হৃদয়নন্দন বনে-হৃদয়নন্দন বন উদ্বেলিত আজ by আলী যাকের
এখন যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই বদান্যতায় গড়ে ওঠা বিশ্বব্যাংক আমাদের দেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণে বরাদ্দকৃত অর্থ তুলে নিয়ে যায়, তখন আমরা হা-হুতাশ করি। আজকে যদি কোনো দুর্নীতির কারণ ঘটে থাকে এই সেতু নির্মাণে, সেই দুর্নীতির পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অবদান বিশ্বব্যাপী এবং আমাদের এই অঞ্চলেও, তা কি অস্বীকার
করা যায়? এ তো সেই দেশেরই ব্যাংক, যারা এমন একটি চৈনিক কোম্পানিকে কন্ট্রাক্ট দেওয়ার কথা বলেছিল, যে কোম্পানি সম্পূর্ণ ভুয়া, যাদের অস্তিত্বই নেই
ÔO Lord, forgiveth Dick for he knoweth not what he doethÕ
পাঠক বন্ধুরা, ওপরের উদ্ধৃত কথাটি শোভিত ছিল কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের বাইরে একটি সাদা হোর্ডিং সাইনে। নিচে ছোট্ট করে এয়ার ইন্ডিয়া বিমানের বহুল পরিচিত চরিত্র মহারাজা হাতজোড় করে, নিমিলিত আঁখি, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনায় রত। তারও নিচে আরও ছোট করে এয়ার ইন্ডিয়ার লোগো। আমি যখনকার ঘটনা বলছি, সেটি ১৯৭১-এর শেষ দিকের সময়। অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষ ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক বাহিনী। মোটামুটি আমরা সবাই এখন আমাদের যুদ্ধকালীন ইতিহাস সম্বন্ধে অবহিত আছি। আমরা জানি কীভাবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আশা, প্রত্যয় এবং ভালোবাসাকে সম্পূর্ণ পদদলিত করে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানকে বাঙালির বিরুদ্ধে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল। ডিসেম্বর মাসে এসে পূর্ব পাকিস্তানে অভিযানরত পাকিস্তান বাহিনী প্রতি মুহূর্তেই যখন আশা করছিল যে, মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর দুর্মর অগ্রাভিযানকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য প্রতিবেশী চীনের সশস্ত্র বাহিনী এগিয়ে আসবে তাদের সহায়তায়, তখন চীন গড়িমসি করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভারত মহাসাগরে অবস্থানরত সপ্তম নৌবহরকে নির্দেশ দিল তারা যেন বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে এবং ভারত ও বাংলাদেশকে সমুচিত শিক্ষা দেয়। এই নির্দেশের বিপরীতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত অত্যন্ত দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তো ভারতীয় নৌবহরকে এমন আদেশও দিয়েছিলেন যে, যদি সেভেন্থ ফ্লিট বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে, তাদের যেন নিদ্বর্িধায় উড়িয়ে দেওয়া হয়। এই যুদ্ধ যদি হতো, তাহলে বঙ্গোপসাগরে দাবানল জ্বলে উঠত এবং এই যুদ্ধ প্রসারিত হতো প্রায় সারাবিশ্বে। ঠিক যেদিন রিচার্ড নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে এই আদেশটি দেন, তার পরের দিনই এয়ার ইন্ডিয়ার উপরোলি্লখিত হোর্ডিং সাইনটি দমদম বিমানবন্দরের বাইরে স্থাপন করা হয়। সাইনটিতে লেখা ঈশ্বরের প্রতি এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজার আবেদন এই ছিল যে, 'হে ঈশ্বর, ডিককে ক্ষমা কর, কেননা সে জানে না সে কী করছে।' ডিক হচ্ছে রিচার্ডের সংক্ষিপ্ত ডাকনাম। অতএব, রিচার্ড নিক্সনকেই ক্ষমা করার জন্য প্রার্থনা করছিল মহারাজা। এই প্রার্থনার জন্যই কিনা জানি না, তবে যে কোনো কারণেই হোক, নিক্সনের শুভ বুদ্ধির উদয় হয় সেই সময় এবং বঙ্গোপসাগরে একটি সম্ভাব্য উত্তাল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়া যায়।
এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামের এই দেশটি অতীতে এবং ঘটিয়ে যাচ্ছে বর্তমানেও। মাঝে মধ্যে অবসর সময়ে এসব চিন্তা মাথায় আসে আর আমি ভাবি, কেন এমন অবিমৃষ্যকারিতার আশ্রয় গ্রহণ করে এমন একটি দেশ, যার রয়েছে সকল ঐশ্বর্য এবং শক্তি? উত্তর খুঁজে পাই না। আমাদের কোনো কোনো বন্ধু আমাদের বলেন যে, উত্তর আমেরিকা অন্যান্য দেশ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন বলেই হয়তোবা তারা বুঝতে পারে না অন্যান্য দেশের গণমানুষ কী চিন্তা করে। সে কারণেই হয়তো তারা এ ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চলে একের পর এক। তারা যে কথা ভেবে এ ধরনের ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সেটা শেষমেশ তাদের বিপক্ষেই যায়। আমরা দেখেছি ইরাকে, আফগানিস্তানে, লিবিয়ায় এবং হয়তো দেখব বিশ্বের আরও অনেক জায়গায়, যেখানে আমেরিকা মনে করে সেসব দেশের সরকারকে উচ্ছেদ করতে পারলেই হয়তো আমেরিকার জন্য শান্তি বয়ে আসবে, কিন্তু ঘটনা ঘটেছে তার ঠিক বিপরীত। এসব দেশে একটি প্রায় ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে বটে, কিন্তু মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মৌলবাদ এবং সেই মৌলবাদীদের হাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই অসংখ্য সৈনিক অকাতরে ও অকারণে প্রাণ দিয়েছে। আমরা একথা স্পষ্টভাবেই জানি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে অন্য কোনো দেশ, সমাজ বা গণমানুষের কী হাল হলো, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা সবসময়ই নিজের নাভির দিকে তাকিয়ে থাকেন। ইংরেজি ভাষায় এর একটি জুতসই অভিব্যক্তি আছে, A navel gazing nation. . তাদের শরীরের কেন্দ্রবিন্দুর বাইরে আর কোনো কিছু নেই। যা কিছু যেখানেই তারা করুক না কেন, এর সবই হচ্ছে নিজ স্বার্থে।
এই স্বার্থ ব্যাহত হয়েছিল বলেই তাদের একসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি নামে আখ্যায়িত করেছিল। তাদেরই ইচ্ছার বিপরীতে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সহায়তা না করার কারণে জেলে আটক অবস্থায় প্রাণ দিতে হয় আমাদের চার জাতীয় নেতাকে। ১৯৭৪-এ শেখ মুজিব নামক বেয়াদব নেতাটিকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৎকালীন মার্কিন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পিএল৪৮০-এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে দেয় খাদ্যসামগ্রী এই দেশে পেঁৗছাতে মাত্র কয়েকদিন বিলম্ব করিয়ে দিয়ে লক্ষাধিক বাঙালির প্রাণ হরণ করা হয়। এ রকম অজস্র উদাহরণ কেবল আমাদের দেশের ইতিহাস থেকেই নয়, দেওয়া যায় সারাবিশ্বের সমস্ত জায়গা থেকে।
এহেন পরাশক্তির কাছ থেকে যে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ। দ্বিধান্বিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুও। আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরুতে আবারও মনে হচ্ছে যে, আমাদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়, তখন আমরা বোধহয় বাধ্য হয়েই হাত বাড়িয়ে দেই এসব অপশক্তির কাছে। তখন আর অন্য কোনো চিন্তা মনে আসে না। উপায়ই থাকে না, তো ভাবব কী নিয়ে? সেই মুহূর্তে মানুষকে কিছুটা অন্তত স্বস্তি দিতে পারলেও মনে হয় অনেক কিছু করলাম। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমবয়সীরা, যারা আমাদের জীবনের শুরু থেকে বাঙালির স্বাতন্ত্র্য ও সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সচেতন ছিলাম এবং এসব সংরক্ষণের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, তারা ভেবেছিলাম যে, ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক পথে নয়, আমাদের সামগ্রিক মুক্তি আসবে খোলনলচা বদলে একটি সম্পূর্ণ নতুন, প্রগতিমুখী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আমাদের এই লক্ষ্যে কাজ করতে দেওয়া হয়নি বিজয় অর্জনের পরও। যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল, তারাই সবার অলক্ষ্যে বসে একজোট হয়ে এমন এক ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল, যাতে করে আমরা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বাতন্ত্র্য নিয়ে জগৎসভায় বলিষ্ঠভাবে পদচারণা করতে না পারি। স্বাধীনতার পরবর্তী সরকার প্রধানরা ভেবেছিলেন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও আমরা নিজের মতো করে আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং তৎসংশ্লিষ্ট উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা নিজেরাই গ্রহণ করব। অতএব বিজয়ের পরপরই তাজউদ্দীন আহমদ যখন নির্দেশ দিলেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশে যতদিন না অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে আসে, কেউ যেন এক হাজার টাকার ওপরে বেতন গ্রহণ না করে, তখন আমরা সাগ্রহে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। যুদ্ধে যাওয়ার সময় আমি যে কোম্পানিতে কাজ করতাম, তারা আমাকে একটি ছোট গাড়ি কিনে দিয়েছিল। আমি সেই গাড়িটি বন্ধ করে রেখে রিকশায় কিংবা পায়ে হেঁটে অফিসে যাতায়াত শুরু করেছিলাম। আমাদের খাদ্য তালিকা থেকে বিলাসবৈভব সম্পূর্ণ বর্জিত হয়েছিল। এমনকি আমাদের বাড়িওয়ালা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলেছিলেন, 'আপনারা এ মাস থেকে মাসে ৬০০ টাকা নয়, ৩০০ টাকা করে ভাড়া দেবেন।' এই কৃচ্ছ্রসাধনে তখন পুরো জাতি সানন্দে রাজি ছিল। কেননা, আমি নিজের চোখে দেখেছি, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভেঙে যাওয়া সড়ক, কী সেতু মেরামতে প্রতিটি মানুষ আগ্রহী হয়ে দিনরাত বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে গেছে। বাংলাদেশ বিরোধী চক্র যখন তাদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এ দেশের ক্ষমতায় আরোহণ করল, তখন একটি এমন ভোগবিলাসী সমাজের প্রতি লালায়িত করে তুলল আমাদের যে, আমরা এসব ইতিহাস বেমালুম ভুলে গিয়ে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ালাম।
এখন যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই বদান্যতায় গড়ে ওঠা বিশ্বব্যাংক আমাদের দেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণে বরাদ্দকৃত অর্থ তুলে নিয়ে যায়, তখন আমরা হা-হুতাশ করি। আজকে যদি কোনো দুর্নীতির কারণ ঘটে থাকে এই সেতু নির্মাণে, সেই দুর্নীতির পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অবদান বিশ্বব্যাপী এবং আমাদের এই অঞ্চলেও, তা কি অস্বীকার করা যায়? এ তো সেই দেশেরই ব্যাংক, যারা এমন একটি চৈনিক কোম্পানিকে কন্ট্রাক্ট দেওয়ার কথা বলেছিল, যে কোম্পানি সম্পূর্ণ ভুয়া, যাদের অস্তিত্বই নেই। এ তো সেই ব্যাংক, যাদের অভ্যন্তরেই দুর্নীতির বসবাস, তাদেরই দেশের প্রগতিশীল লেখক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদদের মতে। এ সম্বন্ধে যদি বিস্তারিত লিখতে যাই, তাহলে একটি কলামে তার স্থান সংকুলান সম্ভব নয়। হয়তো একটি গ্রন্থই রচনা করা যেতে পারে। অতএব, এ নিয়ে আর কথা বাড়াব না।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলছেন বটে যে, আমাদের সেতু আমরাই গড়ব। সেটা যদি করতে হয়, আমাদের সবাইকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং আমি নিশ্চিত যে, আমাদের দেশের জনসাধারণ যেমন, স্কুলের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে, তরুণ, প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধ খেটে খাওয়া মানুষেরা সবাই অত্যন্ত আত্মসম্মান সচেতন। তারা ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর ওপরে তাদের আস্থা অর্পণ করে সামনে এগিয়ে এসেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কেবল এতেই কুলাবে না। যে কৃচ্ছ্রসাধন প্রয়োজন হবে, সেটা করতে আজকের এই দেশের উঁচুতলার মানুষদের এগিয়ে আসার প্রয়োজন রয়েছে। অথচ আমরা জানি যে, তারা নিজেদের স্বার্থ একতিলও ছেড়ে দিতে রাজি নন। ইতিমধ্যেই তারা নানা ধরনের বক্রোক্তি শুরু করে দিয়েছেন বিভিন্ন মাধ্যমে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার ভয় হয়, তার নিজের দলেরই অনেক উচ্চস্থানীয় মানুষের সমর্থন পাবেন না। হ্যাঁ, সামনে পাবেন, কিন্তু পেছন থেকে তারাই আমাদের নেত্রীর ভাবমূর্তি বিনাশ সাধনে সক্রিয় হবেন। অত্যন্ত বড় কথা বলে ফেললাম, হয়তো বেয়াদবি হয়ে গেল, কিন্তু সেই '৭৫ সাল থেকে দেখেছি তো অনেক, তাই বুকে বড় ভয় দানা বেঁধে আসে। আরও একটি কথা এবং এই বিষয় সম্পর্কে আজকের কলামের শেষ কথা, আমাদের সকলের সনির্বন্ধ অনুরোধ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে, পদ্মা সেতুকে ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ যখন এসেছেই, এই অভিযোগটিকে সমূলে বিনাশ করার জন্য অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ এবং ব্যাপক একটি অনুসন্ধান যেন তিনি নিজেই শুরু এবং শেষ করে দেখিয়ে দেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধুরই কন্যা বটে।
আজ হৃদয়নন্দন বন বড় উদ্বেলিত এসব জাগতিক চিন্তা নিয়ে। পরের কিস্তিতে আবার মনোরম বিষয় নিয়ে হয়তো লেখা যাবে।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ÔO Lord, forgiveth Dick for he knoweth not what he doethÕ
পাঠক বন্ধুরা, ওপরের উদ্ধৃত কথাটি শোভিত ছিল কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের বাইরে একটি সাদা হোর্ডিং সাইনে। নিচে ছোট্ট করে এয়ার ইন্ডিয়া বিমানের বহুল পরিচিত চরিত্র মহারাজা হাতজোড় করে, নিমিলিত আঁখি, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনায় রত। তারও নিচে আরও ছোট করে এয়ার ইন্ডিয়ার লোগো। আমি যখনকার ঘটনা বলছি, সেটি ১৯৭১-এর শেষ দিকের সময়। অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষ ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক বাহিনী। মোটামুটি আমরা সবাই এখন আমাদের যুদ্ধকালীন ইতিহাস সম্বন্ধে অবহিত আছি। আমরা জানি কীভাবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আশা, প্রত্যয় এবং ভালোবাসাকে সম্পূর্ণ পদদলিত করে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানকে বাঙালির বিরুদ্ধে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল। ডিসেম্বর মাসে এসে পূর্ব পাকিস্তানে অভিযানরত পাকিস্তান বাহিনী প্রতি মুহূর্তেই যখন আশা করছিল যে, মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর দুর্মর অগ্রাভিযানকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য প্রতিবেশী চীনের সশস্ত্র বাহিনী এগিয়ে আসবে তাদের সহায়তায়, তখন চীন গড়িমসি করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভারত মহাসাগরে অবস্থানরত সপ্তম নৌবহরকে নির্দেশ দিল তারা যেন বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে এবং ভারত ও বাংলাদেশকে সমুচিত শিক্ষা দেয়। এই নির্দেশের বিপরীতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত অত্যন্ত দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তো ভারতীয় নৌবহরকে এমন আদেশও দিয়েছিলেন যে, যদি সেভেন্থ ফ্লিট বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে, তাদের যেন নিদ্বর্িধায় উড়িয়ে দেওয়া হয়। এই যুদ্ধ যদি হতো, তাহলে বঙ্গোপসাগরে দাবানল জ্বলে উঠত এবং এই যুদ্ধ প্রসারিত হতো প্রায় সারাবিশ্বে। ঠিক যেদিন রিচার্ড নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে এই আদেশটি দেন, তার পরের দিনই এয়ার ইন্ডিয়ার উপরোলি্লখিত হোর্ডিং সাইনটি দমদম বিমানবন্দরের বাইরে স্থাপন করা হয়। সাইনটিতে লেখা ঈশ্বরের প্রতি এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজার আবেদন এই ছিল যে, 'হে ঈশ্বর, ডিককে ক্ষমা কর, কেননা সে জানে না সে কী করছে।' ডিক হচ্ছে রিচার্ডের সংক্ষিপ্ত ডাকনাম। অতএব, রিচার্ড নিক্সনকেই ক্ষমা করার জন্য প্রার্থনা করছিল মহারাজা। এই প্রার্থনার জন্যই কিনা জানি না, তবে যে কোনো কারণেই হোক, নিক্সনের শুভ বুদ্ধির উদয় হয় সেই সময় এবং বঙ্গোপসাগরে একটি সম্ভাব্য উত্তাল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়া যায়।
এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামের এই দেশটি অতীতে এবং ঘটিয়ে যাচ্ছে বর্তমানেও। মাঝে মধ্যে অবসর সময়ে এসব চিন্তা মাথায় আসে আর আমি ভাবি, কেন এমন অবিমৃষ্যকারিতার আশ্রয় গ্রহণ করে এমন একটি দেশ, যার রয়েছে সকল ঐশ্বর্য এবং শক্তি? উত্তর খুঁজে পাই না। আমাদের কোনো কোনো বন্ধু আমাদের বলেন যে, উত্তর আমেরিকা অন্যান্য দেশ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন বলেই হয়তোবা তারা বুঝতে পারে না অন্যান্য দেশের গণমানুষ কী চিন্তা করে। সে কারণেই হয়তো তারা এ ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চলে একের পর এক। তারা যে কথা ভেবে এ ধরনের ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সেটা শেষমেশ তাদের বিপক্ষেই যায়। আমরা দেখেছি ইরাকে, আফগানিস্তানে, লিবিয়ায় এবং হয়তো দেখব বিশ্বের আরও অনেক জায়গায়, যেখানে আমেরিকা মনে করে সেসব দেশের সরকারকে উচ্ছেদ করতে পারলেই হয়তো আমেরিকার জন্য শান্তি বয়ে আসবে, কিন্তু ঘটনা ঘটেছে তার ঠিক বিপরীত। এসব দেশে একটি প্রায় ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে বটে, কিন্তু মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মৌলবাদ এবং সেই মৌলবাদীদের হাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই অসংখ্য সৈনিক অকাতরে ও অকারণে প্রাণ দিয়েছে। আমরা একথা স্পষ্টভাবেই জানি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে অন্য কোনো দেশ, সমাজ বা গণমানুষের কী হাল হলো, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা সবসময়ই নিজের নাভির দিকে তাকিয়ে থাকেন। ইংরেজি ভাষায় এর একটি জুতসই অভিব্যক্তি আছে, A navel gazing nation. . তাদের শরীরের কেন্দ্রবিন্দুর বাইরে আর কোনো কিছু নেই। যা কিছু যেখানেই তারা করুক না কেন, এর সবই হচ্ছে নিজ স্বার্থে।
এই স্বার্থ ব্যাহত হয়েছিল বলেই তাদের একসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি নামে আখ্যায়িত করেছিল। তাদেরই ইচ্ছার বিপরীতে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সহায়তা না করার কারণে জেলে আটক অবস্থায় প্রাণ দিতে হয় আমাদের চার জাতীয় নেতাকে। ১৯৭৪-এ শেখ মুজিব নামক বেয়াদব নেতাটিকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৎকালীন মার্কিন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পিএল৪৮০-এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে দেয় খাদ্যসামগ্রী এই দেশে পেঁৗছাতে মাত্র কয়েকদিন বিলম্ব করিয়ে দিয়ে লক্ষাধিক বাঙালির প্রাণ হরণ করা হয়। এ রকম অজস্র উদাহরণ কেবল আমাদের দেশের ইতিহাস থেকেই নয়, দেওয়া যায় সারাবিশ্বের সমস্ত জায়গা থেকে।
এহেন পরাশক্তির কাছ থেকে যে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ। দ্বিধান্বিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুও। আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরুতে আবারও মনে হচ্ছে যে, আমাদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়, তখন আমরা বোধহয় বাধ্য হয়েই হাত বাড়িয়ে দেই এসব অপশক্তির কাছে। তখন আর অন্য কোনো চিন্তা মনে আসে না। উপায়ই থাকে না, তো ভাবব কী নিয়ে? সেই মুহূর্তে মানুষকে কিছুটা অন্তত স্বস্তি দিতে পারলেও মনে হয় অনেক কিছু করলাম। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমবয়সীরা, যারা আমাদের জীবনের শুরু থেকে বাঙালির স্বাতন্ত্র্য ও সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সচেতন ছিলাম এবং এসব সংরক্ষণের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, তারা ভেবেছিলাম যে, ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক পথে নয়, আমাদের সামগ্রিক মুক্তি আসবে খোলনলচা বদলে একটি সম্পূর্ণ নতুন, প্রগতিমুখী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আমাদের এই লক্ষ্যে কাজ করতে দেওয়া হয়নি বিজয় অর্জনের পরও। যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল, তারাই সবার অলক্ষ্যে বসে একজোট হয়ে এমন এক ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল, যাতে করে আমরা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বাতন্ত্র্য নিয়ে জগৎসভায় বলিষ্ঠভাবে পদচারণা করতে না পারি। স্বাধীনতার পরবর্তী সরকার প্রধানরা ভেবেছিলেন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও আমরা নিজের মতো করে আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং তৎসংশ্লিষ্ট উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা নিজেরাই গ্রহণ করব। অতএব বিজয়ের পরপরই তাজউদ্দীন আহমদ যখন নির্দেশ দিলেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশে যতদিন না অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে আসে, কেউ যেন এক হাজার টাকার ওপরে বেতন গ্রহণ না করে, তখন আমরা সাগ্রহে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। যুদ্ধে যাওয়ার সময় আমি যে কোম্পানিতে কাজ করতাম, তারা আমাকে একটি ছোট গাড়ি কিনে দিয়েছিল। আমি সেই গাড়িটি বন্ধ করে রেখে রিকশায় কিংবা পায়ে হেঁটে অফিসে যাতায়াত শুরু করেছিলাম। আমাদের খাদ্য তালিকা থেকে বিলাসবৈভব সম্পূর্ণ বর্জিত হয়েছিল। এমনকি আমাদের বাড়িওয়ালা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলেছিলেন, 'আপনারা এ মাস থেকে মাসে ৬০০ টাকা নয়, ৩০০ টাকা করে ভাড়া দেবেন।' এই কৃচ্ছ্রসাধনে তখন পুরো জাতি সানন্দে রাজি ছিল। কেননা, আমি নিজের চোখে দেখেছি, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভেঙে যাওয়া সড়ক, কী সেতু মেরামতে প্রতিটি মানুষ আগ্রহী হয়ে দিনরাত বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে গেছে। বাংলাদেশ বিরোধী চক্র যখন তাদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এ দেশের ক্ষমতায় আরোহণ করল, তখন একটি এমন ভোগবিলাসী সমাজের প্রতি লালায়িত করে তুলল আমাদের যে, আমরা এসব ইতিহাস বেমালুম ভুলে গিয়ে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ালাম।
এখন যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই বদান্যতায় গড়ে ওঠা বিশ্বব্যাংক আমাদের দেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণে বরাদ্দকৃত অর্থ তুলে নিয়ে যায়, তখন আমরা হা-হুতাশ করি। আজকে যদি কোনো দুর্নীতির কারণ ঘটে থাকে এই সেতু নির্মাণে, সেই দুর্নীতির পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অবদান বিশ্বব্যাপী এবং আমাদের এই অঞ্চলেও, তা কি অস্বীকার করা যায়? এ তো সেই দেশেরই ব্যাংক, যারা এমন একটি চৈনিক কোম্পানিকে কন্ট্রাক্ট দেওয়ার কথা বলেছিল, যে কোম্পানি সম্পূর্ণ ভুয়া, যাদের অস্তিত্বই নেই। এ তো সেই ব্যাংক, যাদের অভ্যন্তরেই দুর্নীতির বসবাস, তাদেরই দেশের প্রগতিশীল লেখক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদদের মতে। এ সম্বন্ধে যদি বিস্তারিত লিখতে যাই, তাহলে একটি কলামে তার স্থান সংকুলান সম্ভব নয়। হয়তো একটি গ্রন্থই রচনা করা যেতে পারে। অতএব, এ নিয়ে আর কথা বাড়াব না।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলছেন বটে যে, আমাদের সেতু আমরাই গড়ব। সেটা যদি করতে হয়, আমাদের সবাইকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং আমি নিশ্চিত যে, আমাদের দেশের জনসাধারণ যেমন, স্কুলের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে, তরুণ, প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধ খেটে খাওয়া মানুষেরা সবাই অত্যন্ত আত্মসম্মান সচেতন। তারা ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর ওপরে তাদের আস্থা অর্পণ করে সামনে এগিয়ে এসেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কেবল এতেই কুলাবে না। যে কৃচ্ছ্রসাধন প্রয়োজন হবে, সেটা করতে আজকের এই দেশের উঁচুতলার মানুষদের এগিয়ে আসার প্রয়োজন রয়েছে। অথচ আমরা জানি যে, তারা নিজেদের স্বার্থ একতিলও ছেড়ে দিতে রাজি নন। ইতিমধ্যেই তারা নানা ধরনের বক্রোক্তি শুরু করে দিয়েছেন বিভিন্ন মাধ্যমে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার ভয় হয়, তার নিজের দলেরই অনেক উচ্চস্থানীয় মানুষের সমর্থন পাবেন না। হ্যাঁ, সামনে পাবেন, কিন্তু পেছন থেকে তারাই আমাদের নেত্রীর ভাবমূর্তি বিনাশ সাধনে সক্রিয় হবেন। অত্যন্ত বড় কথা বলে ফেললাম, হয়তো বেয়াদবি হয়ে গেল, কিন্তু সেই '৭৫ সাল থেকে দেখেছি তো অনেক, তাই বুকে বড় ভয় দানা বেঁধে আসে। আরও একটি কথা এবং এই বিষয় সম্পর্কে আজকের কলামের শেষ কথা, আমাদের সকলের সনির্বন্ধ অনুরোধ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে, পদ্মা সেতুকে ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ যখন এসেছেই, এই অভিযোগটিকে সমূলে বিনাশ করার জন্য অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ এবং ব্যাপক একটি অনুসন্ধান যেন তিনি নিজেই শুরু এবং শেষ করে দেখিয়ে দেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধুরই কন্যা বটে।
আজ হৃদয়নন্দন বন বড় উদ্বেলিত এসব জাগতিক চিন্তা নিয়ে। পরের কিস্তিতে আবার মনোরম বিষয় নিয়ে হয়তো লেখা যাবে।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments