নব ঘোষিত মুদ্রানীতি-মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কতটা সহায়ক

গত অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ১০.৬২ শতাংশের ধারাবাহিকতা কাটিয়ে সুপরিবর্তন প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। নতুন অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য ঘোষিত এই নীতিতে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনে ৭.৫ শতাংশ করার কৌশল অবলম্বন করেছে।


সংকোচনমূলক এই মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে বলা হয়েছে, বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রয়োজনেই এই অবস্থান নিয়েছে তারা। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, এতে করে ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ৭.২ শতাংশ অর্জনে সহায়ক হবে। আমরা বিগত সময়ের বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের একটি চিত্র দেখতে পারি। ২০১০ ও ২০১১ অর্থবছরে যেখানে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ ছিল ২৪.২ ও ২৫.৮ শতাংশ, সেখানে পরবর্তীকালে লক্ষ্যমাত্রাই করা হয় ১৬ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে তা ২ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়াকেও যথাযথ বলে মনে হয় না। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা তাই ১৮ শতাংশের বেশি হওয়ার দরকার ছিল। এতে করে অর্থনীতিতে সুপ্রভাব পড়তে পারত। বিনিয়োগ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল আসত। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রাই যেখানে বাড়েনি, সেখানে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সম্ভাবনার ক্ষেত্রটিও সংকুচিত না হয়ে পারবে না। চড়া সুদে ঋণ আদান-প্রদানের একটা ক্ষেত্র তৈরি হবে। চড়া সুদে ঋণ গ্রহণের কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়তে বাধ্য। এতে করে কি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব? গত বছর দুই অঙ্কের ঘর থেকে মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি যেসব কারণে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ আগের বছরের তুলনায় কমিয়ে আনা। এ বছরও যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা-ও সন্তোষজনক নয়। এর প্রভাব পড়বে উৎপাদন ব্যয়ে। কিন্তু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করে সরকারের গৃহীত পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি না সন্দেহ আছে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফ নির্দেশিত পথে প্রণীত নতুন মুদ্রানীতি ও সরকার গৃহীত পরিকল্পনা পরস্পর বিপরীতমুখী বলেও মনে হয়। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতিতেও স্থিতিশীলতা আনার প্রশ্নটি চলে আসে। নতুন মুদ্রানীতিতে প্রসঙ্গটি এসেছে। কিন্তু রেমিট্যান্স-মন্দা সৃষ্টির আশঙ্কা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, যা বিগত সময়ও আমাদের চোখে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমিয়ে আনা হলে সংগত কারণেই বাণিজ্য বৈষম্য হ্রাস করা সম্ভব হবে না। তিন মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করার ক্ষমতা অর্জনকে এ ক্ষেত্রে সন্তোষ প্রকাশের জন্য যথেষ্ট মনে করার সুযোগ নেই। আমরা দেখেছি, গত জানুয়ারি মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৯৪০ কোটি ডলারের নিচে চলে এসেছিল। যদিও পরবর্তীকালে তা এক হাজার ৩০ কোটি ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গটি নতুন মুদ্রানীতিতে গুরুত্বসহ বিবেচনা করা হয়েছে- এমন বক্তব্য এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। তাদের এই বক্তব্যের পেছনে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির বিষয়টি জড়িত। সরকারের ওপর জনগণের আস্থা অর্জন ও পরবর্তী সময়ে জনসমর্থন লাভের বিষয়টি জড়িত এখানে। সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কি সম্ভব হবে? গত বছর এক অঙ্কে মূল্যস্ফীতিকে ধরে রাখার চেষ্টা করেও তা পারা যায়নি। এবার এমন কোনো সুপরিবর্তনযোগ্য লক্ষণ আমাদের সামনে নেই, যা দেখে আমরা আশার আলো দেখতে পারি।
তবে মূল্যস্ফীতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি নিতে হলেও দরকার হবে ঋণের সুদের হারের লাগাম টেনে ধরার। তা না হলে জনদুর্ভোগ বেড়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.