উনি আসলে মহাপুরুষ by এজাজুল ইসলাম
১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত আমি রংপুর রেডিওতে কাজ করি। ১৯৮৫ সালে চাকরির সুবাদে ঢাকায় আসি। আমার মূল স্বপ্ন কিন্তু শুধু চাকরি ছিল না, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করার স্বপ্নটাই ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৯৮৯ সালে আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনের অভিনয়শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই।
কিন্তু অভিনয়ে যেহেতু আমার কোনো থিয়েটার অভিজ্ঞতা ছিল না, এবং ঢাকায়ও কোনো থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, তাই নির্মাতারা আমাকে তাঁদের নাটকে অভিনয় করানোর সাহস করতেন না। একসময় অনেক ঘোরাঘুরি করার পর যোগ্যতা নেই ভেবে আশাই ছেড়ে দিলাম।
এরপর আমি আবার পড়াশোনায় মনোযোগ দিই। পিজি হাসপাতালে নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে ভর্তি হই। পড়াশোনা শেষে ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক মো. আবদুল করিম স্যারের দপ্তরে সনদ আনতে যেতে হয়েছিল। সেখানে জানতে পারি তিনি তাঁর দপ্তরে নেই, আছেন হুমায়ূন আহমেদ স্যারের অফিসে, যিনি আমার স্বপ্নের মানুষ। সত্যি কথা বলতে কি, যখন জানতে পারলাম আবদুল করিম স্যারের সঙ্গে হুমায়ূন স্যারের অফিসে গিয়ে দেখা করে সনদ তোলার জন্য স্বাক্ষর আনতে হবে, তখন কিন্তু আমার কাছে সনদ তোলা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। আমার লক্ষ্যই ছিল আমার শ্রদ্ধেয় ও স্বপ্নের মানুষ হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সঙ্গে দেখা করা। ভাগ্যও সুপ্রসন্ন ছিল। হুমায়ূন স্যারের চেম্বারে যাওয়ার পর সহকারী পরিচালকের অনুমতি নিয়ে আমি ভেতরে যাই। আমার কিন্তু হাত-পা কাঁপছিল। গিয়েছিলাম আমার বিভাগের স্যারের সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু চেম্বারে যাওয়ার পর দেখলাম, আমার বিভাগের স্যারের চেয়ে হুমায়ূন স্যার আমার সঙ্গে অনেক বেশি কথা বলছেন। কথা প্রসঙ্গে হুমায়ূন স্যার জানতে চাইলেন আমি কোথায় থাকি? বললাম গাজীপুরে। তিনি বললেন, ‘আমি তো গাজীপুরে শুটিং করতে যাই। সময় থাকলে আমার সঙ্গে একটু থেকো।’ কথাটা শোনার পর আমার মনে হলো, আসমানের চাঁদ হাতে পেলাম। আমি অবাক হলাম এই ভেবে, স্যার, যাঁকে আমি স্বপ্নের মানুষ হিসেবে জানি, সেই তিনি কিনা আমাকে কাজের ফরমায়েশ দিচ্ছেন! এটাতে আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছিলাম।
তিন-চার দিন স্যার নিজেই আমাকে ফোন দিয়ে একটি সিরিয়ালের শুটিং করবেন বলে জানালেন। গাজীপুরের চৌরাস্তায় তখন আমার চেম্বার। তিনি শুটিং করেন গাজীপুরের মনিপুরে। শুটিংয়ের এক ফাঁকে আমি স্যারকে অনেকটা ভয়ে ভয়ে বললাম, স্যার আমি রংপুর বেতারে নাটিকাতে কাজ করতাম আর খবরও পড়তাম। তা ছাড়া আমি কিন্তু বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী। স্যার আমার কথাটা শুনে বেশ অবাক হলেন। বললেন, ‘বিষয়টি আমাকে আগে জানাওনি কেন?’ সঙ্গে সঙ্গে স্যার আমাকে ‘সবুজ সাথী’ সিরিয়ালে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। আর এই ছোট্ট অভিনয় দেখেই স্যার সন্তুষ্ট হন। তারপর স্যার কয়েকটি খণ্ডের একটি সিরিয়ালের কাজ শুরু করেন। খণ্ডে খণ্ডে নির্মিত এই সিরিয়ালটিতে কাজ করেছিলেন ফরীদি ভাই (হুমায়ুন ফরীদি), জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ। আর সেই অনুষ্ঠানে স্যার নতুন একটি ছেলেকে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। স্যার অনেকটা এভাবেই বলেছিলেন, ‘আমরা তো সারাক্ষণ জাহিদ-মাহফুজকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি, কিন্তু এমনও অনেক ছেলে আছে, যারা কিনা অনেক ভালো কাজ করে। আমি তেমনই একটি ছেলেকে দিয়ে এক খণ্ড নাটক করাব।’ এটি ছিল ‘বুনোর গল্প’। আর ছেলেটি ছিলাম আমি নিজে। এটা শোনার পর আমি আসলে কান্না ধরে রাখতে পারিনি। সেই থেকে শুরু।
আমার জীবনে যদি আজ পর্যন্ত যত সাফল্য, প্রাপ্তি বা যা কিছু করতে পেরেছি, এর ষোলো আনাই হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের জন্য। আমি এখন প্রায়ই ভাবি, আমার জীবন বৃথা হয়ে যেত যদি স্যারের সঙ্গে আমার দেখা না হতো। আমার জীবনে সবচেয়ে সুখের স্মৃতি, সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতি, সাফল্যের স্মৃতি সবই স্যারের সঙ্গে। আমি সবাইকে বলে থাকি, আমার জীবনের যে আসলে কোনো যে মূল্য আছে, তা স্যারের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই জানতে পেরেছি।
স্যারের সঙ্গে আমার আনন্দের স্মৃতি যদি বলি তবে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় নিয়ে নির্মিত ‘চৈত্রদিনের গান’ নাটকের কথা বলব। এটি আমার জীবনের সেরা আনন্দের স্মৃতি। ‘চৈত্রদিনের গান’ নাটকে একটি দৃশ্য ছিল যুদ্ধকালীন ইরাকের শিশুরা পানি খেতে পারছে না। তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর জন্য আমিও পানি খাওয়া বন্ধ করে দিই। দৃশ্যটা শেষ হওয়ার পর আমি সহকারী পরিচালককে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন হয়েছে। তখন পাশে তাকিয়ে দেখি স্যারের চোখে পানি। আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে আমি কী এমন অভিনয় করেছিলাম যে স্যারের চোখে পানি! এটা আসলে আমার আভিনয়জীবন এবং ব্যক্তিজীবনের সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি। এর চেয়ে বড় আনন্দ আজ পর্যন্ত আর হয়নি। আমার অভিনয় দেখে স্যার কাঁদছেন—এ আনন্দের কথা বলে বোঝানো আমার সম্ভব হবে না।
অনেকে স্যারকে বদরাগী মনে করতেন। স্যার আমাদের প্রায় বকা দিতেন। কিন্তু স্যারের এই বকাটা কিন্তু অনেক আদরের ছিল। স্যার যে কতটা বড় মনের মানুষ, তা স্যারের কাছে যাঁরা যাননি, তাঁদের আসলে বোঝনো যাবে না। স্যারকে আমি তুলনা করি বেলের সঙ্গে, শামুকের সঙ্গে। বেল ও শামুকের যেমন বাইরের শক্ত কিন্তু ভেতরেরটা নরম আর কোমল, স্যারও ছিলেন ঠিক সে রকমই।
স্যারের বিশ্বাসের কোনো জায়গায় আমি ছিলাম, তা একটি ঘটনার মাধ্যমে টের পাই। ১৯৯৬ সালে যখন ‘বুনোর গল্প’ নাটকের শুটিং করতে বাসে করে যাচ্ছিলাম, তখন স্যার আমাকে পেছন থেকে ডেকে বললেন, ‘ডাক্তার আমি একটা সুন্দর বাগানবাড়ি করতে চাই। এর মধ্যে অনেককে বলেছি। কিন্তু এবার পুরো দায়িত্বটা তোমাকে দিতে চাই। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নাই। তুমি আমাকে একটা বাগানবাড়ি করার জায়গা খুঁজে দাও।’ এটা যখন তিনি আমাকে বলেন, তখন আমার মনে হয়েছে আমার দেবতা আমাকে হুকুম করছে। তারপর আমি জায়গাটা নির্বাচন করলাম। তখন স্যারকে দেখার জন্য বললাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার পছন্দ হয়েছে তো?’ একই ঘটনা ঘটে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির শুটিংয়ে জমিদার বাড়ি বাছাইয়ের জন্য। আমি জমিদার বাড়ির খোঁজ দেওয়ার পর স্যার আমাকে একই কথা বললেন, ‘তোমার পছন্দ হয়েছে তো?’ তারপরও আমি বললাম, স্যার আপনি দেখবেন না। স্যার একই কথা বললেন, ‘তোমার পছন্দ হয়েছে তো?’ আমি বললাম, জি স্যার। স্যার আমাকে এতটাই বিশ্বাস করতেন!!!
হুমায়ূন আহমেদের মতো দেবতাতুল্য মানুষের কাছ থেকে আমার মতো একজন মানুষের এই বিশ্বাস ও ভালোবাসা অর্জনের পর এক জীবনে আর কিছু লাগে বলে আমার মনে হয় না। নাটকে অভিনয় করানোর ক্ষেত্রে স্যার আমাকে কীভাবে একটা ভালো চরিত্রে অভিনয় করানো যায়, সেটাই দেখতেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার প্রতি স্নেহ ও ভালোবাসা দেখানোর আর জায়গা স্যারের মধ্যে ছিল না।
স্যারের প্রতি আমার এত শ্রদ্ধা ছিল, তাই তাঁর সঙ্গে যেতে আমার ভয়ও হতো। তার পরও নুহাশপল্লী করার সময় রাস্তা খারাপ থাকার কারণে প্রায়ই স্যারের সঙ্গে রিকশায় ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছে। রিকশায় আমি বসলেও স্যারের গায়ের সঙ্গে লেগে যাবে, এ জন্য একটু জায়গা রেখে বসার চেষ্টা করতাম। কিন্তু স্যারের জন্য সেটা পারতাম না। মনে মনে ভাবতাম, আমি আর হুমায়ূন আহমেদ এক রিকশায়! তখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হত।
নানা করণে দেশের বাইরেও অসংখ্যবার গিয়েছি। কিন্তু আমার জীবনে স্যারের সঙ্গে সুইজারল্যান্ড আর নেপাল যাওয়ার মতো আনন্দ আর আসবে কি না, সন্দেহ। দেশের বাইরে অন্য সবার সঙ্গে যাওয়া আর স্যারের সঙ্গে যাওয়ার কাছে পৃথিবীর সব আনন্দ ম্লান।
আমি জীবনে অনেক নাটকে অভিনয় করেছি এবং করছি। তবে এর মধ্যে স্যারের নাটকের সংখ্যাই বেশি। আর তাই সবাই কিন্তু আমাকে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের অভিনয়শিল্পী হিসেবেই জানে। এ রকম অসংখ্য ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে। পেশাগত কাজের জন্য আমি একদিন মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছিলাম। আমার গাড়ির পেছনে একজন মন্ত্রীর গাড়ি। উনারা আমাকে কিন্তু কোনো হর্ন দিচ্ছেন না। তাঁরা আমাকে উল্টো যাওয়ার জায়গা করে দিলেন।
গত ১৬-১৭ বছরে যেখানেই গেছি, সবাই আমাকে দেখলেই বলে, ‘আপনি হুমায়ূন আহমেদের নাটক করেন না?’ রিকশায় উঠলে বলত, ‘স্যার হুমায়ূন আহমেদের নাটক করেন না?’ হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন মানুষ, যাঁকে আসলে সমাজের উঁচু স্তর থেকে শুরু করে নিচু স্তরের সবাই ভালোবাসে, মমতা করে। তাঁর মতো একজন মানুষের সান্নিধ্য পাওয়াটা আসলে এক জীবনে ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই বলব না। একটা মানুষের জনপ্রিয়তা কী পরিমাণ হতে পারে, তা হুমায়ূন স্যারের নাম বলার পর আর কারও নাম বলার সুযোগ নেই।
স্যারের আমি অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছি। বেশির ভাগ নাটকে আমি ভালো ভালো অনেক চরিত্র পেয়েছি। স্যারের একেকটা কাজ করা মানে একেকটা মাইলস্টোন অতিক্রম করা। শেষের দিকে আমি বেশ কয়েকটা নাটকে কাজ করতে পারিনি। এটা যে আমাকে কীভাবে তাড়িয়ে বেড়াত, সেটা বলে বোঝাতে পারব না। আমার মনে হয়েছে আরেকটি মাইলস্টোন ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। একটি কাজ হারানো মানে আমার জীবনের অনেক কিছুই হারানো মনে হতো।
পেশায় আমি চিকিত্সক হলেও হুমায়ূন আহমেদে স্যারের সঙ্গে পরিচয় আমার পুরো জীবনকে আলোকিত করেছে। আমি প্রায় আমার বন্ধুদের বলি, স্যারের সঙ্গে যদি আমার দেখা না হতো, তাহলে আমার জীবনের কোনো বৈচিত্র্যই থাকত না। একঘেঁয়েমি হতো আমার জীবন। হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সম্মোহন ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। দেখা গেল, আমি চিকিত্সা পেশায় ব্যস্ত থাকার কারণে নাটকের শিডিউল নিয়ে ঝামেলা হতো। একটানা তিন দিন ঢাকার বাইরে থাকাটা আমার জন্য অনেক ঝামেলার হতো। তাই আমি যেতেও চাইতাম না। তারপর স্যার যখন আমাকে ডেকে বলতেন, ‘নাটকের জন্য ঢাকার বাইরে আমাদের সাত দিন থাকতে হবে।’ অমি বলতাম, জি স্যার। ‘সাত দিন কিন্তু তুমি কোথাও যেতে পারবে না।’ জি স্যার। ‘সাত দিন কিন্তু তুমি কিছুই করতে পারবে না।’ বলতাম, জি স্যার। এটা শুনে অন্য সবাই হাসতো। আসলে কী এক সম্মোহনী ক্ষমতা যে উনার মধ্যে ছিল, সেটা আমি এখনো বুঝি না। উনি আসলে মহাপুরুষ।
অনুলিখন: মনজুর জিয়া
এরপর আমি আবার পড়াশোনায় মনোযোগ দিই। পিজি হাসপাতালে নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে ভর্তি হই। পড়াশোনা শেষে ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক মো. আবদুল করিম স্যারের দপ্তরে সনদ আনতে যেতে হয়েছিল। সেখানে জানতে পারি তিনি তাঁর দপ্তরে নেই, আছেন হুমায়ূন আহমেদ স্যারের অফিসে, যিনি আমার স্বপ্নের মানুষ। সত্যি কথা বলতে কি, যখন জানতে পারলাম আবদুল করিম স্যারের সঙ্গে হুমায়ূন স্যারের অফিসে গিয়ে দেখা করে সনদ তোলার জন্য স্বাক্ষর আনতে হবে, তখন কিন্তু আমার কাছে সনদ তোলা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। আমার লক্ষ্যই ছিল আমার শ্রদ্ধেয় ও স্বপ্নের মানুষ হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সঙ্গে দেখা করা। ভাগ্যও সুপ্রসন্ন ছিল। হুমায়ূন স্যারের চেম্বারে যাওয়ার পর সহকারী পরিচালকের অনুমতি নিয়ে আমি ভেতরে যাই। আমার কিন্তু হাত-পা কাঁপছিল। গিয়েছিলাম আমার বিভাগের স্যারের সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু চেম্বারে যাওয়ার পর দেখলাম, আমার বিভাগের স্যারের চেয়ে হুমায়ূন স্যার আমার সঙ্গে অনেক বেশি কথা বলছেন। কথা প্রসঙ্গে হুমায়ূন স্যার জানতে চাইলেন আমি কোথায় থাকি? বললাম গাজীপুরে। তিনি বললেন, ‘আমি তো গাজীপুরে শুটিং করতে যাই। সময় থাকলে আমার সঙ্গে একটু থেকো।’ কথাটা শোনার পর আমার মনে হলো, আসমানের চাঁদ হাতে পেলাম। আমি অবাক হলাম এই ভেবে, স্যার, যাঁকে আমি স্বপ্নের মানুষ হিসেবে জানি, সেই তিনি কিনা আমাকে কাজের ফরমায়েশ দিচ্ছেন! এটাতে আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছিলাম।
তিন-চার দিন স্যার নিজেই আমাকে ফোন দিয়ে একটি সিরিয়ালের শুটিং করবেন বলে জানালেন। গাজীপুরের চৌরাস্তায় তখন আমার চেম্বার। তিনি শুটিং করেন গাজীপুরের মনিপুরে। শুটিংয়ের এক ফাঁকে আমি স্যারকে অনেকটা ভয়ে ভয়ে বললাম, স্যার আমি রংপুর বেতারে নাটিকাতে কাজ করতাম আর খবরও পড়তাম। তা ছাড়া আমি কিন্তু বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী। স্যার আমার কথাটা শুনে বেশ অবাক হলেন। বললেন, ‘বিষয়টি আমাকে আগে জানাওনি কেন?’ সঙ্গে সঙ্গে স্যার আমাকে ‘সবুজ সাথী’ সিরিয়ালে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। আর এই ছোট্ট অভিনয় দেখেই স্যার সন্তুষ্ট হন। তারপর স্যার কয়েকটি খণ্ডের একটি সিরিয়ালের কাজ শুরু করেন। খণ্ডে খণ্ডে নির্মিত এই সিরিয়ালটিতে কাজ করেছিলেন ফরীদি ভাই (হুমায়ুন ফরীদি), জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ। আর সেই অনুষ্ঠানে স্যার নতুন একটি ছেলেকে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। স্যার অনেকটা এভাবেই বলেছিলেন, ‘আমরা তো সারাক্ষণ জাহিদ-মাহফুজকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি, কিন্তু এমনও অনেক ছেলে আছে, যারা কিনা অনেক ভালো কাজ করে। আমি তেমনই একটি ছেলেকে দিয়ে এক খণ্ড নাটক করাব।’ এটি ছিল ‘বুনোর গল্প’। আর ছেলেটি ছিলাম আমি নিজে। এটা শোনার পর আমি আসলে কান্না ধরে রাখতে পারিনি। সেই থেকে শুরু।
আমার জীবনে যদি আজ পর্যন্ত যত সাফল্য, প্রাপ্তি বা যা কিছু করতে পেরেছি, এর ষোলো আনাই হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের জন্য। আমি এখন প্রায়ই ভাবি, আমার জীবন বৃথা হয়ে যেত যদি স্যারের সঙ্গে আমার দেখা না হতো। আমার জীবনে সবচেয়ে সুখের স্মৃতি, সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতি, সাফল্যের স্মৃতি সবই স্যারের সঙ্গে। আমি সবাইকে বলে থাকি, আমার জীবনের যে আসলে কোনো যে মূল্য আছে, তা স্যারের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই জানতে পেরেছি।
স্যারের সঙ্গে আমার আনন্দের স্মৃতি যদি বলি তবে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় নিয়ে নির্মিত ‘চৈত্রদিনের গান’ নাটকের কথা বলব। এটি আমার জীবনের সেরা আনন্দের স্মৃতি। ‘চৈত্রদিনের গান’ নাটকে একটি দৃশ্য ছিল যুদ্ধকালীন ইরাকের শিশুরা পানি খেতে পারছে না। তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর জন্য আমিও পানি খাওয়া বন্ধ করে দিই। দৃশ্যটা শেষ হওয়ার পর আমি সহকারী পরিচালককে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন হয়েছে। তখন পাশে তাকিয়ে দেখি স্যারের চোখে পানি। আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে আমি কী এমন অভিনয় করেছিলাম যে স্যারের চোখে পানি! এটা আসলে আমার আভিনয়জীবন এবং ব্যক্তিজীবনের সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি। এর চেয়ে বড় আনন্দ আজ পর্যন্ত আর হয়নি। আমার অভিনয় দেখে স্যার কাঁদছেন—এ আনন্দের কথা বলে বোঝানো আমার সম্ভব হবে না।
অনেকে স্যারকে বদরাগী মনে করতেন। স্যার আমাদের প্রায় বকা দিতেন। কিন্তু স্যারের এই বকাটা কিন্তু অনেক আদরের ছিল। স্যার যে কতটা বড় মনের মানুষ, তা স্যারের কাছে যাঁরা যাননি, তাঁদের আসলে বোঝনো যাবে না। স্যারকে আমি তুলনা করি বেলের সঙ্গে, শামুকের সঙ্গে। বেল ও শামুকের যেমন বাইরের শক্ত কিন্তু ভেতরেরটা নরম আর কোমল, স্যারও ছিলেন ঠিক সে রকমই।
স্যারের বিশ্বাসের কোনো জায়গায় আমি ছিলাম, তা একটি ঘটনার মাধ্যমে টের পাই। ১৯৯৬ সালে যখন ‘বুনোর গল্প’ নাটকের শুটিং করতে বাসে করে যাচ্ছিলাম, তখন স্যার আমাকে পেছন থেকে ডেকে বললেন, ‘ডাক্তার আমি একটা সুন্দর বাগানবাড়ি করতে চাই। এর মধ্যে অনেককে বলেছি। কিন্তু এবার পুরো দায়িত্বটা তোমাকে দিতে চাই। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নাই। তুমি আমাকে একটা বাগানবাড়ি করার জায়গা খুঁজে দাও।’ এটা যখন তিনি আমাকে বলেন, তখন আমার মনে হয়েছে আমার দেবতা আমাকে হুকুম করছে। তারপর আমি জায়গাটা নির্বাচন করলাম। তখন স্যারকে দেখার জন্য বললাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার পছন্দ হয়েছে তো?’ একই ঘটনা ঘটে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির শুটিংয়ে জমিদার বাড়ি বাছাইয়ের জন্য। আমি জমিদার বাড়ির খোঁজ দেওয়ার পর স্যার আমাকে একই কথা বললেন, ‘তোমার পছন্দ হয়েছে তো?’ তারপরও আমি বললাম, স্যার আপনি দেখবেন না। স্যার একই কথা বললেন, ‘তোমার পছন্দ হয়েছে তো?’ আমি বললাম, জি স্যার। স্যার আমাকে এতটাই বিশ্বাস করতেন!!!
হুমায়ূন আহমেদের মতো দেবতাতুল্য মানুষের কাছ থেকে আমার মতো একজন মানুষের এই বিশ্বাস ও ভালোবাসা অর্জনের পর এক জীবনে আর কিছু লাগে বলে আমার মনে হয় না। নাটকে অভিনয় করানোর ক্ষেত্রে স্যার আমাকে কীভাবে একটা ভালো চরিত্রে অভিনয় করানো যায়, সেটাই দেখতেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার প্রতি স্নেহ ও ভালোবাসা দেখানোর আর জায়গা স্যারের মধ্যে ছিল না।
স্যারের প্রতি আমার এত শ্রদ্ধা ছিল, তাই তাঁর সঙ্গে যেতে আমার ভয়ও হতো। তার পরও নুহাশপল্লী করার সময় রাস্তা খারাপ থাকার কারণে প্রায়ই স্যারের সঙ্গে রিকশায় ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছে। রিকশায় আমি বসলেও স্যারের গায়ের সঙ্গে লেগে যাবে, এ জন্য একটু জায়গা রেখে বসার চেষ্টা করতাম। কিন্তু স্যারের জন্য সেটা পারতাম না। মনে মনে ভাবতাম, আমি আর হুমায়ূন আহমেদ এক রিকশায়! তখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হত।
নানা করণে দেশের বাইরেও অসংখ্যবার গিয়েছি। কিন্তু আমার জীবনে স্যারের সঙ্গে সুইজারল্যান্ড আর নেপাল যাওয়ার মতো আনন্দ আর আসবে কি না, সন্দেহ। দেশের বাইরে অন্য সবার সঙ্গে যাওয়া আর স্যারের সঙ্গে যাওয়ার কাছে পৃথিবীর সব আনন্দ ম্লান।
আমি জীবনে অনেক নাটকে অভিনয় করেছি এবং করছি। তবে এর মধ্যে স্যারের নাটকের সংখ্যাই বেশি। আর তাই সবাই কিন্তু আমাকে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের অভিনয়শিল্পী হিসেবেই জানে। এ রকম অসংখ্য ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে। পেশাগত কাজের জন্য আমি একদিন মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছিলাম। আমার গাড়ির পেছনে একজন মন্ত্রীর গাড়ি। উনারা আমাকে কিন্তু কোনো হর্ন দিচ্ছেন না। তাঁরা আমাকে উল্টো যাওয়ার জায়গা করে দিলেন।
গত ১৬-১৭ বছরে যেখানেই গেছি, সবাই আমাকে দেখলেই বলে, ‘আপনি হুমায়ূন আহমেদের নাটক করেন না?’ রিকশায় উঠলে বলত, ‘স্যার হুমায়ূন আহমেদের নাটক করেন না?’ হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন মানুষ, যাঁকে আসলে সমাজের উঁচু স্তর থেকে শুরু করে নিচু স্তরের সবাই ভালোবাসে, মমতা করে। তাঁর মতো একজন মানুষের সান্নিধ্য পাওয়াটা আসলে এক জীবনে ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই বলব না। একটা মানুষের জনপ্রিয়তা কী পরিমাণ হতে পারে, তা হুমায়ূন স্যারের নাম বলার পর আর কারও নাম বলার সুযোগ নেই।
স্যারের আমি অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছি। বেশির ভাগ নাটকে আমি ভালো ভালো অনেক চরিত্র পেয়েছি। স্যারের একেকটা কাজ করা মানে একেকটা মাইলস্টোন অতিক্রম করা। শেষের দিকে আমি বেশ কয়েকটা নাটকে কাজ করতে পারিনি। এটা যে আমাকে কীভাবে তাড়িয়ে বেড়াত, সেটা বলে বোঝাতে পারব না। আমার মনে হয়েছে আরেকটি মাইলস্টোন ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। একটি কাজ হারানো মানে আমার জীবনের অনেক কিছুই হারানো মনে হতো।
পেশায় আমি চিকিত্সক হলেও হুমায়ূন আহমেদে স্যারের সঙ্গে পরিচয় আমার পুরো জীবনকে আলোকিত করেছে। আমি প্রায় আমার বন্ধুদের বলি, স্যারের সঙ্গে যদি আমার দেখা না হতো, তাহলে আমার জীবনের কোনো বৈচিত্র্যই থাকত না। একঘেঁয়েমি হতো আমার জীবন। হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সম্মোহন ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। দেখা গেল, আমি চিকিত্সা পেশায় ব্যস্ত থাকার কারণে নাটকের শিডিউল নিয়ে ঝামেলা হতো। একটানা তিন দিন ঢাকার বাইরে থাকাটা আমার জন্য অনেক ঝামেলার হতো। তাই আমি যেতেও চাইতাম না। তারপর স্যার যখন আমাকে ডেকে বলতেন, ‘নাটকের জন্য ঢাকার বাইরে আমাদের সাত দিন থাকতে হবে।’ অমি বলতাম, জি স্যার। ‘সাত দিন কিন্তু তুমি কোথাও যেতে পারবে না।’ জি স্যার। ‘সাত দিন কিন্তু তুমি কিছুই করতে পারবে না।’ বলতাম, জি স্যার। এটা শুনে অন্য সবাই হাসতো। আসলে কী এক সম্মোহনী ক্ষমতা যে উনার মধ্যে ছিল, সেটা আমি এখনো বুঝি না। উনি আসলে মহাপুরুষ।
অনুলিখন: মনজুর জিয়া
No comments