কোরবানির ঈদঃ পুরনো দৃশ্য ও কিছু ব্যতিক্রম by মীযানুল করীম
এবার গরুর হাটে যেতে হলো তিনবার। পয়লা দফায় কারণ, ভিড় খুব বেশি। পরের দফায় কারণ, দাম খুব বেশি। তৃতীয় দফায় হাটের দরাদরি আর ঠেলাঠেলির ঝামেলায় না গিয়ে ঢোকার পথেই গরু কেনা হলো। হাটের শুরুতে যে গরুটি পছন্দসই মনে হলো, সেটা কিনেই ফিরতি যাত্রা। রাজধানীর এই গো-হাট অনেক বড়। গরু হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র হিসেবে গণ্য। সেই গো-দেবতা বিকিকিনির হাটটির পাশে দুর্গাপূজার মণ্ডপ। কোনো মারামারি, বাদবিসংবাদ নেই। সম্প্রীতির বাংলাদেশে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু পাশের দেশ ভারতে তা কোনো দিন সম্ভব হবে কি?
অনেক বছর ধরে রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় কোরবানির হাট বসছে। শ্যামলী থেকে পূর্বমুখী প্রধান সড়কের দু’পাশে এ বাজার বসে। আগে থেকেই এলাকাটিতে ছিল পঙ্গু হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল এবং যক্ষ্মা কিনিক। গত কয়েক বছরে এর সাথে যোগ হয়েছে চু হাসপাতাল। আরো হাসপাতাল রয়েছে আশপাশে। অন্তত আধা ডজন গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল এবং সেই সাথে জাতীয় বেতার ভবনের মতো Key Point Installation বা নিরাপত্তা ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পর্শকাতর স্থাপনা এখানেই। এসব সত্ত্বেও কোরবানির পশুর বিরাট হাট এবারো বসেছে এই জায়গাজুড়ে। হয়তো বিকল্প স্থান না পেয়ে এটা করতে হয়েছে। অতীতে আগারগাঁও পশুহাটের ইজারা পেতেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা নূরু হাজী। দুই বছর আগে গুম হয়ে যাওয়ার পর ক্ষমতাসীন মহলের ঘনিষ্ঠ অন্যরা ইজারা পাচ্ছেন। যা হোক, এবার কোরবানির পশুহাটে অসংখ্য দ্বিপদ ও চতুষ্পদ প্রাণীর সমাগম, চলাচল ও কোলাহলে এলাকার বড় রাস্তার পাশের হাসপাতালগুলোকে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এ নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বিরোধ মাথাচাড়া দেয় ঈদের আগেই। তখন মুখ খুলেছেন এক প্রতিমন্ত্রী। ঈদের পর ইস্যুটি কাইমেক্সে ওঠে, যখন একজন পুরো মন্ত্রী প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়লেন।
ঈদের আগেই পত্রপত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে রিপোর্ট ছাপিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় যে, কোরবানির পশুহাটের কারণে অন্তত চারটি প্রধান হাসপাতালে যাতায়াত কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আমরা বড় রাস্তার পাশে হাট বসাতে নিষেধ করেছি; কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তা শোনেনি। উল্লেখ্য, এ মন্ত্রণালয়ের অধীন সিটি করপোরেশন ঢাকার পশুহাটগুলো ইজারা দিয়েছে। কোরবানির হাট দু’টি মিলিয়ে বড় একটি করা হয়েছে আগারগাঁওয়ে। গরুও এসেছে ধারণাতীত সংখ্যায়। ফলে উল্লিখিত হাসপাতালগুলোর রোগী, তাদের স্বজন, ডাক্তার-নার্স-কর্মচারীদের সমস্যায় পড়তে হয়। এ প্রেক্ষাপটে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে একহাত নিলেন। বুধবার সচিবালয়ে এ বিষয়ে দস্তুরমতো সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এতে মন্ত্রী বলেছেন, হাসপাতালের সামনে গরুর হাট বসাতে দিয়ে ওই কর্মকর্তা ক্রিমিনাল অফেন্স (ফৌজদারি অপরাধ) করেছেন। এ ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন লোক প্রশাসনে থাকতে পারে না। তিনি কিসের বিনিময়ে কাজটি করেছেন?
ক্ষুব্ধ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এসব হাসপাতালে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে গরুর হাট বসানোর অনুমতি না দিতে দুই মাস আগেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিলাম। তারা কথা দিয়েছিলেন যে, এখানে কোরবানির হাট বসবে না; কিন্তু পরে অন্যায়ভাবে হাট বসানো হয়েছে।
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, অন্যান্য হাটের মতো এটিরও ইজারা পেয়েছেন এই মন্ত্রীর দলের লোক, তথা অঙ্গসংগঠনের জনৈক নেতা। তার বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা নেয়া হবে’ বলে তিনি জানালেও এর নিশ্চয়তা নেই। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক নিজে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। নানা অনিয়মের মাধ্যমে এবার হাটের ইজারা নিয়েছেন সরকারি দলের লোকেরাই। তাদের ইজারা না দিয়ে আমলাদের উপায়ও থাকে না। এ দিকে আগারগাঁওয়ের পশুহাটের বিষয়ে অভিযুক্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কিন্তু কোনো বক্তব্য দেয়নি।
আগামী বছর থেকে হয়তো আগারগাঁওয়ের হাসপাতাল জোন এবং রেডিও অফিসের পাশে গরুর হাট বসতে দেয়া হবে না। তখন হাটটি উত্তর দিকে সরিয়ে দিতে হবে। যা হোক, বিরাট এই পশুহাটটি ঘুরে দেখা গেছে, গরুর ক্রেতা-বিক্রেতারা প্রয়োজনে পশুচিকিৎসক পাওয়ার কথা থাকলেও সে ব্যবস্থা ছিল নেহাত অপ্রতুল। পুরো হাটে ‘হাসিল’ আদায়ের প্যান্ডেলগুলোতে প্রধানত একজন ডাক্তারের নাম লেখা ছিল। তা-ও তিনি সিরাজগঞ্জের বলে জানানো হয়েছে। তা হলে রাজধানীতে কি পশুচিকিৎসক নেই? শনিবার এই হাট থেকে ফেরার পথে রোকেয়া সরণিতে দেখলাম, একটা হৃষ্টপুষ্ট ও বড় সাইজের গরু অসুস্থ হয়ে রাস্তায় বসে পড়েছে। সেটি আর হাঁটতে পারছিল না। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে গরুটির মাথায় পানি ঢালা হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে গরুর চিকিৎসার উপায় কী?
এবার রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাট অনেক জায়গায় এক দিন আগেই ভেঙে গেছে। ঢাকার যে বিশাল হাটে শনিবার রাতেও হাজার হাজার গরু-ছাগল আর অজস্র মানুষের ভিড়, পরদিন সকালেই তা অনেকটা ফাঁকা। রহস্য কী? দাম পড়ে যাওয়ায় মানুষ অল্প সময়েই অনেক পশু কিনে নিয়ে গেছে। লোকসানের আশঙ্কায় বিক্রেতা তাড়াতাড়ি গরু বেচে দিয়ে হাঁফ ছেড়েছেন। আরেকটা কারণ, সম্ভবত দর কমে যাওয়ায় ব্যাপারীদের গরু অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া।
রোববারে হাটের এই আকর্ষণহীনতার পরদিন জাতীয় ঈদগাহে ঈদের প্রধান জামাতটি এবার ছিল আকর্ষণহীন। টিভির খবর, রাষ্ট্রপতি দেশে না থাকায় এবং বেশির ভাগ মন্ত্রী অনুপস্থিত থাকায় এই জামাত জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছিল কিন্তু রাজধানীর প্রধান জামাত জমজমাট হওয়া-না-হওয়া কোনো বিশেষ ব্যক্তি থাকা-না-থাকার ওপর নির্ভর করবে কেন? টিভির ক্যামেরায় চেহারা দেখাতে কেউ সেখানে যাওয়ার কথা নয়।
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোরবানির সব বর্জ্য অপসারণের ঘোষণা দিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। তারা অনেক ক্ষেত্রে তৎপর ছিল। তবে বহু এলাকায় রক্ত ও নাড়িভুঁড়ির দুর্গন্ধ ঈদের আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে দু-তিন দিন পরও। ঈদের পরদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অল্প দূরে নাখালপাড়ায় দেখি, সদর রাস্তার পাশে গরুর বর্জ্য উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কাছে কোনো কোনো বাড়ির লোকেরা নিজ উদ্যোগেই ব্লিচিং পাউডার ছিটাচ্ছেন।
এবারো ঈদের ছুটিতে ‘মরণ মিছিল’ বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৮-১০ জনের মৃত্যু যেন নিয়মিত ব্যাপার। ঈদের পরদিন টাঙ্গাইলে শোচনীয় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন আমার পরিচিত একটি পরিবারের একজন মহিলা ও কাজের মেয়ে। আহত কয়েকজন। প্রাইভেট কারে তারা ঢাকা থেকে বাড়ি যাচ্ছিলেন। ওই প্রবীণ মহিলা বাংলাদেশ ব্যাংকের জিএম মাসুদ বিশ্বাসের স্নেহময়ী জননী। এই ট্র্যাজেডি ঈদের আনন্দে অকস্মাৎ যবনিকা ফেলে সবাইকে বিষাদে নিমজ্জিত করেছে। টিভির নিউজে বলা হচ্ছিল, টাঙ্গাইলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২; কিন্তু যারা আপনজন হারালেন চিরদিনের জন্য, তাদের কাছে এটা নিছক ‘২’ কিংবা ‘১’ নয়, বরং বিরাট শোক ও বেদনার কারণ। অনেকেই মনে করেন, ঈদপরবর্তী ফাঁকা সড়কে বেপরোয়া যান চালনার ফলে দু’টি গাড়ির সংঘর্ষ ঘটে অথবা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা খায় কিংবা খাদে পড়ে যায়।
মানুষ যখন অধম হয়ে যায়, তখন সে নেমে যায় পশুর চেয়েও নিচের স্তরে। এবারো গরু কোরবানির মওসুমে এমন অনেক ঘটনা দেশে ঘটেছে, যা প্রমাণ করেÑ গরু নামের চতুষ্পদ প্রাণীটি ‘প্রকাশ্য গরু’, কিন্তু ‘মানুষ’ পরিচয়ের মুখোশের আড়ালে রয়েছে দ্বিপদ গরু, যাদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। কারণ, পবিত্র ঈদের দিনেও টিভির সংবাদ শিরোনাম থেকে জানা গেছে, এক জেলায় কোরবানির গোশত ভাগ করা নিয়ে সংঘর্ষে একজন মারা গেছে। আরেক জেলায় গরুর ধান খাওয়াকে কেন্দ্র করে মারামারিতে একজন নিহত। অন্য এক জায়গায় ট্রেনের ছাদে চড়ে বাড়ি যাওয়ার সময় ছয়জনকে অজ্ঞান করে নিচে ফেলে দেয়া হয়েছে, তাদের একজন মারা গেছে। নিশ্চয়ই তার আগে এই হতভাগাদের সব টাকা-পয়সা, মোবাইল লুটে নেয়া হয়েছে। একই দিন সেই একই দল, অর্থাৎ ‘জাতীয় মলম পার্টি’ রাজধানীর উপকণ্ঠে দুইজন গরু বিক্রেতাকে কুপিয়ে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে। ঈদের দুই দিন আগে ঢাকার পল্লবীতে অজ্ঞান পার্টি ১৫ জন গরু বিক্রেতাকে অচেতন করেছে এবং লুট করেছে আড়াই লাখ টাকা। একই দিনের আরেক খবর, এক জেলায় গরুর হাট নিয়ে সংঘর্ষে একজন নিহত, কয়েকজন আহত। সে জেলাতেই কোরবানির গোশত ভাগাভাগি নিয়ে ঈদের দিন আরো একজন প্রাণ হারিয়েছে। সবাই স্বীকার করবেন, গরু যতই গুঁতা দিক, অন্তত এই অমানুষগুলোর পর্যায়ে কোনো দিন ওরা নামবে না।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এক যুবকের প্রেমঘটিত ব্যাপারে তাকে ‘কোরবানি করা’র হুমকি দেয়া হয়েছিল এবার কোরবানির ঈদের আগে। সেদিন তাকে হত্যা করা না হলেও তিন দিন পরে বাড়ির অদূরে তাকে ধরে জবাই করা হয়েছে।
বড় বড় শহরে, অনেক ক্ষেত্রে রাজপথেও ঈদের জামাত হচ্ছে। কারণ, পাশের পাঁচ-ছয়তলা মসজিদেও স্থানসঙ্কুলান হয় না। তখন শত শত মানুষকে নোংরা খোলা রাস্তায় এবং ড্রেনের পাশে ঈদের নামাজ পড়তে হয়। ঈদের আগের দিন এসব স্থানে দুর্গন্ধ ও জীবাণু নাশের জন্য ওষুধ ছিটানো উচিত।
ঈদের জামাতে কিছু দৃষ্টিকটু আচরণ দেখা যাচ্ছে অনেকের। ইমাম সাহেব সালাম ফেরানো মাত্রই অনেকে উঠে চলে যেতে চান কিংবা এ দিক-ও দিক হাঁটাহাঁটি শুরু করে দেন। আর নামাজের সারিতে দাঁড়িয়ে বা বসে মোবাইলে কথা বলা তো চলছেই। অথচ তখন সবে খুতবা শুরু হয়েছে। মুনাজাত শেষ করে বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই দেখা যায়, অনেকে গরু-ছাগল জবাই শেষ করে চামড়া ছাড়াচ্ছেন। তারা ঈদের নামাজ শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করার কারণ কী?
কোরবানি বা ঈদুল আজহার বিরুদ্ধে অপপ্রচার সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। ‘বিষাদ সিন্ধু’ প্রণেতা মীর মশাররফ হোসেন পর্যন্ত ‘গো-হত্যা’ বন্ধ করার ধ্বনি তুলেছিলেন। ত্রিশের দশকে রেজাউল করিম নামের জনৈক প্রগতিবাদী ব্যক্তি কোরবানির বিরুদ্ধে নিবন্ধ লেখায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তবে এ ধরনের পশুপ্রেমীক অর্বাচীনদের মোক্ষম জবাব দিয়েছিলেন মহান মানবপ্রেমীক কবি নজরুল। পরাধীন দেশের মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলোতে জাতিকে জাগাতে চেয়েছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ ক্ষেত্রে একটি বড় দৃষ্টান্ত তার বিখ্যাত ‘কোরবানী’ কবিতা।
সুদীর্ঘ কবিতাটির সূচনাপঙ্ক্তি বহুলপরিচিত, ‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন।’ কোরবানি নিছক গরু-ছাগল জবাই করা নয়, এর বিরাট তাৎপর্য রয়েছে। জাতি তা অনুধাবন করে জেগে ওঠার লক্ষ্যে নজরুল অপূর্ব ওজস্বী ভাষায় ও তেজস্বীভঙ্গিতে ছন্দে ছন্দে সাহস ও সংগ্রামের মহাবাণী উচ্চকিত করেছিলেন।
এই কবিতার প্রথম পর্বটি হলো :
অনেক বছর ধরে রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় কোরবানির হাট বসছে। শ্যামলী থেকে পূর্বমুখী প্রধান সড়কের দু’পাশে এ বাজার বসে। আগে থেকেই এলাকাটিতে ছিল পঙ্গু হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল এবং যক্ষ্মা কিনিক। গত কয়েক বছরে এর সাথে যোগ হয়েছে চু হাসপাতাল। আরো হাসপাতাল রয়েছে আশপাশে। অন্তত আধা ডজন গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল এবং সেই সাথে জাতীয় বেতার ভবনের মতো Key Point Installation বা নিরাপত্তা ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পর্শকাতর স্থাপনা এখানেই। এসব সত্ত্বেও কোরবানির পশুর বিরাট হাট এবারো বসেছে এই জায়গাজুড়ে। হয়তো বিকল্প স্থান না পেয়ে এটা করতে হয়েছে। অতীতে আগারগাঁও পশুহাটের ইজারা পেতেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা নূরু হাজী। দুই বছর আগে গুম হয়ে যাওয়ার পর ক্ষমতাসীন মহলের ঘনিষ্ঠ অন্যরা ইজারা পাচ্ছেন। যা হোক, এবার কোরবানির পশুহাটে অসংখ্য দ্বিপদ ও চতুষ্পদ প্রাণীর সমাগম, চলাচল ও কোলাহলে এলাকার বড় রাস্তার পাশের হাসপাতালগুলোকে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এ নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বিরোধ মাথাচাড়া দেয় ঈদের আগেই। তখন মুখ খুলেছেন এক প্রতিমন্ত্রী। ঈদের পর ইস্যুটি কাইমেক্সে ওঠে, যখন একজন পুরো মন্ত্রী প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়লেন।
ঈদের আগেই পত্রপত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে রিপোর্ট ছাপিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় যে, কোরবানির পশুহাটের কারণে অন্তত চারটি প্রধান হাসপাতালে যাতায়াত কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আমরা বড় রাস্তার পাশে হাট বসাতে নিষেধ করেছি; কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তা শোনেনি। উল্লেখ্য, এ মন্ত্রণালয়ের অধীন সিটি করপোরেশন ঢাকার পশুহাটগুলো ইজারা দিয়েছে। কোরবানির হাট দু’টি মিলিয়ে বড় একটি করা হয়েছে আগারগাঁওয়ে। গরুও এসেছে ধারণাতীত সংখ্যায়। ফলে উল্লিখিত হাসপাতালগুলোর রোগী, তাদের স্বজন, ডাক্তার-নার্স-কর্মচারীদের সমস্যায় পড়তে হয়। এ প্রেক্ষাপটে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে একহাত নিলেন। বুধবার সচিবালয়ে এ বিষয়ে দস্তুরমতো সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এতে মন্ত্রী বলেছেন, হাসপাতালের সামনে গরুর হাট বসাতে দিয়ে ওই কর্মকর্তা ক্রিমিনাল অফেন্স (ফৌজদারি অপরাধ) করেছেন। এ ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন লোক প্রশাসনে থাকতে পারে না। তিনি কিসের বিনিময়ে কাজটি করেছেন?
ক্ষুব্ধ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এসব হাসপাতালে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে গরুর হাট বসানোর অনুমতি না দিতে দুই মাস আগেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিলাম। তারা কথা দিয়েছিলেন যে, এখানে কোরবানির হাট বসবে না; কিন্তু পরে অন্যায়ভাবে হাট বসানো হয়েছে।
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, অন্যান্য হাটের মতো এটিরও ইজারা পেয়েছেন এই মন্ত্রীর দলের লোক, তথা অঙ্গসংগঠনের জনৈক নেতা। তার বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা নেয়া হবে’ বলে তিনি জানালেও এর নিশ্চয়তা নেই। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক নিজে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। নানা অনিয়মের মাধ্যমে এবার হাটের ইজারা নিয়েছেন সরকারি দলের লোকেরাই। তাদের ইজারা না দিয়ে আমলাদের উপায়ও থাকে না। এ দিকে আগারগাঁওয়ের পশুহাটের বিষয়ে অভিযুক্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কিন্তু কোনো বক্তব্য দেয়নি।
আগামী বছর থেকে হয়তো আগারগাঁওয়ের হাসপাতাল জোন এবং রেডিও অফিসের পাশে গরুর হাট বসতে দেয়া হবে না। তখন হাটটি উত্তর দিকে সরিয়ে দিতে হবে। যা হোক, বিরাট এই পশুহাটটি ঘুরে দেখা গেছে, গরুর ক্রেতা-বিক্রেতারা প্রয়োজনে পশুচিকিৎসক পাওয়ার কথা থাকলেও সে ব্যবস্থা ছিল নেহাত অপ্রতুল। পুরো হাটে ‘হাসিল’ আদায়ের প্যান্ডেলগুলোতে প্রধানত একজন ডাক্তারের নাম লেখা ছিল। তা-ও তিনি সিরাজগঞ্জের বলে জানানো হয়েছে। তা হলে রাজধানীতে কি পশুচিকিৎসক নেই? শনিবার এই হাট থেকে ফেরার পথে রোকেয়া সরণিতে দেখলাম, একটা হৃষ্টপুষ্ট ও বড় সাইজের গরু অসুস্থ হয়ে রাস্তায় বসে পড়েছে। সেটি আর হাঁটতে পারছিল না। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে গরুটির মাথায় পানি ঢালা হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে গরুর চিকিৎসার উপায় কী?
এবার রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাট অনেক জায়গায় এক দিন আগেই ভেঙে গেছে। ঢাকার যে বিশাল হাটে শনিবার রাতেও হাজার হাজার গরু-ছাগল আর অজস্র মানুষের ভিড়, পরদিন সকালেই তা অনেকটা ফাঁকা। রহস্য কী? দাম পড়ে যাওয়ায় মানুষ অল্প সময়েই অনেক পশু কিনে নিয়ে গেছে। লোকসানের আশঙ্কায় বিক্রেতা তাড়াতাড়ি গরু বেচে দিয়ে হাঁফ ছেড়েছেন। আরেকটা কারণ, সম্ভবত দর কমে যাওয়ায় ব্যাপারীদের গরু অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া।
রোববারে হাটের এই আকর্ষণহীনতার পরদিন জাতীয় ঈদগাহে ঈদের প্রধান জামাতটি এবার ছিল আকর্ষণহীন। টিভির খবর, রাষ্ট্রপতি দেশে না থাকায় এবং বেশির ভাগ মন্ত্রী অনুপস্থিত থাকায় এই জামাত জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছিল কিন্তু রাজধানীর প্রধান জামাত জমজমাট হওয়া-না-হওয়া কোনো বিশেষ ব্যক্তি থাকা-না-থাকার ওপর নির্ভর করবে কেন? টিভির ক্যামেরায় চেহারা দেখাতে কেউ সেখানে যাওয়ার কথা নয়।
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোরবানির সব বর্জ্য অপসারণের ঘোষণা দিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। তারা অনেক ক্ষেত্রে তৎপর ছিল। তবে বহু এলাকায় রক্ত ও নাড়িভুঁড়ির দুর্গন্ধ ঈদের আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে দু-তিন দিন পরও। ঈদের পরদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অল্প দূরে নাখালপাড়ায় দেখি, সদর রাস্তার পাশে গরুর বর্জ্য উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কাছে কোনো কোনো বাড়ির লোকেরা নিজ উদ্যোগেই ব্লিচিং পাউডার ছিটাচ্ছেন।
এবারো ঈদের ছুটিতে ‘মরণ মিছিল’ বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৮-১০ জনের মৃত্যু যেন নিয়মিত ব্যাপার। ঈদের পরদিন টাঙ্গাইলে শোচনীয় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন আমার পরিচিত একটি পরিবারের একজন মহিলা ও কাজের মেয়ে। আহত কয়েকজন। প্রাইভেট কারে তারা ঢাকা থেকে বাড়ি যাচ্ছিলেন। ওই প্রবীণ মহিলা বাংলাদেশ ব্যাংকের জিএম মাসুদ বিশ্বাসের স্নেহময়ী জননী। এই ট্র্যাজেডি ঈদের আনন্দে অকস্মাৎ যবনিকা ফেলে সবাইকে বিষাদে নিমজ্জিত করেছে। টিভির নিউজে বলা হচ্ছিল, টাঙ্গাইলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২; কিন্তু যারা আপনজন হারালেন চিরদিনের জন্য, তাদের কাছে এটা নিছক ‘২’ কিংবা ‘১’ নয়, বরং বিরাট শোক ও বেদনার কারণ। অনেকেই মনে করেন, ঈদপরবর্তী ফাঁকা সড়কে বেপরোয়া যান চালনার ফলে দু’টি গাড়ির সংঘর্ষ ঘটে অথবা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা খায় কিংবা খাদে পড়ে যায়।
মানুষ যখন অধম হয়ে যায়, তখন সে নেমে যায় পশুর চেয়েও নিচের স্তরে। এবারো গরু কোরবানির মওসুমে এমন অনেক ঘটনা দেশে ঘটেছে, যা প্রমাণ করেÑ গরু নামের চতুষ্পদ প্রাণীটি ‘প্রকাশ্য গরু’, কিন্তু ‘মানুষ’ পরিচয়ের মুখোশের আড়ালে রয়েছে দ্বিপদ গরু, যাদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। কারণ, পবিত্র ঈদের দিনেও টিভির সংবাদ শিরোনাম থেকে জানা গেছে, এক জেলায় কোরবানির গোশত ভাগ করা নিয়ে সংঘর্ষে একজন মারা গেছে। আরেক জেলায় গরুর ধান খাওয়াকে কেন্দ্র করে মারামারিতে একজন নিহত। অন্য এক জায়গায় ট্রেনের ছাদে চড়ে বাড়ি যাওয়ার সময় ছয়জনকে অজ্ঞান করে নিচে ফেলে দেয়া হয়েছে, তাদের একজন মারা গেছে। নিশ্চয়ই তার আগে এই হতভাগাদের সব টাকা-পয়সা, মোবাইল লুটে নেয়া হয়েছে। একই দিন সেই একই দল, অর্থাৎ ‘জাতীয় মলম পার্টি’ রাজধানীর উপকণ্ঠে দুইজন গরু বিক্রেতাকে কুপিয়ে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে। ঈদের দুই দিন আগে ঢাকার পল্লবীতে অজ্ঞান পার্টি ১৫ জন গরু বিক্রেতাকে অচেতন করেছে এবং লুট করেছে আড়াই লাখ টাকা। একই দিনের আরেক খবর, এক জেলায় গরুর হাট নিয়ে সংঘর্ষে একজন নিহত, কয়েকজন আহত। সে জেলাতেই কোরবানির গোশত ভাগাভাগি নিয়ে ঈদের দিন আরো একজন প্রাণ হারিয়েছে। সবাই স্বীকার করবেন, গরু যতই গুঁতা দিক, অন্তত এই অমানুষগুলোর পর্যায়ে কোনো দিন ওরা নামবে না।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এক যুবকের প্রেমঘটিত ব্যাপারে তাকে ‘কোরবানি করা’র হুমকি দেয়া হয়েছিল এবার কোরবানির ঈদের আগে। সেদিন তাকে হত্যা করা না হলেও তিন দিন পরে বাড়ির অদূরে তাকে ধরে জবাই করা হয়েছে।
বড় বড় শহরে, অনেক ক্ষেত্রে রাজপথেও ঈদের জামাত হচ্ছে। কারণ, পাশের পাঁচ-ছয়তলা মসজিদেও স্থানসঙ্কুলান হয় না। তখন শত শত মানুষকে নোংরা খোলা রাস্তায় এবং ড্রেনের পাশে ঈদের নামাজ পড়তে হয়। ঈদের আগের দিন এসব স্থানে দুর্গন্ধ ও জীবাণু নাশের জন্য ওষুধ ছিটানো উচিত।
ঈদের জামাতে কিছু দৃষ্টিকটু আচরণ দেখা যাচ্ছে অনেকের। ইমাম সাহেব সালাম ফেরানো মাত্রই অনেকে উঠে চলে যেতে চান কিংবা এ দিক-ও দিক হাঁটাহাঁটি শুরু করে দেন। আর নামাজের সারিতে দাঁড়িয়ে বা বসে মোবাইলে কথা বলা তো চলছেই। অথচ তখন সবে খুতবা শুরু হয়েছে। মুনাজাত শেষ করে বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই দেখা যায়, অনেকে গরু-ছাগল জবাই শেষ করে চামড়া ছাড়াচ্ছেন। তারা ঈদের নামাজ শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করার কারণ কী?
কোরবানি বা ঈদুল আজহার বিরুদ্ধে অপপ্রচার সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। ‘বিষাদ সিন্ধু’ প্রণেতা মীর মশাররফ হোসেন পর্যন্ত ‘গো-হত্যা’ বন্ধ করার ধ্বনি তুলেছিলেন। ত্রিশের দশকে রেজাউল করিম নামের জনৈক প্রগতিবাদী ব্যক্তি কোরবানির বিরুদ্ধে নিবন্ধ লেখায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তবে এ ধরনের পশুপ্রেমীক অর্বাচীনদের মোক্ষম জবাব দিয়েছিলেন মহান মানবপ্রেমীক কবি নজরুল। পরাধীন দেশের মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলোতে জাতিকে জাগাতে চেয়েছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ ক্ষেত্রে একটি বড় দৃষ্টান্ত তার বিখ্যাত ‘কোরবানী’ কবিতা।
সুদীর্ঘ কবিতাটির সূচনাপঙ্ক্তি বহুলপরিচিত, ‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন।’ কোরবানি নিছক গরু-ছাগল জবাই করা নয়, এর বিরাট তাৎপর্য রয়েছে। জাতি তা অনুধাবন করে জেগে ওঠার লক্ষ্যে নজরুল অপূর্ব ওজস্বী ভাষায় ও তেজস্বীভঙ্গিতে ছন্দে ছন্দে সাহস ও সংগ্রামের মহাবাণী উচ্চকিত করেছিলেন।
এই কবিতার প্রথম পর্বটি হলো :
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!/
দুর্বল ভীরু চুপ রহো, ওহো খাম্খা ুব্ধ মন/
ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,/
আজিকার এ খুন কোরবানীর/
দুম্বা শির রুম-বাসীর/
শহীদের শির-সেরা আজি। রহমান কি রুদ্র নন?
মোট ন’টি পর্বের বড় কবিতাটির শেষ দু’টি পর্ব তুলে ধরা হচ্ছে এখানেÑ
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
মুসলিম রণ-ডঙ্কা সে,
খুন দেখে করে শঙ্কা কে?
টঙ্কারে অসি-ঝঙ্কারে,
ওরে হুঙ্কারে, ভাঙি’ গড়া ভীম কারা, লড়বো রণ-মরণ!
ঢালে বাজবে ঝন-ঝনন্।
সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
জোর চাই, আর যাচনা নয়,
কোরবানী দিন আজ না ওই?
বাজনা কই? সাজনা কই?
কাজ না আজিকে জানমাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধারণ?
বলÑ‘যুঝবো জান ভি পণ!’
খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ,
আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
কোরবানির ঈদ প্রতি বছর আসে, ভবিষ্যতেও আসবে। আরো বেশি দামে আরো বড় গরু কেনা হবে। উৎসবের আয়োজনও বাড়বে দিন দিন। খরচ বাড়বে তাল রেখে; কিন্তু কোরবানির শিক্ষা কতটুকু আমরা গ্রহণ করছি? ঈদুল আজহার প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা না গেলে অবলা প্রাণীর প্রাণনাশই সার হবে, কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণীটি কোনো ফায়দা পাবে না। ঈদে কোটি কোটি টাকার চামড়া সংগ্রহের টার্গেট থাকে; কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন পরকালের জন্য অমূল্য পুণ্য সংগ্রহের উদ্যোগ। আমরা জীবনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রের মতো ঈদের বেলায়ও লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষকে দিচ্ছি বেশি গুরুত্ব।
স্বার্থ, সঙ্কীর্ণতা, প্রবৃত্তির তাড়না, অর্থ-খ্যাতি-বিত্তবিলাসের মোহ, অবৈধ ক্ষমতা ও সম্পদ, ষড়রিপুর দাসত্ব প্রভৃতি কোরবানি করাই কোরবানির ঈদের লক্ষ্য; কিন্তু আমরা ত্যাগের নির্দেশ ভুলে ভোগে মত্ত থাকি। পার্থিব নানা অপশক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করার হীনতায় লজ্জা হয় না। অথচ সর্বজগতের একক অধিপতি, স্রষ্টা, প্রতিপালক বিধানদাতা এবং চূড়ান্ত বিচারকের কাছে আত্মসমর্পণের দায়িত্ব আমাদের ক’জন পালন করছে? যার যত বড় পদ ও ক্ষমতা, যত বেশি সম্পদ ও সুযোগ; তার তত বেশি কোরবানি দেয়া, অর্থাৎ ত্যাগ স্বীকার করা জরুরি। আমাদের সমাজের চিত্রটা এর বিপরীত। আমরা কথায় ত্যাগী : কাজের সময়ে ষোলোআনা ভোগ করতে মরিয়া হয়ে উঠি। এভাবে চললে ঈদুল আজহা পালন করা-না-করা একই।
টিভি চ্যানেলে ঈদ অনুষ্ঠানের ধুম, যেখানে ঈদের সাথে কোনো সম্পর্কই নেই। গৎবাঁধা, কমার্শিয়াল, ছ্যাবলামি ইত্যাদি বিশেষণে এগুলোকে দর্শকেরা অভিহিত করে থাকেন। ছয় হালি চ্যানেলে ঈদ নাটক প্রচার হয় ডজন ডজন; কিন্তু এগুলোকে চমৎকার, মানসম্মত, রুচিশীল ও সুস্থ বিনোদন বলেন ক’জন? এর পাশাপাশি পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীর ঈদসংখ্যা ও বিনোদন ম্যাগাজিন। বিশিষ্টজনদের রঙ-বেরঙের ছবির সাথে রঙিন স্মৃতিচারণ। কিছু তথ্য, কিছু অতিরঞ্জন; কিছুটা আত্মপ্রচারও থাকতে পারে। যা হোক, দৈনিক ইত্তেফাকের ঈদ বিনোদন সাময়িকীর প্রচ্ছদকন্যা অপু বিশ্বাস। চলচ্চিত্রের এই নায়িকার সাক্ষাৎকারধর্মী বক্তব্যের একটি অংশ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
পত্রিকার প্রতিনিধি বলতে চেয়েছেন, মাইনরিটি বা সংখ্যালঘু হলে একটা সমস্যা থাকে। অপু বিশ্বাস হিন্দুর মেয়ে। তাকে এমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয় কি না, এ প্রশ্ন করার আগেই অপু তা বুঝে ফেলেন এবং বললেন, ‘এ দেশে সে ক্ষেত্রে কাজের ব্যাপারে সমস্যা হয় না। মোটেই না। ...আমার একটা প্রশ্ন আছে; সেটা আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে নয়, বলিউড বা কলকাতার চলচ্চিত্র নিয়ে। আমার মনে হয়, ওপার বাংলায় এই ধর্মীয় ব্যাপার নিয়ে ইজমটা অনেকখানি। কারণ, দেখুনÑ ওদেশে কোনো ভালো চরিত্র মুসলিম হিসেবে দেখানো হচ্ছে না। শাহরুখ, আমির, সালমান আজীবন হিন্দু চরিত্রেই কাজ করে গেলেন। কী অদ্ভুত ঘটনা! প্রায় প্রত্যেক ছবিতে মূল ভিলেন বা টেরোরিস্ট মানেই মুসলিম। আমার মনে হয়, সেদিক দিয়ে আমাদের দেশে আমরা অনেকটা সহনশীল। আমি একজন হিন্দু মেয়ে হয়েও এটা (ভারতের ব্যাপারটা) আমার কাছে খুবই দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে।’
‘সেলফি’। শব্দটি অল্প ক’দিনের মধ্যেই বহুলপ্রচলিত হয়ে উঠেছে। সেলফোন দিয়ে বিশেষ করে নিজের নানা ভঙ্গি আর কর্মকাণ্ডের ছবির নাম সেলফি। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে অনেকের খায়েশ, তার কেনা কিংবা তাদের পরিবারের জন্য কেনা চতুষ্পদটির সাথে ছবি তোলা। এই পশুটির নাম গরু; ইংরেজিতে কাউ। অতএব, সেলফি এ ক্ষেত্রে ‘কাউফি’ হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে একটি রম্য সাময়িকীতে ঈদের আগে যে পরামর্শ ফ্রি দেয়া হয়েছে, তা তুলে ধরা হলো। ‘সেলফি তোলার সময়ে গরুকে সামনে রাখবেন, নাকি আপনি সামনে থাকবেন? এ সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত জরুরি। আগে আপনাকে জেনে নিতে হবে, আপনার গরুটি শিং চালাতে ওস্তাদ, নাকি পা চালাতে পারদর্শী। শিং চালাতে ওস্তাদ হলে গরুকে সামনে রেখে সেলফি তুলে ওস্তাদের পরিচয় দিন। আর পা চালাতে দক্ষ হলে আপনিই থাকবেন সামনে।’
পাদটীকা : কী মিয়া, তোমার গরুডা এমুন ঝিম ধইরা আছে ক্যান্? খোঁচা দিলেও যে নড়ে না।’ বড়ি খাওয়াইয়া আর ইনজেক্শন দিয়া তুমিও মোটা-তাজা বানাইবার কেরামতি করছো না কি?
: তোবা তোবা, কী যে কন্ স্যার। আমনেরা জ্ঞানী মানুষ, ভালো বুঝবেন। আসল ব্যাপার অইলো, মানুষের মইদ্যে যেমন চঞ্চল ও দুষ্টু টাইপের আছে, তেমনি আছে গম্ভীর ও শান্ত মানুষ। গরুর মইদ্যেও এই দু’কিসিম কি থাকতে পারে না? আর বিশেষ কইরা যহন কোরবানির দিন ঘনাইছে, তহন তো ভালা গরু মরণের কতা ভাইবা চুপচাপ থাকাই স্বাভাবিক।’
দুর্বল ভীরু চুপ রহো, ওহো খাম্খা ুব্ধ মন/
ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,/
আজিকার এ খুন কোরবানীর/
দুম্বা শির রুম-বাসীর/
শহীদের শির-সেরা আজি। রহমান কি রুদ্র নন?
মোট ন’টি পর্বের বড় কবিতাটির শেষ দু’টি পর্ব তুলে ধরা হচ্ছে এখানেÑ
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
মুসলিম রণ-ডঙ্কা সে,
খুন দেখে করে শঙ্কা কে?
টঙ্কারে অসি-ঝঙ্কারে,
ওরে হুঙ্কারে, ভাঙি’ গড়া ভীম কারা, লড়বো রণ-মরণ!
ঢালে বাজবে ঝন-ঝনন্।
সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
জোর চাই, আর যাচনা নয়,
কোরবানী দিন আজ না ওই?
বাজনা কই? সাজনা কই?
কাজ না আজিকে জানমাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধারণ?
বলÑ‘যুঝবো জান ভি পণ!’
খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ,
আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!
কোরবানির ঈদ প্রতি বছর আসে, ভবিষ্যতেও আসবে। আরো বেশি দামে আরো বড় গরু কেনা হবে। উৎসবের আয়োজনও বাড়বে দিন দিন। খরচ বাড়বে তাল রেখে; কিন্তু কোরবানির শিক্ষা কতটুকু আমরা গ্রহণ করছি? ঈদুল আজহার প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা না গেলে অবলা প্রাণীর প্রাণনাশই সার হবে, কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণীটি কোনো ফায়দা পাবে না। ঈদে কোটি কোটি টাকার চামড়া সংগ্রহের টার্গেট থাকে; কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন পরকালের জন্য অমূল্য পুণ্য সংগ্রহের উদ্যোগ। আমরা জীবনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রের মতো ঈদের বেলায়ও লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষকে দিচ্ছি বেশি গুরুত্ব।
স্বার্থ, সঙ্কীর্ণতা, প্রবৃত্তির তাড়না, অর্থ-খ্যাতি-বিত্তবিলাসের মোহ, অবৈধ ক্ষমতা ও সম্পদ, ষড়রিপুর দাসত্ব প্রভৃতি কোরবানি করাই কোরবানির ঈদের লক্ষ্য; কিন্তু আমরা ত্যাগের নির্দেশ ভুলে ভোগে মত্ত থাকি। পার্থিব নানা অপশক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করার হীনতায় লজ্জা হয় না। অথচ সর্বজগতের একক অধিপতি, স্রষ্টা, প্রতিপালক বিধানদাতা এবং চূড়ান্ত বিচারকের কাছে আত্মসমর্পণের দায়িত্ব আমাদের ক’জন পালন করছে? যার যত বড় পদ ও ক্ষমতা, যত বেশি সম্পদ ও সুযোগ; তার তত বেশি কোরবানি দেয়া, অর্থাৎ ত্যাগ স্বীকার করা জরুরি। আমাদের সমাজের চিত্রটা এর বিপরীত। আমরা কথায় ত্যাগী : কাজের সময়ে ষোলোআনা ভোগ করতে মরিয়া হয়ে উঠি। এভাবে চললে ঈদুল আজহা পালন করা-না-করা একই।
টিভি চ্যানেলে ঈদ অনুষ্ঠানের ধুম, যেখানে ঈদের সাথে কোনো সম্পর্কই নেই। গৎবাঁধা, কমার্শিয়াল, ছ্যাবলামি ইত্যাদি বিশেষণে এগুলোকে দর্শকেরা অভিহিত করে থাকেন। ছয় হালি চ্যানেলে ঈদ নাটক প্রচার হয় ডজন ডজন; কিন্তু এগুলোকে চমৎকার, মানসম্মত, রুচিশীল ও সুস্থ বিনোদন বলেন ক’জন? এর পাশাপাশি পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীর ঈদসংখ্যা ও বিনোদন ম্যাগাজিন। বিশিষ্টজনদের রঙ-বেরঙের ছবির সাথে রঙিন স্মৃতিচারণ। কিছু তথ্য, কিছু অতিরঞ্জন; কিছুটা আত্মপ্রচারও থাকতে পারে। যা হোক, দৈনিক ইত্তেফাকের ঈদ বিনোদন সাময়িকীর প্রচ্ছদকন্যা অপু বিশ্বাস। চলচ্চিত্রের এই নায়িকার সাক্ষাৎকারধর্মী বক্তব্যের একটি অংশ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
পত্রিকার প্রতিনিধি বলতে চেয়েছেন, মাইনরিটি বা সংখ্যালঘু হলে একটা সমস্যা থাকে। অপু বিশ্বাস হিন্দুর মেয়ে। তাকে এমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয় কি না, এ প্রশ্ন করার আগেই অপু তা বুঝে ফেলেন এবং বললেন, ‘এ দেশে সে ক্ষেত্রে কাজের ব্যাপারে সমস্যা হয় না। মোটেই না। ...আমার একটা প্রশ্ন আছে; সেটা আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে নয়, বলিউড বা কলকাতার চলচ্চিত্র নিয়ে। আমার মনে হয়, ওপার বাংলায় এই ধর্মীয় ব্যাপার নিয়ে ইজমটা অনেকখানি। কারণ, দেখুনÑ ওদেশে কোনো ভালো চরিত্র মুসলিম হিসেবে দেখানো হচ্ছে না। শাহরুখ, আমির, সালমান আজীবন হিন্দু চরিত্রেই কাজ করে গেলেন। কী অদ্ভুত ঘটনা! প্রায় প্রত্যেক ছবিতে মূল ভিলেন বা টেরোরিস্ট মানেই মুসলিম। আমার মনে হয়, সেদিক দিয়ে আমাদের দেশে আমরা অনেকটা সহনশীল। আমি একজন হিন্দু মেয়ে হয়েও এটা (ভারতের ব্যাপারটা) আমার কাছে খুবই দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে।’
‘সেলফি’। শব্দটি অল্প ক’দিনের মধ্যেই বহুলপ্রচলিত হয়ে উঠেছে। সেলফোন দিয়ে বিশেষ করে নিজের নানা ভঙ্গি আর কর্মকাণ্ডের ছবির নাম সেলফি। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে অনেকের খায়েশ, তার কেনা কিংবা তাদের পরিবারের জন্য কেনা চতুষ্পদটির সাথে ছবি তোলা। এই পশুটির নাম গরু; ইংরেজিতে কাউ। অতএব, সেলফি এ ক্ষেত্রে ‘কাউফি’ হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে একটি রম্য সাময়িকীতে ঈদের আগে যে পরামর্শ ফ্রি দেয়া হয়েছে, তা তুলে ধরা হলো। ‘সেলফি তোলার সময়ে গরুকে সামনে রাখবেন, নাকি আপনি সামনে থাকবেন? এ সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত জরুরি। আগে আপনাকে জেনে নিতে হবে, আপনার গরুটি শিং চালাতে ওস্তাদ, নাকি পা চালাতে পারদর্শী। শিং চালাতে ওস্তাদ হলে গরুকে সামনে রেখে সেলফি তুলে ওস্তাদের পরিচয় দিন। আর পা চালাতে দক্ষ হলে আপনিই থাকবেন সামনে।’
পাদটীকা : কী মিয়া, তোমার গরুডা এমুন ঝিম ধইরা আছে ক্যান্? খোঁচা দিলেও যে নড়ে না।’ বড়ি খাওয়াইয়া আর ইনজেক্শন দিয়া তুমিও মোটা-তাজা বানাইবার কেরামতি করছো না কি?
: তোবা তোবা, কী যে কন্ স্যার। আমনেরা জ্ঞানী মানুষ, ভালো বুঝবেন। আসল ব্যাপার অইলো, মানুষের মইদ্যে যেমন চঞ্চল ও দুষ্টু টাইপের আছে, তেমনি আছে গম্ভীর ও শান্ত মানুষ। গরুর মইদ্যেও এই দু’কিসিম কি থাকতে পারে না? আর বিশেষ কইরা যহন কোরবানির দিন ঘনাইছে, তহন তো ভালা গরু মরণের কতা ভাইবা চুপচাপ থাকাই স্বাভাবিক।’
No comments