর সর্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটি সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত ‘দর্পণ
বিসর্জনের’ মাধ্যমে সকালেই দেবীর শাস্ত্রীয় বিসর্জন সম্পন্ন হয়। মন্ত্র
উচ্চারণের মাধ্যমে প্রতিমা থেকে ঘটে এবং ঘট থেকে আবার ভক্তের হৃদয়ে ‘মাকে’
নিয়ে আসাকে বিসর্জন বলে।
দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার চলে যাওয়া উপলক্ষে গতকাল সকাল থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে ছিল বিষাদের সুর। পঞ্জিকা মতে, এবার গত শুক্রবার একদিনেই পালিত হয় নবমী ও দশমী। গতকাল সকাল থেকেই সারা দেশে শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জন। রাজধানী ঢাকায় এটি শুরু হয় দুপুর ২টায়। রাজধানীর বেশির ভাগ মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জন হয় সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীতে। সেখানে ওয়াইজঘাটের বিনাস্মৃতি স্নানঘাটে দেয়া হয় প্রতিমা বিসর্জন। গতকাল দুপুরে সর্ব প্রথম সূত্রাপুরের আরএম দাস রোডের একটি মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে রাজধানীতে দেবীকে বিদায় জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বিকাল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর প্রধান পূজা উদযাপন কেন্দ্র ঢাকেশ্বরীর পূজামণ্ডপ থেকে প্রতিমা বিসর্জনের যাত্রা শুরু হয়। এর আগেই নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিমা জড়ো করা হতে থাকে পলাশী মোড়ে। ঢাকার বিভিন্ন মন্দির ও মণ্ডপ থেকে তারা ট্রাকে করে প্রতিমাগুলো নিয়ে আসেন। এরপর শুরু হয় বিসর্জনের র্যালি। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির ব্যানারে পলাশীর মোড় থেকে এই যাত্রা শুরু হয়। র্যালিটি পলাশীর মোড় থেকে শুরু করে শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট, জাতীয় প্রেস ক্লাব, পুরানা পল্টন মোড়, জিরো পয়েন্ট, জজকোর্ট হয়ে সদরঘাটে গিয়ে শেষ হয়। শঙ্খ আর উলুধ্বনি, খোল-করতাল-ঢাক-ঢোলের সনাতনী বাদ্যের সঙ্গে আধুনিক উচ্চস্বরের সাউন্ড সিস্টেমে দেবী বন্দনার গানের মধ্য দিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক দিয়ে এ শোভাযাত্রা চলে। প্রতিমা ঘাটে নিয়ে আসার পর শেষবারের মতো ধুপধুনো নিয়ে আরতিতে মেতে ওঠেন ভক্তরা। শেষে পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের মধ্য দিয়ে দেবীকে নৌকায় তুলে বিসর্জন দেয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ বছর সারা দেশে প্রায় ২৯ হাজার প্রতিমা এবং ঢাকায় ২১১টি প্রতিমা বিসর্জন করা হচ্ছে।
শোভাযাত্রায় যোগ দেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাজল দেবনাথ, সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত দেব, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্মল চাটার্জী, এডভোকেট তাপস পাল, সাবেক সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, মহানগর সর্বজনীন পূর্জা কমিটির সভাপতি জেএল ভৌমিক ও সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ শাহমনি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য সুজিত রায় নন্দী, স্থানীয় সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম, অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভটাচার্য প্রমুখ। কাজল দেবনাথ জানান, প্রতিবারের মতো ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের এই উৎসব পালন করেছে। এই উৎসব সফলভাবে সমাপ্ত হওয়ার জন্য সরকার, দেশের জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তিনি ধন্যবাদ জানান। স্থানীয় সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম জানান, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন বেড়ে যায়। হিন্দুদের বাড়ি ও মন্দিরে হামলা চালানো হয়। তিনি আরও বলেন, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুধু হিন্দু নয় সকল ধর্মের লোকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। সফলভাবে দুর্গাপূজা পালন করাই হচ্ছে এর বড় প্রমাণ। লালবাগ জোনের পুলিশের এডিসি আবিদা সুলতানা জানান, শোভাযাত্রা ও প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী মন্দির ও সদরঘাট এলাকায় পুলিশ কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। শোভাযাত্রা ও প্রতিমা বিসর্জন সময়কালীন পুলিশ এস্কর্ট দিয়েছে। নাশকতা এড়াতে সাদা পোশাকেও পুলিশ দায়িত্ব পালন করেছে।
No comments