স্মরণ-হেনা দাসের জন্য ভালোবাসা by সুচিত্রা সরকার
রাশি রাশি ফুলে ঢাকা পড়ল বাক্সটা। কাঠের বাক্স। দৈর্ঘ্যে সাড়ে তিন হাত। চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর ভালোবাসার স্বজনেরা। সবারই চোখে জল। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে বাক্সটা কাঁধে তুলে নিল আটজন। বাকিরা অনুসরণ করল। মুক্তিভবন থেকে শিক্ষক সমিতির অফিস। সেখান থেকে মহিলা পরিষদের অফিস হয়ে শহীদ মিনার।
এখানে আরও মানুষ। অনেক মানুষ! সবাই এসেছে বাক্সটাতে শুয়ে থাকা হেনা দাসকে শেষ বিদায় জানাতে!
হেনা দাস ২০০৯ সালের ২০ জুলাই চলে গেছেন। ৮৫ বছর বয়সে। এর প্রায় তিন বছর আগে, তাঁর দৃষ্টিশক্তি অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনো ছিল আরও কাজ করার ইচ্ছা। সে সময় তাঁর জীবনে আমার প্রবেশ। বিকল্প চোখ হিসেবে।
কারও সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পালা এলেই বলতেন, ‘ওর চোখ দিয়ে আমি দেখি। ওর হাত দিয়ে লিখি। ও আমার বিকল্প চোখ।’
আমি প্রতিনিয়ত তাঁকে পত্রিকা আর বই পড়ে শোনাতাম। সেগুলো শোনার পর লিখতে চাইতেন। লেখা ছিল তাঁর নেশা। তিনি বলতেন, আমি লিখে দিতাম।
রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক, শিক্ষা, নারীর অধিকার; যেখানেই যা ঘটেছে, সে বিষয়ে নিজের ভাবনাগুলো জানাতে চাইতেন অন্যদের।
আমার যেদিন তাঁর বাসায় যাওয়ার কথা থাকত, সেদিন বৃষ্টি এলেই সর্বনাশ! আকুল হয়ে ফোন করতেন, ‘আসবা আজকে?’ ‘না’ বলতে পারতাম না। বৃষ্টির মধ্যে কেন গেলাম, দীপা আন্টি (হেনা দাসের বড় মেয়ে) রাগ করতেন। আর আমরা অপ্রস্তুত হতাম।
আরেক দিনের ঘটনা মনে পড়ছে। কবীর চৌধুরী আর শাহরিয়ার কবির তাঁকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। গুরুত্ব বিচারে তখনই এটা পড়া চাই। ফোন করলেন আমায়, ‘আসতে পারবা? জরুরি একটা চিঠি ছিল!’ তখন রাত সাড়ে নয়টা। তবু গেলাম। পড়ে শোনালাম চিঠি। সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটি। সেই চিঠিতে হেনাদির স্বাক্ষর নিয়ে তখনই কবীর চৌধুরীর কাছে পাঠানো হলো।
হেনা দাস ছিলেন ভীষণ কর্মযোগী। সমাজের প্রতিটি ভালো কাজে নিজের সরব উপস্থিতি চাইতেন। শরীরে কুলোচ্ছে কি কুলোচ্ছে না, ভাবতেন না। একদিন সকালে পান্না কায়সার ফোন করলেন। খেলাঘরের একটি অনুষ্ঠানে হেনাদিকে যেতেই হবে। কিন্তু কী করে সম্ভব? সে সময় হেনাদি হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতেন। আবার যে বাসায় থাকতেন, সেটাও চারতলায়। হুইলচেয়ারসহ হেনাদিকে নামাতে চারজন লোকের প্রয়োজন। পান্না কায়সার সব শুনে বললেন, ‘কোনো ব্যাপার না। হেনাদির উপস্থিতির কাছে এটা কিছুই না। এখনই লোক পাঠাচ্ছি।’
এক সকালে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে হাতে খুব ব্যথা পেয়েছিলেন। শুনে আঁতকে উঠলাম। বললেন, ‘খবরদার, বইল্ল না। তাহলে বিকালে পার্টির অনুষ্ঠানে যেতে দিব না।’ তারপর বাড়ি ফিরেই অসুস্থ। পরদিন খানিকটা ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘অসুবিধায় পড়ে গেলাম। শরীরটা আবার খারাপ হইল। কিন্তু অনুষ্ঠানটা ভালয় ভালয় শেষ হলো। এ-ই শান্তির কথা!’
হেনাদি ভীষণ ইতিবাচক মানুষ ছিলেন। মারা যাওয়ার ছয়-সাত মাস আগের কথা। একটা সংগঠন অনুরোধ করল হেনা দাসের জীবনবৃত্তান্তটা লিখে দিতে। কিন্তু পাস্ট টেনসে। আমি কিছুই বুঝলাম না। হেনাদি চিরাচরিত মিষ্টি হাসি হেসে বললেন, ‘বুঝলে না! আমি মারা গেলে যাতে জীবনবৃত্তান্ত খুঁজতে কষ্ট না হয়! তাই আগেই তৈরি করে রাখল।’
এত বড় নির্মমতা হেসে উড়িয়ে দিতে পারে কজন?
সব শ্রেণীর মানুষ তাঁর চোখে সমান ছিল। বাসার কাজের মেয়েদের প্রতি ভালোবাসাও ছিল অতুলনীয়। মারা যাওয়ার দিন পঁচিশেক আগে বিছানা থেকে পড়ে কোমর ভেঙেছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীভাবে পড়লেন? রুমা পাশে ছিল না?’
যেন খুব গোপন কথা বলছেন। প্রায় ফিসফিস করে বললেন, ‘আমার একমাত্র চিন্তা ছিল, ওদের বকা খাওয়া থেকে বাঁচাব। বাঁচাইছি। বলছি, ওদের কোনো দোষ নাই।’
লেখা বাবদ যে সম্মানী পেতেন, সবটাই গরিবদের দিয়ে দিতেন। একদিন বললাম, ‘দিদি, এই টাকা দিয়ে আপনার মেয়েদের কিছু কিনে দিন।’ বললেন, ‘ওদের অনেক আছে। আমি যাদের দিই, তাদের কিছু নেই। তারা আমার দেবার অপেক্ষায় থাকে।’
এ রকম হাজারো ঘটনা হেনা দাসের চরিত্রের পরিচয় দেয়। আর এই চরিত্র তিনি গড়ে তুলেছিলেন শৈশব থেকেই। হেনা দাস জন্মেছিলেন সিলেটে। ১৯২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। বাবা সতীশ চন্দ্র দত্ত। মা মনোরমা দত্ত। মাত্র ১৪ বছর বয়সে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। সে-ই শুরু। তারপর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ, শিক্ষা আন্দোলন, নারী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ অনেক মানবতাবাদী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। বিয়াল্লিশ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কন্ট্রোল কমিশনের সদস্য ছিলেন। সুফিয়া কামালের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে মহিলা পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। এ ছাড়া শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সহসভানেত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ও শামসুল হক শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। অবশ্য নীতিগত কারণে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। পেয়েছেন রোকেয়া পদকসহ অনেক পদক। লিখেছেন চার পুরুষের কাহিনী, স্মৃতিময় দিনগুলি, নারী আন্দোলন, কমিউনিষ্ট পার্টির ভূমিকা ইত্যাদি।
তিনি চিন্তায় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। বলতেন, ‘আমি আমার পরিবারে ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টি করেছি। এই পরিবারে ধর্মের কোনো পার্থক্য নেই। এটা করতে গিয়ে যারা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাদের বাধাকে তুচ্ছ করেছি।’
এই অসাম্প্রদায়িক, উদার মুক্তচিন্তার মানুষ হেনা দাসের আজ তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
সুচিত্রা সরকার
হেনা দাস ২০০৯ সালের ২০ জুলাই চলে গেছেন। ৮৫ বছর বয়সে। এর প্রায় তিন বছর আগে, তাঁর দৃষ্টিশক্তি অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনো ছিল আরও কাজ করার ইচ্ছা। সে সময় তাঁর জীবনে আমার প্রবেশ। বিকল্প চোখ হিসেবে।
কারও সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পালা এলেই বলতেন, ‘ওর চোখ দিয়ে আমি দেখি। ওর হাত দিয়ে লিখি। ও আমার বিকল্প চোখ।’
আমি প্রতিনিয়ত তাঁকে পত্রিকা আর বই পড়ে শোনাতাম। সেগুলো শোনার পর লিখতে চাইতেন। লেখা ছিল তাঁর নেশা। তিনি বলতেন, আমি লিখে দিতাম।
রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক, শিক্ষা, নারীর অধিকার; যেখানেই যা ঘটেছে, সে বিষয়ে নিজের ভাবনাগুলো জানাতে চাইতেন অন্যদের।
আমার যেদিন তাঁর বাসায় যাওয়ার কথা থাকত, সেদিন বৃষ্টি এলেই সর্বনাশ! আকুল হয়ে ফোন করতেন, ‘আসবা আজকে?’ ‘না’ বলতে পারতাম না। বৃষ্টির মধ্যে কেন গেলাম, দীপা আন্টি (হেনা দাসের বড় মেয়ে) রাগ করতেন। আর আমরা অপ্রস্তুত হতাম।
আরেক দিনের ঘটনা মনে পড়ছে। কবীর চৌধুরী আর শাহরিয়ার কবির তাঁকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। গুরুত্ব বিচারে তখনই এটা পড়া চাই। ফোন করলেন আমায়, ‘আসতে পারবা? জরুরি একটা চিঠি ছিল!’ তখন রাত সাড়ে নয়টা। তবু গেলাম। পড়ে শোনালাম চিঠি। সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটি। সেই চিঠিতে হেনাদির স্বাক্ষর নিয়ে তখনই কবীর চৌধুরীর কাছে পাঠানো হলো।
হেনা দাস ছিলেন ভীষণ কর্মযোগী। সমাজের প্রতিটি ভালো কাজে নিজের সরব উপস্থিতি চাইতেন। শরীরে কুলোচ্ছে কি কুলোচ্ছে না, ভাবতেন না। একদিন সকালে পান্না কায়সার ফোন করলেন। খেলাঘরের একটি অনুষ্ঠানে হেনাদিকে যেতেই হবে। কিন্তু কী করে সম্ভব? সে সময় হেনাদি হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতেন। আবার যে বাসায় থাকতেন, সেটাও চারতলায়। হুইলচেয়ারসহ হেনাদিকে নামাতে চারজন লোকের প্রয়োজন। পান্না কায়সার সব শুনে বললেন, ‘কোনো ব্যাপার না। হেনাদির উপস্থিতির কাছে এটা কিছুই না। এখনই লোক পাঠাচ্ছি।’
এক সকালে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে হাতে খুব ব্যথা পেয়েছিলেন। শুনে আঁতকে উঠলাম। বললেন, ‘খবরদার, বইল্ল না। তাহলে বিকালে পার্টির অনুষ্ঠানে যেতে দিব না।’ তারপর বাড়ি ফিরেই অসুস্থ। পরদিন খানিকটা ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘অসুবিধায় পড়ে গেলাম। শরীরটা আবার খারাপ হইল। কিন্তু অনুষ্ঠানটা ভালয় ভালয় শেষ হলো। এ-ই শান্তির কথা!’
হেনাদি ভীষণ ইতিবাচক মানুষ ছিলেন। মারা যাওয়ার ছয়-সাত মাস আগের কথা। একটা সংগঠন অনুরোধ করল হেনা দাসের জীবনবৃত্তান্তটা লিখে দিতে। কিন্তু পাস্ট টেনসে। আমি কিছুই বুঝলাম না। হেনাদি চিরাচরিত মিষ্টি হাসি হেসে বললেন, ‘বুঝলে না! আমি মারা গেলে যাতে জীবনবৃত্তান্ত খুঁজতে কষ্ট না হয়! তাই আগেই তৈরি করে রাখল।’
এত বড় নির্মমতা হেসে উড়িয়ে দিতে পারে কজন?
সব শ্রেণীর মানুষ তাঁর চোখে সমান ছিল। বাসার কাজের মেয়েদের প্রতি ভালোবাসাও ছিল অতুলনীয়। মারা যাওয়ার দিন পঁচিশেক আগে বিছানা থেকে পড়ে কোমর ভেঙেছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীভাবে পড়লেন? রুমা পাশে ছিল না?’
যেন খুব গোপন কথা বলছেন। প্রায় ফিসফিস করে বললেন, ‘আমার একমাত্র চিন্তা ছিল, ওদের বকা খাওয়া থেকে বাঁচাব। বাঁচাইছি। বলছি, ওদের কোনো দোষ নাই।’
লেখা বাবদ যে সম্মানী পেতেন, সবটাই গরিবদের দিয়ে দিতেন। একদিন বললাম, ‘দিদি, এই টাকা দিয়ে আপনার মেয়েদের কিছু কিনে দিন।’ বললেন, ‘ওদের অনেক আছে। আমি যাদের দিই, তাদের কিছু নেই। তারা আমার দেবার অপেক্ষায় থাকে।’
এ রকম হাজারো ঘটনা হেনা দাসের চরিত্রের পরিচয় দেয়। আর এই চরিত্র তিনি গড়ে তুলেছিলেন শৈশব থেকেই। হেনা দাস জন্মেছিলেন সিলেটে। ১৯২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। বাবা সতীশ চন্দ্র দত্ত। মা মনোরমা দত্ত। মাত্র ১৪ বছর বয়সে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। সে-ই শুরু। তারপর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ, শিক্ষা আন্দোলন, নারী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ অনেক মানবতাবাদী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। বিয়াল্লিশ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কন্ট্রোল কমিশনের সদস্য ছিলেন। সুফিয়া কামালের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে মহিলা পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। এ ছাড়া শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সহসভানেত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ও শামসুল হক শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। অবশ্য নীতিগত কারণে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। পেয়েছেন রোকেয়া পদকসহ অনেক পদক। লিখেছেন চার পুরুষের কাহিনী, স্মৃতিময় দিনগুলি, নারী আন্দোলন, কমিউনিষ্ট পার্টির ভূমিকা ইত্যাদি।
তিনি চিন্তায় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। বলতেন, ‘আমি আমার পরিবারে ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টি করেছি। এই পরিবারে ধর্মের কোনো পার্থক্য নেই। এটা করতে গিয়ে যারা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাদের বাধাকে তুচ্ছ করেছি।’
এই অসাম্প্রদায়িক, উদার মুক্তচিন্তার মানুষ হেনা দাসের আজ তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
সুচিত্রা সরকার
No comments