লবণাক্ততা-উপকূলীয় অঞ্চলে অশনিসংকেত by এম জি নিয়োগী
কয়েক বছর আগেও উপকূল অঞ্চলের কৃষকরা বেশিরভাগ জমিতে বোরো মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করত এবং এই বোরো মৌসুমে তারা কাঙ্ক্ষিত ফলন ঘরে তুলতে পারত। কিন্তু বর্তমান সময়ে জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে কৃষকরা কাঙ্ক্ষিত ফলন পাচ্ছে না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে পুরো ফসলই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠের অনেক কাছাকাছি হওয়ায় এ দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবও খুব বেশি। আর এই নেতিবাচক প্রভাবের একটি হলো কৃষিজমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি। সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা এই অঞ্চলের কৃষির জন্য একটি বৈরী অবস্থার সৃষ্টি করছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) সাম্প্রতিক একটি তথ্যে জানা যাচ্ছে, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে মোট লবণাক্ত জমি ছিল ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর। ২০০০ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১০ লাখ ২০ হাজার হেক্টর এবং ২০০৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর এবং যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অর্থাৎ গত ৩৫ বছরে এ দেশে প্রায় ২৬ ভাগ লবণাক্ত অঞ্চল বেড়েছে। এই লবণাক্ততা এখন শুধু উপকূল অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, উপকূল অঞ্চল অতিক্রম করে সাধারণ জমিতেও ঢুকে পড়ছে।
সম্প্রতি ইউএসএইডের অর্থায়নে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বীজ প্রকল্প জিআইএস ম্যাপের মাধ্যমে সমুদ্র উপকূলের ১২টি লবণাক্ত অঞ্চল এবং এর লবণাক্ততা চিহ্নিত করে। জিআইএস বিশেষজ্ঞ ড. এএন সিং জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের মোট ১২টি জেলার জমিতে লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। এই জেলাগুলো হলো বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, গোপালগঞ্জ ও নড়াইল। এই ১২টি জেলার মোট লবণাক্ত জমির পরিমাণ ৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা জেলার প্রতিটিতে লবণাক্ত জমির পরিমাণ এক লাখ হেক্টরের মতো। অর্থাৎ এই ৬ জেলাতেই লবণাক্ত জমির পরিমাণ ৬ লাখ হেক্টরেরও বেশি। বিসিএএসের একটি সার্ভেতে দেখা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যেখানে লবণাক্ততার মাত্রা ২.৮-১৮.৫ ডিএস/মিটারের মধ্যে ছিল, এখন সেখানে ৪-৪২.৮ ডিএস/মিটার। এমনকি এসব অঞ্চলে নদীর পানিতেও লবণাক্ততার মাত্রা ১২.৯ ভাগ থেকে বেড়ে ২৪.৫ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। এমনকি ভূগভর্স্থ পানিতেও লবণাক্ততা ৫.৮ ভাগ থেকে বেড়ে ২৫.৬ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা গত ৩০ বছরে ৪১.৪ সেন্টিমিটার বেড়ে যাওয়াতে এক লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমি এ সময়ের মধ্যে লবণাক্ত হয়ে গেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫৯.৩৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাবে এবং নতুন করে দুই লাখ হেক্টরেরও বেশি জমি লবণাক্ত হয়ে যাবে। ১৯৭৫-৭৬ সালে যেখানে ৬১ হাজার হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধতা ছিল, ২০০৮-০৯ সালে সেখানে এক লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর জমি জলাবদ্ধতায় পতিত হয়েছে।
কয়েক বছর আগেও উপকূল অঞ্চলের কৃষকরা বেশিরভাগ জমিতে বোরো মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করত এবং এই বোরো মৌসুমে তারা কাঙ্ক্ষিত ফলন ঘরে তুলতে পারত। কিন্তু বর্তমান সময়ে জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে কৃষকরা কাঙ্ক্ষিত ফলন পাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে পুরো ফসলই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে এসব এলাকার অনেক কৃষক এখন বোরো মৌসুমে ধান বা কোনো ফসল চাষাবাদ করছে না। বোরো মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকার পুরো জমিই ফাঁকা থাকছে।
ইরি পরিচালিত জিআইএস ম্যাপিংয়ে আশা জাগানোর মতো একটি তথ্য পাওয়া গেছে। দেখা যাচ্ছে, ১০.৫৬ হেক্টর লবণাক্ত জমির মধ্যে ৭.৯২ লাখ হেক্টর জমির লবণাক্ততা এখনও ১০ ডিএস/মিটারের কম। এই ৭.৯২ লাখ হেক্টর জমিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (বিনা) উদ্ভাবিত বিনা ধান-৮ এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত ব্রি ধান৪৭ বোরো মৌসুমে চাষাবাদ করে কাঙ্ক্ষিত ফলন ঘরে তোলা সম্ভব। মানচিত্রে সবুজ চিহ্নিত এলাকাটি সুন্দরবন অঞ্চল। গাঢ় লাল চিহ্নিত অঞ্চলে লবণাক্ততার মাত্রা ১০ ডিএস/মিটারের বেশি বিধায় এই ২.৬৪ লাখ হেক্টর জমিতে লবণাক্ততাসহিষ্ণু নতুন উদ্ভাবিত ধানের জাত দুটি চাষাবাদ উপযোগী নয়। বাকি অঞ্চলগুলোতে এই দুটি জাতের চাষাবাদ এবং কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদন সম্ভব। ৭.৯২ লাখ হেক্টর জমির লবণাক্ততা যেহেতু এখন পর্যন্ত ১০ডিএস/মিটারের কম এবং যেহেতু ইরির বীজ প্রকল্প এই ১২টি জেলার ১০ ডিএস/মিটারের কম লবণাক্ততা সমৃদ্ধ মৌজা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করেছে, সেহেতু উপকূল বেষ্টিত ৬৫ উপজেলার ৪০৭০টি চিহ্নিত মৌজাতে কৃষক অনায়াসে বোরো মৌসুমে ব্রি ধান৪৭ এবং বিনা ধান-৮ জাতের লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধান আবাদ করে কাঙ্ক্ষিত ফসল নিশ্চিত করতে পারবেন। ইরির বীজ প্রকল্প এই চিহ্নিত মৌজাগুলোর বিস্তারিত তথ্য সংশ্লিষ্ট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কার্যালয়, স্থানীয় এনজিও, বীজ উৎপাদনকারী ও বিপণন সংস্থাসহ কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অবহিত করছে। অন্তত ৭.৯২ লাখ হেক্টর জমিতে যদি এই দুটি ধানের জাত চাষাবাদে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেওয়া যায়, তাহলে দেশে কম করে হলেও ৭.৯২ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত হবে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে সহায়তা করবে। আর যেহেতু বোরো মৌসুমে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় না, তাই কৃষকরা নির্ভাবনায় এই ধান উৎপাদন করে নিজের ও পরিবারের খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারবে। গত বোরো মৌসুমে ইউএসএইড বীজ প্রকল্পের অর্থায়নে ইরি-ডিএই-এনজিও-বীজ কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে বিনা ধান-৮ এবং ব্রি ধান৪৭-এর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করতে লবণাক্ত অঞ্চলে ৭৮টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করেছিল। যেসব অঞ্চলে লবণাক্ততার মাত্রা ১০ ডিএস/মিটারের নিচে ছিল, সেসব অঞ্চলে বীজ বপনের ১৩০-১৫০ দিনের মধ্যে দুটি ধানের জাতই গড়ে ৪ টন ফলন দিয়েছে। লবণাক্ত অঞ্চলের বাইরেও এই দুটি জাতের ১১২টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। অলবণাক্ত অঞ্চলে এই দুটি জাতের ফলন হেক্টরপ্রতি ৫ টনের বেশি পাওয়া গেছে। তাই শুধু লবণাক্ত অঞ্চল নয়, অলবণাক্ত অঞ্চলেও এই দুটি জাতের সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। লবণাক্ত অঞ্চলে দেখা গেছে, এই ধানের জাত দুটি সম্পূর্ণ পেকে গেলে ধান ঝরে পড়ার হার একটু বেশি। সে জন্য ৮০ ভাগ ধান পেকে গেলেই কেটে ফেলতে হবে। বিনা ধান-৮ যেহেতু আলোক অসংবেদনশীল, সে জন্য আমন ও আউশ মৌসুমেও এই ধান চাষ করা যাবে। এই জাতটি কুশি অবস্থা থেকে ধান পাকা পর্যন্ত ৮-১০ ডিএস/মিটার এবং চারা অবস্থায় ১২-১৪ ডিএস/মিটার পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। জাতটির ডিগপাতা খাড়া ও লম্বা এবং ধান পাকা অবস্থায় এই গাছের পাতা ও কাণ্ড সবুজ থাকে। ধান উজ্জ্বল, শক্ত এবং এর চাল মাঝারি মোটা। এক হাজারটি ধানের ওজন ২৬.৭ গ্রাম। ব্রি ধান৪৭ জাতের ধানও মাঝারি মোটা। এতে এমাইলোজের পরিমাণ ২৮.৩ ভাগ। এর ভাত ঝরঝরে হয় এবং দীর্ঘ সময় রাখলেও নষ্ট হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে লবণাক্ততা ১০ ডিএস/মিটারের বেশি, সেখানে যদি পুকুর, ডোবা বা নালাতে বৃষ্টির পানি জমা থাকে, তাহলে কুশি, ফুল আসা এবং ধান পাকার সময় এই বৃষ্টির পানি জমিতে সেচ দিয়ে জমির লবণাক্ততা কমিয়ে ধানের কাঙ্ক্ষিত ফলন নিশ্চিত করা যায়।
ব্রি ধান৪৭ এবং বিনা ধান-৮ লবণাক্ত অঞ্চলের কৃষকদের জন্য একটি আশীর্বাদ। তবে লবণাক্ততা যেভাবে বাড়ছে, সে জন্য আমাদের আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে, যাতে করে আরও অধিক মাত্রার লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করা যায়। লবণাক্ততাসহিষ্ণু স্থানীয় জাতগুলো নিয়েও আমরা গবেষণা করতে পারি। হয়তো এসব স্থানীয় জাত থেকেও কোনো ভালো জাত বেরিয়ে আসতে পারে। তবে যে দুটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, আপাতত সে দুটি নিয়েই চিহ্নিত মৌজাগুলোতে সম্প্রসারণের কাজ করতে হবে। এ জন্য সরকারকেও বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ইরি-ইউএসএইড প্রকল্প এখানে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারে।
ড. এম জি নিয়োগী :কনসালট্যান্ট আন্তর্র্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি)
mgneogi@gmail.com
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠের অনেক কাছাকাছি হওয়ায় এ দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবও খুব বেশি। আর এই নেতিবাচক প্রভাবের একটি হলো কৃষিজমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি। সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা এই অঞ্চলের কৃষির জন্য একটি বৈরী অবস্থার সৃষ্টি করছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) সাম্প্রতিক একটি তথ্যে জানা যাচ্ছে, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে মোট লবণাক্ত জমি ছিল ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর। ২০০০ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১০ লাখ ২০ হাজার হেক্টর এবং ২০০৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর এবং যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অর্থাৎ গত ৩৫ বছরে এ দেশে প্রায় ২৬ ভাগ লবণাক্ত অঞ্চল বেড়েছে। এই লবণাক্ততা এখন শুধু উপকূল অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, উপকূল অঞ্চল অতিক্রম করে সাধারণ জমিতেও ঢুকে পড়ছে।
সম্প্রতি ইউএসএইডের অর্থায়নে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বীজ প্রকল্প জিআইএস ম্যাপের মাধ্যমে সমুদ্র উপকূলের ১২টি লবণাক্ত অঞ্চল এবং এর লবণাক্ততা চিহ্নিত করে। জিআইএস বিশেষজ্ঞ ড. এএন সিং জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের মোট ১২টি জেলার জমিতে লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। এই জেলাগুলো হলো বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, গোপালগঞ্জ ও নড়াইল। এই ১২টি জেলার মোট লবণাক্ত জমির পরিমাণ ৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা জেলার প্রতিটিতে লবণাক্ত জমির পরিমাণ এক লাখ হেক্টরের মতো। অর্থাৎ এই ৬ জেলাতেই লবণাক্ত জমির পরিমাণ ৬ লাখ হেক্টরেরও বেশি। বিসিএএসের একটি সার্ভেতে দেখা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যেখানে লবণাক্ততার মাত্রা ২.৮-১৮.৫ ডিএস/মিটারের মধ্যে ছিল, এখন সেখানে ৪-৪২.৮ ডিএস/মিটার। এমনকি এসব অঞ্চলে নদীর পানিতেও লবণাক্ততার মাত্রা ১২.৯ ভাগ থেকে বেড়ে ২৪.৫ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। এমনকি ভূগভর্স্থ পানিতেও লবণাক্ততা ৫.৮ ভাগ থেকে বেড়ে ২৫.৬ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা গত ৩০ বছরে ৪১.৪ সেন্টিমিটার বেড়ে যাওয়াতে এক লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমি এ সময়ের মধ্যে লবণাক্ত হয়ে গেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫৯.৩৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাবে এবং নতুন করে দুই লাখ হেক্টরেরও বেশি জমি লবণাক্ত হয়ে যাবে। ১৯৭৫-৭৬ সালে যেখানে ৬১ হাজার হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধতা ছিল, ২০০৮-০৯ সালে সেখানে এক লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর জমি জলাবদ্ধতায় পতিত হয়েছে।
কয়েক বছর আগেও উপকূল অঞ্চলের কৃষকরা বেশিরভাগ জমিতে বোরো মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করত এবং এই বোরো মৌসুমে তারা কাঙ্ক্ষিত ফলন ঘরে তুলতে পারত। কিন্তু বর্তমান সময়ে জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে কৃষকরা কাঙ্ক্ষিত ফলন পাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে পুরো ফসলই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে এসব এলাকার অনেক কৃষক এখন বোরো মৌসুমে ধান বা কোনো ফসল চাষাবাদ করছে না। বোরো মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকার পুরো জমিই ফাঁকা থাকছে।
ইরি পরিচালিত জিআইএস ম্যাপিংয়ে আশা জাগানোর মতো একটি তথ্য পাওয়া গেছে। দেখা যাচ্ছে, ১০.৫৬ হেক্টর লবণাক্ত জমির মধ্যে ৭.৯২ লাখ হেক্টর জমির লবণাক্ততা এখনও ১০ ডিএস/মিটারের কম। এই ৭.৯২ লাখ হেক্টর জমিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (বিনা) উদ্ভাবিত বিনা ধান-৮ এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত ব্রি ধান৪৭ বোরো মৌসুমে চাষাবাদ করে কাঙ্ক্ষিত ফলন ঘরে তোলা সম্ভব। মানচিত্রে সবুজ চিহ্নিত এলাকাটি সুন্দরবন অঞ্চল। গাঢ় লাল চিহ্নিত অঞ্চলে লবণাক্ততার মাত্রা ১০ ডিএস/মিটারের বেশি বিধায় এই ২.৬৪ লাখ হেক্টর জমিতে লবণাক্ততাসহিষ্ণু নতুন উদ্ভাবিত ধানের জাত দুটি চাষাবাদ উপযোগী নয়। বাকি অঞ্চলগুলোতে এই দুটি জাতের চাষাবাদ এবং কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদন সম্ভব। ৭.৯২ লাখ হেক্টর জমির লবণাক্ততা যেহেতু এখন পর্যন্ত ১০ডিএস/মিটারের কম এবং যেহেতু ইরির বীজ প্রকল্প এই ১২টি জেলার ১০ ডিএস/মিটারের কম লবণাক্ততা সমৃদ্ধ মৌজা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করেছে, সেহেতু উপকূল বেষ্টিত ৬৫ উপজেলার ৪০৭০টি চিহ্নিত মৌজাতে কৃষক অনায়াসে বোরো মৌসুমে ব্রি ধান৪৭ এবং বিনা ধান-৮ জাতের লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধান আবাদ করে কাঙ্ক্ষিত ফসল নিশ্চিত করতে পারবেন। ইরির বীজ প্রকল্প এই চিহ্নিত মৌজাগুলোর বিস্তারিত তথ্য সংশ্লিষ্ট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কার্যালয়, স্থানীয় এনজিও, বীজ উৎপাদনকারী ও বিপণন সংস্থাসহ কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অবহিত করছে। অন্তত ৭.৯২ লাখ হেক্টর জমিতে যদি এই দুটি ধানের জাত চাষাবাদে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেওয়া যায়, তাহলে দেশে কম করে হলেও ৭.৯২ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত হবে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে সহায়তা করবে। আর যেহেতু বোরো মৌসুমে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় না, তাই কৃষকরা নির্ভাবনায় এই ধান উৎপাদন করে নিজের ও পরিবারের খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারবে। গত বোরো মৌসুমে ইউএসএইড বীজ প্রকল্পের অর্থায়নে ইরি-ডিএই-এনজিও-বীজ কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে বিনা ধান-৮ এবং ব্রি ধান৪৭-এর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করতে লবণাক্ত অঞ্চলে ৭৮টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করেছিল। যেসব অঞ্চলে লবণাক্ততার মাত্রা ১০ ডিএস/মিটারের নিচে ছিল, সেসব অঞ্চলে বীজ বপনের ১৩০-১৫০ দিনের মধ্যে দুটি ধানের জাতই গড়ে ৪ টন ফলন দিয়েছে। লবণাক্ত অঞ্চলের বাইরেও এই দুটি জাতের ১১২টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। অলবণাক্ত অঞ্চলে এই দুটি জাতের ফলন হেক্টরপ্রতি ৫ টনের বেশি পাওয়া গেছে। তাই শুধু লবণাক্ত অঞ্চল নয়, অলবণাক্ত অঞ্চলেও এই দুটি জাতের সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। লবণাক্ত অঞ্চলে দেখা গেছে, এই ধানের জাত দুটি সম্পূর্ণ পেকে গেলে ধান ঝরে পড়ার হার একটু বেশি। সে জন্য ৮০ ভাগ ধান পেকে গেলেই কেটে ফেলতে হবে। বিনা ধান-৮ যেহেতু আলোক অসংবেদনশীল, সে জন্য আমন ও আউশ মৌসুমেও এই ধান চাষ করা যাবে। এই জাতটি কুশি অবস্থা থেকে ধান পাকা পর্যন্ত ৮-১০ ডিএস/মিটার এবং চারা অবস্থায় ১২-১৪ ডিএস/মিটার পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। জাতটির ডিগপাতা খাড়া ও লম্বা এবং ধান পাকা অবস্থায় এই গাছের পাতা ও কাণ্ড সবুজ থাকে। ধান উজ্জ্বল, শক্ত এবং এর চাল মাঝারি মোটা। এক হাজারটি ধানের ওজন ২৬.৭ গ্রাম। ব্রি ধান৪৭ জাতের ধানও মাঝারি মোটা। এতে এমাইলোজের পরিমাণ ২৮.৩ ভাগ। এর ভাত ঝরঝরে হয় এবং দীর্ঘ সময় রাখলেও নষ্ট হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে লবণাক্ততা ১০ ডিএস/মিটারের বেশি, সেখানে যদি পুকুর, ডোবা বা নালাতে বৃষ্টির পানি জমা থাকে, তাহলে কুশি, ফুল আসা এবং ধান পাকার সময় এই বৃষ্টির পানি জমিতে সেচ দিয়ে জমির লবণাক্ততা কমিয়ে ধানের কাঙ্ক্ষিত ফলন নিশ্চিত করা যায়।
ব্রি ধান৪৭ এবং বিনা ধান-৮ লবণাক্ত অঞ্চলের কৃষকদের জন্য একটি আশীর্বাদ। তবে লবণাক্ততা যেভাবে বাড়ছে, সে জন্য আমাদের আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে, যাতে করে আরও অধিক মাত্রার লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করা যায়। লবণাক্ততাসহিষ্ণু স্থানীয় জাতগুলো নিয়েও আমরা গবেষণা করতে পারি। হয়তো এসব স্থানীয় জাত থেকেও কোনো ভালো জাত বেরিয়ে আসতে পারে। তবে যে দুটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, আপাতত সে দুটি নিয়েই চিহ্নিত মৌজাগুলোতে সম্প্রসারণের কাজ করতে হবে। এ জন্য সরকারকেও বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ইরি-ইউএসএইড প্রকল্প এখানে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারে।
ড. এম জি নিয়োগী :কনসালট্যান্ট আন্তর্র্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি)
mgneogi@gmail.com
No comments