বেঁচে থাকলে প্রফেসর সালাম যে চিঠি মালালাকে লিখতেন by হুমায়ূন রেজা
প্রিয় মালালা,
যাই ঘটুক না কেন আমি সব সময় এক টুকরো আশা আমার বুকের ভেতরে লালন করে পথ চলি। আমাকে সবাই পরিচয় করিয়ে দিত পাকিস্তানের একমাত্র নোবেলজয়ী মানুষ হিসেবে। আর আমি চেষ্টা করেছি যাতে সবাই পাকিস্তানের প্রথম নোবেলজয়ী হিসেবে আমাকে চেনে।
পাকিস্তানে সানতোখ দাস নামের খুব ছোট্ট এক মফস্বল শহরে আমার জন্ম হয়েছিল। তোমার সোয়াত ভ্যালির সৌন্দর্যের কাছে সে নস্যি। আমি বেড়ে উঠেছিলাম জঙ্গে। এর নামের অর্থ আজ মারাত্মক সব অপরাধী দলের সঙ্গে মিশে নষ্ট হয়ে গেছে।
আমার বাবা চাকরি করতেন পাঞ্জাব সরকারের, শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে। কেন জানি মনে হয়, সাক্ষাৎ হলে তোমার বাবা তাঁকে অপছন্দ করতেন না; বরং পছন্দই করতেন হয়তো।
যাই ঘটুক না কেন আমি সব সময় এক টুকরো আশা আমার বুকের ভেতরে লালন করে পথ চলি। আমাকে সবাই পরিচয় করিয়ে দিত পাকিস্তানের একমাত্র নোবেলজয়ী মানুষ হিসেবে। আর আমি চেষ্টা করেছি যাতে সবাই পাকিস্তানের প্রথম নোবেলজয়ী হিসেবে আমাকে চেনে।
পাকিস্তানে সানতোখ দাস নামের খুব ছোট্ট এক মফস্বল শহরে আমার জন্ম হয়েছিল। তোমার সোয়াত ভ্যালির সৌন্দর্যের কাছে সে নস্যি। আমি বেড়ে উঠেছিলাম জঙ্গে। এর নামের অর্থ আজ মারাত্মক সব অপরাধী দলের সঙ্গে মিশে নষ্ট হয়ে গেছে।
আমার বাবা চাকরি করতেন পাঞ্জাব সরকারের, শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে। কেন জানি মনে হয়, সাক্ষাৎ হলে তোমার বাবা তাঁকে অপছন্দ করতেন না; বরং পছন্দই করতেন হয়তো।
তোমার মতো আমিও কিন্তু পড়ালেখাতেই মন দিয়েছিলাম। ভালোবাসতাম ইংরেজি আর উর্দু সাহিত্য। কিন্তু খুব ভালো করছিলাম অঙ্কে। খুব অল্প বয়সেই ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখলাম, অঙ্কে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে রেকর্ডই করে ফেলেছি।
যদিও আমার পড়ালেখার বিষয়টি তোমার মতো সমস্যাসংকুল আর আতঙ্কের পরিবেশ পায়নি। তালেবানদের হামলায় যেমন ধ্বংস হয়নি আমার স্কুল, ঠিক তেমনি তাদের হুমকির কারণে আমাদের ছেলেদের পড়ালেখাও বন্ধ করতে হয়নি। কিন্তু তোমার যাত্রাপথে যতবারই তারা প্রতিবন্ধকতার দেয়াল খাড়া করেছে, ততবারই সাহসের সঙ্গে সেসব বাধা ভেঙে বেরিয়ে গেছ তুমি।
আদতে প্রতি পদে তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসেই তুমি তাদের প্রতিরোধ করে এসেছ। তোমার এই নোবেল প্রাপ্তি তোমার আক্রমণকারীদের আরও খেপিয়ে তুলবে। তোমার দেশের কিছু মানুষকে এরই মধ্যে তা ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। এসব প্রতিকূলতার মধ্যে হেঁটে যেতে হলে অনেক সাহস লাগে। তোমাকে যতটুকু জেনেছি, সাহসের ক্ষেত্রে তোমার কোনো ঘাটতি নেই।
এই দেশে বলতে গেলে তেমন কিছুই বদলায়নি। তোমার দেশের মানুষই তোমাকে বিদ্রূপ করেছে, তারাই তোমাকে পৃথক করে রেখেছে। অথচ আমি জানি তুমি কোনো ভুলই করোনি। জাতি হিসেবে আসলেই আমরা বিখ্যাত বা সম্মানিত হতে চাই না। আমরা যা চাই তা হচ্ছে—করুণাপ্রার্থী হতে।
তারা ততক্ষণই সন্তুষ্ট ছিল; যতক্ষণ তুমি দেশের আর দশজন সাধারণ ভুক্তভোগীর কাতারেরই একজন ছিলে। কিন্তু যখনই এই ভুক্তভোগীর ম্লান মুখোশ ছুড়ে ফেলে একজন নায়কের প্রতিকৃতি হয়ে তুমি জেগে উঠলে, পৃথিবীতে তোমার বয়সী মেয়েদের কাছে হয়ে উঠলে আশার আলোর রেখা। সে মুহূর্তেই তুমি সেখানেই তাদের হারালে।
আমরা সাহসীদের পছন্দ করি না, মালালা।
আমরা বিশ্বকে দেখাতে পছন্দ করি পরাজিত মননের মানুষদের। এই উপমহাদেশের মুসলমানবিরোধী ‘সাম্রাজ্যবাদীদের’ আমরা হেয় প্রতিপন্ন করতে চাই; হোক না তা বাস্তবের কিংবা কল্পনার সৃষ্টি। আমরা চাই, তারা মেনে নিক; স্বীকার করুক ইকবালের সেই স্বর্গ যা বহিরাগতদের কারণে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের মধ্যকার বিশ্বাসঘাতকদের কারণে সৃষ্ট অব্যক্ত সব ক্ষতির বিবরণ, কিন্তু এই বিবৃতি একটুও সমর্থন করে না।
আমরা আমাদের ভেতরের অন্ধত্ব আর অসহিষ্ণুতাকে স্বীকার করতে চাই না। এর কিছু কিছু অংশ আমিও জানি।
অবশ্য, ঠিক যে দিন আমি নোবেল পুরস্কার হাতে নিয়েছিলাম, বিষয়টা সম্পর্কে সেদিনই পুরোপুরি জেনে গিয়েছিলাম, এমন নয়। একদল কোট-প্যান্ট পরা মানুষদের মাঝে যখন ঐতিহ্যবাহী পাঞ্জাবি পোশাক পরে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। আমি আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি ভেবে গর্ব বোধ করছিলাম। যদিও, আমার দেশ আমার জন্য এর বিপরীতে ন্যূনতম কোনো গর্ব অনুভব করেনি।
ধর্মীয় বোধ বা বিশ্বাসের কারণে হেয় প্রতিপন্ন করে নিষিদ্ধ আর বাতিলের খাতায় সাফল্যের সঙ্গে আমার নাম তোলা হয়েছিল। সহিংসতার আশঙ্কার অজুহাত তুলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে পড়ানোর অনুমতিও দেওয়া হতো না। আমার কৃতিত্ব আর সাফল্য ধুলোয় মিশেছিল আমারই আপন মানুষের জন্য।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম স্বদেশে এমন ‘বিদেশি’ হিসেবে থাকার চেয়ে বিদেশে গিয়ে কাজ করাই শ্রেয়। আর এ বিষয়টিই আমাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ প্রতিপন্ন করার যে প্রচার-প্রচারণা তার আগুনে যেন ঘি ঢেলেছিল।
আজ, এখন এই পতাকা আমি তোমার হাতে দিলাম, প্রিয়তম মালালা। আর এর সঙ্গে সঙ্গে এ পতাকা বহনের যে অপরিসীম বেদনার ভার তোমাকে দিলাম এর জন্য অনুতপ্ত আমি।
তুমিই এখন নতুন ‘বিশ্বাসঘাতক’।
তুমি এমন একটি দেশের শান্তি আর সম্মান আনার দুরূহ দায়িত্ব উপহার পেয়েছ, যে তোমার এ উপহার চায় না।
প্রচণ্ড দুষ্ট আর ভয়াবহ অবাধ্য এক সন্তানের মায়ের মতো তাকে ভালোবাসার একটা পথ তোমাকে খুঁজে বের করতেই হবে। আর আমিও একান্তভাবে প্রার্থনা করছি, তারাও যেন বিষয়টা বুঝতে সক্ষম হয়।
আমি এ দেশের প্রথম নোবেলজয়ী মানুষ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমরা দুজন।
এবং, আমি এখনো পথ চেয়ে আছি।
তোমার একান্ত
আবদুস সালাম
ডন ডটকমে প্রকাশিত ফরাজ তালাতের ‘ আ লেটার ফ্রম ড. আবদুস সালাম টু মালালা’ থেকে ভাবানুবাদ
No comments