শিক্ষাঙ্গন-ছাত্ররাজনীতির নির্মমতা by কুদরাত-ই-খুদা
দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে বই-খাতার পরিবর্তে অস্ত্র হাতে ছাত্র নামধারীদের মধ্যে সংঘর্ষ, সংঘাত, হানাহানি ও খুনোখুনির ঘটনায় কেবল শিক্ষার্থী নয়, সর্বস্তরের মানুষই উদ্বিগ্ন ও বিচলিত। ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক প্রবণতা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চিরতরে মুক্ত করার দাবি এ দেশের সচেতন জনগণ অনেক আগে থেকে জানিয়ে এলেও
এখন পর্যন্ত ফলাফল শূন্য। নোংরা ছাত্ররাজনীতির কদর্য রূপ সর্বশেষ ১৬ জুলাই দেখা গেল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, যার শিকার হলেন ছাত্রলীগের কর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল হাসান ওরফে সোহেল রানা। এর আগে চলতি বছরের গত ১৬ মার্চ ছাত্ররাজনীতির নির্মমতায় মারা যান রুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবদুল আজিজ খান। শুধু তা-ই নয়, গত ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষে মারা যান ছাত্রশিবিরের নেতা মাসুদ বিন হাবিব ও মুজাহিদ। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরগুলোতে ছাত্ররাজনীতির শিকার হয়ে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরই ২৭ জন শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছাত্ররাজনীতির শিকার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবু বকর সিদ্দিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারুক হোসেন, শরিফুজ্জামান নোমানী, নাসরুল্লাহ্ নাসিম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুবায়ের, ঢাকা মেডিকেল কলেজে আবুল কালাম, রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে রেজানুর চৌধুরী সানি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিউদ্দিন মাসুমসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক ছাত্র অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। দূষিত এ ছাত্ররাজনীতির শিকার হয়ে অসংখ্য ছাত্র পঙ্গুত্বও বরণ করেছেন।
গত ১৮ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত তিন বছরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন ১৮ জন ছাত্র। গত ৪০ বছরে দেশের চারটি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন সব মিলিয়ে ১২৯ জন ছাত্র। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখন পর্যন্ত এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের এক শ্রেণীর কর্মী সন্ত্রাস, হামলা, ভাঙচুর, দখলদারি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঠিক যেমনটি ছাত্রদল ও শিবির করেছিল বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। এ যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
স্বাভাবিকভাবেই উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-গবেষণা চর্চায় ব্যস্ত থাকার কথা। মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে ছাত্রদের দেশ, জাতি ও সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করার কথা। কিন্তু যাঁদের এসব কাজে ভূমিকা রাখার কথা, আজ তাঁরাই জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করছে। এ সুযোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারাও তাঁদের দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার করছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেও ‘ছাত্র’ নামধারী এসব সন্ত্রাসী বরাবরই রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। ফলে শিক্ষাঙ্গনে তারা হত্যা, হামলা, ভাঙচুর, হল দখল, পদ দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাতে কোনো দ্বিধাবোধ করছে না। একটু লক্ষ করলে দেখা যায়, এসব ঘটনায় মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ, নষ্ট হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটি কোটি টাকার সম্পদ। তা ছাড়া এসব ঘটনার কারণে একদিকে যেমন দেশ-জাতি গঠনের জন্য যোগ্য ও উপযুক্ত নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না, তেমনি নানা দিক থেকে সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।
এ কথা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই যে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের সৃষ্ট অপকর্মের জন্য দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়নরত হাজার হাজার সাধারণ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত পথে ধাবিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করার পরিবর্তে কখন সংঘর্ষ বাধে—এ ভয়ে ও শঙ্কায় তটস্থ থাকতে হচ্ছে। তা ছাড়া এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ সেশনজটেরও শিকার হতে হচ্ছে। আর এ সেশনজটের কারণে ওই সব শিক্ষার্থীর অভিভাবকদেরও ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের লেখাপড়া করতে পাঠিয়ে অভিভাবকদের থাকতে হচ্ছে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার মধ্যে।
ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে তাদের বৃহত্তর স্বার্থেই সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কারণ, এ কথা সব রাজনৈতিক দলেরই স্মরণ রাখা দরকার, কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন কর্তৃক ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানো হলে সেই সংগঠনের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়। তা ছাড়া পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনে বা নির্বাচনে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে অপরাধী হিসেবে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যা যে অচিরেই ‘লয়’ (ধ্বংস) হবে।
কুদরাত-ই-খুদা: গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
kekbabu@yahoo.com
গত ১৮ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত তিন বছরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন ১৮ জন ছাত্র। গত ৪০ বছরে দেশের চারটি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন সব মিলিয়ে ১২৯ জন ছাত্র। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখন পর্যন্ত এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের এক শ্রেণীর কর্মী সন্ত্রাস, হামলা, ভাঙচুর, দখলদারি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঠিক যেমনটি ছাত্রদল ও শিবির করেছিল বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। এ যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
স্বাভাবিকভাবেই উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-গবেষণা চর্চায় ব্যস্ত থাকার কথা। মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে ছাত্রদের দেশ, জাতি ও সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করার কথা। কিন্তু যাঁদের এসব কাজে ভূমিকা রাখার কথা, আজ তাঁরাই জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করছে। এ সুযোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারাও তাঁদের দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার করছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেও ‘ছাত্র’ নামধারী এসব সন্ত্রাসী বরাবরই রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। ফলে শিক্ষাঙ্গনে তারা হত্যা, হামলা, ভাঙচুর, হল দখল, পদ দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাতে কোনো দ্বিধাবোধ করছে না। একটু লক্ষ করলে দেখা যায়, এসব ঘটনায় মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ, নষ্ট হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটি কোটি টাকার সম্পদ। তা ছাড়া এসব ঘটনার কারণে একদিকে যেমন দেশ-জাতি গঠনের জন্য যোগ্য ও উপযুক্ত নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না, তেমনি নানা দিক থেকে সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।
এ কথা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই যে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের সৃষ্ট অপকর্মের জন্য দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়নরত হাজার হাজার সাধারণ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত পথে ধাবিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করার পরিবর্তে কখন সংঘর্ষ বাধে—এ ভয়ে ও শঙ্কায় তটস্থ থাকতে হচ্ছে। তা ছাড়া এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ সেশনজটেরও শিকার হতে হচ্ছে। আর এ সেশনজটের কারণে ওই সব শিক্ষার্থীর অভিভাবকদেরও ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের লেখাপড়া করতে পাঠিয়ে অভিভাবকদের থাকতে হচ্ছে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার মধ্যে।
ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে তাদের বৃহত্তর স্বার্থেই সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কারণ, এ কথা সব রাজনৈতিক দলেরই স্মরণ রাখা দরকার, কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন কর্তৃক ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানো হলে সেই সংগঠনের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়। তা ছাড়া পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনে বা নির্বাচনে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে অপরাধী হিসেবে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যা যে অচিরেই ‘লয়’ (ধ্বংস) হবে।
কুদরাত-ই-খুদা: গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
kekbabu@yahoo.com
No comments