অলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারি-ছায়া ও আলো by মোবাশ্বির আলম মজুমদার
যেকোনো শিল্পকর্মের সৌন্দর্য তিনটি অবস্থান থেকে বিবেচনা করা যায়—আকৃতি, উপকরণ ও অভিব্যক্তি। শিল্পী ফকরুল ইসলামের আঁকা ছবি এ তিনের সমন্বয়ে শক্তি অর্জন করেছে। প্রকৃতির অন্তর্গত সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য ফর্মগুলো অতি সাধারণভাবে ছবিতে উপস্থাপন করেছেন। নিভৃতচারী শিল্পী ফকরুল ইসলাম সদ্যপ্রয়াত (৬ এপ্রিল)।
শিল্পীর ৩০টি শিল্পকর্ম নিয়ে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে ১০ জুলাই শুরু হয়েছে একক প্রদর্শনী। তাঁর সর্বশেষ একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় এই গ্যালারিতে, ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি। ফকরুল ইসলামের কাজে আলো-ছায়ার বিষয় বৈপরীত্যে স্পষ্ট। অন্ধকার ক্যানভাসের মাঝে আলোর উদ্ভাসন জ্যামিতির আনাগোনা, বুনট, কাগজের গায়ে লেপে দেওয়া তেলের নিজস্ব রং হয়ে ওঠে ছবির রং। তাঁর শিল্পকর্ম সম্পর্কে তিনি মনে করতেন: ‘দক্ষতা প্রমাণে আমি মোটেও সচেষ্ট নই। আমি যখনই দক্ষতা প্রমাণে সচেষ্ট হই, তখন তা শিল্প না হয়ে ওঠে শুধুই দক্ষতা।’ শুধু প্রকৃতির ফর্ম, আলো-ছায়া ছাড়াও বিষয় হিসেবে উলম্ব জ্যামিতির ছায়া, দরজা, জানালা, আয়তাকার আকৃতির ভেতরে বুনটের চলাচল ছবিতে তুলে এনেছেন তিনি সাবলীলভাবে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকা দেশ-এর ৫ মে, ২০০৫ সংখ্যায় শিল্পসমালোচক শোভন সোম ফকরুলের ছবির বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে, ফকরুলের প্রকৃতি জনমানবহীন, অনাহূত, অকৃত্রিম, ছবির সামনে দাঁড়ালে এই বোধ জাগে যে প্রকৃতির বিশালত্বের কাছে মানুষ কত তুচ্ছ, কত গৌণ এবং প্রকৃতির তুলনায় তার পরিমাপ কত ছোট। প্রকৃতির ছবিগুলোতে ফকরুল আলোর উপস্থিতির সঙ্গে বিষয়ের গড়ন তৈরি করেন। বক্সবোর্ডের ওপর ছাপার কালি লেপনের পর ধারালো ছুরি বা কাটারের সাহায্যে উলম্ব ও আড়াআড়ি কাটাকুটি করেন পরিকল্পিতভাবে। ছবির জমিনের সমস্ত পরিসরে রেখা ও বুনটের ব্যবহার থাকে না। দিনের আলো হারিয়ে যায় রাতের গাঢ় রঙে। প্রকৃতির মাঝে, গাঢ় অন্ধকারের মাঝে রেখার চলাচল তাঁর কাজে গতির সঞ্চার করেছে। প্রথাবদ্ধ তেলরং, জলরং, মিশ্রমাধ্যমের ব্যাকরণের প্রয়োগে ফকরুল বিশ্বাস করতেন না। তাঁর ছবি আঁকার মূল উপকরণ কাগজ, ছাপার কালি, সরষের তেল, লিনসেড অয়েল বা তিসির তেল। কাটাকুটির মাধ্যমে তৈরি করা এক পদ্ধতির বাইরে আরও এক নিরীক্ষা আমরা লক্ষ করি তাঁর কাজে। কাটাকুটি করা কাগজের স্তর উঠিয়ে তার ওপর আবার তেলের আস্তর দিয়ে কোথাও কোথাও আগুনের আঁচে পোড়া আবহ তৈরি করেছেন। এ ধরনের ইমেজ গোলাকৃতির, লম্বালম্বি, আড়াআড়ি তিন রকমের দেখা যায়। চীনে বৃত্তি নিয়ে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অধ্যয়নকালে চীনা আকৃতিগত প্রভাব ফকরুলের কাজে স্পষ্ট। তবে বিষয়ের দিক থেকে চীনা শিল্পকর্ম প্রভাব ফেলতে পারেনি। ফকরুলের কাজের বিষয় একেবারে স্বদেশি। প্রকৃতির আলো-ছায়ার ভেতরে সূক্ষ্ম ও সুন্দর জ্যামিতিক আকৃতির ঊর্ধ্বমুখে ছুটে চলা, এ যেন শিল্পীর মনের ভেতরে চলতে থাকা গতির প্রতীকও। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরেও ছবির প্রদর্শনীর আয়োজনে তিনি নিয়মিত ছিলেন। ২০টি একক প্রদর্শনীর পর টানা দুই বছর বেশ কিছু কাজের মধ্য থেকে বাছাই করা ৩০টি কাজের মধ্যে ইমেজ-২০ কাজটি একক বৃত্তাকার কাঠের খণ্ডের ইমেজ। বৃত্তের চারপাশে বহিঃরেখার সাহায্যে বন্দী হয়ে আছে অজস্র বিন্দুর সাহায্যে গড়ে ওঠা জমিন। ছবির রং হয়ে উঠেছে পোড়া কাগজের গায়ে গাঢ় সোনালি রং। ইমেজ সিরিজের কাজগুলোতে দুই ধরনের কৌশল প্রয়োগে ফকরুল স্থির হয়েছিলেন দীর্ঘ সময়। প্রদর্শিত কাজের মধ্যে নিসর্গ চিত্রের ভেতর জ্যামিতির অবস্থান ছবিতে আধাবাস্তবরূপ এনে দিয়েছেন। সূর্যাস্ত, বনবনানী, ঝড়, অস্থিরতা, দিনের আলোর শেষে রাতের শুরুকে ফকরুল উদ্যাপন করেন ছবিতে। সিরামিকস বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের পর চীনে যাওয়া। পরে ফিরে এসে ফকরুলের ছবি বদলে যায়নি, শিল্পীর ইমেজে যোগ হয়েছে আরও মনোযোগ। ছায়ায় ঢাকা ঘন বনানীর চঞ্চলতা থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজে একটি প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে—একজন শিল্পী প্রকৃতির কাছে কী খোঁজেন? কোন দিকে তাঁর গন্তব্য? এর উত্তর পাওয়া যায়নি। খেপা, অশান্ত, আত্মমগ্ন শিল্পীর হয়তো এই প্রশ্নটি মুখ্য হয়েছিল। তিনিও হয়তো ওই একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে গেছেন। এ প্রদর্শনী আমাদের এ কথাই জানায়। প্রদর্শনীটি শেষ হবে ২৪ জুলাই।
শিল্পী ফকরুল ইসলাম: জন্ম: ১৫ মে, ১৯৬৪। ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সিরামিকস বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন। ১৯৮৮-১৯৯০ পর্যন্ত চীনের বেইজিং থেকে বৃত্তি নিয়ে চিত্রকলায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ২০টি একক প্রদর্শনী ও আটটি উল্লেখযোগ্য কর্মশালা ছাড়াও অসংখ্য দলীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। ২০১২ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকায় পরলোক গমন করেন তিনি।
No comments