নেলসন ম্যান্ডেলা তনয়ারা
নেলসন ম্যান্ডেলা-তনয়ারা জীবন গড়ে তুলতে তাঁর ছায়া থেকে বেরিয়ে আসছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্টের পরিবার তাঁর অর্জিত মুক্তির সুযোগ নিতে ডানা মেলে দিয়েছে। ‘তুমি জানো, বলতে গেলে জেলখানাতেই জন্ম হয়েছিল তোমার?
’ মেয়ে জেনানিকে একবার লিখেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা, ‘তোমার জন্মের আগে খুব বেশি লোকের কিন্তু তোমার মতো জেলে থাকার অভিজ্ঞতা হয়নি।’
জেনানির মা উইনি ম্যান্ডেলা তাঁর জন্মের আগে ১৯৫৯ সালে সোয়েতোয় বর্ণবাদবিরোধী মহিলাদের বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার দায়ে আটক হয়েছিলেন। জেনানির পাঁচ বছর বয়সে বাবা জেলে ছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বিখ্যাত পদবি ধারণ করার ভেতর তেমন কোনো সারল্য থাকে না। কিন্তু জেনানি ম্যান্ডেলা-লামিনি (হোসা ভাষায় জেনানি নামের অর্থ, ‘জগতে কী নিয়ে এসেছ তুমি?’) সম্প্রতি দেশের কূটনৈতিক বহরে যোগ দিতে বাবার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছেন। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি, বিয়ের সুবাদে সোয়াজি রাজকন্যায় পরিণত ৫৩ বছর বয়সী জেনানি সফল ব্যবসা পরিচালনা শেষে আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছেন।
এই ঘটনাটাকে ম্যান্ডেলার কোনো সন্তানের সরকারি পেশায় পা রাখার প্রথম প্রয়াস হিসেবে ব্যাপকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে প্রচার মাধ্যমে; যদিও জেনানির বোন জিন্দজি আগেই বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আত্মগোপনকালে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি ১৯৮৫ সালে সোয়েতোয় এক জনসভায় বাবার পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। আইন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শেষে জিন্দজি নানামুখি কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত হন, তিনি ব্যবসা ছাড়াও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে। নেলসন ম্যান্ডেলা চিলড্রেন ফান্ডের ট্রাস্টি তিনি, আফ্রিকান স্পোর্টস নেটওয়ার্কের প্রধান, লাভ লাইফ নামে একটি এইডস সচেতনতা তৈরির কাজে নিয়োজিত সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা। ১৯৯৭ সালে জিন্দজি নেলসন ম্যানেডলার সঙ্গে ঢাকা সফর করেন।
ম্যান্ডেলার নাতি ও জ্যেষ্ঠ পুরুষ বংশধর মান্ডলা খানিকটা ম্যান্ডেলার নজির অনুসরণ করতে চেয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন। কিন্তু তিনিই ব্যতিক্রম। বাবা মাকগাথো ম্যান্ডেলা ২০০৫ সালে মারা যাওয়ার পর তাঁকে রাজনীতিতে আসতে হয়। হোসা গোত্রের নেতার পদ ম্যান্ডেলা ছেড়েছিলেন ৭০ বছর আগে, দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। ২০০৭ সালে আবারও নেলসন ম্যান্ডেলাকে ওই পদে যোগ দেওয়ার জন্য গোত্র থেকে অনুরোধ জানালে ম্যান্ডেলা নাতি মান্ডলার নাম প্রস্তাব করে। আর এতে মাত্র ৩২ বছর বয়সে মান্ডলা গোত্রপ্রধান হন। এতে তাঁর দায়িত্ব বর্তায় গোত্রের নানা আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া, গোত্রের নানা বিরোধ মেটানো আর রাজনৈতিক বিষয়ে গোত্রকে প্রতিনিধিত্ব করা। তবে বিতর্ক তাঁর সঙ্গী এখন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলা নামটি অমূল্য প্রতীক বহন করে। সেতু, চত্বর, থিয়েটার, বার্ষিক ভাষণ, স্কলারশিপ, মদের নাম, জাদুঘর আর রাস্তার চেয়েও বেশি বিষয়ের সঙ্গেও এই নাম সম্পর্কিত। নির্বাচনী জনসভায় ৯৪ বছর বয়সী দুর্বল সাবেক প্রেসিডেন্টকে টেনে আনায় এএনসির ( আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস) বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।
একথা অতি বাস্তব ম্যান্ডেলার ডিএনএ ধারণ করেন, এমন একজন আকর্ষণীয় উত্তরসূরি সত্যি সত্যি দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে প্রবলভাবে আসতে চাইলে তাকে প্রতিহত করা যাবে না। ম্যান্ডেলার মতো ভাবমূর্তি নেই এমন ব্যক্তিত্বের অনেক উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও ক্ষমতা দখলের নজির আফ্রিকায় মহাদেশে অজানা নয়। কিন্তু মাত্র এক মেয়াদ শাসন করার পর সরে দাঁড়ানো ম্যান্ডেলা ও ম্যান্ডেলার পরিবারের ক্ষেত্রে এটা ভিন্ন কথা।
‘আমার চোখে এটা বিস্ময়কর না,’ বলেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা সেন্টার অফ মেমোরির প্রধান ভার্ন হ্যারিস। ‘আমার বাবা ছিলেন জাজ সংগীতজ্ঞ, কিন্তু আমি ইচ্ছা করেই বাদ্যযন্ত্র বেছে নিইনি। কারণ, আমি পারীক্ষার মুখে পড়ে অযোগ্য প্রমাণিত হতে চাইনি। সম্ভবত সফল মা-বাবার সন্তানদের ক্ষেত্রে এটাই সাধারণ প্রতিক্রিয়া।’
দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলা পরিবারকে কোনোভাবেই সাধারণ বলা যাবে না। রাজনীতির প্রতি ম্যান্ডেলার ভালোবাসার জন্য চড়া দাম দিতে হয়েছে। তাঁর সন্তানদের সেটা মনে আছে, এমনকি জেলে না থাকলেও আবেগের দিক থেকে তিনি থাকতেন শীতল ও দূরবর্তী, নিজের ভূমিকাকে শাসক ও প্রতিপালকের মনে করেছেন।
তিনবার বিয়ে করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা, ছয় সন্তানের জনক হয়েছেন। তিনজন মারা গেছেন—একজন শিশু অবস্থায় ১৯৪৮ সালে, আরেকজন ১৯৬৯ সালে মোটর দুর্ঘটনায় আর ২০০৫ সালে এইডস-সংক্রান্ত অসুস্থতায় তৃতীয়জনের মৃত্যু ঘটে।
তাঁর জীবিত সন্তানদের সবাই মেয়ে—প্রথম স্ত্রী ইভলিন মেজের ঘরে জন্ম নেওয়া মাকি এবং দ্বিতীয় স্ত্রী উইনি মাদিকিজেলা-ম্যান্ডেলার ঘরে জন্মানো জেনানি ও জিন্দজি। ১৯৯৬ সালে তিনি উইনির সঙ্গে বিচ্ছেদ নেন এবং স্বাধীন মোজাম্বিকের প্রথম রাষ্ট্রপতি সামোরা মাচেলের স্ত্রী গ্রাসা মাচেলের সঙ্গে বর্তমানে সংসার করছেন। ১৯৮৬ সালে সামোরা মাচেল মারা যান। সেন্টার অফ মেমোরির ভাষ্য মোতাবেক ম্যান্ডেলার বর্তমানে ১৭ জন পৌত্র ও ১৪ জন প্রপ্রৌত্র রয়েছে।
৫৮ বছর বয়সী মাকা একজন ব্যবসায়ী ও হাউস অফ ম্যান্ডেলা মদের প্রতিষ্ঠাতা, শ্বেতাঙ্গ প্রাধান্যবিশিষ্ট শিল্পে স্থান করে নিয়েছেন। রাজনীতি-পেশায় যোগ দেওয়ার কথা কখনো ভেবেছেন কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি লন্ডনের অবজারভার পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ নই। আমার মনে হয়, এই পরিবারের দু-একজন সদস্যের রাজনীতিতে যোগ দেওয়াই যথেষ্ট। আমাদের ছড়িয়ে পড়া দরকার। আমি আসলে ব্যবসাতেই অভিজ্ঞতা লাভ করতে চাই, কী দাঁড়ায়, দেখতে চাই আমি। কারণ, আমরা পারব বলে মনে করি। রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী হওয়াটা এক কথা। আমাদের এখনো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংগ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে কালো মানুষের কোনো অবস্থান নেই। উল্লেখযোগ্য কালো মানুষ সক্রিয়ভাবে অর্থনীতিতে অংশ নিলেই আমরা জানব যে দেশটি সত্যিকার অর্থে বদলে গেছে। আমরা এখনো সেই পর্যায়ে যাইনি।’
তাঁর মেয়ে ৩৭ বছর বয়স্ক তুকবিনিও হাউস অব ম্যান্ডেলায় কাজ করেন, তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, আমার পিতামহ ও ওয়াল্টার সিসুলু (ম্যান্ডেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং একসঙ্গে শ্বেতাঙ্গ সরকার বিরোধী আন্দোলনে কারাবাস করেছেন) এবং অন্য মুক্তিসংগ্রামীরা যুদ্ধ করেছেন, যাতে আমরা যে যা হতে চাই, তা হয়ে ওঠার আত্মপ্রত্যয় লাভ করতে পারি। এখন সেসব কাজ করার সুযোগ এসেছে আমাদের। সব রাস্তাই রাজনীতির দিকে যায় না; অন্য দিকেও যায় বটে।’
পিতামহের টান জোরালো হলেও তুকবিনির ভাই কিউকি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, তাঁর প্রকল্পের ভেতর রয়েছে ম্যান্ডেলার জীবননির্ভর একটি টিভি মিনি সিরিজ ও পৌত্র-পৌত্রীদের সঙ্গে তাঁর একটি প্রামাণ্যচিত্র। পরিবারের কোনো কোনো সদস্য প্রচারণায় সানন্দে যোগ দিয়েছেন, আবার অন্যরা পিছিয়ে গেছেন।
পরিবারের বৈচিত্র্য স্পষ্ট। তবে কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে, ম্যান্ডেলা পরিবার নিজের বিরুদ্ধেই বিভক্ত। তাঁরা বিশেষ করে ২০০৪ সালে মৃত্যুবরণকারী প্রথম স্ত্রী ইভলিন ও বর্তমানে ৭৫ বছর বয়সী উইনির উত্তরসূরিদের ভেতর বিরোধিতার কথা বলেন।
সম্ভবত পিতামহের সঙ্গে লক্ষণীয় সাদৃশ্যের অধিকারী গ্রাম্য সর্দার বা হোসা গোত্রের প্রধান মান্ডলাই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণকারী ব্যক্তিত্ব। তাঁকে ঘিরে নেতিবাচক সব শিরোনাম ঘূর্ণি খায়। তিনি ম্যান্ডেলার মৃত সন্তানদের লাশ কবর থেকে উত্তোলন ও নতুন করে কবর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং বিতর্কমূলকভাবে রাষ্ট্রনায়কের জন্মস্থানে সংরক্ষিত জরাজীর্ণ কুঁড়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে তাঁর অনুকৃতি নির্মাণ করেছেন।
তবে পরিবারের একজন সদস্য বলেছেন, ‘একদিন পরিবারের কর্তা হবেন তিনি, এটাই রীতি। একে আমাদের সম্মান দেখাতে হবে।’
অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে মাকি ম্যান্ডেলা হাসিতে ভেঙে পড়েন। ‘দ্বন্দ্ব নেই, এমন একটা পরিবার আমাকে দেখান,’ বলেছেন তিনি। ‘চার্চিলের পরিবারেও দ্বন্দ্ব ছিল। সব পরিবারেরই জটিলতা রয়েছে। আমাদের পরিবার ব্যতিক্রম নয়। তার মানে এই নয় যে আমাদের মিল নেই...
‘হ্যাঁ, অনেক সময় সবার মতো এক রকম হয় না—ভাই-বোনের সঙ্গেও বনিবনা না হতে পারে। এ জন্য ভাইবোনের ঝগড়া বলে একটা কথা আছে। আমরা ম্যান্ডেলারা এটা সৃষ্টি করিনি। এটা সব সময়ই ছিল।
‘তবে আমার ধারণা যে ব্যাপারটা আমাদের এক করে রেখেছে, সেটা হলো বাবা। আমাদের মা ভিন্ন হতে পারেন, কিন্তু তাতা [বাবা]ই আমাদের এক রেখেছেন।’
দি গার্ডিয়ান অবলম্বনে লিখেছেন শওকত হোসেন
জেনানির মা উইনি ম্যান্ডেলা তাঁর জন্মের আগে ১৯৫৯ সালে সোয়েতোয় বর্ণবাদবিরোধী মহিলাদের বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার দায়ে আটক হয়েছিলেন। জেনানির পাঁচ বছর বয়সে বাবা জেলে ছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বিখ্যাত পদবি ধারণ করার ভেতর তেমন কোনো সারল্য থাকে না। কিন্তু জেনানি ম্যান্ডেলা-লামিনি (হোসা ভাষায় জেনানি নামের অর্থ, ‘জগতে কী নিয়ে এসেছ তুমি?’) সম্প্রতি দেশের কূটনৈতিক বহরে যোগ দিতে বাবার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছেন। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি, বিয়ের সুবাদে সোয়াজি রাজকন্যায় পরিণত ৫৩ বছর বয়সী জেনানি সফল ব্যবসা পরিচালনা শেষে আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছেন।
এই ঘটনাটাকে ম্যান্ডেলার কোনো সন্তানের সরকারি পেশায় পা রাখার প্রথম প্রয়াস হিসেবে ব্যাপকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে প্রচার মাধ্যমে; যদিও জেনানির বোন জিন্দজি আগেই বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আত্মগোপনকালে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি ১৯৮৫ সালে সোয়েতোয় এক জনসভায় বাবার পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। আইন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শেষে জিন্দজি নানামুখি কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত হন, তিনি ব্যবসা ছাড়াও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে। নেলসন ম্যান্ডেলা চিলড্রেন ফান্ডের ট্রাস্টি তিনি, আফ্রিকান স্পোর্টস নেটওয়ার্কের প্রধান, লাভ লাইফ নামে একটি এইডস সচেতনতা তৈরির কাজে নিয়োজিত সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা। ১৯৯৭ সালে জিন্দজি নেলসন ম্যানেডলার সঙ্গে ঢাকা সফর করেন।
ম্যান্ডেলার নাতি ও জ্যেষ্ঠ পুরুষ বংশধর মান্ডলা খানিকটা ম্যান্ডেলার নজির অনুসরণ করতে চেয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন। কিন্তু তিনিই ব্যতিক্রম। বাবা মাকগাথো ম্যান্ডেলা ২০০৫ সালে মারা যাওয়ার পর তাঁকে রাজনীতিতে আসতে হয়। হোসা গোত্রের নেতার পদ ম্যান্ডেলা ছেড়েছিলেন ৭০ বছর আগে, দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। ২০০৭ সালে আবারও নেলসন ম্যান্ডেলাকে ওই পদে যোগ দেওয়ার জন্য গোত্র থেকে অনুরোধ জানালে ম্যান্ডেলা নাতি মান্ডলার নাম প্রস্তাব করে। আর এতে মাত্র ৩২ বছর বয়সে মান্ডলা গোত্রপ্রধান হন। এতে তাঁর দায়িত্ব বর্তায় গোত্রের নানা আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া, গোত্রের নানা বিরোধ মেটানো আর রাজনৈতিক বিষয়ে গোত্রকে প্রতিনিধিত্ব করা। তবে বিতর্ক তাঁর সঙ্গী এখন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলা নামটি অমূল্য প্রতীক বহন করে। সেতু, চত্বর, থিয়েটার, বার্ষিক ভাষণ, স্কলারশিপ, মদের নাম, জাদুঘর আর রাস্তার চেয়েও বেশি বিষয়ের সঙ্গেও এই নাম সম্পর্কিত। নির্বাচনী জনসভায় ৯৪ বছর বয়সী দুর্বল সাবেক প্রেসিডেন্টকে টেনে আনায় এএনসির ( আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস) বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।
একথা অতি বাস্তব ম্যান্ডেলার ডিএনএ ধারণ করেন, এমন একজন আকর্ষণীয় উত্তরসূরি সত্যি সত্যি দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে প্রবলভাবে আসতে চাইলে তাকে প্রতিহত করা যাবে না। ম্যান্ডেলার মতো ভাবমূর্তি নেই এমন ব্যক্তিত্বের অনেক উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও ক্ষমতা দখলের নজির আফ্রিকায় মহাদেশে অজানা নয়। কিন্তু মাত্র এক মেয়াদ শাসন করার পর সরে দাঁড়ানো ম্যান্ডেলা ও ম্যান্ডেলার পরিবারের ক্ষেত্রে এটা ভিন্ন কথা।
‘আমার চোখে এটা বিস্ময়কর না,’ বলেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা সেন্টার অফ মেমোরির প্রধান ভার্ন হ্যারিস। ‘আমার বাবা ছিলেন জাজ সংগীতজ্ঞ, কিন্তু আমি ইচ্ছা করেই বাদ্যযন্ত্র বেছে নিইনি। কারণ, আমি পারীক্ষার মুখে পড়ে অযোগ্য প্রমাণিত হতে চাইনি। সম্ভবত সফল মা-বাবার সন্তানদের ক্ষেত্রে এটাই সাধারণ প্রতিক্রিয়া।’
দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলা পরিবারকে কোনোভাবেই সাধারণ বলা যাবে না। রাজনীতির প্রতি ম্যান্ডেলার ভালোবাসার জন্য চড়া দাম দিতে হয়েছে। তাঁর সন্তানদের সেটা মনে আছে, এমনকি জেলে না থাকলেও আবেগের দিক থেকে তিনি থাকতেন শীতল ও দূরবর্তী, নিজের ভূমিকাকে শাসক ও প্রতিপালকের মনে করেছেন।
তিনবার বিয়ে করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা, ছয় সন্তানের জনক হয়েছেন। তিনজন মারা গেছেন—একজন শিশু অবস্থায় ১৯৪৮ সালে, আরেকজন ১৯৬৯ সালে মোটর দুর্ঘটনায় আর ২০০৫ সালে এইডস-সংক্রান্ত অসুস্থতায় তৃতীয়জনের মৃত্যু ঘটে।
তাঁর জীবিত সন্তানদের সবাই মেয়ে—প্রথম স্ত্রী ইভলিন মেজের ঘরে জন্ম নেওয়া মাকি এবং দ্বিতীয় স্ত্রী উইনি মাদিকিজেলা-ম্যান্ডেলার ঘরে জন্মানো জেনানি ও জিন্দজি। ১৯৯৬ সালে তিনি উইনির সঙ্গে বিচ্ছেদ নেন এবং স্বাধীন মোজাম্বিকের প্রথম রাষ্ট্রপতি সামোরা মাচেলের স্ত্রী গ্রাসা মাচেলের সঙ্গে বর্তমানে সংসার করছেন। ১৯৮৬ সালে সামোরা মাচেল মারা যান। সেন্টার অফ মেমোরির ভাষ্য মোতাবেক ম্যান্ডেলার বর্তমানে ১৭ জন পৌত্র ও ১৪ জন প্রপ্রৌত্র রয়েছে।
৫৮ বছর বয়সী মাকা একজন ব্যবসায়ী ও হাউস অফ ম্যান্ডেলা মদের প্রতিষ্ঠাতা, শ্বেতাঙ্গ প্রাধান্যবিশিষ্ট শিল্পে স্থান করে নিয়েছেন। রাজনীতি-পেশায় যোগ দেওয়ার কথা কখনো ভেবেছেন কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি লন্ডনের অবজারভার পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ নই। আমার মনে হয়, এই পরিবারের দু-একজন সদস্যের রাজনীতিতে যোগ দেওয়াই যথেষ্ট। আমাদের ছড়িয়ে পড়া দরকার। আমি আসলে ব্যবসাতেই অভিজ্ঞতা লাভ করতে চাই, কী দাঁড়ায়, দেখতে চাই আমি। কারণ, আমরা পারব বলে মনে করি। রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী হওয়াটা এক কথা। আমাদের এখনো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংগ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে কালো মানুষের কোনো অবস্থান নেই। উল্লেখযোগ্য কালো মানুষ সক্রিয়ভাবে অর্থনীতিতে অংশ নিলেই আমরা জানব যে দেশটি সত্যিকার অর্থে বদলে গেছে। আমরা এখনো সেই পর্যায়ে যাইনি।’
তাঁর মেয়ে ৩৭ বছর বয়স্ক তুকবিনিও হাউস অব ম্যান্ডেলায় কাজ করেন, তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, আমার পিতামহ ও ওয়াল্টার সিসুলু (ম্যান্ডেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং একসঙ্গে শ্বেতাঙ্গ সরকার বিরোধী আন্দোলনে কারাবাস করেছেন) এবং অন্য মুক্তিসংগ্রামীরা যুদ্ধ করেছেন, যাতে আমরা যে যা হতে চাই, তা হয়ে ওঠার আত্মপ্রত্যয় লাভ করতে পারি। এখন সেসব কাজ করার সুযোগ এসেছে আমাদের। সব রাস্তাই রাজনীতির দিকে যায় না; অন্য দিকেও যায় বটে।’
পিতামহের টান জোরালো হলেও তুকবিনির ভাই কিউকি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, তাঁর প্রকল্পের ভেতর রয়েছে ম্যান্ডেলার জীবননির্ভর একটি টিভি মিনি সিরিজ ও পৌত্র-পৌত্রীদের সঙ্গে তাঁর একটি প্রামাণ্যচিত্র। পরিবারের কোনো কোনো সদস্য প্রচারণায় সানন্দে যোগ দিয়েছেন, আবার অন্যরা পিছিয়ে গেছেন।
পরিবারের বৈচিত্র্য স্পষ্ট। তবে কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে, ম্যান্ডেলা পরিবার নিজের বিরুদ্ধেই বিভক্ত। তাঁরা বিশেষ করে ২০০৪ সালে মৃত্যুবরণকারী প্রথম স্ত্রী ইভলিন ও বর্তমানে ৭৫ বছর বয়সী উইনির উত্তরসূরিদের ভেতর বিরোধিতার কথা বলেন।
সম্ভবত পিতামহের সঙ্গে লক্ষণীয় সাদৃশ্যের অধিকারী গ্রাম্য সর্দার বা হোসা গোত্রের প্রধান মান্ডলাই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণকারী ব্যক্তিত্ব। তাঁকে ঘিরে নেতিবাচক সব শিরোনাম ঘূর্ণি খায়। তিনি ম্যান্ডেলার মৃত সন্তানদের লাশ কবর থেকে উত্তোলন ও নতুন করে কবর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং বিতর্কমূলকভাবে রাষ্ট্রনায়কের জন্মস্থানে সংরক্ষিত জরাজীর্ণ কুঁড়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে তাঁর অনুকৃতি নির্মাণ করেছেন।
তবে পরিবারের একজন সদস্য বলেছেন, ‘একদিন পরিবারের কর্তা হবেন তিনি, এটাই রীতি। একে আমাদের সম্মান দেখাতে হবে।’
অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে মাকি ম্যান্ডেলা হাসিতে ভেঙে পড়েন। ‘দ্বন্দ্ব নেই, এমন একটা পরিবার আমাকে দেখান,’ বলেছেন তিনি। ‘চার্চিলের পরিবারেও দ্বন্দ্ব ছিল। সব পরিবারেরই জটিলতা রয়েছে। আমাদের পরিবার ব্যতিক্রম নয়। তার মানে এই নয় যে আমাদের মিল নেই...
‘হ্যাঁ, অনেক সময় সবার মতো এক রকম হয় না—ভাই-বোনের সঙ্গেও বনিবনা না হতে পারে। এ জন্য ভাইবোনের ঝগড়া বলে একটা কথা আছে। আমরা ম্যান্ডেলারা এটা সৃষ্টি করিনি। এটা সব সময়ই ছিল।
‘তবে আমার ধারণা যে ব্যাপারটা আমাদের এক করে রেখেছে, সেটা হলো বাবা। আমাদের মা ভিন্ন হতে পারেন, কিন্তু তাতা [বাবা]ই আমাদের এক রেখেছেন।’
দি গার্ডিয়ান অবলম্বনে লিখেছেন শওকত হোসেন
No comments