দূরের নয় তো কাছেরই লোক by ফারুক ওয়াসিফ
এ
বছর শান্তিতে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন পাকিস্তানের মালালা
ইউসুফজাই ও ভারতের কৈলাস সত্যার্থী। দুজনেরই অবদানের ক্ষেত্র শিশু, শিক্ষা ও
শৈশব। তাঁদের কাজের ওপর আলোকপাত করে প্রথম আলোর আয়োজন...
২০১৪ সালের শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার অবতরণ করল যেন শিশু-কিশোরদেরই কোলে। পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই আর ভারতের কৈলাস সত্যার্থীর জীবন, স্বপ্ন, ভালোবাসা ও সংগ্রামের কেন্দ্রে রয়েছে শিশু, শৈশব ও মুক্ত জীবনের প্রতিশ্রুতি। কৈলাস সত্যার্থী যেন এক বিরাট শিশু। তাঁর কর্মী ব্যক্তিত্বে শিশুর সারল্য আর সাধুর নিষ্ঠা একাকার হয়ে আছে। কাজ ও চিন্তায় কৈলাসের মধ্যে তাই স্বাভাবিকভাবেই মহাত্মা গান্ধীর ছায়াপাত দেখেন অনেকে।
‘আমরা এমন এক দুনিয়ায় বাস করি, যেখানে অনেক সময় কপটেরাই শক্তিশালী। তারা বলে একটা আর করে আরেকটা। আমেরিকার দিকেই দেখুন, করপোরেশনগুলোর অতিরিক্ত লোভের জন্য সেখানে সরকারকে বেইল-আউট কর্মসূচির নামে সাত ট্রিলিয়ন ডলার দিতে হচ্ছে। সবই যাচ্ছে ব্যাংক-বাজারের কাছে। অথচ শিশুদের শিক্ষার জন্য তারা মাত্র ১১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে রাজি নয়। সুতরাং গভীরভাবে এটা একটা নৈতিক প্রশ্ন।’ (৮–২–২০০৯, প্রথম আলো) ২০০৯ সালে বাংলাদেশে এসে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কথাগুলো। এটা তাঁর কথার কথা না, এটা তাঁর বিশ্বাস। তাঁর নেতৃত্বে ভারতের ৮০ হাজার শিশু শ্রমদাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে।
কৈলাস সত্যার্থী একাধারে বৈশ্বিক শিক্ষা অভিযান এবং শিশুশ্রমবিরোধী বৈশ্বিক পদযাত্রার প্রধান। তাঁর নেতৃত্বেই এ দুটি আন্দোলন তৃণমূল পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক দাবিতে পরিণত হয়। শিশুশ্রম বন্ধের দাবিতে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৯৯৮ সালে ১০০টি দেশে ৮০ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পদযাত্রা সংগঠিত করেন। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে জাতিসংঘ পর্যন্ত তাঁর কর্মকাণ্ডের প্রভাবে অনেক দেশে শিক্ষা বিস্তার ও শিশুশ্রম বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ২০০৬ সালের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের ছোট তালিকায় প্রথম তাঁর নাম আসে।
তিন দশক ধরে কৈলাস কাজ করছেন, অথচ শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে ‘বাচপান (শৈশব) বাঁচাও আন্দোলন’ চালু করেন তিনি। শিশুদের শ্রমদাসত্ব ও অশিক্ষার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা কৈলাসের কাছে নৈতিক প্রশ্ন বটে। কোনো দেশের শিশুদের বড় একটি অংশ যদি মুনাফা ও অবহেলার শিকার হতেই থাকে, তবে সেই দেশের নীতিনির্ধারকেরা নিজেদের কীভাবে দায়মুক্ত ভাবেন?
সেই দায়টাই যেন শোধ করতে চান কৈলাস। সবকিছুরই মূল্য দিতে হয়, এমনকি জনসেবারও। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা নিয়মিতভাবে হানা দেন কারখানায়, শিশু পাচারের আস্তানায়, বাল্যবিবাহের ঘাঁটিতে। ঝুঁকির খতিয়ানটা এমন: ‘আমার পা ভেঙেছে, মাথা ফেটেছে, পিঠ ভেঙেছে, কাঁধ ভেঙেছে। আমার সহকর্মীদের একজনকে গুলি করে এবং অন্যজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমার অনুজ সহকর্মীদের বেশির ভাগই প্রহৃত হয়েছেন। এটা কোনো গোলাপযুদ্ধ নয়। অবশ্যই এটা এক চ্যালেঞ্জ। আমি জানি, এই লড়াই খুবই দীর্ঘ, কিন্তু দাসত্ব তো কোনোভাবেই মানা যায় না। এটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। নৈতিকভাবে আমি আমার দেশে শিশুদের অধিকার হরণ কোনোভাবেই মানতে পারি না। এই অর্থে আমি অস্থির মানুষ। আমরা এ রকমটা আর চলতে দিতে পারি না।’ নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগের সপ্তাহেও তিনি ছুটে গেছেন শিশুশ্রম ব্যবহারকারী এক কারখানায়।
ভারতের মধ্যপ্রদেশের ঐতিহাসিক নগর বিদিশায় জন্ম কৈলাসের; ১৯৫৪ সালে। বিদ্যুৎ প্রকৌশলে পড়াশোনা শেষে যোগ দেন পেশায়। কিন্তু অচিরেই নেমে পড়েন স্বেচ্ছাসেবামূলক বেসরকারি উদ্যোগে। কেবল শিশুদের শ্রমদাসত্ব ও পাচারের হাত থেকেই নয়, তিনি শুরু করেন শিশুশ্রম ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন। এভাবে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন অনেক তরুণের। সর্বকালের সেরা মানবাধিকারকর্মীদের তালিকায় তাঁকে আমরা পাই ডেসমন্ড টুটু, এলি ওয়েসেল ও দালাই লামার মতো ব্যক্তির পাশে। বর্তমানে তিনি জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দিকনির্দেশনায় জড়িত।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হয়নি, এমন কোনো বছর যায়নি। অনেকের মনেই শান্তির বরমাল্যভূষণে মালালা ও কৈলাসের চেয়ে অন্য কেউ হয়তো বেশি গ্রহণীয়। কারও মতে, শান্তি পুরস্কার উত্তরোত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতা এবং প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি করে ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান ও এনজিও সংগঠকদের বেছে নিচ্ছে; যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা গ্রামীণ ব্যাংক। তাহলেও কৈলাসকে নিয়ে বিতর্ক কম। অন্যদিকে তালেবানি শক্তির বিরুদ্ধে মালালা চরিত্রের রাজনৈতিক ব্যবহার ঘটলেও কৈলাসের বেলায় এই অভিযোগ বেমানান। কারণ, তিনি নিজেকে মানবিক ও সামাজিক সমতলেই নিয়োজিত রাখতে চান। এই বিনয় ও সাধুতা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।
এনজিও কার্যক্রমের নায়ক হলেও সরকার ও রাজনীতির ভূমিকাকে কৈলাস খাটো করেন না। প্রথম আলোকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে তাই তিনি জোর দেন রাষ্ট্রের ভূমিকার ওপর: সবার আগে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে শিক্ষা মৌলিক মানবাধিকার। এটা দান-খয়রাতের বিষয় নয়, এটা কেবল উদারতার ব্যাপার নয়, এটা কেবল উন্নয়ন প্রকল্প নয়। আর অধিকার নিশ্চিত হয় অধিকারকেন্দ্রিক কর্মসূচি ও অধিকার-মনা পদ্ধতির মাধ্যমে। যদি আমরা শিক্ষাকে পণ্য করে তুলি, তাহলে সবচেয়ে ভালো মানের শিক্ষা কিনবে সবচেয়ে বেশি ক্রয়ক্ষমতার অধিকারীরা, অর্থাৎ উচ্চমধ্যবিত্ত। আবার যদি একে দয়ার ব্যাপার করে তুলি, তাহলে জনগণ সবচেয়ে খারাপ মানের শিক্ষাটাই পাবে। কিন্তু একে মৌলিক অধিকার মনে করলে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব এর সুবন্দোবস্ত করা। এই দায়িত্ব অন্য কারও হাতে অর্পণের প্রশ্নই আসে না।’
উপমহাদেশীয় হিসেবে, অভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত দেশ হিসেবে এবং এই অন্ধকার সময়ে মানবতার জন্য ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে কৈলাস সত্যার্থীকে দূরের নয়, কাছের লোক বলেই মনে হয়।
No comments