‘কেঁদেছিলেন মা’ -কৈলাশ সত্যার্থী
শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এক
পর্যায়ে প্রকৌশল পড়া ছেড়ে দেন কৈলাশ সত্যার্থী। এজন্য তার মা কেঁদেছিলেন।
সেই কৈলাশই এবার মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার
জিতলেন। এ নিয়ে তার অনুভূতি, ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা, শিশু অধিকার নিয়ে
বর্তমান বিশ্বের অবস্থানসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন
টাইমস অব ইন্ডিয়াকে। এখানে তা তুলে ধরা হলো:
প্র: ভারতে শিশু অধিকার আন্দোলনের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার কি বোঝায়?
উ: আমি আশা করি যে, তরুণ ও সুশীল সমাজ এবং প্রত্যেক ভারতীয় গর্ববোধ করবেন। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করাটা একটি মহৎ কাজ। শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন এবং সবার উচিত অবশ্যই এ আন্দোলনে যোগ দেয়া।
প্র: শিশু পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরবর্তী পর্যায় কি?
উ: কেবলমাত্র ভারতে কাজ করার জন্য আমাকে এ পুরস্কার দেয়া হয়নি। আমি ১৪৪টি দেশে কাজ করি। আমি আফ্রিকায় বা লাতিন আমেরিকায়ও একই আবেগ নিয়ে কাজ করি। আমি পাকিস্তানেও একই সমান আবেগ নিয়ে কাজ করেছি। সুতরাং এটি একটি বৈশ্বিক লড়াই। কিন্তু আমি গর্বিত যে, ভারতেই এ লড়াই শুরু হয়েছে এবং আমার মাধ্যমেই শুরু হয়েছে। এরপর এটি অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা মহাত্মা গান্ধীর দেশে জন্ম নিয়েছি, যেখানে অহিংসা ও শান্তির মাধ্যমেই সমাধান রচিত হয়। আমি কাজ করেছি শতভাগ অহিংস উপায়ে। আমি আমার সকল লড়াইয়ে শান্তির নীতিতে খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
প্র: এ পুরস্কার জয়ের পর আপনার কেমন লাগছে?
উ: বিশ্বের লাখ লাখ শিশুর জন্য এটি একটি বিশাল স্বীকৃতি ও সম্মান। আমি আশা করি, অনেক বেশি মানুষ এখন শিশু দাসবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হবে। এটা কেবল ভারতের সমস্যা নয়, গোটা বিশ্বের সমস্যা। আমরা এটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী কাজ করবো। আমি ১৪৪টি দেশে কাজ করছি এবং বিশ্বের সকল শিশুর প্রতি আমার দায়িত্ব রয়েছে।
প্র: আপনি আজকের দিনে কাকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করবেন?
উ: আমার পিতা-মাতাকে। আমার মা আমাকে আক্রমণের শিকার হতে দেখেছেন। আমি যখন এ কারণে প্রকৌশল পড়াশোনা ছেড়ে দিই, তখন তিনি কেঁদেছিলেন। তিনি আমার লড়াইটা বুঝতেন এবং আমাকে সাহস দিতেন। সংগ্রামের সে সব দিনে আমার সঙ্গে যারা ছিলেন, তাদের স্মরণ করি। এদের মধ্যে রয়েছে আমার দুই সহকর্মী, যাদের হত্যা করা হয়েছে। যখনই আমি দাসবৃত্তি থেকে শিশুদের মুক্ত করে তাদের মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেই, তাদের চোখে যে সুখের অশ্রু আমি দেখি, তা যেন স্রষ্টার আশীর্বাদ। যখন আমি স্বাধীন শিশুদের মুখ দেখি, তখন তাদের মুক্ত হওয়ার হাসিকে আমার ঐশ্বরিক মনে হয়। এটা আমাকে এক ঐশ্বরিক শক্তি দেয়। আমার কখনও মনে হয় না, আমি তাদের মুক্ত করছি। বরং মনে হয় তারা আমাকে মুক্তি দিচ্ছে।
মালালার ব্যাপারে তিনি বললেন, আমি মালালাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য অবশ্যই ফোন করবো। আমি তাকে বলবো, শিশু ও বিশেষ করে নারী অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের পাশাপাশি আমাদের এ উপমহাদেশে শান্তি আনয়নের জন্যও আমাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে। আমাদের সন্তানরা শান্তির মধ্যে জন্ম নেবে ও বড় হবে- এ বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা কিভাবে জন্মালো- এমন প্রশ্নের জবাবে কৈলাশ চলে গেলেন তার শৈশবকালে। ৫ বছর বয়সেই তিনি দেখতে পেলেন শিশু বৈষম্য। স্কুলের পাশেই মুচি পিতার সঙ্গে কাজ করছিল তার মতোই এক শিশু। কিন্তু সে স্কুলে যায় না। তার ভাষায়, আমি এ ব্যাপারে আমার শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞেস করি। তারা বললেন, ওই শিশুরা গরিব। আমি খুব ভাল করে বুঝলাম না। এরপর আমি ওই মুচিকে জিজ্ঞেস করি, কেন সে তার ছেলেকে পড়তে পাঠাচ্ছে না। সে পিতা জবাব দিলো, কাজ করার জন্যই আমাদের জন্ম হয়েছে। আমি সেদিন বুঝে উঠতে পারিনি, কেন কিছু মানুষের জন্ম হয় কেবল কাজ করার জন্যই এবং কেন অন্যদের জন্ম হয় জীবনটা উপভোগ করার জন্য।
সেই আশির দশক থেকে শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন কৈলাশ। তখন জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার নজরও এদিকে খুব একটা ছিল না। কৈলাশ প্রথম এক শিশুকে উদ্ধার করেন ১৯৮১ সালে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, এক মেয়ের পিতা আমাদের কাছে এলেন। আমরা একটি ম্যাগাজিন বের করতে যাচ্ছিলাম। তিনি কিভাবে যেন এর খবর পেয়ে আমাদের কাছে এলেন। তিনি চেয়েছিলেন তার দুঃখগাথা যেন আমরা প্রকাশ করি। কিন্তু আমি উপলব্ধি করলাম, এটা কিছু একটা লেখার বিষয় নয়। আমার দ্রুত কিছু একটা করতে হয়েছিল। কেননা ১৩-১৪ বছরের মেয়েটিকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হতো। যখন আমি কোন শিশুকে সাহায্য করি ও তার চোখের দিকে তাকাই, তখন আমার মনে হয় সে যেন আমাকে মুক্তি দিচ্ছে।
নোবেল পুরস্কার জয় নিয়ে বললেন, আমি মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর জন্মেছি। আমার আগে যদি এ পুরস্কার মহাত্মা গান্ধী পেতেন, আমি আরও সম্মানিত বোধ করতাম। এ পুরস্কার এ দেশের সকল নাগরিকের। আমরা খুশি যে, শিশু অধিকার রক্ষার বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমি আমার কাজ অব্যাহত রাখবো। এটি আমার সকল সহকর্মীর অর্জন। একই সঙ্গে এর আগে যে সব শিশুর কণ্ঠ বিশ্ব শুনতে পায়নি, তাদেরও অর্জন এটি। নোবেল পুরস্কার জয় কিভাবে উদযাপন করবেন? বললেন, শ্যামেপন দিয়ে নয়। আমি এ সব থেকে বিরত থাকি। আমি অপেক্ষা করছি শিশুরা কখন আসবে।
এ বছরের শুরুর দিকে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন কৈলাশ। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। শিশুদের শোষণ থেকে রক্ষা করতে পদক্ষেপ নেয়া সমপর্কে বলেছিলেন, যে সব পণ্য বা সেবায় শিশুশ্রম রয়েছে সেসব ক্রেতারা কেনা বা গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে পারেন। যে সব খাবারের দোকান ও সাধারণ দোকানে শিশু কর্মচারী রয়েছে, সেখান থেকে সেবা গ্রহণ করবেন না। একই সঙ্গে তাদের সাহস নিয়ে বলুন, তারা শিশুদের কর্মচারী হিসেবে ব্যবহার করছে দেখেই আপনি তাদের সেবা নিচ্ছেন না। সে সব একটি অপরাধ। এর ফলে মানসিকভাবে চাপে পড়বে সে সব শিল্প। যেসব দোকানে আপনি যান, তাদের কাছে দাবি করুন যে তারা কোন শিশুকে কাজে রাখবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেও এ শোষণ প্রতিরোধ করা যায়।
তার অফিস ও দলের উপর আক্রমণ সমপর্কে বলেছিলেন, আমরা ভেঙে যাওয়া পরিবার ও মানুষজন নিয়ে কাজ করি, যারা সকল আশা হারিয়ে অসহায়। যদি মানুষ আমার কাজের বিরোধিতা করে তখন ব্যক্তিগত আক্রমণ করে। আমরা জানি আমরা সঠিক পথে আছি। আমার এক সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, আরেকজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। আমার গোটা শরীরে আঘাতের চিহ্ন আছে। আমরা আসলে একটি সামাজিক অমঙ্গলের বিরুদ্ধে কাজ করছি। যদি এ অমঙ্গল প্রতিক্রিয়া না দেখায়, তার মানে আমরা তাদের প্রতি কোন হুমকি নই।
নিজের দর্শন নিয়ে বলেছিলেন, আমি শিশুদের একজন বন্ধু। এদেরকে করুণার পাত্র হিসেবে কারও দেখা উচিত নয়। মানুষ প্রায়ই বোকামি ও নির্বুদ্ধিতাকে শিশুসুলভ আচরণ হিসেবে আখ্যা দেয়। এর পরিবর্তন হওয়া জরুরি। আমি এক্ষেত্র সমান করতে চাই, যেখানে আমিও শিশুদের কাছ থেকে শিখতে পারবো। আমি শিশুদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা শিখতে পারি। তারা নিষ্পাপ আর অকপট আচরণের অধিকারী।
No comments