বৈদেশিক অর্থ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রবাসীর সঞ্চয় by মেজর সুধীর সাহা (অব.)
ইতিপূর্বে অন্য একটি লেখায় ইমিগ্রেশনের কারণে বাংলাদেশ থেকে মেধা পাচারের বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম। মেধা বাংলাদেশ থেকে স্থায়ীভাবে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন উন্নত দেশে ইমিগ্রেশনের নামে। এটাই আমাদের বাস্তবতা। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও কিন্তু ঠিক যে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ অনেক দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের দ্বৈত
নাগরিকত্বের আইন প্রযোজ্য আছে। সুতরাং বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার পাসপোর্ট এবং বাংলাদেশের পাসপোর্ট একই সঙ্গে গ্রহণ করতে পারছেন এবং যেকোনো সময় যেকোনোটি ব্যবহার করে বিদেশ ভ্রমণ করতে পারছেন। এই আইনগত ব্যবস্থার একটি সুফল বাংলাদেশ গ্রহণ করছে। বাংলাদেশে বসবাস করছেন এমন কিছু বাংলাদেশি নাগরিকেরই আছে কানাডা বা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বা পাসপোর্ট। সহজে বিদেশে ভ্রমণের সুবিধার কারণে তারা বাংলাদেশে বসবাস করলেও উন্নত কোনো দেশের (যে দেশেরই তিনি নাগরিক) পাসপোর্ট বহন করছেন। এর ফলে ভিসা পাওয়ার কঠিন সমস্যা থেকে তিনি রক্ষা পাচ্ছেন। কানাডার পাসপোর্ট থাকলে বিদেশি অনেক দেশেরই ভিসা প্রয়োজন হয় না। এ সুবিধার জন্যই বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করেও একজন বাঙালি কানাডার পাসপোর্ট বহন করছেন। বাংলাদেশের পাসপোর্টে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা বিদ্যমান। প্রথমত, প্রায় সব দেশেরই ভিসা করতে হয় ভ্রমণের ক্ষেত্রে এবং সেই ভিসা প্রাপ্তিরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। দ্বিতীয়ত, ভ্রমণের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীকে বিনা কারণে সন্দেহের চোখে দেখে। উন্নত দেশের পাশাপাশি, এমন কি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও বাংলাদেশের পাসপোর্টকে বাঁকা চোখে দেখে। তাই প্রতিনিয়ত যেসব বাংলাদেশি বিদেশে যাতায়াত করেন, তাঁরা ঝামেলা এড়ানোর জন্য অন্য কোনো দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে ভ্রমণ করতে চান। ভিসা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েননি অথবা সময়মতো ভিসা পাননি, ভ্রমণরত এমন কম বাংলাদেশিই আছেন যাঁরা বাংলাদেশ পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করেন।
আন অফিসিয়াল হিসাবমতে বাংলাদেশের এক কোটি লোক বিদেশে বসবাস করেন। এর মধ্যে একটি অংশের আছে দ্বৈত নাগরিকত্ব অর্থাৎ বিদেশি পাসপোর্ট। বিদেশি পাসপোর্টধারী কিছু বাংলাদেশি আবার স্থায়ীভাবে বাংলাদেশেই বসবাস করছেন। চাকরি করছেন বা ব্যবসা করছেন। বিদেশি পাসপোর্টধারীদের অনেক বেশি সংখ্যককেই বাংলাদেশ ধরে রাখতে পারত এবং তা করতে পারলে ইনভেস্টমেন্টসহ আরো অনেক দিকেই বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল। কেননা বিদেশি পাসপোর্টধারী এসব বাংলাদেশি সংশ্লিষ্ট বিদেশে বেশ কিছুদিন বসবাস এবং কর্মদক্ষতা প্রয়োগ করেই সেই দেশের পাসপোর্ট লাভ করেছেন। ফলে সেসব বাংলাদেশি আর্থিকভাবে সচ্ছলতা লাভ করেছেন। তিনি যদি বাংলাদেশে বসবাস শুরু করেন তবে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক একটি লাভের দিকও বাংলাদেশের থাকবে এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু অনেক কারণে এই সুবিধা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যতম প্রধান একটি কারণ নিয়েই আজ লিখতে মনস্থ করেছি। আমি অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম না, তাই অর্থনীতির মারপ্যাঁচ বুঝি না। তবে সাদামাটাভাবে এটুকু বুঝি যে সারা পৃথিবীতে যে লাখ লাখ সচ্ছল, কর্মক্ষম এবং মেধাসম্পন্ন বাংলাদেশি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তাঁরা যদি বাংলাদেশে ইনভেস্ট করার সুযোগ পেতেন অথবা ফেরত আসার সুযোগ পেতেন তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারাটাই বদলে যেতে পারত। অর্থের সঙ্গে সঙ্গে মেধাও ফিরে আসত বাংলাদেশে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। রাষ্ট্রের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা নেই, কর্মদক্ষতা দেখানোর পরিবেশ ও সুযোগ নেই, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর ভরসা নেই, শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় জীবন ব্যবস্থার সঠিক মান নেই ইত্যাদি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভবত বড় কারণটি হলো আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনটি। পৃথিবীতে সম্ভবত আজকের মুক্তবাজারে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যার আছে কঠিন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রবাসী যে কেউ বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে পাঠাতে পারছেন। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ আছে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে মাত্র কিছু ক্ষেত্রে যেমন আমদানি করার ক্ষেত্রে, শিক্ষা ক্ষেত্রে শুধু ভর্তির ফি প্রদানে, বিদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে, বিদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এবং এমন আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাঠানো যায়। এর বাইরে কোনো বাংলাদেশিই কোনো বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাঠাতে পারেন না। বৈদেশিক মুদ্রার ওপর এমন শক্ত নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেই নেই। সরকার কেন বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের আইনটি শিথিল করছে না তার জবাব সরকারই দিতে পারে। সরকারের সব লোকেই বিদেশে যাতায়াত করেন এবং বিদেশে তাঁদের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অবলোকন করেন। তারপরও কেন তাঁরা শত বছরের পুরনো নীতি নিয়েই আছেন তা তাঁরাই ভালো জানেন। এটা খুলে দিলে দেশের কী ক্ষতি হতে পারে তা তাঁরাই বোঝেন। কিন্তু আমাদের চোখে ধরা পড়ে অন্য চিত্র। বৈদেশিক মুদ্রার কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণের ফলে আমাদের আমদানি ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেননা এলসি খোলার ব্যাপারে কড়াকড়ি বিধান থাকায় আমদানিকারকরা অনেক সময় আন্ডার ইনভয়েস করে ভিন্ন পথে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন। ভ্রমণের ক্ষেত্রে খুবই সামান্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার বিধান আছে এবং তা আবার বছরের সীমায় সীমাবদ্ধ করা। একজন ব্যবসায়ীর বছরে অনেকবার বিদেশে ভ্রমণ করার প্রয়োজন পড়ে এবং বরাদ্দকৃত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে একজন বড় ব্যবসায়ীর অসংখ্য ভ্রমণ খরচ সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে ওই ব্যবসায়ী কী করবেন? ভিন্ন পথে বৈদেশিক মুদ্রা নেওয়া ছাড়া তাঁর কাছে অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে বাংলাদেশে ব্যাংকের সুদের হার বেশি। এখানে শতকরা ১০-১২ সতাংশ সুদ লাভ করা যায় সাধারণ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। অন্যদিকে কানাডা-আমেরিকায় সুদের হার ১-৩ শতাংশ। প্রবাসীদের অর্থের একটি বড় অংশই তাঁরা ইচ্ছা করলে বাংলাদেশে প্রেরণ করে এখানে সঞ্চয় করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা তা করছেন না মূলত বৈদেশিক মুদ্রা বিষয়ে বাংলাদেশের কড়াকড়ি আইনের কারণে। কেননা তাঁরা যদি বাংলাদেশের চড়া সুদের সুযোগ নিতে চান তবে তাঁদের প্রেরিত অর্থকে বাংলাদেশি টাকায় বদলাতে হবে। আর সেখানেই সমস্যা। কেননা সেই টাকা তাঁরা ইচ্ছা করলেও কখনো বাংলাদেশ থেকে বাইরে নিতে পারবেন না। এই বাধ্যবাধকতার জন্য এবং যেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতির ওপর প্রবাসীদের আস্থার জায়গাটি সৃষ্টি হয়নি, তাই তাঁরা বাংলাদেশে টাকা এনে সঞ্চয় করার সাহস পাননি। বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ সরকার খুলে দিলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাসীদের মাধ্যামে বাংলাদেশে আসতে পারে এটা আজ কোনো কল্পনা নয়, এটি চরম এক বাস্তবতা।
বাংলাদেশ যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তখন বৈদেশিক মুদ্রাকে খোলাবাজারে ছেড়ে না দিয়ে শত বছরের পুরনো বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের মধ্যে তাকে আবদ্ধ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। উন্নতির পথে ধাবমান ভারতও ইতিমধ্যে এই সহজ সত্যটি অনুধাবন করে তাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা নীতিকে সহজ করেছে। সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, দুবাইসহ অসংখ্য দেশ আজ মুক্তবাজার অর্থনীতি ব্যবস্থায় তাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা নীতিকে খোলাবাজারে ছেড়ে দিয়ে অভূতপূর্ব উন্নয়নে সক্ষম হলেও আমাদের দেশটি আজও এর সুফল সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারছে না। তাই বাংলাদেশে প্রায়ই শোনা যায়, বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের কথা। ব্যবসা বা অন্য প্রয়োজনে বাংলাদেশ থেকে টাকা ঠিকই বাইরে যাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু তা যাচ্ছে বেআইনি রাস্তায়, তাই তার প্রাপ্ত লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। বিষয়টি তাই নতুন করে ভাববার সময় এসেছে আজ।
লেখক : কলাম লেখক ও ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ
No comments