গোলটেবিল বৈঠক-শিশু সুরক্ষায় করণীয়
২৮ জুন ২০১২ প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘শিশু সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সহযোগিতায়ছিল ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’। এতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।
যাঁরা অংশ নিলেন
মেহের আফরোজ চুমকি
সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
তারানা হালিম
সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
নায়োমি কাননানগারা
পরিচালক, শিশু সুরক্ষা, সেভ দ্য চিলড্রেন
কাজী রিয়াজুল হক
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান
শাহ আলম
চেয়ারম্যান, আইন কমিশন
সাদেকা হালিম
সদস্য, তথ্য অধিকার কমিশন
এ এস এম আমানউল্লাহ
অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মো. ওমর ফারুক
উপসচিব, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়
কাজী জিয়াউদ্দিন
সহকারী মহাপরিদর্শক, পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স
মেহতাব খানম
অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সালমা আলী
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি
সারা যাকের
নাট্যব্যক্তিত্ব, প্রকল্প পরিচালক, সিসিমপুর
মুমিনুন নেছা
ভিকটিম সাপোর্ট এক্সপার্ট, পুলিশ রিফর্ম প্রোগ্রাম, ইউএনডিপি
এহছানুর রহমান
সহসভাপতি, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম
এম এম আমিনুল ইসলাম
শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
এ কে এম মাসুদ আলী
নির্বাহী পরিচালক, ইনসিডিন
সুমনা শারমীন
সাংবাদিক
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কমবেশি শিশু নির্যাতন হয়ে থাকে। আমাদের মতো দেশগুলোতে শিশুরা অতিমাত্রায় নির্যাতিত হয়। নানা সমস্যার মধ্যে শিশুদের দিন কাটে। শিশুরা গৃহে, কর্মক্ষেত্রে নির্যাতিত হচ্ছে। তাদের খেলার মাঠ নেই, টেলিভিশনে বিনোদনের সুযোগ নেই। ‘ডরিমন’ কার্টুন দেখে তারা হিন্দিতে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, অথচ এত সুন্দর এবং শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় কার্টুনটি বাংলায় করা হচ্ছে না। এক কথায়, শিশুদের বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ আমরা দিতে পারছি না। এ বিষয়ে আজ আলোচনা হবে। প্রথমে আলোচনার জন্য মেহের আফরোজ চুমকিকে অনুরোধ করছি।
মেহের আফরোজ চুমকি
শিশুদের কথা বললে একটি সুন্দর বাংলাদেশের চিত্র ভেসে ওঠে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ শিশু। সংবিধানের ২৮(৪) ধারায় সব ধর্ম-বর্ণের শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
আজকের প্রথম আলোয় একটা সংবাদ দেখলাম, শিশু আইনের খসড়ায় শিশুর বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করা হয়েছে। আমি খুবই বিস্মিত হয়েছি। আমি শিশুদের নিয়ে কাজ করছি এবং মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান। আমি বিষয়টি দেখব। শিশুদের বয়সসীমা ১৬ বছর থাকলে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এখানে অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁরা এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন। এই আলোচনা থেকে অনেক দিকনির্দেশনা বেরিয়ে আসবে এবং এর আলোকে আমরা আমাদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করব।
আব্দুল কাইয়ুম
আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এবার বলবেন নায়োমি কাননানগারা।
নায়োমি কাননানগারা
ভালো লাগছে যে আপনারা শিশু সুরক্ষার বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। আর এই অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত থাকতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি। আজকের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, দীর্ঘদিন ধরে সেভ দ্য চিলড্রেন বিশ্বব্যাপী শিশুদের সুরক্ষার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে, ১৯৮৯ সালের জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুদের অপব্যবহার, শোষণ, বঞ্চনা, সহিংসতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কীভাবে তাদের রক্ষা করতে হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেন বিশ্বে শিশু সুরক্ষার ব্যাপারে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। আমরা দুই ধরনের কাজ করি।
আমরা সব ধরনের নির্যাতন, শোষণ, অবহেলা ও বৈষম্য থেকে শিশুদের প্রতিরোধ করার জন্য কাজ করে থাকি এবং প্রয়োজনে সাড়া দিয়ে থাকি। এ ছাড়া জরুরি অবস্থায় শিশুদের নির্যাতন, সহিংসতা ও অপব্যবহার থেকে রক্ষা করার জন্য কাজ করে থাকি। শিশুদের জন্য যে আন্তর্জাতিক সনদ আছে, সব দেশ সেটা মেনে চলে। বাংলাদেশও শিশু সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা এবং বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করলে এ ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা অর্জন করা সম্ভব। আমরা কীভাবে সরকারের সঙ্গে কাজ করব, তার ভালো উপায় খুঁজছি। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি, একসঙ্গে কাজ করলে কমিউনিটি স্তরে নির্যাতন, সহিংসতাসহ সব দিক থেকে শিশুদের রক্ষা করা সম্ভব হবে।
এভাবে কমিউনিটি থেকে কাজ করতে করতে আমরা জাতীয় পর্যায়ে পরিবর্তন আনতে পারব। আমি বিশ্বাস করি, আজকের আলোচনা বাংলাদেশের শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করবে। বাংলাদেশে সেভ দ্য চিলড্রেন দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করছে এবং করে যাবে।
এ কে এম মাসুদ আলী
আমাদের দেশে শিশুদের জন্য কিছু আইন আছে। এ আইন আসলে শিশু সনদের প্রতিফলন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাইভাক নামে শিশুদের জন্য একটি আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। আফগানিস্তানসহ এই সংগঠনের সব দেশ বলছে যে তারা সব ধরনের শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি উদ্যোগ গ্রহণের জন্য একমত পোষণ করেছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব নিজ উদ্যোগে বিশ্বে শিশুদের অবস্থা কী, সে বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। এটা হচ্ছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক অবস্থা নির্ধারণের জন্য একটি মাইলফলক গবেষণা।
আজকে বিশ্বায়ন নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রযুক্তিকে সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে উন্মুক্ত করেছে। কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। দেশীয় একটি শিশু প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব পরিমণ্ডলের সাইবার বা কাল্পনিক জগতে প্রবেশ করছে। তাদের অনেকে অনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এতে শিশুদের মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হচ্ছে। রাষ্ট্র, সংগঠন, এমনকি জাতিসংঘ—কেউ এই বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করেনি। তবে এখানে আশার কথা হলো, এখন বিশ্বব্যাপী শিশুরা সংগঠিত হচ্ছে। শুধু আইন ও রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার সময় শেষ হয়েছে। এখন শিশুদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য সামাজিক আন্দোলনের চাহিদা তৈরি হয়েছে। এই সামাজিক আন্দোলন ছাড়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বড় সংগঠন কাউকে কাছে পাওয়া যাবে না। সেভ দ্য চিলড্রেনকে ধন্যবাদ জানাব একটি সামাজিক পরিসরে বিষয়টি আলোচনার আয়োজন করার জন্য।
আব্দুল কাইয়ুম
তারানা হালিম শিশুদের নিয়ে অনেক কাজ করেছেন, তাঁকে বলার জন্য অনুরোধ করছি।
তারানা হালিম
শিশুদের জন্য অনেক কিছু করার আছে। সংসদে থাকায় শিশুদের নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা কাজে লাগাতে পারছি। যেমন: আমার একটি দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল স্কুল ফিডিং কর্মসূচির। স্বল্প পরিসরে হলেও সেটা বাস্তবায়ন করা গেছে। গৃহে শিশুদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই আমি কাজ করে যাচ্ছি। সংসদে এসে এ ব্যাপারে আইন পাসের ক্ষেত্রে ভূমিকা নিয়েছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন মা এবং নারী হওয়ায় তিনি সবকিছু মানবিক দৃষ্টি দিয়ে দেখেন। এ জন্য অটিজমের ওপর আমরা অনেক বেশি কাজ করতে পেরেছি। শিশুদের জন্য স্কুল অবৈতনিক করা হয়েছে। এতিমদের জন্য ভাতা বাড়ানো হয়েছে। উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। শিশুমৃত্যুর হার কমাতে পেরেছি। তার পরও যা করতে পারিনি, মনে হয় তা-ই আজকে আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত।
এ ক্ষেত্রে প্রথমত আমার মনে হয়, আমরা এমন একটি দেশের নাগরিক, যেখানে আইনের অভাব নেই। কিন্তু প্রয়োগ হয় না বললেই চলে। আমি ওয়েল্ডিংসহ বিভিন্ন কারখানায় গিয়ে দেখেছি, সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, গরমে মাথার ওপর ফ্যান নেই, সময়ের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। আরও নানা সমস্যা। অথচ আইনে বলা আছে, মালিককে শ্রমিকের কাজের পরিবেশ দিতে হবে। এখানে আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। আজকে অসংখ্য শিশু মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে। আইনের প্রয়োগ নেই। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মেয়েদের ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছরের আগে বিয়ে হলে তারা শাস্তির আওতায় আসবে। বিবাহটা কিন্তু বৈধ থেকে যাচ্ছে। ফলে মেয়েটি স্বামিত্বের দাবি নিয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে যাচ্ছে। আমরা স্বীকার করি আর না করি, দেশে যৌনকর্মী আছে। তাদের সন্তানেরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে সামাজিক সুবিধা থেকে। তাদের জন্য কিছু করার উদ্যোগ গ্রহণ করছি। আপনারাও এদিকে এগিয়ে আসুন।
আব্দুল কাইয়ুম
জেনে ভালো লাগল, তারানা হালিম শিশুদের জন্য নিজেই কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এবার শুনব সাদেকা হালিমের কাছ থেকে।
সাদেকা হালিম
তারানা হালিমকে অনেক ধন্যবাদ। কারণ, কোনো সাংসদের মুখ থেকে যৌনকর্মীদের কথা শোনা যায় না। আমরা শিশু সুরক্ষার কথা বলছি। ২০০৫ সালের মধ্যে শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছি। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব শিশু ঝরে পড়ছে, তাদের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা শিশুদের এখনো সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারিনি। আরও একটি আতঙ্কের বিষয় হলো, যদি শিশুদের বয়সসীমা ১৮ থেকে ১৬তে নেমে আসে, তাহলে গ্রামে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসবে। বিবাহের ক্ষেত্রে কাজিরা দুটো রেজিস্টার রাখেন। একটাতে তাঁরা বয়স কম হলে ১৮ লেখেন। অন্যটিতে ঠিক বয়স লেখেন। স্থানীয় সাংসদেরাও কাজিদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানেন। আইন মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫৯ শতাংশ শিশুর কোনো তথ্যই আমরা জানি না। ৪১ শতাংশ শিশুর কোনো খাদ্য, আশ্রয় ও শিক্ষা নেই। সামাজের অসমতা শিশুদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ব্রাজিলসহ অনেক দেশের কাছাকাছি আমাদের প্রবৃদ্ধি। কিন্তু সমতাহীনতা এত বেশি যে একটা শ্রেণী আমাদের প্রবৃদ্ধিকে গ্রাস করে ফেলছে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কথা বলছি। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত আনিলা নামের এক মেধাবী অটিজম মেয়েকে একটি নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করাতে পারছি না। স্কুলের প্রধান দায়িত্বে আছেন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক। যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী সব প্রতিবন্ধী শিশুর কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন, সেখানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক তাদের স্কুলে ভর্তি করতে চাইছেন না। তাহলে অন্যদের থেকে কী আশা করা যেতে পারে, এ থেকে সেটি সহজে বোঝা যায়। লালবাগ থানায় শিশুদের ধর্ষণসহ ২৫টি ঘটনার তদন্ত করেছিলাম। তখন শিশুরা বলেছিল, ওয়ার্ড কমিশনার থাকলে আমরা কোনো কথা বলব না। কারণ, তাঁর উপস্থিতিতে সরাসরি কিছু বলতে তারা নিরাপদ বোধ করে না। এসব বিষয়ে আমাদের চোখ বন্ধ করে থাকার সময় শেষ হয়ে এসেছে।
সালমা আলী
শারীরিক ও মানসিক বিভিন্নভাবে শিশুরা নির্যাতিত হচ্ছে। আমি বিশেষভাবে দুই ধরনের শিশুর কথা বলতে চাই। ঝুঁকিপূর্ণ শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। শিশুরা ঘরে-বাইরে সব জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। শিশুদের প্রতি সরকার ও মা-বাবা উভয়ের দায়িত্ব রয়েছে। কোনো শিশুকে সুরক্ষার জন্য কেস করলে তখন আবার তার পরিবার বা কমিউনিটি থেকে কেস তুলে নেওয়ার চাপ আসে। শিশু সুরক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি সমস্যা। শিশুর কাজের একটা বয়সসীমা নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে।
পারিবারিক সুরক্ষা আইনের নিয়মাবলি এখনো তৈরি হয়নি। এই সরকার অনেক ভালো আইন করেছে। শিশু পাচার প্রতিরোধ ও পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আইন হয়েছে। ভবঘুরে আইন হচ্ছে। ভবঘুরে নামটি পরিবর্তনের কথা বলেছি। বাল্যবিবাহের আইন আছে, সেটা মানা হচ্ছে না। আমি জনস্বার্থে মামলা করেছি। সেখানে কাবিননামার কয়েকটি জায়গায় পরিবর্তনের কথা বলেছি। বিয়ের সময় অবশ্যই ভোটার আইডি কার্ড জমা দেওয়ার কথা বলেছি। এই দুটি কাজ করতে পারলে কাজিদের বাল্যবিবাহ করানোর সুযোগ কমে যাবে। সর্বোপরি বাবা-মায়ের ভালো আচরণ থেকে শুরু করে শিশুদের কাজকর্ম ও বিনোদনের ক্ষেত্রগুলো সুরক্ষিত করতে পারলে শিশু সুরক্ষা হবে বলে আশা করি।
কাজী রিয়াজুল হক
স্বাধীনতার মাত্র দুই বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিশু ও নারীদের জন্য আইন করেছিলেন। সে সময় পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও এ রকম আইন ছিল না। শিশু অধিকারবিষয়ক সিআরসিতে, ২০১২ সালের প্রস্তাবিত আইনে সব জায়গায় শিশুদের বয়সসীমা ১৮ ধরা হয়েছে। হঠাৎ করে সংশ্লিষ্ট অনেকের অজান্তে কীভাবে বয়সসীমা ১৬ হলো, সেটা ভাবনার বিষয়। আমরা প্রতিটি থানায় শিশুবান্ধব কর্মকর্তা থাকার প্রস্তাব করেছি।
আমাদের দেশে শিশুকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করার বয়স নয় বছর। কিন্তু আমরা বলেছি, কোনো শিশুকে ১২ বছরের আগে হাজত বা জেলে নেওয়া যাবে না। শিশুদের সরাসরি বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা যাবে না। শিশুদের বিচারিক ব্যবস্থা হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে যে শিশু উন্নয়নকেন্দ্র আছে, তার প্রাচীরের উচ্চতা কিন্তু জেলখানার প্রাচীর থেকে উঁচু। এই প্রাচীরের মধ্যে কীভাবে তার মানসিক ও শারীরিক বিচার হবে, সেটা বুঝতে কষ্ট হয়। আমার প্রস্তাব হলো, শিশুর সব প্রক্রিয়া হবে শিশুবান্ধব ও বন্ধুসুলভ।
আব্দুল কাইয়ুম
ড. শাহ আলম হয়তো বলতে পারবেন শিশুদের বিষয়ে আইন ও আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করার কথা।
শাহ আলম
প্রথমে বলে নিই, আইন কমিশন এখনো পর্যন্ত শিশুবিষয়ক আইন নিয়ে কোনো কাজ করেনি। তবে আমাদের কিছু কাজ হয়েছে, যেগুলো পরোক্ষভাবে শিশুদের প্রভাবিত করে। আমি জনকণ্ঠ পত্রিকার একটা খবরে দেখলাম, আমাদের পথশিশুদের সংখ্যা ১০ লাখ। এই ১০ লাখ শিশু অমানবিক জীবন যাপন করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এদের জন্য সরকার অতি সত্বর কী করছে। সব ক্ষেত্রে বয়সসীমা ১৮ বছর প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ১৮ বছরকে ঠিক রেখে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে পারে। আইন যথেষ্ট আছে। আমাদের দেশে আইনের অভাব নেই। আইনের প্রয়োগই বড় কথা। আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকলে শিশুদের অধিকার রক্ষা করা যাবে না।
মুমিনুন নেছা
হঠাৎ করে শিশুদের বয়সসীমা ১৬তে নেমে আশায় খুবই হতাশ হয়েছি। আরেকটি কথা শোনা যায়, ইদানীং আমাদের শিশুরা বেশি অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। দেশে তিনটি কিশোর উন্নয়নকেন্দ্র আছে—একটি মেয়েদের, দুটি ছেলেদের। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বছরে ৪০০ থেকে ৫০০ ছেলেমেয়ে এই কেন্দ্রগুলোতে আসে। তাদের মধ্যে সবাই আবার অপরাধী নয়। তাহলে শিশুরা যে বেশি অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠিক নয়। গত তিন বছরে আমরা ৩৫ জন শিশুকে রক্ষা করতে পেরেছি। এর জন্য আমাদের অনেক সমস্যা হয়েছে। যেমন: আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করে পুনর্বাসন করতে হয়েছে। তার ওপর প্রতিবন্ধী শিশুদের কেউ নিতে চায় না। ১০ লাখ পথশিশুর ব্যাপারে আমার মত হলো, এরা কোনো রকমেই পথশিশু নয়।
এদের কোনো না কোনো অভিভাবক আছেন। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হলো, প্রায় ১০ থেকে ১৫ বছর পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে উটের জকি হিসেবে ব্যবহূত ১১৫টি শিশু বাংলাদেশে ফিরে আসে। তখন তাদের প্রত্যেককেই অভিভাবকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। আমাদের কমিউনিটি-ভিত্তিক শিশু সুরক্ষার কর্মসূচি নিতে হবে। এর জন্য একটা গাইডলাইন করেছিলাম। এখন সেটা কী অবস্থায় আছে জানি না। শিশুদের সুরক্ষার ব্যাপারে সবাইকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
এহছানুর রহমান
আমাদের শিশুনীতি ও সিআরসির মধ্যে শিশু সুরক্ষার বিষয়ে আলাদা আলাদা অনুচ্ছেদ আছে। গত বছর ইউনিসেফের বিশ্ব শিশুবিষয়ক প্রতিবেদনে চারটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। যেমন: শিশুদের সহিংসতা, বাল্যবিবাহ, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ ও গমনাগমন (ট্রাফিকিং)। কমিউনিটি-ভিত্তিক শিশু সুরক্ষার বিষয়টি এখন জরুরি। কমিউনিটি-ভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কী হতে পারে? কমিউনিটিতে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সংগঠন আছে। এরা শিশুদের বিষয়ে কথা বলছে। এরা সহিংসতা, বাল্যবিবাহসহ বিভিন্ন বিষয় প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। তবে এটি বড় আকারে আমাদের দেশে এখনো শুরু হয়নি।
একে একটি সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে আনতে হবে। শিশু অধিকার ফোরামসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে শিশু-সাহায্যের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভুক্তভোগী শিশুর সাহায্য নেওয়ার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকা দরকার, সরকারের সেটা নেই। কমিউনিটি থেকে সুরক্ষা শুরু করতে হবে। তাহলে ব্যবস্থাটি পরিবারে, নিয়োগকারী মালিকদের কাছে—সব জায়গায় পৌঁছে যাবে। সব শেষে বসয়সীমা ১৬ বছরের বিরোধিতা করছি।
এ এস এম আমানউল্লাহ
বাংলাদেশে শিশুনীতি ও আইনের সহিংসতা চলছে। ১৯৭৪ ও ২০১১ সালের শিশু আইন এবং নারী ও শিশু অধিকার আইনের মধ্যে প্রচণ্ড বৈষম্য রয়েছে। ১৯৮২ সালের আইএলও, রিয়াদ ও হাভানা সম্মেলনকে বাংলাদেশ সমর্থন করেছিল। কিন্তু এর প্রয়োগ, নীতি ও নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে না। দেশে শিশুর ক্ষেত্রে একধরনের নীতি ও আইনি সহিংসতা চলছে। থানার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, শিশুদের জন্য পৃথক হাজতখানা নেই। বয়স্ক অপরাধীদের সঙ্গে তাদের জেলে আনা-নেওয়া করা হয়। একই সঙ্গে হাতকড়া পরানো হচ্ছে। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় শিশুবান্ধব বিচারব্যবস্থা চাই। নোটারি পাবলিকের বিষয়টি এখানে কেউ আনেননি। তারা অনেক শিশুর বয়স ১৮ বছরের বেশি হিসেবে প্রত্যয়ন করে। এভাবে বয়স বাড়িয়ে অনেক শিশুকে যৌন কাজে নিয়োজিত করা হয়।
এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে সবার ভাবা উচিত। শিশুদের পর্নোগ্রাফি নিয়ে আমার একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরে মাসে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার পর্নোগ্রাফি শিশুরা ডাউনলোড করে। এবং স্কুলে বসে এগুলো দেখে। কথা হচ্ছে, পর্নোগ্রাফি আইন ও রুলস যেটা করা হলো, তার শিশুবান্ধব কোনো প্রয়োগ আমরা দেখতে পেলাম না। আরেকটি বিষয় হলো, দেশে প্রচুর পরিমাণে মাদক (ড্রাগস) আসছে। ইয়াবায় বাজার ছেয়ে গেছে। ইদানীং আবার সেনেগ্রাসহ নতুন নতুন ড্রাগ যুক্ত হচ্ছে ইয়াবার সঙ্গে। ঢাকায় মাসে ১০ থেকে ১২ লাখ পিস ইয়াবার চাহিদা রয়েছে। শিশুদের মধ্যে এই চাহিদা বেশি। এ ক্ষেত্রে আইন, নীতি—সবই আছে। কিন্তু প্রয়োগের অভাবে শিশুরা ইয়াবার রাজ্যে ডুবে আছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য এখনই আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে। তা না হলে আমরা বড় রকমের সংকটের মুখে পড়ে যাব।
এম এম আমিনুল ইসলাম
অন্যদের মতো শিশুদের বয়সসীমা ১৬ বছর কোনোভাবে মানি না। শিশু সুরক্ষার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বলতে চাই, জাতীয় ও কমিউনিটি পর্যায়ে দুই জায়গাতেই বাংলাদেশে আদৌ শিশু সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা আছে কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি প্রশ্ন করি, কে শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি দেখে? মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়? সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়? না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়? এই প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না।
জাতীয় নারী ও শিশুবিষয়ক পরিষদমণ্ডলী আছে। আমার জানামতে, গত দুই বছর সেখানে কোনো সভা হয়নি। আর ওই পরিষদের ৯০ শতাংশ কথা হয় নারীকে নিয়ে। তারপর শিশুদের কথা আসে। যে কারণে শিশুদের বয়স যখন ১৮ থেকে ১৬ হয়ে যায়, তখন নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি সেটা জানতে পারেন না। বাজেটের ১২ থেকে ১৫ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ। এখানেও শিশুদের জন্য কিছু নেই। মাত্র শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ শিশুর জন্য বরাদ্দ। দারিদ্র্যের জন্য বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম হয়। দারিদ্র্য বিমোচনে বরাদ্দ পর্যাপ্ত নেই। সবকিছু মিলিয়ে শিশুদের বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে।
আব্দুল কাইয়ুম
এবার গণমাধ্যমে শিশুদের সমস্যা ও প্রতিকারের প্রতিফলন কতটুকু ঘটে, সে বিষয়ে বলবেন সুমনা শারমীন। নারী-শিশু বিষয়ে তাঁর অনেক লেখা বেরিয়েছে।
সুমনা শারমীন
আমাদের ফিচার পাতায় শিশুদের জন্য অনেক কিছু থাকে। দরকার হলে আরও কিছু করতে পারি। কিন্তু মূল পাতায় তেমন কিছু থাকে না। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সব পত্রিকা মিলে মূল পাতায় শিশুদের জন্য খবর থাকে ৩ শতাংশ। এগুলো আবার সব দুর্ঘটনাজনিত খবর। যেমন: কেউ পানিতে পড়ে গেছে; কাউকে সাপে কেটেছে; কেউ অপরাধ ও সহিংসতার শিকার; কেউ আবার অগ্নিদগ্ধ ইত্যাদি। অর্থাৎ শিশুকে খবর হতে হলে হয় তাকে অপরাধী হতে হবে, অথবা মানবিক বিপর্যয়ে পড়তে হবে। এমন মন খারাপ করা খবর আমরা ছাপতে চাই না। ইদানীং শিশুদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো খুব স্পর্শকাতর খবর ছাপতে হচ্ছে। এখন শিশুরা হয়েছে মুক্তিপণের পণ্য। তার অপরাধ? অপরাধ হলো, বাবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে কিছু টাকা এনেছেন। অপরাধ হলো, বাবার সঙ্গে জমিজমা নিয়ে পাশের বাড়ির বিরোধ। অপরাধ হলো, শিক্ষক তাকে পড়াতেন। অপরাধ হলো, বাবার ঢাকা শহরে বাড়ি আছে। তিনি অনেক টাকা ভাড়া পান। এ রকম অনেক ঘটনা আছে।
এসব খবর ছাপার সময় ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। কারণ, এদের ছবি ছাপা যায় না। মা-বাবার সঙ্গে কথা বলা যায় না। তাঁরা চিৎকার করে সন্তানের জন্য আহাজারি করতে থাকেন। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, সাংবাদিক এবং পুলিশও এই নৃশংসতার বাইরে নয়। আমাদেরই এক সাংবাদিকের বোনের সন্তানকে অপহরণ করা হয়েছে। এই পরিবারে পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আছেন। সাংবাদিক, পুলিশ—সবাই খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু ফোন করে বলছে, এখানে টাকা রেখে যাও, ওখানে টাকা রেখে যাও। টাকাও রাখা হচ্ছে, কিন্তু শিশু ফিরে আসছে না। পরদিন একটি কবরস্থানে তাকে এমনভাবে পাওয়া গেল যে শিশুটি আর কোনো দিন মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। আমরা খুব কাছ থেকে এই পরিবারটির হাহাকার দেখেছি। দেখেছি সন্তান হারানোর কী বেদনা! শিশু সুরক্ষার বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। আমি মনে করি, অন্যদের মতো সাংবাদিকদেরও এ ক্ষেত্রে অনেক দায়িত্ব রয়েছে। আমরা প্রথম আলো এ ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা মেনে চলার চেষ্টা করি।
সারা যাকের
শিশু সুরক্ষা ও করণীয় নিয়ে আলোচনা শুনলাম। ১৯৭৪ সালে আমাদের দেশে শিশু সুরক্ষার আইন ছিল। আবার ২০১২ সালে নতুন করে হবে। আইন, নীতি, নিয়ম—সবই প্রয়োজন। এবং সেটা আছেও। শুধু নেই প্রয়োগ। এর সঙ্গে যুক্ত করতে চাই অ্যাডভোকেসি ও সচেতনতা। দেশব্যাপী শিশু সুরক্ষার বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। তাহলে মানুষ এসব বিষয়ে জানতে ও বুঝতে পারবে।
এ ক্ষেত্রে শিশুদের প্রতি সহিংসতা কমে আসবে। পাশাপাশি সুরক্ষা জোরদার হবে। আরেকটি বড় বিষয় হলো, শিশুদের মাদক গ্রহণ, অপব্যবহার, পর্নোগ্রাফি, সহিংসতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ হচ্ছে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এগুলো সামাজিক আন্দোলন হিসেবে সামনে না আসবে, ততক্ষণ ফলপ্রসূ কিছু অর্জিত হবে না। আমি মনে করি, সেভ দ্য চিলড্রেন ও অন্য যারা কাজ করছে, সে ক্ষেত্রে কাজের পরিধি বাড়বে। কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দরকার সামাজিক আন্দোলন।
মেহতাব খানম
বারবার শুধু সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলি। আমার কাছে মনে হয়, পরিবারই সব। আমাকেসহ সব বাবা-মাকে বলতে চাই, আমরা মা-বাবা হওয়ার যোগ্যতা রাখি কি না। চাল-চুলা নেই, এমন মা-বাবা পাঁচ থেকে সাতটি সন্তান পৃথিবীতে এনেছেন। প্রত্যেক সন্তানকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে দিয়ে নিজেদের আয়ের হাতিয়ার বানিয়েছেন। শুধু দরিদ্ররা নয়, সবাই নিজেদের স্বার্থে পৃথিবীতে সন্তান এনেছি। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তাদের ব্যবহার করছি। এই দেশটা মোটেই শিশুবান্ধব নয়। এটা প্রাপ্তবয়স্কদের দেশ।
সম্প্রতি মেঘ নামের মেয়েটিকে গণমাধ্যম যেভাবে ব্যবহার করেছে, সে ক্ষেত্রে তাদের ওপর ন্যূনতম আস্থা রাখার কোনো কারণ নেই। আজকে শিশুর বয়স ১৬ না ১৮, এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমার তো মনে হয়, সবাই আমরা শিশুর মতো আচরণ করছি। বয়স ১৬ ও ১৮-এর মধ্যে অবশ্য আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। আমাদের বিত্তবান ব্যক্তিরা বাড়াবাড়ি রকমের আদর-আহ্লাদ দিয়ে সন্তানদের বড় করছেন। এই সন্তানেরা ২০-২২ বছর পর্যন্ত শিশু থেকে যাচ্ছে। শিশুবান্ধব কর্মকর্তা প্রসঙ্গে আমার মত হলো, এদের অন্য গ্রহ থেকে আনতে হবে। সংসারে একজন নারী যখন স্বামী বা শাশুড়ির দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন, তখন ওই নারী তাঁর সন্তানকে মেরে সব প্রতিশোধ নিচ্ছেন। শিশু সুরক্ষার জন্য অভিভাবকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সবশেষে বলব, গুড প্যারেন্টিংয়ের কোনো বিকল্প নেই।
কাজী জিয়াউদ্দিন
আমাদের দেশে দিনের শেষে সব অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে যায়। অভিযোগ স্বীকার করেই কথা বলছি। একটি বিষয় হলো, যেখানে আইন বেশি, সেখানে আইন ভাঙার প্রবণতাও বেশি। আজকে মানবতা, সভ্যতা, শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি—সবকিছু বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। সবকিছু থেকে সুবিধা খুঁজতে গিয়ে আমাদের আসল কাজ হচ্ছে না। মধ্যযুগের এক কবি বলেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। আমাদের সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখতে হলে সব ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবর্তন আনার জন্য সবার আগে নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। পরিবর্তিত হওয়ার জন্য আমাদের আচরণ, শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, অর্থাৎ সম্পূর্ণ মানসকাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে। আমরা ভালো মানুষ হলে আমাদের শিশুরা হবে আলোকিত শিশু। সমাজের সব স্তর থেকে ভালো মানুষ হওয়ার ধ্বনি উচ্চারিত না হলে ভালো হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের শিশুরা রূপকথার সিনডারেলার মতো উপেক্ষিত।
এ অবস্থা থেকে তাদের মুক্ত করার জন্য সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাতে হাত রেখে এগিয়ে আসতে হবে। কারও একার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। শিশুদের বহুমুখী সমস্যা। একটা একটা করে সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে এবং সমাধানের জন্য সমাজের বিত্তবানদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। সিঙ্গাপুরে শিশুদের স্কুলে লাইফ স্কিল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জাপানে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের মাদার ক্লাব আছে। শিশুরা পৃথিবীতে আসার আগেই এখান থেকে মায়েরা শিশুর পরিচর্যা শিখে নেন। শিশু স্কুলে যাওয়া পর্যন্ত ক্লাবের নির্দেশাবলি মেনে চলার শিক্ষা দেওয়া হয়। শিশুরা সমাজে কত মহিমান্বিত, আমরা সেটা বুঝতে পারি না। আমাদের সমাজবোধের মধ্যে এটা নেই। ওয়ার্ডস ওয়ার্থ শিশুদের মধ্যে দেখেছিলেন ‘স্বর্গীয় দ্যুতি’। বিদেশে অনেক জায়গায় শিশুদের ‘ঈশ্বরের দূত’, ‘শান্তির বার্তাবাহক’ ইত্যদি বলে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘প্রতিটি শিশু জানান দিয়ে যাচ্ছে যে আমি একটি নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।’ শিশুদের এই ধারণাগুলো মাথায় নিয়ে সুশীল সমাজ, বিত্তবান মানুষেরা, গণমাধ্যম—সবাই যদি একসঙ্গে কাজ করি, তাহলে এই সংকট থেকে উত্তরণ হওয়া অসম্ভব নয়। কারণ, শিশুদের সমস্যা এখনো আমাদের নিয়ন্ত্রণসীমাকে অতিক্রম করেনি। একজন দার্শনিক বলেছিলেন, মানুষের কোনো পরাজয় নেই। সবাইকে আশাবাদী হতে হবে। শেষ করতে চাই বঙ্গবন্ধুর উচ্চারণ দিয়ে, ‘এটা অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা। বিপন্নতা থেকে ঘরে ফেরার যাত্রা। বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পথে যাত্রা। সঠিক জীবন গড়ার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ হবে একসঙ্গে।’
আব্দুল কাইয়ুম
আজকে সব মন্ত্রণালয়ের সভা ছিল। উপসচিব মো. ওমর ফারুক হয়তো কষ্ট করেই আজকের আলোচনায় এসেছেন। এখন তাঁর কাছ থেকে শুনব।
মো. ওমর ফারুক
শিশু সুরক্ষার বিষয়টি আমাদের মন্ত্রণালয়ের বিষয়। শিশু আইনও আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে তৈরি করা হয়। আমরা অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় করে শিশু আইনের বিষয়গুলো তৈরি করেছিলাম। এটি ছিল যুগোপযোগী ও আধুনিক। এ আইনে আমরা ৮০টি ধারা সংযোজন করেছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারিনি। তবে আমাদের মন্ত্রণালয়ে এটার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আমরা একটি তুলনামূলক বিবরণী তৈরি করছি। মূল বিষয়টি সামনে আনতে ছয় মাসের মতো সময় লাগবে। আমাদের কাছে যেটা ফেরত এসেছে, সেখানে ১০০ ধারা আছে। বয়সসহ আমাদের পাঠানো ধারার অনেক কিছু পরিবর্তন করে ফেলেছে।
আমরা কোনোক্রমেই বয়সসীমা ১৮-এর নিচে নামাব না। আমরা কয়েক দিন আগে ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় আইন করেছি। সেখানেও শিশুদের বয়স ১৮ রেখেছি। শিশু সুরক্ষা ও করণীয় বিষয়ে আমাদের আইনে কিছু বলা নেই। তবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ১৩টি কারণ বলা আছে। মাতৃগর্ভ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত একজন মানুষ শিশু থাকে। একা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ২০৫টি শিশুসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আমাদের অধীনে রয়েছে। ৮৫টি শিশু পরিবার আছে। ১০ লাখ পথশিশুর কথা বলা হয়েছে। এই হিসাবটি ঠিক নয়। কারণ, ছয়টি বিভাগীয় শহরে ছয়টি শিশু বিকাশকেন্দ্র আছে। প্রতিটি কেন্দ্রে ২৫০ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু শিশু পাওয়া যাচ্ছে না। ইউনিয়ন পর্যায়ে আমাদের সামাজিক কর্মী আছেন। তাঁদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশু সুরক্ষায় কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আমার শেষ কথা হলো, শুধু সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় নয়, সবাই মিলে শিশু সুরক্ষার একটি বলয় তৈরি করতে হবে।
মেহের আফরোজ চুমকি
শিশুরা যাতে সমস্যায় না পড়ে, সেই জায়গাগুলো ঠিক করতে হবে। উন্নত বিশ্বের মতো অভিভাবকদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। অভিভাবকেরা সচেতন হলে শিশুর সুরক্ষা অনেকাংশে নিশ্চিত হয়। গরিব মা-বাবার সামর্থ্য নেই পাঁচ থেকে সাতটি সন্তান লালন-পালনের। প্রত্যেক সন্তান ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে মা-বাবাকে টাকা দিচ্ছে। এই মা-বাবার আইনের আওতায় আসা উচিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি—সব ক্ষেত্রে শিশুরা যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। ব্রেস্ট ফিডিংয়ে আমরা লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি এগিয়েছি। শিশুর বয়স ১৬ হওয়ায় আমি নিজে বিস্মিত হয়েছি। এ ব্যাপারে জোরালো প্রতিবাদ করব। শিশুরা যেন আগামী দিনে একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে পারে, তার জন্য যা যা দরকার, তার সবকিছু করার চেষ্টা করব।
আব্দুল কাইয়ুম
আপনারা সবাই দীর্ঘ সময় নিয়ে শিশু সুরক্ষা ও করণীয় বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা করেছেন। আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা ও তথ্য উঠে এসেছে। সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
মেহের আফরোজ চুমকি
সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
তারানা হালিম
সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
নায়োমি কাননানগারা
পরিচালক, শিশু সুরক্ষা, সেভ দ্য চিলড্রেন
কাজী রিয়াজুল হক
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান
শাহ আলম
চেয়ারম্যান, আইন কমিশন
সাদেকা হালিম
সদস্য, তথ্য অধিকার কমিশন
এ এস এম আমানউল্লাহ
অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মো. ওমর ফারুক
উপসচিব, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়
কাজী জিয়াউদ্দিন
সহকারী মহাপরিদর্শক, পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স
মেহতাব খানম
অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সালমা আলী
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি
সারা যাকের
নাট্যব্যক্তিত্ব, প্রকল্প পরিচালক, সিসিমপুর
মুমিনুন নেছা
ভিকটিম সাপোর্ট এক্সপার্ট, পুলিশ রিফর্ম প্রোগ্রাম, ইউএনডিপি
এহছানুর রহমান
সহসভাপতি, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম
এম এম আমিনুল ইসলাম
শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
এ কে এম মাসুদ আলী
নির্বাহী পরিচালক, ইনসিডিন
সুমনা শারমীন
সাংবাদিক
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কমবেশি শিশু নির্যাতন হয়ে থাকে। আমাদের মতো দেশগুলোতে শিশুরা অতিমাত্রায় নির্যাতিত হয়। নানা সমস্যার মধ্যে শিশুদের দিন কাটে। শিশুরা গৃহে, কর্মক্ষেত্রে নির্যাতিত হচ্ছে। তাদের খেলার মাঠ নেই, টেলিভিশনে বিনোদনের সুযোগ নেই। ‘ডরিমন’ কার্টুন দেখে তারা হিন্দিতে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, অথচ এত সুন্দর এবং শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় কার্টুনটি বাংলায় করা হচ্ছে না। এক কথায়, শিশুদের বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ আমরা দিতে পারছি না। এ বিষয়ে আজ আলোচনা হবে। প্রথমে আলোচনার জন্য মেহের আফরোজ চুমকিকে অনুরোধ করছি।
মেহের আফরোজ চুমকি
শিশুদের কথা বললে একটি সুন্দর বাংলাদেশের চিত্র ভেসে ওঠে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ শিশু। সংবিধানের ২৮(৪) ধারায় সব ধর্ম-বর্ণের শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
আজকের প্রথম আলোয় একটা সংবাদ দেখলাম, শিশু আইনের খসড়ায় শিশুর বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করা হয়েছে। আমি খুবই বিস্মিত হয়েছি। আমি শিশুদের নিয়ে কাজ করছি এবং মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান। আমি বিষয়টি দেখব। শিশুদের বয়সসীমা ১৬ বছর থাকলে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এখানে অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁরা এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন। এই আলোচনা থেকে অনেক দিকনির্দেশনা বেরিয়ে আসবে এবং এর আলোকে আমরা আমাদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করব।
আব্দুল কাইয়ুম
আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এবার বলবেন নায়োমি কাননানগারা।
নায়োমি কাননানগারা
ভালো লাগছে যে আপনারা শিশু সুরক্ষার বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। আর এই অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত থাকতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি। আজকের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, দীর্ঘদিন ধরে সেভ দ্য চিলড্রেন বিশ্বব্যাপী শিশুদের সুরক্ষার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে, ১৯৮৯ সালের জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুদের অপব্যবহার, শোষণ, বঞ্চনা, সহিংসতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কীভাবে তাদের রক্ষা করতে হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেন বিশ্বে শিশু সুরক্ষার ব্যাপারে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। আমরা দুই ধরনের কাজ করি।
আমরা সব ধরনের নির্যাতন, শোষণ, অবহেলা ও বৈষম্য থেকে শিশুদের প্রতিরোধ করার জন্য কাজ করে থাকি এবং প্রয়োজনে সাড়া দিয়ে থাকি। এ ছাড়া জরুরি অবস্থায় শিশুদের নির্যাতন, সহিংসতা ও অপব্যবহার থেকে রক্ষা করার জন্য কাজ করে থাকি। শিশুদের জন্য যে আন্তর্জাতিক সনদ আছে, সব দেশ সেটা মেনে চলে। বাংলাদেশও শিশু সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা এবং বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করলে এ ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা অর্জন করা সম্ভব। আমরা কীভাবে সরকারের সঙ্গে কাজ করব, তার ভালো উপায় খুঁজছি। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি, একসঙ্গে কাজ করলে কমিউনিটি স্তরে নির্যাতন, সহিংসতাসহ সব দিক থেকে শিশুদের রক্ষা করা সম্ভব হবে।
এভাবে কমিউনিটি থেকে কাজ করতে করতে আমরা জাতীয় পর্যায়ে পরিবর্তন আনতে পারব। আমি বিশ্বাস করি, আজকের আলোচনা বাংলাদেশের শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করবে। বাংলাদেশে সেভ দ্য চিলড্রেন দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করছে এবং করে যাবে।
এ কে এম মাসুদ আলী
আমাদের দেশে শিশুদের জন্য কিছু আইন আছে। এ আইন আসলে শিশু সনদের প্রতিফলন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাইভাক নামে শিশুদের জন্য একটি আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। আফগানিস্তানসহ এই সংগঠনের সব দেশ বলছে যে তারা সব ধরনের শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি উদ্যোগ গ্রহণের জন্য একমত পোষণ করেছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব নিজ উদ্যোগে বিশ্বে শিশুদের অবস্থা কী, সে বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। এটা হচ্ছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক অবস্থা নির্ধারণের জন্য একটি মাইলফলক গবেষণা।
আজকে বিশ্বায়ন নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রযুক্তিকে সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে উন্মুক্ত করেছে। কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। দেশীয় একটি শিশু প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব পরিমণ্ডলের সাইবার বা কাল্পনিক জগতে প্রবেশ করছে। তাদের অনেকে অনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এতে শিশুদের মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হচ্ছে। রাষ্ট্র, সংগঠন, এমনকি জাতিসংঘ—কেউ এই বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করেনি। তবে এখানে আশার কথা হলো, এখন বিশ্বব্যাপী শিশুরা সংগঠিত হচ্ছে। শুধু আইন ও রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার সময় শেষ হয়েছে। এখন শিশুদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য সামাজিক আন্দোলনের চাহিদা তৈরি হয়েছে। এই সামাজিক আন্দোলন ছাড়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বড় সংগঠন কাউকে কাছে পাওয়া যাবে না। সেভ দ্য চিলড্রেনকে ধন্যবাদ জানাব একটি সামাজিক পরিসরে বিষয়টি আলোচনার আয়োজন করার জন্য।
আব্দুল কাইয়ুম
তারানা হালিম শিশুদের নিয়ে অনেক কাজ করেছেন, তাঁকে বলার জন্য অনুরোধ করছি।
তারানা হালিম
শিশুদের জন্য অনেক কিছু করার আছে। সংসদে থাকায় শিশুদের নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা কাজে লাগাতে পারছি। যেমন: আমার একটি দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল স্কুল ফিডিং কর্মসূচির। স্বল্প পরিসরে হলেও সেটা বাস্তবায়ন করা গেছে। গৃহে শিশুদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই আমি কাজ করে যাচ্ছি। সংসদে এসে এ ব্যাপারে আইন পাসের ক্ষেত্রে ভূমিকা নিয়েছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন মা এবং নারী হওয়ায় তিনি সবকিছু মানবিক দৃষ্টি দিয়ে দেখেন। এ জন্য অটিজমের ওপর আমরা অনেক বেশি কাজ করতে পেরেছি। শিশুদের জন্য স্কুল অবৈতনিক করা হয়েছে। এতিমদের জন্য ভাতা বাড়ানো হয়েছে। উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। শিশুমৃত্যুর হার কমাতে পেরেছি। তার পরও যা করতে পারিনি, মনে হয় তা-ই আজকে আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত।
এ ক্ষেত্রে প্রথমত আমার মনে হয়, আমরা এমন একটি দেশের নাগরিক, যেখানে আইনের অভাব নেই। কিন্তু প্রয়োগ হয় না বললেই চলে। আমি ওয়েল্ডিংসহ বিভিন্ন কারখানায় গিয়ে দেখেছি, সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, গরমে মাথার ওপর ফ্যান নেই, সময়ের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। আরও নানা সমস্যা। অথচ আইনে বলা আছে, মালিককে শ্রমিকের কাজের পরিবেশ দিতে হবে। এখানে আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। আজকে অসংখ্য শিশু মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে। আইনের প্রয়োগ নেই। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মেয়েদের ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছরের আগে বিয়ে হলে তারা শাস্তির আওতায় আসবে। বিবাহটা কিন্তু বৈধ থেকে যাচ্ছে। ফলে মেয়েটি স্বামিত্বের দাবি নিয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে যাচ্ছে। আমরা স্বীকার করি আর না করি, দেশে যৌনকর্মী আছে। তাদের সন্তানেরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে সামাজিক সুবিধা থেকে। তাদের জন্য কিছু করার উদ্যোগ গ্রহণ করছি। আপনারাও এদিকে এগিয়ে আসুন।
আব্দুল কাইয়ুম
জেনে ভালো লাগল, তারানা হালিম শিশুদের জন্য নিজেই কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এবার শুনব সাদেকা হালিমের কাছ থেকে।
সাদেকা হালিম
তারানা হালিমকে অনেক ধন্যবাদ। কারণ, কোনো সাংসদের মুখ থেকে যৌনকর্মীদের কথা শোনা যায় না। আমরা শিশু সুরক্ষার কথা বলছি। ২০০৫ সালের মধ্যে শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছি। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব শিশু ঝরে পড়ছে, তাদের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা শিশুদের এখনো সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারিনি। আরও একটি আতঙ্কের বিষয় হলো, যদি শিশুদের বয়সসীমা ১৮ থেকে ১৬তে নেমে আসে, তাহলে গ্রামে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসবে। বিবাহের ক্ষেত্রে কাজিরা দুটো রেজিস্টার রাখেন। একটাতে তাঁরা বয়স কম হলে ১৮ লেখেন। অন্যটিতে ঠিক বয়স লেখেন। স্থানীয় সাংসদেরাও কাজিদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানেন। আইন মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫৯ শতাংশ শিশুর কোনো তথ্যই আমরা জানি না। ৪১ শতাংশ শিশুর কোনো খাদ্য, আশ্রয় ও শিক্ষা নেই। সামাজের অসমতা শিশুদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ব্রাজিলসহ অনেক দেশের কাছাকাছি আমাদের প্রবৃদ্ধি। কিন্তু সমতাহীনতা এত বেশি যে একটা শ্রেণী আমাদের প্রবৃদ্ধিকে গ্রাস করে ফেলছে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কথা বলছি। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত আনিলা নামের এক মেধাবী অটিজম মেয়েকে একটি নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করাতে পারছি না। স্কুলের প্রধান দায়িত্বে আছেন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক। যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী সব প্রতিবন্ধী শিশুর কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন, সেখানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক তাদের স্কুলে ভর্তি করতে চাইছেন না। তাহলে অন্যদের থেকে কী আশা করা যেতে পারে, এ থেকে সেটি সহজে বোঝা যায়। লালবাগ থানায় শিশুদের ধর্ষণসহ ২৫টি ঘটনার তদন্ত করেছিলাম। তখন শিশুরা বলেছিল, ওয়ার্ড কমিশনার থাকলে আমরা কোনো কথা বলব না। কারণ, তাঁর উপস্থিতিতে সরাসরি কিছু বলতে তারা নিরাপদ বোধ করে না। এসব বিষয়ে আমাদের চোখ বন্ধ করে থাকার সময় শেষ হয়ে এসেছে।
সালমা আলী
শারীরিক ও মানসিক বিভিন্নভাবে শিশুরা নির্যাতিত হচ্ছে। আমি বিশেষভাবে দুই ধরনের শিশুর কথা বলতে চাই। ঝুঁকিপূর্ণ শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। শিশুরা ঘরে-বাইরে সব জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। শিশুদের প্রতি সরকার ও মা-বাবা উভয়ের দায়িত্ব রয়েছে। কোনো শিশুকে সুরক্ষার জন্য কেস করলে তখন আবার তার পরিবার বা কমিউনিটি থেকে কেস তুলে নেওয়ার চাপ আসে। শিশু সুরক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি সমস্যা। শিশুর কাজের একটা বয়সসীমা নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে।
পারিবারিক সুরক্ষা আইনের নিয়মাবলি এখনো তৈরি হয়নি। এই সরকার অনেক ভালো আইন করেছে। শিশু পাচার প্রতিরোধ ও পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আইন হয়েছে। ভবঘুরে আইন হচ্ছে। ভবঘুরে নামটি পরিবর্তনের কথা বলেছি। বাল্যবিবাহের আইন আছে, সেটা মানা হচ্ছে না। আমি জনস্বার্থে মামলা করেছি। সেখানে কাবিননামার কয়েকটি জায়গায় পরিবর্তনের কথা বলেছি। বিয়ের সময় অবশ্যই ভোটার আইডি কার্ড জমা দেওয়ার কথা বলেছি। এই দুটি কাজ করতে পারলে কাজিদের বাল্যবিবাহ করানোর সুযোগ কমে যাবে। সর্বোপরি বাবা-মায়ের ভালো আচরণ থেকে শুরু করে শিশুদের কাজকর্ম ও বিনোদনের ক্ষেত্রগুলো সুরক্ষিত করতে পারলে শিশু সুরক্ষা হবে বলে আশা করি।
কাজী রিয়াজুল হক
স্বাধীনতার মাত্র দুই বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিশু ও নারীদের জন্য আইন করেছিলেন। সে সময় পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও এ রকম আইন ছিল না। শিশু অধিকারবিষয়ক সিআরসিতে, ২০১২ সালের প্রস্তাবিত আইনে সব জায়গায় শিশুদের বয়সসীমা ১৮ ধরা হয়েছে। হঠাৎ করে সংশ্লিষ্ট অনেকের অজান্তে কীভাবে বয়সসীমা ১৬ হলো, সেটা ভাবনার বিষয়। আমরা প্রতিটি থানায় শিশুবান্ধব কর্মকর্তা থাকার প্রস্তাব করেছি।
আমাদের দেশে শিশুকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করার বয়স নয় বছর। কিন্তু আমরা বলেছি, কোনো শিশুকে ১২ বছরের আগে হাজত বা জেলে নেওয়া যাবে না। শিশুদের সরাসরি বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা যাবে না। শিশুদের বিচারিক ব্যবস্থা হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে যে শিশু উন্নয়নকেন্দ্র আছে, তার প্রাচীরের উচ্চতা কিন্তু জেলখানার প্রাচীর থেকে উঁচু। এই প্রাচীরের মধ্যে কীভাবে তার মানসিক ও শারীরিক বিচার হবে, সেটা বুঝতে কষ্ট হয়। আমার প্রস্তাব হলো, শিশুর সব প্রক্রিয়া হবে শিশুবান্ধব ও বন্ধুসুলভ।
আব্দুল কাইয়ুম
ড. শাহ আলম হয়তো বলতে পারবেন শিশুদের বিষয়ে আইন ও আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করার কথা।
শাহ আলম
প্রথমে বলে নিই, আইন কমিশন এখনো পর্যন্ত শিশুবিষয়ক আইন নিয়ে কোনো কাজ করেনি। তবে আমাদের কিছু কাজ হয়েছে, যেগুলো পরোক্ষভাবে শিশুদের প্রভাবিত করে। আমি জনকণ্ঠ পত্রিকার একটা খবরে দেখলাম, আমাদের পথশিশুদের সংখ্যা ১০ লাখ। এই ১০ লাখ শিশু অমানবিক জীবন যাপন করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এদের জন্য সরকার অতি সত্বর কী করছে। সব ক্ষেত্রে বয়সসীমা ১৮ বছর প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ১৮ বছরকে ঠিক রেখে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে পারে। আইন যথেষ্ট আছে। আমাদের দেশে আইনের অভাব নেই। আইনের প্রয়োগই বড় কথা। আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকলে শিশুদের অধিকার রক্ষা করা যাবে না।
মুমিনুন নেছা
হঠাৎ করে শিশুদের বয়সসীমা ১৬তে নেমে আশায় খুবই হতাশ হয়েছি। আরেকটি কথা শোনা যায়, ইদানীং আমাদের শিশুরা বেশি অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। দেশে তিনটি কিশোর উন্নয়নকেন্দ্র আছে—একটি মেয়েদের, দুটি ছেলেদের। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বছরে ৪০০ থেকে ৫০০ ছেলেমেয়ে এই কেন্দ্রগুলোতে আসে। তাদের মধ্যে সবাই আবার অপরাধী নয়। তাহলে শিশুরা যে বেশি অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠিক নয়। গত তিন বছরে আমরা ৩৫ জন শিশুকে রক্ষা করতে পেরেছি। এর জন্য আমাদের অনেক সমস্যা হয়েছে। যেমন: আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করে পুনর্বাসন করতে হয়েছে। তার ওপর প্রতিবন্ধী শিশুদের কেউ নিতে চায় না। ১০ লাখ পথশিশুর ব্যাপারে আমার মত হলো, এরা কোনো রকমেই পথশিশু নয়।
এদের কোনো না কোনো অভিভাবক আছেন। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হলো, প্রায় ১০ থেকে ১৫ বছর পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে উটের জকি হিসেবে ব্যবহূত ১১৫টি শিশু বাংলাদেশে ফিরে আসে। তখন তাদের প্রত্যেককেই অভিভাবকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। আমাদের কমিউনিটি-ভিত্তিক শিশু সুরক্ষার কর্মসূচি নিতে হবে। এর জন্য একটা গাইডলাইন করেছিলাম। এখন সেটা কী অবস্থায় আছে জানি না। শিশুদের সুরক্ষার ব্যাপারে সবাইকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
এহছানুর রহমান
আমাদের শিশুনীতি ও সিআরসির মধ্যে শিশু সুরক্ষার বিষয়ে আলাদা আলাদা অনুচ্ছেদ আছে। গত বছর ইউনিসেফের বিশ্ব শিশুবিষয়ক প্রতিবেদনে চারটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। যেমন: শিশুদের সহিংসতা, বাল্যবিবাহ, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ ও গমনাগমন (ট্রাফিকিং)। কমিউনিটি-ভিত্তিক শিশু সুরক্ষার বিষয়টি এখন জরুরি। কমিউনিটি-ভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কী হতে পারে? কমিউনিটিতে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সংগঠন আছে। এরা শিশুদের বিষয়ে কথা বলছে। এরা সহিংসতা, বাল্যবিবাহসহ বিভিন্ন বিষয় প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। তবে এটি বড় আকারে আমাদের দেশে এখনো শুরু হয়নি।
একে একটি সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে আনতে হবে। শিশু অধিকার ফোরামসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে শিশু-সাহায্যের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভুক্তভোগী শিশুর সাহায্য নেওয়ার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকা দরকার, সরকারের সেটা নেই। কমিউনিটি থেকে সুরক্ষা শুরু করতে হবে। তাহলে ব্যবস্থাটি পরিবারে, নিয়োগকারী মালিকদের কাছে—সব জায়গায় পৌঁছে যাবে। সব শেষে বসয়সীমা ১৬ বছরের বিরোধিতা করছি।
এ এস এম আমানউল্লাহ
বাংলাদেশে শিশুনীতি ও আইনের সহিংসতা চলছে। ১৯৭৪ ও ২০১১ সালের শিশু আইন এবং নারী ও শিশু অধিকার আইনের মধ্যে প্রচণ্ড বৈষম্য রয়েছে। ১৯৮২ সালের আইএলও, রিয়াদ ও হাভানা সম্মেলনকে বাংলাদেশ সমর্থন করেছিল। কিন্তু এর প্রয়োগ, নীতি ও নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে না। দেশে শিশুর ক্ষেত্রে একধরনের নীতি ও আইনি সহিংসতা চলছে। থানার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, শিশুদের জন্য পৃথক হাজতখানা নেই। বয়স্ক অপরাধীদের সঙ্গে তাদের জেলে আনা-নেওয়া করা হয়। একই সঙ্গে হাতকড়া পরানো হচ্ছে। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় শিশুবান্ধব বিচারব্যবস্থা চাই। নোটারি পাবলিকের বিষয়টি এখানে কেউ আনেননি। তারা অনেক শিশুর বয়স ১৮ বছরের বেশি হিসেবে প্রত্যয়ন করে। এভাবে বয়স বাড়িয়ে অনেক শিশুকে যৌন কাজে নিয়োজিত করা হয়।
এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে সবার ভাবা উচিত। শিশুদের পর্নোগ্রাফি নিয়ে আমার একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরে মাসে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার পর্নোগ্রাফি শিশুরা ডাউনলোড করে। এবং স্কুলে বসে এগুলো দেখে। কথা হচ্ছে, পর্নোগ্রাফি আইন ও রুলস যেটা করা হলো, তার শিশুবান্ধব কোনো প্রয়োগ আমরা দেখতে পেলাম না। আরেকটি বিষয় হলো, দেশে প্রচুর পরিমাণে মাদক (ড্রাগস) আসছে। ইয়াবায় বাজার ছেয়ে গেছে। ইদানীং আবার সেনেগ্রাসহ নতুন নতুন ড্রাগ যুক্ত হচ্ছে ইয়াবার সঙ্গে। ঢাকায় মাসে ১০ থেকে ১২ লাখ পিস ইয়াবার চাহিদা রয়েছে। শিশুদের মধ্যে এই চাহিদা বেশি। এ ক্ষেত্রে আইন, নীতি—সবই আছে। কিন্তু প্রয়োগের অভাবে শিশুরা ইয়াবার রাজ্যে ডুবে আছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য এখনই আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে। তা না হলে আমরা বড় রকমের সংকটের মুখে পড়ে যাব।
এম এম আমিনুল ইসলাম
অন্যদের মতো শিশুদের বয়সসীমা ১৬ বছর কোনোভাবে মানি না। শিশু সুরক্ষার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বলতে চাই, জাতীয় ও কমিউনিটি পর্যায়ে দুই জায়গাতেই বাংলাদেশে আদৌ শিশু সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা আছে কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি প্রশ্ন করি, কে শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি দেখে? মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়? সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়? না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়? এই প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না।
জাতীয় নারী ও শিশুবিষয়ক পরিষদমণ্ডলী আছে। আমার জানামতে, গত দুই বছর সেখানে কোনো সভা হয়নি। আর ওই পরিষদের ৯০ শতাংশ কথা হয় নারীকে নিয়ে। তারপর শিশুদের কথা আসে। যে কারণে শিশুদের বয়স যখন ১৮ থেকে ১৬ হয়ে যায়, তখন নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি সেটা জানতে পারেন না। বাজেটের ১২ থেকে ১৫ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ। এখানেও শিশুদের জন্য কিছু নেই। মাত্র শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ শিশুর জন্য বরাদ্দ। দারিদ্র্যের জন্য বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম হয়। দারিদ্র্য বিমোচনে বরাদ্দ পর্যাপ্ত নেই। সবকিছু মিলিয়ে শিশুদের বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে।
আব্দুল কাইয়ুম
এবার গণমাধ্যমে শিশুদের সমস্যা ও প্রতিকারের প্রতিফলন কতটুকু ঘটে, সে বিষয়ে বলবেন সুমনা শারমীন। নারী-শিশু বিষয়ে তাঁর অনেক লেখা বেরিয়েছে।
সুমনা শারমীন
আমাদের ফিচার পাতায় শিশুদের জন্য অনেক কিছু থাকে। দরকার হলে আরও কিছু করতে পারি। কিন্তু মূল পাতায় তেমন কিছু থাকে না। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সব পত্রিকা মিলে মূল পাতায় শিশুদের জন্য খবর থাকে ৩ শতাংশ। এগুলো আবার সব দুর্ঘটনাজনিত খবর। যেমন: কেউ পানিতে পড়ে গেছে; কাউকে সাপে কেটেছে; কেউ অপরাধ ও সহিংসতার শিকার; কেউ আবার অগ্নিদগ্ধ ইত্যাদি। অর্থাৎ শিশুকে খবর হতে হলে হয় তাকে অপরাধী হতে হবে, অথবা মানবিক বিপর্যয়ে পড়তে হবে। এমন মন খারাপ করা খবর আমরা ছাপতে চাই না। ইদানীং শিশুদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো খুব স্পর্শকাতর খবর ছাপতে হচ্ছে। এখন শিশুরা হয়েছে মুক্তিপণের পণ্য। তার অপরাধ? অপরাধ হলো, বাবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে কিছু টাকা এনেছেন। অপরাধ হলো, বাবার সঙ্গে জমিজমা নিয়ে পাশের বাড়ির বিরোধ। অপরাধ হলো, শিক্ষক তাকে পড়াতেন। অপরাধ হলো, বাবার ঢাকা শহরে বাড়ি আছে। তিনি অনেক টাকা ভাড়া পান। এ রকম অনেক ঘটনা আছে।
এসব খবর ছাপার সময় ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। কারণ, এদের ছবি ছাপা যায় না। মা-বাবার সঙ্গে কথা বলা যায় না। তাঁরা চিৎকার করে সন্তানের জন্য আহাজারি করতে থাকেন। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, সাংবাদিক এবং পুলিশও এই নৃশংসতার বাইরে নয়। আমাদেরই এক সাংবাদিকের বোনের সন্তানকে অপহরণ করা হয়েছে। এই পরিবারে পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আছেন। সাংবাদিক, পুলিশ—সবাই খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু ফোন করে বলছে, এখানে টাকা রেখে যাও, ওখানে টাকা রেখে যাও। টাকাও রাখা হচ্ছে, কিন্তু শিশু ফিরে আসছে না। পরদিন একটি কবরস্থানে তাকে এমনভাবে পাওয়া গেল যে শিশুটি আর কোনো দিন মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। আমরা খুব কাছ থেকে এই পরিবারটির হাহাকার দেখেছি। দেখেছি সন্তান হারানোর কী বেদনা! শিশু সুরক্ষার বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। আমি মনে করি, অন্যদের মতো সাংবাদিকদেরও এ ক্ষেত্রে অনেক দায়িত্ব রয়েছে। আমরা প্রথম আলো এ ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা মেনে চলার চেষ্টা করি।
সারা যাকের
শিশু সুরক্ষা ও করণীয় নিয়ে আলোচনা শুনলাম। ১৯৭৪ সালে আমাদের দেশে শিশু সুরক্ষার আইন ছিল। আবার ২০১২ সালে নতুন করে হবে। আইন, নীতি, নিয়ম—সবই প্রয়োজন। এবং সেটা আছেও। শুধু নেই প্রয়োগ। এর সঙ্গে যুক্ত করতে চাই অ্যাডভোকেসি ও সচেতনতা। দেশব্যাপী শিশু সুরক্ষার বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। তাহলে মানুষ এসব বিষয়ে জানতে ও বুঝতে পারবে।
এ ক্ষেত্রে শিশুদের প্রতি সহিংসতা কমে আসবে। পাশাপাশি সুরক্ষা জোরদার হবে। আরেকটি বড় বিষয় হলো, শিশুদের মাদক গ্রহণ, অপব্যবহার, পর্নোগ্রাফি, সহিংসতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ হচ্ছে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এগুলো সামাজিক আন্দোলন হিসেবে সামনে না আসবে, ততক্ষণ ফলপ্রসূ কিছু অর্জিত হবে না। আমি মনে করি, সেভ দ্য চিলড্রেন ও অন্য যারা কাজ করছে, সে ক্ষেত্রে কাজের পরিধি বাড়বে। কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দরকার সামাজিক আন্দোলন।
মেহতাব খানম
বারবার শুধু সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলি। আমার কাছে মনে হয়, পরিবারই সব। আমাকেসহ সব বাবা-মাকে বলতে চাই, আমরা মা-বাবা হওয়ার যোগ্যতা রাখি কি না। চাল-চুলা নেই, এমন মা-বাবা পাঁচ থেকে সাতটি সন্তান পৃথিবীতে এনেছেন। প্রত্যেক সন্তানকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে দিয়ে নিজেদের আয়ের হাতিয়ার বানিয়েছেন। শুধু দরিদ্ররা নয়, সবাই নিজেদের স্বার্থে পৃথিবীতে সন্তান এনেছি। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তাদের ব্যবহার করছি। এই দেশটা মোটেই শিশুবান্ধব নয়। এটা প্রাপ্তবয়স্কদের দেশ।
সম্প্রতি মেঘ নামের মেয়েটিকে গণমাধ্যম যেভাবে ব্যবহার করেছে, সে ক্ষেত্রে তাদের ওপর ন্যূনতম আস্থা রাখার কোনো কারণ নেই। আজকে শিশুর বয়স ১৬ না ১৮, এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমার তো মনে হয়, সবাই আমরা শিশুর মতো আচরণ করছি। বয়স ১৬ ও ১৮-এর মধ্যে অবশ্য আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। আমাদের বিত্তবান ব্যক্তিরা বাড়াবাড়ি রকমের আদর-আহ্লাদ দিয়ে সন্তানদের বড় করছেন। এই সন্তানেরা ২০-২২ বছর পর্যন্ত শিশু থেকে যাচ্ছে। শিশুবান্ধব কর্মকর্তা প্রসঙ্গে আমার মত হলো, এদের অন্য গ্রহ থেকে আনতে হবে। সংসারে একজন নারী যখন স্বামী বা শাশুড়ির দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন, তখন ওই নারী তাঁর সন্তানকে মেরে সব প্রতিশোধ নিচ্ছেন। শিশু সুরক্ষার জন্য অভিভাবকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সবশেষে বলব, গুড প্যারেন্টিংয়ের কোনো বিকল্প নেই।
কাজী জিয়াউদ্দিন
আমাদের দেশে দিনের শেষে সব অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে যায়। অভিযোগ স্বীকার করেই কথা বলছি। একটি বিষয় হলো, যেখানে আইন বেশি, সেখানে আইন ভাঙার প্রবণতাও বেশি। আজকে মানবতা, সভ্যতা, শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি—সবকিছু বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। সবকিছু থেকে সুবিধা খুঁজতে গিয়ে আমাদের আসল কাজ হচ্ছে না। মধ্যযুগের এক কবি বলেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। আমাদের সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখতে হলে সব ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবর্তন আনার জন্য সবার আগে নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। পরিবর্তিত হওয়ার জন্য আমাদের আচরণ, শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, অর্থাৎ সম্পূর্ণ মানসকাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে। আমরা ভালো মানুষ হলে আমাদের শিশুরা হবে আলোকিত শিশু। সমাজের সব স্তর থেকে ভালো মানুষ হওয়ার ধ্বনি উচ্চারিত না হলে ভালো হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের শিশুরা রূপকথার সিনডারেলার মতো উপেক্ষিত।
এ অবস্থা থেকে তাদের মুক্ত করার জন্য সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাতে হাত রেখে এগিয়ে আসতে হবে। কারও একার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। শিশুদের বহুমুখী সমস্যা। একটা একটা করে সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে এবং সমাধানের জন্য সমাজের বিত্তবানদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। সিঙ্গাপুরে শিশুদের স্কুলে লাইফ স্কিল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জাপানে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের মাদার ক্লাব আছে। শিশুরা পৃথিবীতে আসার আগেই এখান থেকে মায়েরা শিশুর পরিচর্যা শিখে নেন। শিশু স্কুলে যাওয়া পর্যন্ত ক্লাবের নির্দেশাবলি মেনে চলার শিক্ষা দেওয়া হয়। শিশুরা সমাজে কত মহিমান্বিত, আমরা সেটা বুঝতে পারি না। আমাদের সমাজবোধের মধ্যে এটা নেই। ওয়ার্ডস ওয়ার্থ শিশুদের মধ্যে দেখেছিলেন ‘স্বর্গীয় দ্যুতি’। বিদেশে অনেক জায়গায় শিশুদের ‘ঈশ্বরের দূত’, ‘শান্তির বার্তাবাহক’ ইত্যদি বলে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘প্রতিটি শিশু জানান দিয়ে যাচ্ছে যে আমি একটি নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।’ শিশুদের এই ধারণাগুলো মাথায় নিয়ে সুশীল সমাজ, বিত্তবান মানুষেরা, গণমাধ্যম—সবাই যদি একসঙ্গে কাজ করি, তাহলে এই সংকট থেকে উত্তরণ হওয়া অসম্ভব নয়। কারণ, শিশুদের সমস্যা এখনো আমাদের নিয়ন্ত্রণসীমাকে অতিক্রম করেনি। একজন দার্শনিক বলেছিলেন, মানুষের কোনো পরাজয় নেই। সবাইকে আশাবাদী হতে হবে। শেষ করতে চাই বঙ্গবন্ধুর উচ্চারণ দিয়ে, ‘এটা অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা। বিপন্নতা থেকে ঘরে ফেরার যাত্রা। বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পথে যাত্রা। সঠিক জীবন গড়ার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ হবে একসঙ্গে।’
আব্দুল কাইয়ুম
আজকে সব মন্ত্রণালয়ের সভা ছিল। উপসচিব মো. ওমর ফারুক হয়তো কষ্ট করেই আজকের আলোচনায় এসেছেন। এখন তাঁর কাছ থেকে শুনব।
মো. ওমর ফারুক
শিশু সুরক্ষার বিষয়টি আমাদের মন্ত্রণালয়ের বিষয়। শিশু আইনও আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে তৈরি করা হয়। আমরা অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় করে শিশু আইনের বিষয়গুলো তৈরি করেছিলাম। এটি ছিল যুগোপযোগী ও আধুনিক। এ আইনে আমরা ৮০টি ধারা সংযোজন করেছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারিনি। তবে আমাদের মন্ত্রণালয়ে এটার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আমরা একটি তুলনামূলক বিবরণী তৈরি করছি। মূল বিষয়টি সামনে আনতে ছয় মাসের মতো সময় লাগবে। আমাদের কাছে যেটা ফেরত এসেছে, সেখানে ১০০ ধারা আছে। বয়সসহ আমাদের পাঠানো ধারার অনেক কিছু পরিবর্তন করে ফেলেছে।
আমরা কোনোক্রমেই বয়সসীমা ১৮-এর নিচে নামাব না। আমরা কয়েক দিন আগে ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় আইন করেছি। সেখানেও শিশুদের বয়স ১৮ রেখেছি। শিশু সুরক্ষা ও করণীয় বিষয়ে আমাদের আইনে কিছু বলা নেই। তবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ১৩টি কারণ বলা আছে। মাতৃগর্ভ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত একজন মানুষ শিশু থাকে। একা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ২০৫টি শিশুসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আমাদের অধীনে রয়েছে। ৮৫টি শিশু পরিবার আছে। ১০ লাখ পথশিশুর কথা বলা হয়েছে। এই হিসাবটি ঠিক নয়। কারণ, ছয়টি বিভাগীয় শহরে ছয়টি শিশু বিকাশকেন্দ্র আছে। প্রতিটি কেন্দ্রে ২৫০ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু শিশু পাওয়া যাচ্ছে না। ইউনিয়ন পর্যায়ে আমাদের সামাজিক কর্মী আছেন। তাঁদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশু সুরক্ষায় কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আমার শেষ কথা হলো, শুধু সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় নয়, সবাই মিলে শিশু সুরক্ষার একটি বলয় তৈরি করতে হবে।
মেহের আফরোজ চুমকি
শিশুরা যাতে সমস্যায় না পড়ে, সেই জায়গাগুলো ঠিক করতে হবে। উন্নত বিশ্বের মতো অভিভাবকদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। অভিভাবকেরা সচেতন হলে শিশুর সুরক্ষা অনেকাংশে নিশ্চিত হয়। গরিব মা-বাবার সামর্থ্য নেই পাঁচ থেকে সাতটি সন্তান লালন-পালনের। প্রত্যেক সন্তান ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে মা-বাবাকে টাকা দিচ্ছে। এই মা-বাবার আইনের আওতায় আসা উচিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি—সব ক্ষেত্রে শিশুরা যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। ব্রেস্ট ফিডিংয়ে আমরা লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি এগিয়েছি। শিশুর বয়স ১৬ হওয়ায় আমি নিজে বিস্মিত হয়েছি। এ ব্যাপারে জোরালো প্রতিবাদ করব। শিশুরা যেন আগামী দিনে একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে পারে, তার জন্য যা যা দরকার, তার সবকিছু করার চেষ্টা করব।
আব্দুল কাইয়ুম
আপনারা সবাই দীর্ঘ সময় নিয়ে শিশু সুরক্ষা ও করণীয় বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা করেছেন। আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা ও তথ্য উঠে এসেছে। সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
No comments