আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৮৫)-স্বাধীনতার আর বেশি দেরি নেই by আলী যাকের
মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই কলকাতায় বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের ওপর নানা রকম বইপত্র ছাপতে শুরু করে দেয়। যেহেতু কাজের চাপে এসব বইপত্র অথবা প্রকাশনার খবরাখবর রাখা সব সময় সম্ভব হতো না, তবুও এর বেশ কিছুই নজরে পড়ত তখন। এসব বইপত্র বেশির ভাগই বাংলাদেশ থেকে আগত ভারতীয় বাঙালিদের দ্বারা লিখিত।
এরাও একসময় ছিল ছিন্নমূল শরণার্থী এবং এদের অনেকেরই মনে বাংলাদেশের স্মৃতি তখনো অম্লান ছিল। সেই দেশ, সেই গ্রামগঞ্জ-জনপদ, যেখান থেকে প্রাণভয়ে তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিল, সে সম্বন্ধে নানা বাস্তব অভিজ্ঞতা ও কল্পনা মিশিয়ে রচিত এসব গ্রন্থ খুব বড় মাপের লেখা না হলেও পড়তে ভালোই লাগত। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে যত না বই প্রকাশিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বই লেখা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। আসলে এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায় যে লেখাপড়ায় ওপার বাংলা প্রথম থেকেই আমাদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। তবে বেশি লেখা হলে, বিশেষ করে এমন একটি সমসাময়িক এবং জীবন্ত ইতিহাস সম্বন্ধে, যা সাধারণত হয়ে থাকে, তা-ই হয়েছিল। এই লেখাগুলোর বেশির ভাগই বস্তুনিষ্ঠ ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও তখন বাংলাদেশের যুদ্ধই হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রধান বিষয়। এর পেছনে এক ধরনের রোমান্টিসিজম কাজ করত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর তা ছাড়া গোটা পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত আগ্রহী আর উত্তেজিত ছিল যে কলকাতার পত্রপত্রিকার আর কোনো উপায় ছিল না ওই খবর না ছেপে। ওই সময় ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিটি সেক্টরেই প্রত্যক্ষ সহায়তা করছিল। ইনফেন্ট্রি হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যখন পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতো, তখন পাকিস্তানি ইনফেন্ট্রিদের ওপর পেছন থেকে আর্টিলারি বা ভারী গোলা নিক্ষেপ করা হতো। যেহেতু তখন আমাদের কোনো গোলন্দাজ বাহিনী ছিল না, সেহেতু অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় আর্টিলারি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পেছন থেকে পাকিস্তানিদের ওপর ভারী গোলা বর্ষণ করেছে তখন। যা সূচনায় ছিল কেবলই রাজনৈতিক অথবা কূটনৈতিক সমর্থন, তা সামরিক সহায়তার রূপ পরিগ্রহ করে যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় থেকেই।
এই সময় আমরা বুঝতে পারলাম যে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী অনেক চিন্তাভাবনা করে সব দিক গুছিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আগে বেড়েছিলেন। তিনি সারা বিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশে পাকিস্তানের আগ্রাসন এবং গণহত্যা সম্বন্ধে বিশ্বমত সংগঠনের প্রচেষ্টায়। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষ তখন বাংলাদেশের জনযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। একদিকে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে একের পর এক যুদ্ধে পর্যুদস্ত করে চলেছে এবং ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করছেন, তখন পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান প্রায় প্রতিদিন পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে হাস্যকর হুংকার দিয়ে চলেছিল। এমনকি জুলফিকার আলী ভুট্টোও তখন দুচোখে আঁধার দেখছেন। যদিও তিনি বলেছেন যে প্রয়োজনে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও হাজার বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন তাঁরা। এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের প্রতি কখনো নীরব, কখনো সরব সমর্থন জানিয়ে গেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির ওপর প্রস্তাব পেশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করে সেটা নাকচ করে দিয়েছে। তখন বিশ্ব বিভক্ত ছিল দুই মেরুতে, যাকে ইংরেজিতে বলা হতো Bi-polar world। অতএব বাংলাদেশের যুদ্ধেও এই বিভাজন একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন পেয়েছি।
ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব জয় করে বেশির ভাগ গণতন্ত্রমনা নেতাদের এ কথা বোঝাতে সক্ষম হলেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশিদের আর থাকা সম্ভব নয়। বিভিন্ন দেশে কার্য সমাধা করে ইন্দিরা গান্ধী ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় এলেন দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রথমত, কলকাতার অদূরে অবস্থিত শরণার্থী শিবির পরিদর্শন এবং তারপর কলকাতার ময়দানে একটি জনসভায় বক্তৃতা প্রদান। ওই দিন কলকাতার সেই বিশাল জনসভা থেকে ইন্দিরা গান্ধী যখন কলকাতাবাসীর সঙ্গে তাঁর আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করছেন এবং বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করছেন, তখন আমি স্বয়ং মঞ্চেরই কাছে উপস্থিত ছিলাম। বস্তুতপক্ষে আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিবেদক হিসেবেই ওখানে থাকতে পেরেছিলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম যে নিচে থেকে দ্রুত মঞ্চের ওপর উঠে গেলেন তাঁর কোনো একান্ত সচিব এবং ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা চলাকলীনই তাঁর কাছে গিয়ে ক্ষীণ স্বরে কিছু বললেন। ইন্দিরা গান্ধী মনোযোগ সহকারে সেই কথা শুনলেন। তাঁর চেহারায় ভাবান্তর লক্ষ করা গেল। তিনি যেন একটু অস্থির হয়ে উঠেছেন। অতি সামান্য কিছুক্ষণের বিরতি। তারপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন- এই মাত্র আমরা খবর পেলাম যে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ভারতের পাঠানকোট, অমৃতসর, আম্বালা, আগ্রা, ফরিদকোট, অবন্তীপুর, জামনগর এবং আরো কয়েকটি ভারতীয় বিমানবন্দরে আক্রমণ করেছে। অতএব বন্ধুগণ, আমরা এখন পাকিস্তান দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত। এখন আসুন, আমরা আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হই। এই বলেই তিনি দ্রুত মঞ্চ ত্যাগ করে কলকাতা বিমানবন্দরের উদ্দেশে চলে গেলেন। আমরা বুঝলাম যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আর বেশি দেরি নেই।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
এই সময় আমরা বুঝতে পারলাম যে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী অনেক চিন্তাভাবনা করে সব দিক গুছিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আগে বেড়েছিলেন। তিনি সারা বিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশে পাকিস্তানের আগ্রাসন এবং গণহত্যা সম্বন্ধে বিশ্বমত সংগঠনের প্রচেষ্টায়। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষ তখন বাংলাদেশের জনযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। একদিকে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে একের পর এক যুদ্ধে পর্যুদস্ত করে চলেছে এবং ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করছেন, তখন পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান প্রায় প্রতিদিন পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে হাস্যকর হুংকার দিয়ে চলেছিল। এমনকি জুলফিকার আলী ভুট্টোও তখন দুচোখে আঁধার দেখছেন। যদিও তিনি বলেছেন যে প্রয়োজনে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও হাজার বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন তাঁরা। এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের প্রতি কখনো নীরব, কখনো সরব সমর্থন জানিয়ে গেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির ওপর প্রস্তাব পেশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করে সেটা নাকচ করে দিয়েছে। তখন বিশ্ব বিভক্ত ছিল দুই মেরুতে, যাকে ইংরেজিতে বলা হতো Bi-polar world। অতএব বাংলাদেশের যুদ্ধেও এই বিভাজন একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন পেয়েছি।
ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব জয় করে বেশির ভাগ গণতন্ত্রমনা নেতাদের এ কথা বোঝাতে সক্ষম হলেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশিদের আর থাকা সম্ভব নয়। বিভিন্ন দেশে কার্য সমাধা করে ইন্দিরা গান্ধী ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় এলেন দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রথমত, কলকাতার অদূরে অবস্থিত শরণার্থী শিবির পরিদর্শন এবং তারপর কলকাতার ময়দানে একটি জনসভায় বক্তৃতা প্রদান। ওই দিন কলকাতার সেই বিশাল জনসভা থেকে ইন্দিরা গান্ধী যখন কলকাতাবাসীর সঙ্গে তাঁর আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করছেন এবং বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করছেন, তখন আমি স্বয়ং মঞ্চেরই কাছে উপস্থিত ছিলাম। বস্তুতপক্ষে আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিবেদক হিসেবেই ওখানে থাকতে পেরেছিলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম যে নিচে থেকে দ্রুত মঞ্চের ওপর উঠে গেলেন তাঁর কোনো একান্ত সচিব এবং ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা চলাকলীনই তাঁর কাছে গিয়ে ক্ষীণ স্বরে কিছু বললেন। ইন্দিরা গান্ধী মনোযোগ সহকারে সেই কথা শুনলেন। তাঁর চেহারায় ভাবান্তর লক্ষ করা গেল। তিনি যেন একটু অস্থির হয়ে উঠেছেন। অতি সামান্য কিছুক্ষণের বিরতি। তারপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন- এই মাত্র আমরা খবর পেলাম যে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ভারতের পাঠানকোট, অমৃতসর, আম্বালা, আগ্রা, ফরিদকোট, অবন্তীপুর, জামনগর এবং আরো কয়েকটি ভারতীয় বিমানবন্দরে আক্রমণ করেছে। অতএব বন্ধুগণ, আমরা এখন পাকিস্তান দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত। এখন আসুন, আমরা আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হই। এই বলেই তিনি দ্রুত মঞ্চ ত্যাগ করে কলকাতা বিমানবন্দরের উদ্দেশে চলে গেলেন। আমরা বুঝলাম যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আর বেশি দেরি নেই।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments