চরাচর-বয়াতির হাট by স্বপন কুমার দাস
প্রতিদিন বিকেল হলেই নগরীর নানা প্রান্ত থেকে দু-চারজন করে এসে জড়ো হতে থাকেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে তাঁদের সংখ্যা শত ছাড়িয়ে যায়। স্থান সংকুলানের অভাবে কেউ কেউ ফুটপাতের ওপরই দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁদের মধ্যে বহুসংখ্যক নারীও দেখা যায়। এভাবে তাঁরা পার্টির জন্য অপেক্ষা করেন।
কখন পার্টি আসবে, বায়না হবে- তারপর অগ্রিম টাকা নিয়ে আসরে গাইতে যাবেন- সবার ভেতর এই ভাবনা। তাঁরা বয়াতি। প্রতিদিন মিরপুর শাহ আলী (রহ.) দরগার পাশে বয়াতিদের কার্যালয়ের সামনে তাঁদের দেখা যায়।
বয়াতিরা পীর, ফকির ও দরবেশদের দরগায় তাঁদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে এক ধরনের আধ্যাত্মিক গান পরিবেশন করেন, যা মারফতি ও মুর্শিদি গান নামে পরিচিত। বহুকাল আগে থেকে এ দেশের গ্রামগঞ্জে কবিগান বা জারিগানের প্রচলন ছিল। কালক্রমে বয়াতিদের পরিবেশিত মারফতি ও মুর্শিদি গান বা পালা গান সে স্থান দখল করে নেয়। এ গানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দুজন বয়াতি পালা করে নিজ নিজ দল নিয়ে সারা রাত গান করেন। একজন বয়াতি যে বিষয়ে গান করেন, অপরজন তাঁর বিপক্ষে গান করেন। এভাবে যাঁর যাঁর বিষয় নিয়ে গান এবং যুক্তিতর্ক দিয়ে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন এবং শেষের দিকে উভয়ে উভয়ের যুক্তি ও বিশ্বাসকে স্বীকার করে সমঝোতা করে চলার অঙ্গীকার করেন।
বয়াতিদের মূলত উত্থান ঘটে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। ঢাকা শহরে একসময় বিভিন্ন মাজার ও পীর-ফকিরের দরগায় ওরস-মাহফিলে কাওয়ালি গানের আসর বসত। কাওয়ালি গানের ভাষা ও সুর দুর্বোধ্য হওয়ায় এবং পঞ্চাশের দশকে মাতৃভাষা আন্দোলন বিস্তার ঘটায় বয়াতিদের পরিবেশিত মারফতি ও মুর্শিদি গান সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বয়াতি গানে নতুন মাত্রা যোগ হয়। এ সময় দেশের প্রায় প্রতিটি মাজার ও দরগায় বার্ষিক ওরস মাহফিলে মঞ্চ তৈরি করে রাতব্যাপী মারফতি-মুর্শিদি গানের আসর বসে। এ সময় বেশ কিছু সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিক গান রচিত হয়, যা বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁদের মধ্যে মালেক দেওয়ান, খালেক দেওয়ান, হালিম বয়াতি, শাহ আবদুল করিম, রহমান বয়াতি, হাসান চিশতি অন্যতম। তাঁরা গান লেখেন ও সুর দিয়ে পরিবেশন করে বিপুল যশ, খ্যাতি ও অর্থ আয় করেন। এভাবে পালা গান বাংলার সমৃদ্ধ সংগীত জগৎকে আরো সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় করে তোলে।
কিন্তু সংগীত ও ওরসবিরোধী এক শ্রেণীর লোক বয়াতিদের পেছনে লাগে। তারা গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে হাইকোর্টের বটতলা থেকে বয়াতিদের আস্তানা উচ্ছেদ করতে সমর্থ হয়। বাধ্য হয়ে বয়াতিরা ফুলবাড়িয়া সিটি করপোরেশন মার্কেটে কার্যালয় গড়ে তোলেন। পরে সেখান থেকে মিরপুর শাহ আলী (রহ.) মাজারের পাশে কার্যালয় গড়ে তোলেন। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বয়াতিরা দুঃসময়ের মুখোমুখি হন। নিরাপত্তার অজুহাতে সারা দেশে পালা গানের আসর বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় সাধারণ বয়াতিরা খেয়ে না খেয়ে কালাতিপাত করেন। কেউ কেউ সংগীত চর্চা বন্ধ করে দেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর তাঁদের আবার সুদিন ফিরে আসে। মিরপুরে এখন তাঁদের তিনটি কার্যালয়। বয়াতিদের কেউ কেউ এখন এক রাতের জন্য লাখ টাকা পারিশ্রমিক নেন। তাঁদের মধ্যে এখন বহু নারী বয়াতিও দেখা যায়।
স্বপন কুমার দাস
বয়াতিরা পীর, ফকির ও দরবেশদের দরগায় তাঁদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে এক ধরনের আধ্যাত্মিক গান পরিবেশন করেন, যা মারফতি ও মুর্শিদি গান নামে পরিচিত। বহুকাল আগে থেকে এ দেশের গ্রামগঞ্জে কবিগান বা জারিগানের প্রচলন ছিল। কালক্রমে বয়াতিদের পরিবেশিত মারফতি ও মুর্শিদি গান বা পালা গান সে স্থান দখল করে নেয়। এ গানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দুজন বয়াতি পালা করে নিজ নিজ দল নিয়ে সারা রাত গান করেন। একজন বয়াতি যে বিষয়ে গান করেন, অপরজন তাঁর বিপক্ষে গান করেন। এভাবে যাঁর যাঁর বিষয় নিয়ে গান এবং যুক্তিতর্ক দিয়ে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন এবং শেষের দিকে উভয়ে উভয়ের যুক্তি ও বিশ্বাসকে স্বীকার করে সমঝোতা করে চলার অঙ্গীকার করেন।
বয়াতিদের মূলত উত্থান ঘটে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। ঢাকা শহরে একসময় বিভিন্ন মাজার ও পীর-ফকিরের দরগায় ওরস-মাহফিলে কাওয়ালি গানের আসর বসত। কাওয়ালি গানের ভাষা ও সুর দুর্বোধ্য হওয়ায় এবং পঞ্চাশের দশকে মাতৃভাষা আন্দোলন বিস্তার ঘটায় বয়াতিদের পরিবেশিত মারফতি ও মুর্শিদি গান সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বয়াতি গানে নতুন মাত্রা যোগ হয়। এ সময় দেশের প্রায় প্রতিটি মাজার ও দরগায় বার্ষিক ওরস মাহফিলে মঞ্চ তৈরি করে রাতব্যাপী মারফতি-মুর্শিদি গানের আসর বসে। এ সময় বেশ কিছু সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিক গান রচিত হয়, যা বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁদের মধ্যে মালেক দেওয়ান, খালেক দেওয়ান, হালিম বয়াতি, শাহ আবদুল করিম, রহমান বয়াতি, হাসান চিশতি অন্যতম। তাঁরা গান লেখেন ও সুর দিয়ে পরিবেশন করে বিপুল যশ, খ্যাতি ও অর্থ আয় করেন। এভাবে পালা গান বাংলার সমৃদ্ধ সংগীত জগৎকে আরো সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় করে তোলে।
কিন্তু সংগীত ও ওরসবিরোধী এক শ্রেণীর লোক বয়াতিদের পেছনে লাগে। তারা গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে হাইকোর্টের বটতলা থেকে বয়াতিদের আস্তানা উচ্ছেদ করতে সমর্থ হয়। বাধ্য হয়ে বয়াতিরা ফুলবাড়িয়া সিটি করপোরেশন মার্কেটে কার্যালয় গড়ে তোলেন। পরে সেখান থেকে মিরপুর শাহ আলী (রহ.) মাজারের পাশে কার্যালয় গড়ে তোলেন। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বয়াতিরা দুঃসময়ের মুখোমুখি হন। নিরাপত্তার অজুহাতে সারা দেশে পালা গানের আসর বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় সাধারণ বয়াতিরা খেয়ে না খেয়ে কালাতিপাত করেন। কেউ কেউ সংগীত চর্চা বন্ধ করে দেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর তাঁদের আবার সুদিন ফিরে আসে। মিরপুরে এখন তাঁদের তিনটি কার্যালয়। বয়াতিদের কেউ কেউ এখন এক রাতের জন্য লাখ টাকা পারিশ্রমিক নেন। তাঁদের মধ্যে এখন বহু নারী বয়াতিও দেখা যায়।
স্বপন কুমার দাস
No comments