আত্মজা ও একটি করবী গাছ: ফিরে দেখা by হাসান ফেরদৌস
তখন সতেরো কি আঠারো বছর হবে, যখন প্রথম হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটি পড়ি। একই নামকের শীর্ণকায় একটি গ্রন্থের নাম-গল্প। সেটি এমন এক বয়স, যখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের প্রতি, আমাদের প্রবল উপেক্ষা। সদ্য চিনেছি কাফকা, কামু ও জিদকে। হাতে নিয়ে ঘুরি বেকেট।
সাহিত্যে কাহিনির চেয়ে আইডিয়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ, এমন অদ্ভুত তত্ত্বে আমাদের আস্থা আমুণ্ডু। এমনকি এ কথাও আমরা ভাবতে শিখেছিলাম যে সাহিত্য ও টেক্সট সমার্থবোধক, সাহিত্যের আসল তাৎপর্য কেবল সেই টেক্সটের পাঠপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয়।
সেই না-অতি তরুণ বয়সে গল্পটি পড়ে প্রচণ্ড হোঁচট খেয়েছিলাম। সাহিত্যের আসল লক্ষ্য মানুষ—তার বেদনা ও অব্যাহত ক্ষরণ এবং সেই ক্ষরণের সঙ্গে নিরন্তর সংহতি, এমন একটি ধারণার প্রতি কেউ একজন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। ‘এমপ্যাথি’ শব্দটির সঙ্গে পরিচয় আরও পরে, তবে লেখকের মূল অর্জন মানবিক সংহতির ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয়, এই গল্পটি এবং গল্পগ্রন্থের অন্যান্য গল্প পাঠের মাধ্যমে এই সত্যের সঙ্গে ভাসা ভাসা হলেও পরিচিত হয়েছিলাম। কামু-কাফকার কাছ থেকে শিখেছিলাম মানুষ একটি দ্বীপমাত্র অথবা কোনো দ্বীপে জেগে থাকা একা একটি বৃক্ষ। ‘আত্মজা’ পড়ে মনে হলো, মানুষ হয়তো একটি বৃক্ষ, কিন্তু তার চারপাশে আরও অসংখ্য বৃক্ষ নিয়ে জেগে থাকে অরণ্য। দেখতে একা মনে হয়, কিন্তু কোনো বৃক্ষই বিচ্ছিন্ন নয়। শিকড়ে শিকড়ে তার সম্পৃক্তি অরণ্যজুড়ে। সেই অরণ্যের নাম মানবসমাজ—এর কোনো চিহ্নিত সীমানা নেই, তার কোনো মেয়াদ-বাঁধা সময়সীমা নেই, কোনো জাতপাত নেই। যেমন ভেদচিহ্ন নেই, জাতপাত নেই ভালোবাসার, বেদনার, পরাজয়ের ও একাকিত্বের।
আরও একটা জিনিস শিখেছিলাম। সাহিত্যের আসল শক্তি হলো ভাষা। আমাদের চেনা-জানা শব্দ দিয়ে ভাষার নির্মিতি, অথচ সেই বহু ব্যবহূত, চিরচেনা শব্দ দিয়েই একটি নতুন জগৎ গড়ে ওঠে, যে জগতে মানুষ, পশু ও প্রকৃতি পাশাপাশি বাস করে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্ব, আপাত সম্পর্কবিহীন। লেখক ভাষার তুলি দিয়ে তাদের আন্তসম্পর্ক গড়ে তোলেন, আবার প্রত্যেকের জন্য নির্মাণ করেন স্বতন্ত্রব্যক্তিত্ব। সেই গল্পের শুরুতেই এমন একটি আশ্চর্য বাক্য পড়েছিলাম, যা আমার চোখে এখনো ছবির মতো ভাসে, ‘এখন নির্দয় শীতকাল, ঠান্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেলগাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়।’
প্রায় ৪০ বছর পর সেই একই গল্প পড়লাম। আশ্চর্য, সেই একই অভিজ্ঞতা।
২.
কোনো কোনো লেখককে শুধু একটি বই, এমনকি একটি গল্প দিয়ে চিহ্নিত করা সম্ভব। যেমন কাফকার মেটামরফসিস অথবা জয়েসের দি ডেড। হাসান আজিজের বেলায় যদি সে চেষ্টা হয়, তাহলে কোন গল্পটি নির্বাচন করা যাবে?
হাসান আজিজ বরাবরই তাঁর গল্পের প্রবল অথচ নিরাসক্ত কঠিন-কঠোর-আপসহীন বাস্তবতার জন্য পরিচিত। ‘সাহিত্যের বাস্তব’ এই নামের একটি প্রবন্ধে হাসান আজিজ নিজেই সে বাস্তবতার ভেতর-রূপ, তার চেহারা-চরিত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেছেন, সাহিত্যে একমাত্র তখনই সাদামাটা বাস্তবের পাশাপাশি দেখা দেয় আন্তর বাস্তবতা, যখন লেখক বহিরঙ্গ-সাদৃশ্য ভেদ করে চলে যান বাস্তবের তীব্রতর, তীক্ষতর চেহারা ফুটিয়ে তুলতে, বাস্তবের সচরাচর দৃশ্যগোচর রূপ ভেঙে দিয়ে তাকে দলে-মুচড়ে তছনছ করেন। আর এভাবে শতপথে সূচিতীক্ষ আলো এসে পড়ে, লেখকের মনন-মেধা-প্রজ্ঞা মিশে যায় তার সঙ্গে।
বাস্তব যখন এত নিকট ও প্রবল, তখন শুধু কল্পনার সাহায্য নিয়ে সে বাস্তবের পুনর্নির্মাণ সম্ভব নয়। লেখককে হয় সে জীবনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, অথবা কোনো না-কোনোভাবে সে জীবনের অংশীদার হতে হয়। হাসান আজিজের অতি-সাম্প্রতিক কিছু নাগরিক গল্প বাদ দিলে প্রায় সব গল্পই যাপিত-জীবননির্ভর। ফলে গল্পকার হিসেবে তিনি বিভূতিভূষণ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোত্রভুক্ত। পশ্চিমে এবং দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর লাতিন সাহিত্যে পরাবাস্তব কল্পনার ব্যবহার আমাদের সুপরিচিত। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজনের লেখা বাদ দিলে এই রচনাধারা যতটা ফ্যাশনদুরস্ত, সাহিত্য হিসেবে ততটা মানোত্তীর্ণ নয়। মার্কিন লেখক জেমস সালটারের একটি মন্তব্য এখানে প্রাসঙ্গিক হবে বলে উল্লেখ করছি। পশ্চিমে ফিকশন ও নন-ফিকশনের মধ্যে ফারাক করার একটি প্রচলন দীর্ঘদিনের। সালটার আপত্তি করে বলেছেন, ফিকশন মানে কি এই যে লেখক যা লেখেন তার উৎস শুধু সে লেখকের নিজস্ব মস্তিষ্ক? ‘বস্তুত, সফল গল্প বা উপন্যাস যা কিছু আমরা পড়েছি, তার কোনোটাই লেখকের নিজস্ব আবিষ্কার নয়। এসব লেখার পেছনে থাকে পরিষ্কার ধারণা ও নিকট অবলোকন। যেসব লেখক বলেন, সবকিছুই তাঁদের কল্পনাসঞ্জাত, আমি সেসব লেখকের ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নই; বরং আমি এমন একজন লোকের সাথে এক কক্ষে থাকতে আগ্রহী, যে আমাকে তার নিজের জীবনের গল্প বলবে। সে গল্পে হয়তো অতিরঞ্জন থাকবে, মিথ্যা কথনও হয়তো থাকবে, কিন্তু সে গল্পের হাড়-মাংস, তার সারার্থ হবে জীবন থেকে নেওয়া সত্য গল্প।’
কম-বেশি এমন কথা হয়তো হাসান আজিজও কোথাও না কোথাও বলেছেন। তাঁর নিজের গল্প সম্বন্ধে এ কথা টায় টায় সত্য, বিশেষভাবে ষাটের দশকে লেখা গল্পগুলোর বেলায়। গ্রামীণ জীবন নিয়ে খুব কাছ থেকে দেখা, শুধু দেখা নয়, নিজের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা-ঋদ্ধ এই গল্পগুলো, একজন সমালোচকের ভাষায়, ‘বাস্তবের বীভৎসতা ও ভেতরের উদ্ভট অনৈতিকতার নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ।’ একাত্তরের পর প্রথম এক-দেড় দশকে সে কঠোর-কঠিন-আপসহীন বাস্তবতা থেকে তিনি সরে আসেননি বটে, কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয় এক প্রবল পরিহাস। এই সময়ের লেখা প্রতিটি গল্প হয়ে ওঠে তাঁর সময়ের নির্দয় কমেন্টারি। কিন্তু গল্পগুলো যদি তাঁর সময়ের স্যাটায়ার হিসেবেও না পড়া হয়, প্রতিবেদিত অভিজ্ঞতার ‘আইরনি’টুকু অনুদ্ঘাটিত থেকে যায়, তাহলে পাঠক শুধু লেখকের একটি মনোভাবের সঙ্গে পরিচিত হবেন—তার বিবমিষার। সে বিবমিষার পেছনে যে গভীর বঞ্চনা রয়েছে, রয়েছে আশাভঙ্গের বেদনা, তার কোনো পরিচয়ই তিনি পাবেন না। এই সময়ের কোনো কোনো গল্প একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিকাঠামোয় অনুসৃত হওয়ায় তা কিঞ্চিত কম উপভোগ্য ও তার স্থায়িত্ব কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ। এ অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মতামত। পরবর্তী সময়ে হাসান আজিজের গল্পে মোড় ফেরার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তার স্বর অনেক কোমল হয়ে এসেছে, এমনকি শুদ্ধ নীতি উপদেশমূলক গল্পও তার কাছ থেকে আমরা পেয়েছি।
অর্ধ শতকের এই দীর্ঘ প্রবজ্যায় হাসান আজিজুল হককে যদি শুধু একটি গল্প দিয়ে চিহ্নিত করতে হয়, তাহলে কেউ কেউ ‘শকুন’-এর কথা বলবেন অথবা উদাহরণ দেবেন ‘কেউ আসেনি’র। আমার চোখে সে রকম একটি গল্প ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ।’ এ গল্প হয়তো ‘শকুন’-এর মতো নিষ্ঠুর, তিক্ত ও সম্পূর্ণ আভরণহীন বাস্তবতার চালচিত্র নয়। অথবা ‘কেউ আসেনি’র মতো প্রবল রকম রাজনৈতিকও নয়, যদিও দেশভাগের রাজনীতি মানুষকে কেমন ছিন্নভিন্ন করে দেয়, কীভাবে তাকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে ফেলে, তার কান্নাভেজা দীর্ঘশ্বাস এই গল্পেও ঠিকই মেলে। সেই অর্থে ‘আত্মজা’ প্রবল রকম রাজনৈতিক বৈকি। তবে সবচেয়ে যা লক্ষণীয় তা হলো আত্মজায় এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনার আড়াল আছে, যা গল্পটিকে একটি কমিক্যাল চরিত্র দেয়, এমনকি বিবৃত ভাষাতেও সেই কমিকের আভরণ রয়েছে, আমার বিবেচনায় যা মুখ্যত গল্পের নগ্ন, রিক্ত, নির্দয় বাস্তবতাকে কিছুটা প্রতিক্ষেপক দূরত্ব প্রদান করে। বিপরীত-নৈতিকতা—রিবার্স মরালিটির একটি প্রায় নিঃশব্দ উচ্চারণও এখানে শুনি, যা হাসান আজিজের এই গল্পটিকে একটি বহুমাত্রিক নিজস্বতা প্রদান করে। এখানে আরও লক্ষণীয় আখ্যান-আঙ্গিকের (ন্যারেটিভ ফর্ম) ও বিষয়গত জটিলতার (থিমেটিক কল্পলেক্সিটি) আন্তসম্পর্ক। ব্যর্থ, অসম্পূর্ণ ও অসহায় কয়েকজন মানুষ, যাদের জোড়া লাগালে একটা সময় ও তার সমাজের চালচিত্র জেগে ওঠে, তাদের কথা এমন আশ্চর্য নৈর্ব্যক্তিকতায় বিবৃত হয় যে মনে হয় লেখক এখানে বড়জোর একজন নিস্পৃহ দর্শক মাত্র। অথচ গল্পটি পড়া শেষে একটি সপাং চাবুক এসে লাগে, যার আঘাত এড়ানো পাঠকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। লেখক নিস্পৃহ হলে তাকে ওই অদৃশ্য চাবুক হাঁকানোর প্রয়োজন পড়ত না।
সামান্য কয়েক পাতার গল্প, কাহিনি ভেঙে দেখতে চেষ্টা করলে দেখা যাবে সে অর্থে কোনো গল্পও নেই। এক সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টার অভিজ্ঞতা, এক মফস্বল শহরে—অথবা গ্রামে তিন অকালকুষ্মাণ্ড যুবকের সস্তায় ফুর্তি খোঁজার বিবরণ। ইনাম বেকার, ফেকু ছিঁচকে চোর আর সুহাস নাপিত। এক নির্দয় শীতের সন্ধ্যায় তারা চলেছে অজ্ঞাতনামা এক বৃদ্ধের বাড়িতে, তার কিশোরী কন্যাটির সাথে নিভৃতে সময় কাটাতে। মেয়েটি কেমন, তার বয়স কত, কিছুই আমরা জানি না, তবে যুবকদের একজনের নির্লজ্জ বর্ণনায় জানতে পারি, ‘এট্টু এট্টু সর হইছে এমন ডাবের মতো লাগে মেয়েডারে।’ জনপ্রতি এক টাকা, বড় ভাইয়ের পকেট হাতড়ে এনেছে একজন, আরেকজনের পকেট শূন্য, কাতরভাবে সে টাকা ধার চায় বন্ধুর কাছে, কিন্তু মেলে না। সামান্য সে অর্থ তুলে দিতে হবে শীর্ণকায়, পাণ্ডুর, প্রায় মৃত্যুমুখী সেই বৃদ্ধের হাতে। দেশভাগের পর সব খুইয়ে সপরিবারে তারা আশ্রয় পেয়েছে আলোহীন-আশাহীন এই গ্রামে। মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই আছে বটে, কিন্তু দিনাতিপাতের কোনো অবলম্বন নেই। দেশভাগের আগে যে পেশা তার ছিল, এই গ্রামে তার কোনো ব্যবহার নেই। এক ধরনের মেকি অহংকারও আছে, কৃষিকাজ তার জানা নেই, বলে, ‘বাড়ির বাগান থেকে অন্ন জোটানো আমার কম্ম—হ্যাঃ। আমরা শুকনো দেশের লোক, বুইলে না?’ কোথায় যাবে সে, কার কাছে হাত পাতবে? অবশেষে ভর করতে হয় কিশোরী কন্যার ওপর। লজ্জা, ভীতি, ঘৃণা তার চেহারায়, গলার স্বরে। কিন্তু ক্ষুধার চেয়ে বড় শত্রু আর নেই—সে কোনো আব্রু মানে না, শিক্ষা মানে না, বয়স বা পদবির ওজন তার কাছে গ্রাহ্য হয় না। শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য নিজের কিশোরী কন্যাকে পণ্য করবে, তাই বা কীভাবে মেনে নেয় সে? বৃদ্ধ নিজেকে মিথ্যা আশ্বাস দেয় এই বলে, যুবকেরা মেয়েটির সঙ্গে গল্প করবে, আর কিছু নয়। ‘যাও তোমরা, কথা বলে এসো। উই পাশের ঘরে।’ হাত পেতে যে টাকাটা নেয়, তা কোনো পণ্যের বিনিময়ে পাওয়া নয়, ধার, নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার মতো বলে। ‘আর কত যে ধার নিতে হবে তোমাদের কাছে! কবেই বা শুধতে পারব এইসব টাকা?’ বন্ধকি বিবেক, নিরুপায় পিতা। একমাত্র উদ্ধার মৃত্যুতে। বৃদ্ধ জানায়, সে একটি করবী গাছ লাগিয়েছে, ফুলের জন্য নয়, বিচির জন্য। ‘চমৎকার ফুল হয় করবী ফুলের বিচিতে।’ কথা বলে আর চোখের জলে সে ভাসে। ইনাম, টাকা নেই বলে ফুর্তি থেকে বঞ্চিত যুবকটি, তেতো গলায় বলে, ‘এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ?’
গল্পটি এইখানে শেষ, কিন্তু সত্যিই কি তা শেষ হয়?
গল্পে হাসান আজিজ একটি বাস্তব ও দৈনন্দিক সংকটের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটান, পাশাপাশি থাকে একটি নৈতিক নির্বাচনের জটিলতা। তীব্র অভাব ও ক্ষুধার মুখে সব সামাজিক বা ধর্মীয় অনুশাসন ফুৎকারে উড়ে যায়, কিন্তু চেতনার গভীরে যে দ্বন্দ্ব, কঠোরতম বাস্তবতার মুখেও তা কাঁটার মতো খচ খচ বিঁধে থাকে। সব প্রথাবদ্ধ সমাজে নৈতিকতার চরিত্রটি মুখ্যত বহির্মুখী—তার চেহারা ও চরিত্র নির্মিত হয় সামাজিক অনুশাসনের ছত্রচ্ছায়ায়। তা পালনও করা হয় সামাজিক অভিভাবকদের মন জুগিয়ে চলতে। এই অভিভাবকত্ব অর্জন অবশ্য এই শর্ত দ্বারা নির্ধারিত যে সামাজিক অভিভাবকেরাও তাঁদের নিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠীর মানব সদস্যদের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে কোনো না কোনো রকম ভূমিকা পালন করবেন। নৈতিকতার এই সামাজিক বহির্বরণটি ভেঙে পড়ে যখন অভিভাবকেরা তাঁদের সে ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হন। লক্ষণীয় হলো, নৈতিকতার সামাজিক বহির্বরণ ভেঙে পড়লেও ব্যক্তিগত নীতিবোধ, যা সমাজ থেকে আহরিত কিন্তু সমাজনির্ভর নয়, অক্ষুণ্ন থাকে। অর্থাৎ সমাজ তার সম্মিলিত নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেও ব্যক্তির নৈতিকতা, অন্তত নৈতিকতার কৃত্রিম অহংকার রয়ে যায়। এই গল্পের বৃদ্ধ সারা পৃথিবীর চোখে পরাস্ত হলেও নিজের কাছে পরাজয় মানতে পুরোপুরি প্রস্তুত নয়, ব্যক্তিগত অহংকার ও নীতিবোধ সে জাগিয়ে রাখে এক মিথ্যার আবরণে। সে যে মৃত্যুর কথা ভাবে, তার কারণ জীবন ও বিশ্বকে বুড়ো আঙুল দেখানোর সেটাই তার শেষ অস্ত্র।
এই ‘ডিনাইয়াল’ ব্যক্তিগত তা ঠিক, তবে তার একটি সামাজিক চরিত্রও আছে। গল্পের সময়গত, তথা ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতটি বিবেচনা করলে তা স্পষ্ট হবে। ‘আত্মজা’ দেশভাগের পরবর্তী কোনো একসময়ের ঘটনা। নিজের স্থাবর-অস্থাবর সব সহায়-সম্পদ ছেড়ে দেশ ছেড়ে আসতে হয়েছে যেসব অগুনতি মানুষকে, এই গল্পের বৃদ্ধ ও তার পরিবার তাদেরই অন্তর্গত। দেশভাগে তার কোনো হাত ছিল না, কিন্তু সে বিভক্তিতে এই অলিখিত আশ্বাস ছিল, ভিটেমাটি ছেড়ে এলেও নতুন ঠিকানায় তাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক আশ্রয় মিলবে। মেলেনি, ফলে গভীর এক অন্ধকূপে পড়ে যায় অগুনতি মানুষ। প্রতিশ্রুতি পালনে এই ব্যর্থতার একটি সম্মিলিত চরিত্র অবশ্যই আছে। কিন্তু সে দায়িত্ব আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বীকার করি না। এই অস্বীকৃতির প্রক্রিয়াটি হলো যে এই বৃদ্ধ ও তার মতো আরও অগুনতি উদ্বাস্তু পরিবারের অস্তিত্ব অগ্রাহ্য করা। পরাজিত, প্রায়-মৃত মানুষের মতো জীবনযাপনরত এসব মানুষকে আমরা মনে রাখি না, কারণ মনে রাখার অর্থই হলো সে ব্যর্থতার দায়ভার স্বীকার করে নেওয়া।
সবাই ভুলে গেলেও ভোলেন না লেখক। তাঁর চোখ দিয়ে নতুন করে পরাস্ত সে জীবন আমাদের সামনে গুটিসুটি এসে দাঁড়ায়। সরকারি হিসাবে, পত্রিকার প্রতিবেদনে অথবা সমাজবিজ্ঞানীর গবেষণাপত্রে এসব উদ্বাস্তু বড়জোর এক একটি পরিসংখ্যান। কিন্তু লেখকের কাছে তারা প্রত্যেকে রক্তমাংসের মানুষ। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, এরা কেউ পিতা, কেউ কন্যা, কেউ স্বজন। আত্মসম্মান নিয়ে, মানবিক মর্যাদা নিয়ে জীবন ধারণের অধিকার তাদের প্রত্যেকের ছিল। সে জীবন ধারণ যে সম্ভব হয়নি এ কেবল তাদের ব্যর্থতা নয়, আমাদেরও। সে দায়ভার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য জেগে থাকেন লেখক, জেগে থাকেন কবি। এই হলো সাহিত্যের নৈতিকতা। এভাবে একটি ছোটগল্প পরিশেষে পরিণত হয় একটি সক্রিয় সংলাপে।
‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটিতে হাসান আজিজ আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধ ও তা পালনে ব্যর্থতার কোনো কথাই বলেন না। বস্তুত, তার গল্পে কোনো নীতিকথা নেই, কোনো ইতিহাস পাঠও নেই। অনুক্ত সে সব কথা আমরা যে যার মতো করে আবিষ্কার করে নিই গল্পপাঠের মধ্য দিয়ে। এখানে লেখক একটি মানবিক ট্র্যাজেডির নিস্পৃহ দর্শকমাত্র, তাঁর কোনো পক্ষপাত নেই, ঠিক-বেঠিক নিয়ে তাঁর কোনো পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তও নেই। তৃতীয় বাচ্যে প্রকাশিত হওয়ায় লেখকের এই নিরাসক্তি গোড়া থেকেই স্পষ্ট। কাহিনিকথনে তিনি মোটামুটি একরৈখিক, লিনিয়ার-অনুক্রম রক্ষা করে চলেন, যদিও সে অনুক্রম প্রায়ই বিঘ্নিত হয়, মুখ্যত গল্পটির বর্ণনা-প্রসঙ্গ বিস্তারে। এই গল্পে রয়েছে দুটি সংযুক্ত আখ্যান বা ন্যারেটিভ। প্রথমটি যুবক তিনটিকে নিয়ে, দ্বিতীয়টির কেন্দ্রে উদ্বাস্তু বৃদ্ধ। প্রথম আখ্যানে নির্মিত হয় এই গল্পের বহিরঙ্গ, তার আউটার টোন। দ্বিতীয় আখ্যানটি গল্পের প্রায় শেষ পর্যায়ে, কিন্তু সেটিই এ গল্পের অন্তর্জগৎ, তার শাঁস। এই অন্তর্জগতে প্রবেশের জন্যই প্রয়োজন প্রথম ন্যারেটিভটির। প্রথমটির বেলায় লেখক নির্ভর করেন বিক্ষিপ্ত কথোপকথন, কিন্তু দ্বিতীয় ন্যারেটিভে লেখকের প্রধান হাতিয়ার ‘আত্মগত সংলাপ’।
অসংলগ্ন ও বিক্ষিপ্ত কথোপকথনের মাধ্যমে অতি সামান্য পরিসরেও লেখক প্রতিটি চরিত্রকে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব প্রদানে সক্ষম হন। আমরা উপলব্ধি করি, যে তিনটি যুবক নৈশ অভিসারে সহযাত্রী, তাদের মধ্যে গোপন বৈরিতা রয়েছে, রয়েছে এক ধরনের উদ্বেগ, রয়েছে এমনকি অপরাধবোধও। বৃদ্ধ ও তার পরিবারের নিরুপায় অবস্থার সুযোগ তারা নিচ্ছে, এমন কথাও তাদের আলাপচারিতায় স্পষ্ট হয়।
ছোট মামার বিয়ের গল্প করছে সুহাস। ‘ইনামের মনে হোল সুহাস গতকাল থেকে গল্পটা বলছে আর আগামিকাল পর্যন্ত বলবে। নাপিত বিটা কমিয়ে কতি পারে না।
‘ভাঙ্গা দরজার ফাঁক দিয়ে ঘুম-জড়ানো গোঙ্গানি ভেসে আসে। সব ঘুমায়ে পড়িছে—সুহাস বলে। ফেকু সায় দেয় ঘ্যোঁত করে। আজ না আসলিই হতো—সুহাস অভিযোগ করতে থাকে, ভয় করতিছে আমার।
‘বুড়োর মুখ এখন বহুরূপী। সুহাস ভাবছে, বুড়োটা খুন করবেন মনে হতিছে আমার। আজ ক্যানো যে আলাম।’
অন্যদিকে বৃদ্ধের অসহায়ত্ব প্রকাশে লেখক কখনো পরিহাসপ্রবণ, কখনো বা সহানুভূতিশীল।
‘তারপর কি খবর? অ্যাঁ? সব ভালো ত? ঘড় ঘড় করে একটানা কথা আরম্ভ হয়। আক্ষেপ বিলাপ, মরে গেলেই তো হয় এখন, কি বলো তোমরা? টক করে মরে গেলাম ধরো। তারপরে? আমার আর কি—ড্যাং ড্যাড্যাং ড্যাং, চলে গেলাম, বুঝে মরগে তুই বুড়ি—ছানাপোনা নিয়ে বুঝে মরগে।
‘এই তোমরা একটু আধটু আসো, যখন তখন এসে খোঁজখবর নাও। সময় অসময় নেই বাবা তোমাদের। তোমরাই ভরসা, আমার পরিবার তোমাদের কথা বলতে অজ্ঞান।’
গল্পের শেষে করবী বিচির উল্লেখে আত্মহননের একটি ইংগিত আছে। মৃত্যু এই বৃদ্ধের জীবনযুদ্ধে পরাজয়ের চূড়ান্ত স্বীকারোক্তি, সমাজকে ছুড়ে দেওয়া তার শেষ তিরস্কার। বৃদ্ধ যদি ভেবে থাকে মৃত্যুকে গ্রহণের মাধ্যমে নৈতিকতার পরীক্ষায় সে পার পেয়ে যাবে, গল্পের শেষ বাক্য থেকে মনে হয় না লেখক সে ব্যাপারে একমত। করবী ফুলে চমৎকার বিচি হয়, এই কথা বলে বৃদ্ধ যখন ‘পানিতে ডুবে যেতে যেতে, ভেসে যেতে থাকে বুড়োর মুখ,’ ইনাম তখন তেতো গলায় প্রশ্ন রাখে, ‘এহন তুমি কাঁদতিছ?’ পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত সে প্রশ্ন থেকে স্পষ্ট, ইনাম বুড়োর শ্লেষ্মা জড়ানো সে কান্নার প্রতি মোটেই সহানুভূতিশীল নয়। বরং এক ধরনের পরিহাসই যেন তাতে প্রচ্ছন্ন, ইনাম যেন বলছে, ‘এহন কান্দো ক্যা, আগে ভাইবে কাজ করলি তো আর কানতি হতো না!’
৩.
ফিকশন ও গানের মধ্যে কোনো ঐক্য আছে কি না, এমন একটি প্রশ্ন তুলে ফরস্টার মন্তব্য করেছেন, বিটোফেনের ফিফথ সিম্ফনি শুনতে শুনতে একসময় তা শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তার পরেও আমাদের মাথার মধ্যে এক বিস্ময়কর নতুন সিম্ফনির সম্মোহন জেগে থাকে। অর্কেস্ট্রা থেমে গেছে, কিন্তু গান থামেনি। যে সুর কেউ বাজায়নি, আমাদের চেতনায় এক নিজস্ব দ্যোতনায় তা বেজে চলে। ফিকশনের বেলাতেও ঠিক একই রকম ব্যাপার ঘটে। ফরেস্টারের ভাষায়, এ হলো সাহিত্যের ‘এক্সপানশন’—তার বিস্তৃতি। অনেক ক্ষেত্রেই যে বই বা গল্প আমরা পড়ি, তা শেষ হওয়া মাত্রই তার সমাপ্তি হলো, এমন নয়। বরং সে বই বা গল্প পড়া শেষ হওয়ার পরও আমাদের মাথায়, আমাদের বুকের ভেতর একটা অজ্ঞাত শিরশির অনুভূতি জেগে থাকে। ফরস্টার ওয়্যার অ্যান্ড পিস উপন্যাসের উদাহরণে এ কথা বলেছেন। গ্রন্থটি তাঁর চোখে কিঞ্চিত ‘অগোছালো’—‘আন-টাইডি’। অথচ তার পরও এক নতুন সুর আমাদের অনুসরণ করে, যা এই কাহিনিকে বিস্তৃততর করে, তার সব চরিত্র ও ঘটনাপুঞ্জকে সম্প্রসারিত করে। ছোটগল্প প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠিক একই কথা বলেছিলেন—শেষ হইয়াও হইল না শেষ।
‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ পাঠশেষে আমাদের দুই ধরনের সম্প্রসারণ বা এক্সপানশনের অভিজ্ঞতা হয়। এক. দেশভাগের ফলে যে দুর্যোগ ও ব্যক্তিগত সংকটমুহূর্ত তৈরি হয়, তার একটি মানবিক মানচিত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি। এই গল্পে দেশভাগ কেবল একটি নীরব বহিরাবরণ, কিন্তু গল্পপাঠ শেষে সেই নীরব বহিরাবরণটি একটি বড় রকমের প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের মনের মধ্যে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, যে রাজনৈতিক ট্র্যাজেডিতে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না, তার ফলভোগ কেন করতে হয় সাধারণ মানুষকে? বিগতকাল বর্তমানেরই ক্রিয়াকলাপ। যাদের রাজনৈতিক উচ্চাশা, দুরভিসন্ধি এবং ছলচাতুরী সে দুর্ভাগ্যের কারণ, তা যত বিগত কালেরই হোক না কেন, এ অপরাধের জন্য তারা কেন পার পেয়ে যায়? আমার বিবেচনায়, অন্য কেউ না করুক, একজন লেখক—যেমন এই গল্পের লেখক—অলক্ষ্যে বিগত সময় ও তার খলনায়কদের কাঠগড়ায় বসাতে সক্ষম।
দ্বিতীয় সম্প্রসারণটি সংবেদনির্ভর। অন্য পাঠকের কথা জানি না, এই গল্পপাঠের সময় আমি সেই অভাগা কিশোরীর কথা ভেবেছি। লেখক একবার মাত্র তার নাম উল্লেখ করেন, রুকু, একবার মাত্র তার ‘হু হু করে কেঁদে ওঠার’ কথা বলেন, একবার শুধু বলেন চুড়ির শব্দ, এলোমেলো শাড়ির শব্দ, সুহাসের হি হি হাসির শব্দ। এই প্রতিটি শব্দ লেখার সময় এখনো আমার হাত কাঁপে, বুকের ভেতর আচমকা টান লাগে, নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমি এমন কথাও ভাবি, এই গল্পের বৃদ্ধ যে করবী বিচির অপেক্ষায়, সে কার জন্য—নিজের, না তার আত্মজার হননে ব্যবহারের জন্য? আমার সন্দেহ জাগে, গল্পের নামকরণে তার একটি ইংগিত রেখে গেছেন লেখক। এই বিষ সেই বৃদ্ধ নিজের জন্য নয়, তার আত্মজার জন্য চাষ করেছে, অপেক্ষায় আছে তার পূর্ণ স্ফোটনে। অক্ষম পুরুষ নিজের স্ত্রী, আত্মজা অথবা ভগ্নিকে রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে পরিঘাতের চেষ্টা করে, এ ঘটনা আমাদের অভিজ্ঞতার বহির্গত নয়। মনে পড়ছে, গোবিন্দ নিহালিনি পরিচালিত হিন্দি চলচ্চিত্র আক্রোশ-এ নিম্নবর্গীয় এক যুবক ধর্ষণের হাত থেকে অনুজাকে রক্ষায় তাকে হত্যা করে। আক্রোশ তার অত্যাচারী জোতদারের প্রতি, কিন্তু ক্ষমতার কাছে নতজানু পুরুষ সে পথই অনুসরণ করে যা তার আয়ত্তাধীন। ক্লীবের, পরাজিতের এই মূর্খ-প্রতিশোধ, তা যেমন গভীর বেদনার, তেমনি অবোধ্য ক্রোধের।
সাহিত্য ও নৈতিকতার যদি কোনো সংযুক্তি থাকে তা শুধু এখানে যে একজন সৎ, নির্ভীক ও চিন্তাশীল লেখক মানব অভিজ্ঞতার জটিল গ্রন্থিসমূহ উন্মোচনের মাধ্যমে আমাদের, তার পাঠকদের, সে অভিজ্ঞতা বিষয়ে অধিক সচেতন ও সংবেদনশীল করেন। মানুষ একাকী ও বিচ্ছিন্ন বৃক্ষ নয়, এক বৃহৎ মানব গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে সে তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে লেখক আমাকে এই মানবিক সংহতি অর্জনে সাহায্য করেন, আমার চোখে তিনি কেবল সফল নন, নৈতিকও বটে।
চল্লিশ বছর পরে, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ নতুন করে পাঠের পরেও হাসান আজিজুল হক সম্বন্ধে আমার এই সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রয়ে যায়।
সেই না-অতি তরুণ বয়সে গল্পটি পড়ে প্রচণ্ড হোঁচট খেয়েছিলাম। সাহিত্যের আসল লক্ষ্য মানুষ—তার বেদনা ও অব্যাহত ক্ষরণ এবং সেই ক্ষরণের সঙ্গে নিরন্তর সংহতি, এমন একটি ধারণার প্রতি কেউ একজন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। ‘এমপ্যাথি’ শব্দটির সঙ্গে পরিচয় আরও পরে, তবে লেখকের মূল অর্জন মানবিক সংহতির ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয়, এই গল্পটি এবং গল্পগ্রন্থের অন্যান্য গল্প পাঠের মাধ্যমে এই সত্যের সঙ্গে ভাসা ভাসা হলেও পরিচিত হয়েছিলাম। কামু-কাফকার কাছ থেকে শিখেছিলাম মানুষ একটি দ্বীপমাত্র অথবা কোনো দ্বীপে জেগে থাকা একা একটি বৃক্ষ। ‘আত্মজা’ পড়ে মনে হলো, মানুষ হয়তো একটি বৃক্ষ, কিন্তু তার চারপাশে আরও অসংখ্য বৃক্ষ নিয়ে জেগে থাকে অরণ্য। দেখতে একা মনে হয়, কিন্তু কোনো বৃক্ষই বিচ্ছিন্ন নয়। শিকড়ে শিকড়ে তার সম্পৃক্তি অরণ্যজুড়ে। সেই অরণ্যের নাম মানবসমাজ—এর কোনো চিহ্নিত সীমানা নেই, তার কোনো মেয়াদ-বাঁধা সময়সীমা নেই, কোনো জাতপাত নেই। যেমন ভেদচিহ্ন নেই, জাতপাত নেই ভালোবাসার, বেদনার, পরাজয়ের ও একাকিত্বের।
আরও একটা জিনিস শিখেছিলাম। সাহিত্যের আসল শক্তি হলো ভাষা। আমাদের চেনা-জানা শব্দ দিয়ে ভাষার নির্মিতি, অথচ সেই বহু ব্যবহূত, চিরচেনা শব্দ দিয়েই একটি নতুন জগৎ গড়ে ওঠে, যে জগতে মানুষ, পশু ও প্রকৃতি পাশাপাশি বাস করে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্ব, আপাত সম্পর্কবিহীন। লেখক ভাষার তুলি দিয়ে তাদের আন্তসম্পর্ক গড়ে তোলেন, আবার প্রত্যেকের জন্য নির্মাণ করেন স্বতন্ত্রব্যক্তিত্ব। সেই গল্পের শুরুতেই এমন একটি আশ্চর্য বাক্য পড়েছিলাম, যা আমার চোখে এখনো ছবির মতো ভাসে, ‘এখন নির্দয় শীতকাল, ঠান্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেলগাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়।’
প্রায় ৪০ বছর পর সেই একই গল্প পড়লাম। আশ্চর্য, সেই একই অভিজ্ঞতা।
২.
কোনো কোনো লেখককে শুধু একটি বই, এমনকি একটি গল্প দিয়ে চিহ্নিত করা সম্ভব। যেমন কাফকার মেটামরফসিস অথবা জয়েসের দি ডেড। হাসান আজিজের বেলায় যদি সে চেষ্টা হয়, তাহলে কোন গল্পটি নির্বাচন করা যাবে?
হাসান আজিজ বরাবরই তাঁর গল্পের প্রবল অথচ নিরাসক্ত কঠিন-কঠোর-আপসহীন বাস্তবতার জন্য পরিচিত। ‘সাহিত্যের বাস্তব’ এই নামের একটি প্রবন্ধে হাসান আজিজ নিজেই সে বাস্তবতার ভেতর-রূপ, তার চেহারা-চরিত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেছেন, সাহিত্যে একমাত্র তখনই সাদামাটা বাস্তবের পাশাপাশি দেখা দেয় আন্তর বাস্তবতা, যখন লেখক বহিরঙ্গ-সাদৃশ্য ভেদ করে চলে যান বাস্তবের তীব্রতর, তীক্ষতর চেহারা ফুটিয়ে তুলতে, বাস্তবের সচরাচর দৃশ্যগোচর রূপ ভেঙে দিয়ে তাকে দলে-মুচড়ে তছনছ করেন। আর এভাবে শতপথে সূচিতীক্ষ আলো এসে পড়ে, লেখকের মনন-মেধা-প্রজ্ঞা মিশে যায় তার সঙ্গে।
বাস্তব যখন এত নিকট ও প্রবল, তখন শুধু কল্পনার সাহায্য নিয়ে সে বাস্তবের পুনর্নির্মাণ সম্ভব নয়। লেখককে হয় সে জীবনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, অথবা কোনো না-কোনোভাবে সে জীবনের অংশীদার হতে হয়। হাসান আজিজের অতি-সাম্প্রতিক কিছু নাগরিক গল্প বাদ দিলে প্রায় সব গল্পই যাপিত-জীবননির্ভর। ফলে গল্পকার হিসেবে তিনি বিভূতিভূষণ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোত্রভুক্ত। পশ্চিমে এবং দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর লাতিন সাহিত্যে পরাবাস্তব কল্পনার ব্যবহার আমাদের সুপরিচিত। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজনের লেখা বাদ দিলে এই রচনাধারা যতটা ফ্যাশনদুরস্ত, সাহিত্য হিসেবে ততটা মানোত্তীর্ণ নয়। মার্কিন লেখক জেমস সালটারের একটি মন্তব্য এখানে প্রাসঙ্গিক হবে বলে উল্লেখ করছি। পশ্চিমে ফিকশন ও নন-ফিকশনের মধ্যে ফারাক করার একটি প্রচলন দীর্ঘদিনের। সালটার আপত্তি করে বলেছেন, ফিকশন মানে কি এই যে লেখক যা লেখেন তার উৎস শুধু সে লেখকের নিজস্ব মস্তিষ্ক? ‘বস্তুত, সফল গল্প বা উপন্যাস যা কিছু আমরা পড়েছি, তার কোনোটাই লেখকের নিজস্ব আবিষ্কার নয়। এসব লেখার পেছনে থাকে পরিষ্কার ধারণা ও নিকট অবলোকন। যেসব লেখক বলেন, সবকিছুই তাঁদের কল্পনাসঞ্জাত, আমি সেসব লেখকের ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নই; বরং আমি এমন একজন লোকের সাথে এক কক্ষে থাকতে আগ্রহী, যে আমাকে তার নিজের জীবনের গল্প বলবে। সে গল্পে হয়তো অতিরঞ্জন থাকবে, মিথ্যা কথনও হয়তো থাকবে, কিন্তু সে গল্পের হাড়-মাংস, তার সারার্থ হবে জীবন থেকে নেওয়া সত্য গল্প।’
কম-বেশি এমন কথা হয়তো হাসান আজিজও কোথাও না কোথাও বলেছেন। তাঁর নিজের গল্প সম্বন্ধে এ কথা টায় টায় সত্য, বিশেষভাবে ষাটের দশকে লেখা গল্পগুলোর বেলায়। গ্রামীণ জীবন নিয়ে খুব কাছ থেকে দেখা, শুধু দেখা নয়, নিজের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা-ঋদ্ধ এই গল্পগুলো, একজন সমালোচকের ভাষায়, ‘বাস্তবের বীভৎসতা ও ভেতরের উদ্ভট অনৈতিকতার নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ।’ একাত্তরের পর প্রথম এক-দেড় দশকে সে কঠোর-কঠিন-আপসহীন বাস্তবতা থেকে তিনি সরে আসেননি বটে, কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয় এক প্রবল পরিহাস। এই সময়ের লেখা প্রতিটি গল্প হয়ে ওঠে তাঁর সময়ের নির্দয় কমেন্টারি। কিন্তু গল্পগুলো যদি তাঁর সময়ের স্যাটায়ার হিসেবেও না পড়া হয়, প্রতিবেদিত অভিজ্ঞতার ‘আইরনি’টুকু অনুদ্ঘাটিত থেকে যায়, তাহলে পাঠক শুধু লেখকের একটি মনোভাবের সঙ্গে পরিচিত হবেন—তার বিবমিষার। সে বিবমিষার পেছনে যে গভীর বঞ্চনা রয়েছে, রয়েছে আশাভঙ্গের বেদনা, তার কোনো পরিচয়ই তিনি পাবেন না। এই সময়ের কোনো কোনো গল্প একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিকাঠামোয় অনুসৃত হওয়ায় তা কিঞ্চিত কম উপভোগ্য ও তার স্থায়িত্ব কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ। এ অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মতামত। পরবর্তী সময়ে হাসান আজিজের গল্পে মোড় ফেরার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তার স্বর অনেক কোমল হয়ে এসেছে, এমনকি শুদ্ধ নীতি উপদেশমূলক গল্পও তার কাছ থেকে আমরা পেয়েছি।
অর্ধ শতকের এই দীর্ঘ প্রবজ্যায় হাসান আজিজুল হককে যদি শুধু একটি গল্প দিয়ে চিহ্নিত করতে হয়, তাহলে কেউ কেউ ‘শকুন’-এর কথা বলবেন অথবা উদাহরণ দেবেন ‘কেউ আসেনি’র। আমার চোখে সে রকম একটি গল্প ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ।’ এ গল্প হয়তো ‘শকুন’-এর মতো নিষ্ঠুর, তিক্ত ও সম্পূর্ণ আভরণহীন বাস্তবতার চালচিত্র নয়। অথবা ‘কেউ আসেনি’র মতো প্রবল রকম রাজনৈতিকও নয়, যদিও দেশভাগের রাজনীতি মানুষকে কেমন ছিন্নভিন্ন করে দেয়, কীভাবে তাকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে ফেলে, তার কান্নাভেজা দীর্ঘশ্বাস এই গল্পেও ঠিকই মেলে। সেই অর্থে ‘আত্মজা’ প্রবল রকম রাজনৈতিক বৈকি। তবে সবচেয়ে যা লক্ষণীয় তা হলো আত্মজায় এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনার আড়াল আছে, যা গল্পটিকে একটি কমিক্যাল চরিত্র দেয়, এমনকি বিবৃত ভাষাতেও সেই কমিকের আভরণ রয়েছে, আমার বিবেচনায় যা মুখ্যত গল্পের নগ্ন, রিক্ত, নির্দয় বাস্তবতাকে কিছুটা প্রতিক্ষেপক দূরত্ব প্রদান করে। বিপরীত-নৈতিকতা—রিবার্স মরালিটির একটি প্রায় নিঃশব্দ উচ্চারণও এখানে শুনি, যা হাসান আজিজের এই গল্পটিকে একটি বহুমাত্রিক নিজস্বতা প্রদান করে। এখানে আরও লক্ষণীয় আখ্যান-আঙ্গিকের (ন্যারেটিভ ফর্ম) ও বিষয়গত জটিলতার (থিমেটিক কল্পলেক্সিটি) আন্তসম্পর্ক। ব্যর্থ, অসম্পূর্ণ ও অসহায় কয়েকজন মানুষ, যাদের জোড়া লাগালে একটা সময় ও তার সমাজের চালচিত্র জেগে ওঠে, তাদের কথা এমন আশ্চর্য নৈর্ব্যক্তিকতায় বিবৃত হয় যে মনে হয় লেখক এখানে বড়জোর একজন নিস্পৃহ দর্শক মাত্র। অথচ গল্পটি পড়া শেষে একটি সপাং চাবুক এসে লাগে, যার আঘাত এড়ানো পাঠকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। লেখক নিস্পৃহ হলে তাকে ওই অদৃশ্য চাবুক হাঁকানোর প্রয়োজন পড়ত না।
সামান্য কয়েক পাতার গল্প, কাহিনি ভেঙে দেখতে চেষ্টা করলে দেখা যাবে সে অর্থে কোনো গল্পও নেই। এক সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টার অভিজ্ঞতা, এক মফস্বল শহরে—অথবা গ্রামে তিন অকালকুষ্মাণ্ড যুবকের সস্তায় ফুর্তি খোঁজার বিবরণ। ইনাম বেকার, ফেকু ছিঁচকে চোর আর সুহাস নাপিত। এক নির্দয় শীতের সন্ধ্যায় তারা চলেছে অজ্ঞাতনামা এক বৃদ্ধের বাড়িতে, তার কিশোরী কন্যাটির সাথে নিভৃতে সময় কাটাতে। মেয়েটি কেমন, তার বয়স কত, কিছুই আমরা জানি না, তবে যুবকদের একজনের নির্লজ্জ বর্ণনায় জানতে পারি, ‘এট্টু এট্টু সর হইছে এমন ডাবের মতো লাগে মেয়েডারে।’ জনপ্রতি এক টাকা, বড় ভাইয়ের পকেট হাতড়ে এনেছে একজন, আরেকজনের পকেট শূন্য, কাতরভাবে সে টাকা ধার চায় বন্ধুর কাছে, কিন্তু মেলে না। সামান্য সে অর্থ তুলে দিতে হবে শীর্ণকায়, পাণ্ডুর, প্রায় মৃত্যুমুখী সেই বৃদ্ধের হাতে। দেশভাগের পর সব খুইয়ে সপরিবারে তারা আশ্রয় পেয়েছে আলোহীন-আশাহীন এই গ্রামে। মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই আছে বটে, কিন্তু দিনাতিপাতের কোনো অবলম্বন নেই। দেশভাগের আগে যে পেশা তার ছিল, এই গ্রামে তার কোনো ব্যবহার নেই। এক ধরনের মেকি অহংকারও আছে, কৃষিকাজ তার জানা নেই, বলে, ‘বাড়ির বাগান থেকে অন্ন জোটানো আমার কম্ম—হ্যাঃ। আমরা শুকনো দেশের লোক, বুইলে না?’ কোথায় যাবে সে, কার কাছে হাত পাতবে? অবশেষে ভর করতে হয় কিশোরী কন্যার ওপর। লজ্জা, ভীতি, ঘৃণা তার চেহারায়, গলার স্বরে। কিন্তু ক্ষুধার চেয়ে বড় শত্রু আর নেই—সে কোনো আব্রু মানে না, শিক্ষা মানে না, বয়স বা পদবির ওজন তার কাছে গ্রাহ্য হয় না। শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য নিজের কিশোরী কন্যাকে পণ্য করবে, তাই বা কীভাবে মেনে নেয় সে? বৃদ্ধ নিজেকে মিথ্যা আশ্বাস দেয় এই বলে, যুবকেরা মেয়েটির সঙ্গে গল্প করবে, আর কিছু নয়। ‘যাও তোমরা, কথা বলে এসো। উই পাশের ঘরে।’ হাত পেতে যে টাকাটা নেয়, তা কোনো পণ্যের বিনিময়ে পাওয়া নয়, ধার, নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার মতো বলে। ‘আর কত যে ধার নিতে হবে তোমাদের কাছে! কবেই বা শুধতে পারব এইসব টাকা?’ বন্ধকি বিবেক, নিরুপায় পিতা। একমাত্র উদ্ধার মৃত্যুতে। বৃদ্ধ জানায়, সে একটি করবী গাছ লাগিয়েছে, ফুলের জন্য নয়, বিচির জন্য। ‘চমৎকার ফুল হয় করবী ফুলের বিচিতে।’ কথা বলে আর চোখের জলে সে ভাসে। ইনাম, টাকা নেই বলে ফুর্তি থেকে বঞ্চিত যুবকটি, তেতো গলায় বলে, ‘এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ?’
গল্পটি এইখানে শেষ, কিন্তু সত্যিই কি তা শেষ হয়?
গল্পে হাসান আজিজ একটি বাস্তব ও দৈনন্দিক সংকটের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটান, পাশাপাশি থাকে একটি নৈতিক নির্বাচনের জটিলতা। তীব্র অভাব ও ক্ষুধার মুখে সব সামাজিক বা ধর্মীয় অনুশাসন ফুৎকারে উড়ে যায়, কিন্তু চেতনার গভীরে যে দ্বন্দ্ব, কঠোরতম বাস্তবতার মুখেও তা কাঁটার মতো খচ খচ বিঁধে থাকে। সব প্রথাবদ্ধ সমাজে নৈতিকতার চরিত্রটি মুখ্যত বহির্মুখী—তার চেহারা ও চরিত্র নির্মিত হয় সামাজিক অনুশাসনের ছত্রচ্ছায়ায়। তা পালনও করা হয় সামাজিক অভিভাবকদের মন জুগিয়ে চলতে। এই অভিভাবকত্ব অর্জন অবশ্য এই শর্ত দ্বারা নির্ধারিত যে সামাজিক অভিভাবকেরাও তাঁদের নিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠীর মানব সদস্যদের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে কোনো না কোনো রকম ভূমিকা পালন করবেন। নৈতিকতার এই সামাজিক বহির্বরণটি ভেঙে পড়ে যখন অভিভাবকেরা তাঁদের সে ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হন। লক্ষণীয় হলো, নৈতিকতার সামাজিক বহির্বরণ ভেঙে পড়লেও ব্যক্তিগত নীতিবোধ, যা সমাজ থেকে আহরিত কিন্তু সমাজনির্ভর নয়, অক্ষুণ্ন থাকে। অর্থাৎ সমাজ তার সম্মিলিত নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেও ব্যক্তির নৈতিকতা, অন্তত নৈতিকতার কৃত্রিম অহংকার রয়ে যায়। এই গল্পের বৃদ্ধ সারা পৃথিবীর চোখে পরাস্ত হলেও নিজের কাছে পরাজয় মানতে পুরোপুরি প্রস্তুত নয়, ব্যক্তিগত অহংকার ও নীতিবোধ সে জাগিয়ে রাখে এক মিথ্যার আবরণে। সে যে মৃত্যুর কথা ভাবে, তার কারণ জীবন ও বিশ্বকে বুড়ো আঙুল দেখানোর সেটাই তার শেষ অস্ত্র।
এই ‘ডিনাইয়াল’ ব্যক্তিগত তা ঠিক, তবে তার একটি সামাজিক চরিত্রও আছে। গল্পের সময়গত, তথা ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতটি বিবেচনা করলে তা স্পষ্ট হবে। ‘আত্মজা’ দেশভাগের পরবর্তী কোনো একসময়ের ঘটনা। নিজের স্থাবর-অস্থাবর সব সহায়-সম্পদ ছেড়ে দেশ ছেড়ে আসতে হয়েছে যেসব অগুনতি মানুষকে, এই গল্পের বৃদ্ধ ও তার পরিবার তাদেরই অন্তর্গত। দেশভাগে তার কোনো হাত ছিল না, কিন্তু সে বিভক্তিতে এই অলিখিত আশ্বাস ছিল, ভিটেমাটি ছেড়ে এলেও নতুন ঠিকানায় তাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক আশ্রয় মিলবে। মেলেনি, ফলে গভীর এক অন্ধকূপে পড়ে যায় অগুনতি মানুষ। প্রতিশ্রুতি পালনে এই ব্যর্থতার একটি সম্মিলিত চরিত্র অবশ্যই আছে। কিন্তু সে দায়িত্ব আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বীকার করি না। এই অস্বীকৃতির প্রক্রিয়াটি হলো যে এই বৃদ্ধ ও তার মতো আরও অগুনতি উদ্বাস্তু পরিবারের অস্তিত্ব অগ্রাহ্য করা। পরাজিত, প্রায়-মৃত মানুষের মতো জীবনযাপনরত এসব মানুষকে আমরা মনে রাখি না, কারণ মনে রাখার অর্থই হলো সে ব্যর্থতার দায়ভার স্বীকার করে নেওয়া।
সবাই ভুলে গেলেও ভোলেন না লেখক। তাঁর চোখ দিয়ে নতুন করে পরাস্ত সে জীবন আমাদের সামনে গুটিসুটি এসে দাঁড়ায়। সরকারি হিসাবে, পত্রিকার প্রতিবেদনে অথবা সমাজবিজ্ঞানীর গবেষণাপত্রে এসব উদ্বাস্তু বড়জোর এক একটি পরিসংখ্যান। কিন্তু লেখকের কাছে তারা প্রত্যেকে রক্তমাংসের মানুষ। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, এরা কেউ পিতা, কেউ কন্যা, কেউ স্বজন। আত্মসম্মান নিয়ে, মানবিক মর্যাদা নিয়ে জীবন ধারণের অধিকার তাদের প্রত্যেকের ছিল। সে জীবন ধারণ যে সম্ভব হয়নি এ কেবল তাদের ব্যর্থতা নয়, আমাদেরও। সে দায়ভার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য জেগে থাকেন লেখক, জেগে থাকেন কবি। এই হলো সাহিত্যের নৈতিকতা। এভাবে একটি ছোটগল্প পরিশেষে পরিণত হয় একটি সক্রিয় সংলাপে।
‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটিতে হাসান আজিজ আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধ ও তা পালনে ব্যর্থতার কোনো কথাই বলেন না। বস্তুত, তার গল্পে কোনো নীতিকথা নেই, কোনো ইতিহাস পাঠও নেই। অনুক্ত সে সব কথা আমরা যে যার মতো করে আবিষ্কার করে নিই গল্পপাঠের মধ্য দিয়ে। এখানে লেখক একটি মানবিক ট্র্যাজেডির নিস্পৃহ দর্শকমাত্র, তাঁর কোনো পক্ষপাত নেই, ঠিক-বেঠিক নিয়ে তাঁর কোনো পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তও নেই। তৃতীয় বাচ্যে প্রকাশিত হওয়ায় লেখকের এই নিরাসক্তি গোড়া থেকেই স্পষ্ট। কাহিনিকথনে তিনি মোটামুটি একরৈখিক, লিনিয়ার-অনুক্রম রক্ষা করে চলেন, যদিও সে অনুক্রম প্রায়ই বিঘ্নিত হয়, মুখ্যত গল্পটির বর্ণনা-প্রসঙ্গ বিস্তারে। এই গল্পে রয়েছে দুটি সংযুক্ত আখ্যান বা ন্যারেটিভ। প্রথমটি যুবক তিনটিকে নিয়ে, দ্বিতীয়টির কেন্দ্রে উদ্বাস্তু বৃদ্ধ। প্রথম আখ্যানে নির্মিত হয় এই গল্পের বহিরঙ্গ, তার আউটার টোন। দ্বিতীয় আখ্যানটি গল্পের প্রায় শেষ পর্যায়ে, কিন্তু সেটিই এ গল্পের অন্তর্জগৎ, তার শাঁস। এই অন্তর্জগতে প্রবেশের জন্যই প্রয়োজন প্রথম ন্যারেটিভটির। প্রথমটির বেলায় লেখক নির্ভর করেন বিক্ষিপ্ত কথোপকথন, কিন্তু দ্বিতীয় ন্যারেটিভে লেখকের প্রধান হাতিয়ার ‘আত্মগত সংলাপ’।
অসংলগ্ন ও বিক্ষিপ্ত কথোপকথনের মাধ্যমে অতি সামান্য পরিসরেও লেখক প্রতিটি চরিত্রকে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব প্রদানে সক্ষম হন। আমরা উপলব্ধি করি, যে তিনটি যুবক নৈশ অভিসারে সহযাত্রী, তাদের মধ্যে গোপন বৈরিতা রয়েছে, রয়েছে এক ধরনের উদ্বেগ, রয়েছে এমনকি অপরাধবোধও। বৃদ্ধ ও তার পরিবারের নিরুপায় অবস্থার সুযোগ তারা নিচ্ছে, এমন কথাও তাদের আলাপচারিতায় স্পষ্ট হয়।
ছোট মামার বিয়ের গল্প করছে সুহাস। ‘ইনামের মনে হোল সুহাস গতকাল থেকে গল্পটা বলছে আর আগামিকাল পর্যন্ত বলবে। নাপিত বিটা কমিয়ে কতি পারে না।
‘ভাঙ্গা দরজার ফাঁক দিয়ে ঘুম-জড়ানো গোঙ্গানি ভেসে আসে। সব ঘুমায়ে পড়িছে—সুহাস বলে। ফেকু সায় দেয় ঘ্যোঁত করে। আজ না আসলিই হতো—সুহাস অভিযোগ করতে থাকে, ভয় করতিছে আমার।
‘বুড়োর মুখ এখন বহুরূপী। সুহাস ভাবছে, বুড়োটা খুন করবেন মনে হতিছে আমার। আজ ক্যানো যে আলাম।’
অন্যদিকে বৃদ্ধের অসহায়ত্ব প্রকাশে লেখক কখনো পরিহাসপ্রবণ, কখনো বা সহানুভূতিশীল।
‘তারপর কি খবর? অ্যাঁ? সব ভালো ত? ঘড় ঘড় করে একটানা কথা আরম্ভ হয়। আক্ষেপ বিলাপ, মরে গেলেই তো হয় এখন, কি বলো তোমরা? টক করে মরে গেলাম ধরো। তারপরে? আমার আর কি—ড্যাং ড্যাড্যাং ড্যাং, চলে গেলাম, বুঝে মরগে তুই বুড়ি—ছানাপোনা নিয়ে বুঝে মরগে।
‘এই তোমরা একটু আধটু আসো, যখন তখন এসে খোঁজখবর নাও। সময় অসময় নেই বাবা তোমাদের। তোমরাই ভরসা, আমার পরিবার তোমাদের কথা বলতে অজ্ঞান।’
গল্পের শেষে করবী বিচির উল্লেখে আত্মহননের একটি ইংগিত আছে। মৃত্যু এই বৃদ্ধের জীবনযুদ্ধে পরাজয়ের চূড়ান্ত স্বীকারোক্তি, সমাজকে ছুড়ে দেওয়া তার শেষ তিরস্কার। বৃদ্ধ যদি ভেবে থাকে মৃত্যুকে গ্রহণের মাধ্যমে নৈতিকতার পরীক্ষায় সে পার পেয়ে যাবে, গল্পের শেষ বাক্য থেকে মনে হয় না লেখক সে ব্যাপারে একমত। করবী ফুলে চমৎকার বিচি হয়, এই কথা বলে বৃদ্ধ যখন ‘পানিতে ডুবে যেতে যেতে, ভেসে যেতে থাকে বুড়োর মুখ,’ ইনাম তখন তেতো গলায় প্রশ্ন রাখে, ‘এহন তুমি কাঁদতিছ?’ পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত সে প্রশ্ন থেকে স্পষ্ট, ইনাম বুড়োর শ্লেষ্মা জড়ানো সে কান্নার প্রতি মোটেই সহানুভূতিশীল নয়। বরং এক ধরনের পরিহাসই যেন তাতে প্রচ্ছন্ন, ইনাম যেন বলছে, ‘এহন কান্দো ক্যা, আগে ভাইবে কাজ করলি তো আর কানতি হতো না!’
৩.
ফিকশন ও গানের মধ্যে কোনো ঐক্য আছে কি না, এমন একটি প্রশ্ন তুলে ফরস্টার মন্তব্য করেছেন, বিটোফেনের ফিফথ সিম্ফনি শুনতে শুনতে একসময় তা শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তার পরেও আমাদের মাথার মধ্যে এক বিস্ময়কর নতুন সিম্ফনির সম্মোহন জেগে থাকে। অর্কেস্ট্রা থেমে গেছে, কিন্তু গান থামেনি। যে সুর কেউ বাজায়নি, আমাদের চেতনায় এক নিজস্ব দ্যোতনায় তা বেজে চলে। ফিকশনের বেলাতেও ঠিক একই রকম ব্যাপার ঘটে। ফরেস্টারের ভাষায়, এ হলো সাহিত্যের ‘এক্সপানশন’—তার বিস্তৃতি। অনেক ক্ষেত্রেই যে বই বা গল্প আমরা পড়ি, তা শেষ হওয়া মাত্রই তার সমাপ্তি হলো, এমন নয়। বরং সে বই বা গল্প পড়া শেষ হওয়ার পরও আমাদের মাথায়, আমাদের বুকের ভেতর একটা অজ্ঞাত শিরশির অনুভূতি জেগে থাকে। ফরস্টার ওয়্যার অ্যান্ড পিস উপন্যাসের উদাহরণে এ কথা বলেছেন। গ্রন্থটি তাঁর চোখে কিঞ্চিত ‘অগোছালো’—‘আন-টাইডি’। অথচ তার পরও এক নতুন সুর আমাদের অনুসরণ করে, যা এই কাহিনিকে বিস্তৃততর করে, তার সব চরিত্র ও ঘটনাপুঞ্জকে সম্প্রসারিত করে। ছোটগল্প প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠিক একই কথা বলেছিলেন—শেষ হইয়াও হইল না শেষ।
‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ পাঠশেষে আমাদের দুই ধরনের সম্প্রসারণ বা এক্সপানশনের অভিজ্ঞতা হয়। এক. দেশভাগের ফলে যে দুর্যোগ ও ব্যক্তিগত সংকটমুহূর্ত তৈরি হয়, তার একটি মানবিক মানচিত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি। এই গল্পে দেশভাগ কেবল একটি নীরব বহিরাবরণ, কিন্তু গল্পপাঠ শেষে সেই নীরব বহিরাবরণটি একটি বড় রকমের প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের মনের মধ্যে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, যে রাজনৈতিক ট্র্যাজেডিতে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না, তার ফলভোগ কেন করতে হয় সাধারণ মানুষকে? বিগতকাল বর্তমানেরই ক্রিয়াকলাপ। যাদের রাজনৈতিক উচ্চাশা, দুরভিসন্ধি এবং ছলচাতুরী সে দুর্ভাগ্যের কারণ, তা যত বিগত কালেরই হোক না কেন, এ অপরাধের জন্য তারা কেন পার পেয়ে যায়? আমার বিবেচনায়, অন্য কেউ না করুক, একজন লেখক—যেমন এই গল্পের লেখক—অলক্ষ্যে বিগত সময় ও তার খলনায়কদের কাঠগড়ায় বসাতে সক্ষম।
দ্বিতীয় সম্প্রসারণটি সংবেদনির্ভর। অন্য পাঠকের কথা জানি না, এই গল্পপাঠের সময় আমি সেই অভাগা কিশোরীর কথা ভেবেছি। লেখক একবার মাত্র তার নাম উল্লেখ করেন, রুকু, একবার মাত্র তার ‘হু হু করে কেঁদে ওঠার’ কথা বলেন, একবার শুধু বলেন চুড়ির শব্দ, এলোমেলো শাড়ির শব্দ, সুহাসের হি হি হাসির শব্দ। এই প্রতিটি শব্দ লেখার সময় এখনো আমার হাত কাঁপে, বুকের ভেতর আচমকা টান লাগে, নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমি এমন কথাও ভাবি, এই গল্পের বৃদ্ধ যে করবী বিচির অপেক্ষায়, সে কার জন্য—নিজের, না তার আত্মজার হননে ব্যবহারের জন্য? আমার সন্দেহ জাগে, গল্পের নামকরণে তার একটি ইংগিত রেখে গেছেন লেখক। এই বিষ সেই বৃদ্ধ নিজের জন্য নয়, তার আত্মজার জন্য চাষ করেছে, অপেক্ষায় আছে তার পূর্ণ স্ফোটনে। অক্ষম পুরুষ নিজের স্ত্রী, আত্মজা অথবা ভগ্নিকে রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে পরিঘাতের চেষ্টা করে, এ ঘটনা আমাদের অভিজ্ঞতার বহির্গত নয়। মনে পড়ছে, গোবিন্দ নিহালিনি পরিচালিত হিন্দি চলচ্চিত্র আক্রোশ-এ নিম্নবর্গীয় এক যুবক ধর্ষণের হাত থেকে অনুজাকে রক্ষায় তাকে হত্যা করে। আক্রোশ তার অত্যাচারী জোতদারের প্রতি, কিন্তু ক্ষমতার কাছে নতজানু পুরুষ সে পথই অনুসরণ করে যা তার আয়ত্তাধীন। ক্লীবের, পরাজিতের এই মূর্খ-প্রতিশোধ, তা যেমন গভীর বেদনার, তেমনি অবোধ্য ক্রোধের।
সাহিত্য ও নৈতিকতার যদি কোনো সংযুক্তি থাকে তা শুধু এখানে যে একজন সৎ, নির্ভীক ও চিন্তাশীল লেখক মানব অভিজ্ঞতার জটিল গ্রন্থিসমূহ উন্মোচনের মাধ্যমে আমাদের, তার পাঠকদের, সে অভিজ্ঞতা বিষয়ে অধিক সচেতন ও সংবেদনশীল করেন। মানুষ একাকী ও বিচ্ছিন্ন বৃক্ষ নয়, এক বৃহৎ মানব গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে সে তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে লেখক আমাকে এই মানবিক সংহতি অর্জনে সাহায্য করেন, আমার চোখে তিনি কেবল সফল নন, নৈতিকও বটে।
চল্লিশ বছর পরে, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ নতুন করে পাঠের পরেও হাসান আজিজুল হক সম্বন্ধে আমার এই সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রয়ে যায়।
No comments