নিউইয়র্কে বইমেলা by হাসান ফেরদৌস
বস্টন থেকে এসেছিল মেয়েটি। অর্থনীতি বা এই রকম ভারী কী একটা বিষয় নিয়ে স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রী। আগের সন্ধ্যায় ফোন করে জেনে নিয়েছিল, কখন কোথায় বইমেলা হবে। জানতে চেয়েছিল সময়মতো আসতে পারলে ঠিক ঠিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হবে কি না।
‘আমি কিন্তু অনেক দূর থেকে আসব। শুধু এক দিনের জন্য।’ কিছুটা আশায়, কিছুটা উদ্বেগের সঙ্গে মেয়েটি বলেছিল।
নাম জানা নেই। আগে কখনো দেখিনি। শনিবার সকালে বইমেলার উদ্বোধন। কাগজে-কলমে ১১টায় শুরু, কিন্তু বাঙালির অনুষ্ঠান কবে আর সময়মতো শুরু হয়েছে! আমি একটা-দেড়টার দিকে দুপুরের খাওয়া সেরে হাজির। দেখি একটি মেয়ে সিঁড়িতে বসা, পাশে একগাদা বই। আমাকে দেখেই মুখখানা প্রসন্ন হয়ে উঠল তার। উঠে দাঁড়িয়ে কিছুটা অনুযোগের সুরে বলল, ‘কই, সুনীলদা তো এখনো আসেননি।’ কথা শুনে বুঝতে বাকি রইল না এই মেয়েই আগের সন্ধ্যায় ফোন করে খোঁজখবর নিয়েছিল। আমি কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, ‘মেলার তো মাত্র শুরু। এসে পড়বেন।’ মেয়েটি নিজে থেকেই দেখাল কী কী বই সে ইতিমধ্যে কিনেছে। অধিকাংশই কবিতার, অথবা মুক্তিযুদ্ধের। দুটি বই সে সঙ্গে করে বয়ে এনেছে, একটি কবিতার, হঠাৎ নীরার জন্য; অন্যটি একটি শিশুতোষ গ্রন্থ। ‘আমার ভীষণ প্রিয়, ঢাকা থেকে আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। সুনীল গাঙ্গুলির অটোগ্রাফের জন্য আলাদা করে রেখে দিয়েছি।’
আমি অবাক হয়ে মেয়েটিকে ভালো করে দেখি। এ দেশে সম্ভবত খুব বেশি দিন হয়নি, সে জন্যই কথায়, উচ্চারণে কঠিন ‘আর’ এখনো পেয়ে বসেনি। চ ও ছ মিলিয়ে এক বিচিত্র উচ্চারণের বাতিকও নেই। কবিতার জন্য ভালোবাসাটা কৃত্রিম নয় বলে মনে হলো। মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার দরকার পড়ল না, সুনীলদা এসে পড়লেন। দুই হাতে বই নিয়ে মেয়েটি প্রিয় কবির সামনে দাঁড়াল।
গত ২০ বছরে নিউইয়র্কের বইমেলায় এমন আহ্লাদি, আগ্রহী পাঠকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে বিস্তর। কেউ সদ্য দেশ থেকে আসা, কেউ দীর্ঘদিন আগে এসেছে। আগে হোক বা পরে, প্রত্যেকের বুকের ভেতরেই বাংলা ভাষা, তার সাহিত্য ও সংগীতের জন্য আলাদা একটা জায়গা করা আছে। অন্য কিছু দিয়ে সে জায়গা পূরণ হওয়ার নয়। বাংলা বই হাতে নিলে শৈশব ফিরে আসে, বুকের ভেতর বেজে ওঠে প্রিয় গানের সুর, ইচ্ছে জাগে বৃষ্টিতে ভিজতে। যত দিন যায় তত বিবর্ণ হয় স্মৃতি, বাড়ে নিজস্ব গৃহস্থালি, দেশের সঙ্গে প্রাত্যহিক সংযোগও শিথিল হয়ে আসে। অথচ হাতে একটা বাংলা বই, রেজওয়ানা চৌধুরীর গলায় একটি রবীন্দ্রসংগীত, হঠাৎ কাসুন্দি দিয়ে কাঁচা আমের ভর্তা—এসবই নিমেষে সব ব্যবধান দূর করে নিয়ে যায় বুকের ভেতর সযত্নে লালিত এক দ্বীপে।
সে দ্বীপের নাম বাংলাদেশ। বইমেলাকে উপলক্ষ করে সে দ্বীপ এসে পৌঁছায় আমাদের দোরগোড়ায়।
গত ২০ বছর ধরে নিউইয়র্কে বাংলা বইমেলা হয়ে আসছে। দুই-আড়াই দিনের অনুষ্ঠান, সারা বছর ধরেই সে অনুষ্ঠানের অপেক্ষায় থাকি আমরা। কারণ, এই একটা সময় যখন পুরো বাংলাদেশকে তার সকল বর্ণাঢ্য আয়োজনে আমরা কাছে পাই। যে দ্বীপ ছিল বুকের ভেতর, সে ধরা দেয় সত্যি হয়ে। এ শহরে বাঙালির স্বাদ ও সাধ মেটাতে হরেক রকম আয়োজনের কমতি নেই, এ কথা সত্যি। শীত নেই গ্রীষ্ম নেই; গানের, কবিতার, নাটকের আসর বসছে। বাঙালি খাবার খেতে চাইলে তারও কমতি নেই। হাজির বিরিয়ানি বা আলাউদ্দিনের মিষ্টি; স্বাদে না হোক, নামে মিলবে বছরের প্রতিদিন। ইলিশ মাছ—হোক না সে বার্মা থেকে আনা—তাও মিলবে বছরের চার ঋতুতেই। অচেনা দেশ, সবাই কথা বলে বিজাতীয় ভাষায়, অথচ দোকানের সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা ‘ভূতের আড্ডা’। নিয়ন সাইনের দূর থেকে চোখে পড়ে চেনা নাম, গুলশান ক্লাব।
নিউইয়র্কে এর সবই আছে, তার পরও বইমেলা ভিন্ন। ঠিক যেমন ভিন্ন—একদম আলাদা—ঢাকায় বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলা।
বইমেলার শুরুটা হয়েছিল কিছুটা অপরিকল্পিতভাবে, একদম ব্যক্তিগত উদ্যোগে। বিশ্বজিৎ সাহা এ দেশে আসার আগে দেশে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আত্মীয়তার সূত্রে বাঁধা ছিলেন বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহার সঙ্গে। তাঁরই উদ্যোগে বইমেলার শুরু ১৯৯১ সালে। সে সময় বিশ্বজিৎ এ দেশে বাংলা বই বাজারজাত করার চেষ্টা করছেন। তখন তাঁর না ছিল কোনো দোকান, না ছিল কোনো প্রদর্শনীকক্ষ। হাতে হাতে বই নিয়ে ঘুরেছেন। অনেক বেশি লোকের কাছে বছরে এক দিনের জন্য হলেও অনেক বই পৌঁছে দেবেন, সম্ভবত সে চিন্তা থেকেই বইমেলার শুরু। তার চেয়ে বড় চিন্তা ছিল এই এক বা দুই দিনের জন্য প্রবাসী বাঙালিদের বিদেশের মাটিতে স্বদেশের আয়না তুলে ধরা। প্রথমে এক বিকেল ও সন্ধ্যা, তারপর দুই দিন, এখন পরপর তিন দিনে গিয়ে ঠেকেছে বইমেলা।
একদম গোড়া থেকেই বইমেলা একটি নিজস্ব রাজনৈতিক চেহারা গ্রহণ করে। একানব্বইতে যখন মেলা শুরু, বাংলাদেশে তখন সদ্য গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে, দেশজুড়ে চলছে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার দাবি নিয়ে আন্দোলন। সেই আন্দোলনের উত্তাপ এই শহরের বাঙালিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। একদম গোড়া থেকে এ কথাটা স্পষ্ট হয়ে যায়: বই যেমন নিরপেক্ষ নয়, তেমনি নিরপেক্ষ নয় এই বইমেলা। কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম না হয়েও সেখানে একটি অনুচ্চ রাজনৈতিক মন্ত্র উচ্চারিত হয়। ‘এই মেলায় কোনো ঘাতক-দালাল বা তাদের বান্ধবের স্থান নেই।’ গত ২০ বছরে এই নিয়মের কোনো নড়চড় হয়নি।
আরও একটি ব্যাপার নিউইয়র্কের বইমেলাকে অন্য সব উৎসব-আয়োজন থেকে স্বতন্ত্র করেছে। এই মেলা সকল বাঙালির, তা সে যে দেশের নাগরিকই হোক না কেন। মেলাটি গড়ে উঠেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কিন্তু এই একটি ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে পরিকল্পিত উদ্যোগ। ভৌগোলিক মানচিত্রে যত দূরত্বই থাক না কেন, পৃথিবীর সকল বাঙালিই এক সূত্রে বাঁধা পড়েছেন রবীন্দ্রনাথে, নজরুলে, লালনে ও জীবনানন্দে। সেই অভিন্ন গ্রন্থির পুনরাঙ্গিকার হিসেবে প্রতিবছর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক, বাংলা সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ রূপকারদের আমন্ত্রণ জানানো হয় এই মেলায়। প্রতিবছর তাঁদের ভেতর থেকে এক বা একাধিক ব্যক্তিত্বকে জানানো হয় আন্তরিক সম্মাননা। ঢাকা থেকে আসা লেখকদের মধ্যে সেই সম্মাননা পেয়েছেন হাসান আজিজুল হক, রফিক আজাদ, হুমায়ুন আজাদ ও হুমায়ূন আহমেদ। কলকাতা থেকে আসা লেখকদের মধ্যে সম্মাননা পেয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার ও জয় গোস্বামী। লন্ডন থেকে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন তপন রায় চৌধুরী ও গোলাম মুরশিদ।
এ বছর একুশতম বইমেলা বসছে ২৯ ও ৩০ জুন ও ১ জুলাই। বাঙালি-অধ্যুষিত জ্যামাইকার একটি স্কুলে তিন দিন ধরে চলবে এই মেলা। বই তো থাকছেই, সঙ্গে থাকছে গান, নাটক ও কাব্য পাঠের আসর। এই মেলার একটি প্রধান আকর্ষণ হুমায়ূন আহমেদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী। দেশে বা বিদেশে এই প্রথম হুমায়ূনের আঁকা ছবি আমরা দেখতে পাব। মেলার জন্য তিনি বিশেষভাবে লিখেছেন শতবর্ষের বাংলা গান। হুমায়ূন আহমেদের উপস্থাপনায় সে গান পরিবেশনার কথা তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের। মেলার তরফ থেকে বিশেষ সম্মাননাও দেওয়ার কথা তাঁকে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে সংশয় জাগছে, হুমায়ূন নিজে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবেন কি না। দুরারোগ্য ব্যাধিতে চিকিৎসাধীন তিনি। মাত্র এক সপ্তাহ আগে তাঁর সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে। আমরা সবাই এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিলাম, তিনি নিশ্চয় অনুষ্ঠানে থাকবেন। ঢাকায় নানা সাক্ষাৎকারে মেলার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ ও উৎসাহের কথা তিনি নিজেই ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু হঠাৎ জটিলতা দেখা দেওয়ায় নতুন করে জরুরি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি তখনো তিনি হাসপাতালে। হুমায়ূন উপস্থিত থাকুন অথবা না থাকুন, মেলার প্রতিটি দর্শকের প্রার্থনায় তিনি উপস্থিত থাকবেন, এ কথায় কোনো ভুল নেই।
এ বছর মেলার একটি বড় আকর্ষণ বাংলাদেশ থেকে আগত একটি সরকারি প্রতিনিধিদল। সে দলের সদস্য হিসেবে যাঁদের আসার কথা, তাঁদের মধ্যে আছেন কথাসাহিত্যিক শওকত আলী, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও নাশিদ কামাল। এ ছাড়া কলকাতা থেকে আসছেন সমরেশ মজুমদার ও বিনতা রায় চৌধুরী।
এবার মেলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছেন একাত্তরে বাঙালির সহমুক্তিযোদ্ধা মার্কিন মানবাধিকারকর্মী রিচার্ড টেইলার। ১৯৭১-এ বালটিমোর সমুদ্রবন্দরে মার্কিন শান্তিকর্মীরা অস্ত্রবোঝাই সমুদ্রগামী পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মাকে ছোট ছোট ডিঙিনৌকা দিয়ে আটকে দেন। রিচার্ড টেইলার ছিলেন সেই শান্তিকর্মীদের অন্যতম নেতা। সেই আন্দোলনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি পরে লিখেছিলেন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নীতিমালাবিষয়ক গ্রন্থ ব্লকেড। এ বছর মেলার পক্ষ থেকে তাঁকে জানানো হবে বিশেষ সম্মাননা। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের ঢাকায় যে সম্মাননার আয়োজন করা হয়, তাতে রিচার্ডের যোগ দেওয়ার কথা ছিল। অজ্ঞাত কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি আমন্ত্রণ পাননি। সরকার যে কাজ করতে পারেনি, সে কাজ করবে নিউইয়র্কের বইমেলা। সকল বাঙালির পক্ষ থেকে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হবে আমাদের সকৃতজ্ঞ সংশাপত্র।
আগামী তিনটি দিন এক ভিন্ন সাজে সাজবে মহানগর নিউইয়র্ক। বসবে বাঙালির মিলনমেলা। প্রায় এক কোটি মানুষের এই শহরে সে মেলার কথা আর কেউ জানুক বা না জানুক, আমরা বাঙালিরা তার জন্য থাকব গভীর অপেক্ষায়। আমি নিশ্চিত জানি, লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে আসবেন পরিচিত-অপরিচিত লেখক। কবিতা পাঠের অনুরোধ পাবেন ভেবে টেলিফোনের দিকে সতৃষ্ণ তাকিয়ে থাকবেন বিনয়ী আবৃত্তিকার। কানাডা থেকে গাড়ি চালিয়ে আসবেন ঝানু সাংবাদিক। শিশুকন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে ফ্লোরিডা থেকে আসবেন আড্ডাবাজ ঔপন্যাসিক-ডাক্তার। ওয়াশিংটন থেকে আসবেন প্রবীণ লেখিকা, সঙ্গে থাকবে সদ্য প্রকাশিত উপন্যাসের কপি। নিজের প্রকাশিত দুই ডজন বই নিয়ে দোকান সাজাবেন আস্থাবান কবি। শাড়ির সঙ্গে মিল রেখে রুপোর গয়না বেছে রাখবেন সংস্কৃতিকর্মী। লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি পরবেন কলাম লেখক।
যাই, মেলায় যাই।
২৯ জুন ২০১২, নিউইয়র্ক
নাম জানা নেই। আগে কখনো দেখিনি। শনিবার সকালে বইমেলার উদ্বোধন। কাগজে-কলমে ১১টায় শুরু, কিন্তু বাঙালির অনুষ্ঠান কবে আর সময়মতো শুরু হয়েছে! আমি একটা-দেড়টার দিকে দুপুরের খাওয়া সেরে হাজির। দেখি একটি মেয়ে সিঁড়িতে বসা, পাশে একগাদা বই। আমাকে দেখেই মুখখানা প্রসন্ন হয়ে উঠল তার। উঠে দাঁড়িয়ে কিছুটা অনুযোগের সুরে বলল, ‘কই, সুনীলদা তো এখনো আসেননি।’ কথা শুনে বুঝতে বাকি রইল না এই মেয়েই আগের সন্ধ্যায় ফোন করে খোঁজখবর নিয়েছিল। আমি কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, ‘মেলার তো মাত্র শুরু। এসে পড়বেন।’ মেয়েটি নিজে থেকেই দেখাল কী কী বই সে ইতিমধ্যে কিনেছে। অধিকাংশই কবিতার, অথবা মুক্তিযুদ্ধের। দুটি বই সে সঙ্গে করে বয়ে এনেছে, একটি কবিতার, হঠাৎ নীরার জন্য; অন্যটি একটি শিশুতোষ গ্রন্থ। ‘আমার ভীষণ প্রিয়, ঢাকা থেকে আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। সুনীল গাঙ্গুলির অটোগ্রাফের জন্য আলাদা করে রেখে দিয়েছি।’
আমি অবাক হয়ে মেয়েটিকে ভালো করে দেখি। এ দেশে সম্ভবত খুব বেশি দিন হয়নি, সে জন্যই কথায়, উচ্চারণে কঠিন ‘আর’ এখনো পেয়ে বসেনি। চ ও ছ মিলিয়ে এক বিচিত্র উচ্চারণের বাতিকও নেই। কবিতার জন্য ভালোবাসাটা কৃত্রিম নয় বলে মনে হলো। মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার দরকার পড়ল না, সুনীলদা এসে পড়লেন। দুই হাতে বই নিয়ে মেয়েটি প্রিয় কবির সামনে দাঁড়াল।
গত ২০ বছরে নিউইয়র্কের বইমেলায় এমন আহ্লাদি, আগ্রহী পাঠকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে বিস্তর। কেউ সদ্য দেশ থেকে আসা, কেউ দীর্ঘদিন আগে এসেছে। আগে হোক বা পরে, প্রত্যেকের বুকের ভেতরেই বাংলা ভাষা, তার সাহিত্য ও সংগীতের জন্য আলাদা একটা জায়গা করা আছে। অন্য কিছু দিয়ে সে জায়গা পূরণ হওয়ার নয়। বাংলা বই হাতে নিলে শৈশব ফিরে আসে, বুকের ভেতর বেজে ওঠে প্রিয় গানের সুর, ইচ্ছে জাগে বৃষ্টিতে ভিজতে। যত দিন যায় তত বিবর্ণ হয় স্মৃতি, বাড়ে নিজস্ব গৃহস্থালি, দেশের সঙ্গে প্রাত্যহিক সংযোগও শিথিল হয়ে আসে। অথচ হাতে একটা বাংলা বই, রেজওয়ানা চৌধুরীর গলায় একটি রবীন্দ্রসংগীত, হঠাৎ কাসুন্দি দিয়ে কাঁচা আমের ভর্তা—এসবই নিমেষে সব ব্যবধান দূর করে নিয়ে যায় বুকের ভেতর সযত্নে লালিত এক দ্বীপে।
সে দ্বীপের নাম বাংলাদেশ। বইমেলাকে উপলক্ষ করে সে দ্বীপ এসে পৌঁছায় আমাদের দোরগোড়ায়।
গত ২০ বছর ধরে নিউইয়র্কে বাংলা বইমেলা হয়ে আসছে। দুই-আড়াই দিনের অনুষ্ঠান, সারা বছর ধরেই সে অনুষ্ঠানের অপেক্ষায় থাকি আমরা। কারণ, এই একটা সময় যখন পুরো বাংলাদেশকে তার সকল বর্ণাঢ্য আয়োজনে আমরা কাছে পাই। যে দ্বীপ ছিল বুকের ভেতর, সে ধরা দেয় সত্যি হয়ে। এ শহরে বাঙালির স্বাদ ও সাধ মেটাতে হরেক রকম আয়োজনের কমতি নেই, এ কথা সত্যি। শীত নেই গ্রীষ্ম নেই; গানের, কবিতার, নাটকের আসর বসছে। বাঙালি খাবার খেতে চাইলে তারও কমতি নেই। হাজির বিরিয়ানি বা আলাউদ্দিনের মিষ্টি; স্বাদে না হোক, নামে মিলবে বছরের প্রতিদিন। ইলিশ মাছ—হোক না সে বার্মা থেকে আনা—তাও মিলবে বছরের চার ঋতুতেই। অচেনা দেশ, সবাই কথা বলে বিজাতীয় ভাষায়, অথচ দোকানের সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা ‘ভূতের আড্ডা’। নিয়ন সাইনের দূর থেকে চোখে পড়ে চেনা নাম, গুলশান ক্লাব।
নিউইয়র্কে এর সবই আছে, তার পরও বইমেলা ভিন্ন। ঠিক যেমন ভিন্ন—একদম আলাদা—ঢাকায় বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলা।
বইমেলার শুরুটা হয়েছিল কিছুটা অপরিকল্পিতভাবে, একদম ব্যক্তিগত উদ্যোগে। বিশ্বজিৎ সাহা এ দেশে আসার আগে দেশে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আত্মীয়তার সূত্রে বাঁধা ছিলেন বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহার সঙ্গে। তাঁরই উদ্যোগে বইমেলার শুরু ১৯৯১ সালে। সে সময় বিশ্বজিৎ এ দেশে বাংলা বই বাজারজাত করার চেষ্টা করছেন। তখন তাঁর না ছিল কোনো দোকান, না ছিল কোনো প্রদর্শনীকক্ষ। হাতে হাতে বই নিয়ে ঘুরেছেন। অনেক বেশি লোকের কাছে বছরে এক দিনের জন্য হলেও অনেক বই পৌঁছে দেবেন, সম্ভবত সে চিন্তা থেকেই বইমেলার শুরু। তার চেয়ে বড় চিন্তা ছিল এই এক বা দুই দিনের জন্য প্রবাসী বাঙালিদের বিদেশের মাটিতে স্বদেশের আয়না তুলে ধরা। প্রথমে এক বিকেল ও সন্ধ্যা, তারপর দুই দিন, এখন পরপর তিন দিনে গিয়ে ঠেকেছে বইমেলা।
একদম গোড়া থেকেই বইমেলা একটি নিজস্ব রাজনৈতিক চেহারা গ্রহণ করে। একানব্বইতে যখন মেলা শুরু, বাংলাদেশে তখন সদ্য গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে, দেশজুড়ে চলছে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার দাবি নিয়ে আন্দোলন। সেই আন্দোলনের উত্তাপ এই শহরের বাঙালিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। একদম গোড়া থেকে এ কথাটা স্পষ্ট হয়ে যায়: বই যেমন নিরপেক্ষ নয়, তেমনি নিরপেক্ষ নয় এই বইমেলা। কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম না হয়েও সেখানে একটি অনুচ্চ রাজনৈতিক মন্ত্র উচ্চারিত হয়। ‘এই মেলায় কোনো ঘাতক-দালাল বা তাদের বান্ধবের স্থান নেই।’ গত ২০ বছরে এই নিয়মের কোনো নড়চড় হয়নি।
আরও একটি ব্যাপার নিউইয়র্কের বইমেলাকে অন্য সব উৎসব-আয়োজন থেকে স্বতন্ত্র করেছে। এই মেলা সকল বাঙালির, তা সে যে দেশের নাগরিকই হোক না কেন। মেলাটি গড়ে উঠেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কিন্তু এই একটি ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে পরিকল্পিত উদ্যোগ। ভৌগোলিক মানচিত্রে যত দূরত্বই থাক না কেন, পৃথিবীর সকল বাঙালিই এক সূত্রে বাঁধা পড়েছেন রবীন্দ্রনাথে, নজরুলে, লালনে ও জীবনানন্দে। সেই অভিন্ন গ্রন্থির পুনরাঙ্গিকার হিসেবে প্রতিবছর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক, বাংলা সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ রূপকারদের আমন্ত্রণ জানানো হয় এই মেলায়। প্রতিবছর তাঁদের ভেতর থেকে এক বা একাধিক ব্যক্তিত্বকে জানানো হয় আন্তরিক সম্মাননা। ঢাকা থেকে আসা লেখকদের মধ্যে সেই সম্মাননা পেয়েছেন হাসান আজিজুল হক, রফিক আজাদ, হুমায়ুন আজাদ ও হুমায়ূন আহমেদ। কলকাতা থেকে আসা লেখকদের মধ্যে সম্মাননা পেয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার ও জয় গোস্বামী। লন্ডন থেকে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন তপন রায় চৌধুরী ও গোলাম মুরশিদ।
এ বছর একুশতম বইমেলা বসছে ২৯ ও ৩০ জুন ও ১ জুলাই। বাঙালি-অধ্যুষিত জ্যামাইকার একটি স্কুলে তিন দিন ধরে চলবে এই মেলা। বই তো থাকছেই, সঙ্গে থাকছে গান, নাটক ও কাব্য পাঠের আসর। এই মেলার একটি প্রধান আকর্ষণ হুমায়ূন আহমেদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী। দেশে বা বিদেশে এই প্রথম হুমায়ূনের আঁকা ছবি আমরা দেখতে পাব। মেলার জন্য তিনি বিশেষভাবে লিখেছেন শতবর্ষের বাংলা গান। হুমায়ূন আহমেদের উপস্থাপনায় সে গান পরিবেশনার কথা তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের। মেলার তরফ থেকে বিশেষ সম্মাননাও দেওয়ার কথা তাঁকে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে সংশয় জাগছে, হুমায়ূন নিজে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবেন কি না। দুরারোগ্য ব্যাধিতে চিকিৎসাধীন তিনি। মাত্র এক সপ্তাহ আগে তাঁর সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে। আমরা সবাই এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিলাম, তিনি নিশ্চয় অনুষ্ঠানে থাকবেন। ঢাকায় নানা সাক্ষাৎকারে মেলার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ ও উৎসাহের কথা তিনি নিজেই ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু হঠাৎ জটিলতা দেখা দেওয়ায় নতুন করে জরুরি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি তখনো তিনি হাসপাতালে। হুমায়ূন উপস্থিত থাকুন অথবা না থাকুন, মেলার প্রতিটি দর্শকের প্রার্থনায় তিনি উপস্থিত থাকবেন, এ কথায় কোনো ভুল নেই।
এ বছর মেলার একটি বড় আকর্ষণ বাংলাদেশ থেকে আগত একটি সরকারি প্রতিনিধিদল। সে দলের সদস্য হিসেবে যাঁদের আসার কথা, তাঁদের মধ্যে আছেন কথাসাহিত্যিক শওকত আলী, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও নাশিদ কামাল। এ ছাড়া কলকাতা থেকে আসছেন সমরেশ মজুমদার ও বিনতা রায় চৌধুরী।
এবার মেলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছেন একাত্তরে বাঙালির সহমুক্তিযোদ্ধা মার্কিন মানবাধিকারকর্মী রিচার্ড টেইলার। ১৯৭১-এ বালটিমোর সমুদ্রবন্দরে মার্কিন শান্তিকর্মীরা অস্ত্রবোঝাই সমুদ্রগামী পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মাকে ছোট ছোট ডিঙিনৌকা দিয়ে আটকে দেন। রিচার্ড টেইলার ছিলেন সেই শান্তিকর্মীদের অন্যতম নেতা। সেই আন্দোলনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি পরে লিখেছিলেন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নীতিমালাবিষয়ক গ্রন্থ ব্লকেড। এ বছর মেলার পক্ষ থেকে তাঁকে জানানো হবে বিশেষ সম্মাননা। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের ঢাকায় যে সম্মাননার আয়োজন করা হয়, তাতে রিচার্ডের যোগ দেওয়ার কথা ছিল। অজ্ঞাত কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি আমন্ত্রণ পাননি। সরকার যে কাজ করতে পারেনি, সে কাজ করবে নিউইয়র্কের বইমেলা। সকল বাঙালির পক্ষ থেকে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হবে আমাদের সকৃতজ্ঞ সংশাপত্র।
আগামী তিনটি দিন এক ভিন্ন সাজে সাজবে মহানগর নিউইয়র্ক। বসবে বাঙালির মিলনমেলা। প্রায় এক কোটি মানুষের এই শহরে সে মেলার কথা আর কেউ জানুক বা না জানুক, আমরা বাঙালিরা তার জন্য থাকব গভীর অপেক্ষায়। আমি নিশ্চিত জানি, লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে আসবেন পরিচিত-অপরিচিত লেখক। কবিতা পাঠের অনুরোধ পাবেন ভেবে টেলিফোনের দিকে সতৃষ্ণ তাকিয়ে থাকবেন বিনয়ী আবৃত্তিকার। কানাডা থেকে গাড়ি চালিয়ে আসবেন ঝানু সাংবাদিক। শিশুকন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে ফ্লোরিডা থেকে আসবেন আড্ডাবাজ ঔপন্যাসিক-ডাক্তার। ওয়াশিংটন থেকে আসবেন প্রবীণ লেখিকা, সঙ্গে থাকবে সদ্য প্রকাশিত উপন্যাসের কপি। নিজের প্রকাশিত দুই ডজন বই নিয়ে দোকান সাজাবেন আস্থাবান কবি। শাড়ির সঙ্গে মিল রেখে রুপোর গয়না বেছে রাখবেন সংস্কৃতিকর্মী। লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি পরবেন কলাম লেখক।
যাই, মেলায় যাই।
২৯ জুন ২০১২, নিউইয়র্ক
No comments