জলাবদ্ধতা নিরসনের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন by প্রণব বল ও মিঠুন চৌধুরী

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচনে মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলমের প্রধান ইস্যু ছিল নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন। নির্বাচনী ইশতেহারে তাঁর চতুর্থ প্রতিশ্রুতি ছিল কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন খালের মুখে স্লুইসগেট নির্মাণ করা। টানা বৃষ্টিতে নগরের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা দুই দিন ডুবে থাকায় সেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এখন আলোচনায়।


২০১০ সাল থেকেই জলাবদ্ধতা নিরসনে কয়েকটি খালে স্লুইসগেট নির্মাণ, নতুন খাল খনন এবং খাল অবৈধ দখলমুক্ত করার আশ্বাস দিয়ে আসছেন মেয়র। কিন্তু এ-সংক্রান্ত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে করপোরেশনের নিজস্ব কোনো উদ্যোগ নেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠিয়ে অর্থায়নের জন্য এখন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন মেয়র।
করপোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসনবিষয়ক কমিটির সভাপতি ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিজয় কুমার চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, মহেশখালে দুটি, চাক্তাই খালে একটি এবং কর্ণফুলী নদীর ১৫ নম্বর জেটি ঘাটের মুখে একটি স্লুইসগেট নির্মাণ প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু শুধু স্লুইসগেট দিয়ে সমস্যা নিরসন হবে না। এলাকাভিত্তিক খাল-নালা তৈরি ও সংস্কার করতে হবে। হিজড়া, চাক্তাই ও মির্জা খাল কোথাও চওড়া কোথাও সরু, এটা পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতার অন্যতম কারণ।
জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসনে সিটি করপোরেশনের বাজেটে বিভিন্ন খাল থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, স্লুইসগেট নির্মাণ, নতুন খাল খনন এবং মেরিনার্স বাইপাস সড়ক নির্মাণের স্বপ্ন দেখানো হয়। গত দুই বাজেটের মতো গতকাল প্রস্তাব করা বাজেটেও এসব কাজ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে মাঝারি মাত্রার ঘণ্টা খানেকের বৃষ্টিতে নগরের চকবাজার, কাপাসগোলা, বাদুড়তলা, আগ্রাবাদ সিডিএ, প্রবর্তক মোড়, হালিশহর, বাকলিয়া, মুরাদপুর ও চান্দগাঁও এলাকায় হাঁটুপানি জমে যেত। কিন্তু এই মৌসুমে জলাবদ্ধ স্থানের তালিকায় নতুন যোগ হয়েছে মেহেদিবাগ, জিইসি, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, দেওয়ান বাজার, হেম সেন লেনসহ কয়েকটি এলাকা। আর গত মঙ্গলবার রেকর্ড বৃষ্টিপাতে নগরের উঁচু ও পাহাড়ি এলাকা ছাড়া বাকি অংশ চলে যায় পানির নিচে।
গতকাল করপোরেশনের বাজেট বক্তৃতায় মেয়র মন্জুর আলম গত অর্থবছরে ১৬টি প্রধান খালের ১৪৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মাটি উত্তোলন করা হয়েছে বলে দাবি করেন। পাশাপাশি ৪১টি ওয়ার্ডের ৪১৮ কিলোমিটার নালা-নর্দমার মাটি তোলার তথ্য দেন তিনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, চাক্তাই খালের মিয়াখান নগর সেতুর আশপাশে, নতুন চাক্তাই সেতু এলাকা, বারইপাড়া, বহদ্দারহাট, ধোনির পোল ও মহেশখালের হালিশহরসংলগ্ন বিভিন্ন অংশে মাটি ও আবর্জনার স্তূপ।
নগরের চন্দনপুরা মিয়ার বাপের মসজিদ এলাকার দোকানি আবদুর রশিদ জানান, খালের কিছু মাটি তুলে খালের প্রায় ভেতরেই ফেলে রাখা হয়েছে। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে সব মাটি আবার খালে মিশে গেছে। মাটি কাটার যে এসকাভেটর আনা হয়েছিল, সেটা খালের ভেতর পড়ে আছে। তার গোড়ায় মাটি জমে চরা পড়ে গেছে।
তবে এবারের জলাবদ্ধতাকে ‘বন্যা’ অভিহিত করে মেয়র মন্জুর জানান, চট্টগ্রামে সব বালুর পাহাড়। বৃষ্টিতে পাহাড় ধুয়ে আসা বালুতে নালা-নর্দমা বন্ধ হয়ে যায়। পানি রাস্তার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে অল্প বৃষ্টিতেই বাকলিয়া, চকবাজার, কাপাসগোলাসহ কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেন তিনি।
জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রামের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেন মজুমদার প্রথম আলোকে জানান, সংকট নিরসনে বর্তমান খালগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি নতুন তিনটি খাল খনন জরুরি। এগুলো হলো: বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী নদীর মোহনা, বিপ্লব উদ্যান থেকে বহদ্দারহাট ও চাক্তাই ডাইভারশন খাল। তিনি আরও জানান, শুধু আন্তরিকতা নয়, যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়া অনেক বেশি জরুরি। খালের মাটি কাটার কাজ ঠিকভাবে হয়েছে কি না, তা-ও দেখতে হবে।
মেয়র মন্জুর আলম জানান, গত ২০ বছরে কোনো খাল খনন করা হয়নি। যে খাল আছে সেগুলোর কিছু অংশ দখল হয়ে গেছে। যে নালা-নর্দমা আছে, তা পানিনিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় চাক্তাই খালের মুখে কাঠ ও নৌকা রেখে পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি জানান, নগরের পূর্বাংশে একাধিক বড় খাল থাকলেও পশ্চিমাংশে বড় খাল আছে মাত্র একটি। তাই এই অংশে পানি নামতে দেরি হয়।
জলাবদ্ধতার কারণ: ২০০৮ সালে জলাবদ্ধতার ১০টি কারণ চিহ্নিত করেছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ছিল নগরের খাল-নালা অবৈধভাবে দখল হওয়া, নালা-নর্দমায় ময়লা ফেলা, খালের পাড়ে বস্তি স্থাপন, পাহাড় কাটার ফলে খাল-নালা ভরাট হওয়া, পুকুর-জলাভূমি ও নিচু জমি ভরাট করা, খালের পাড়ে সড়ক না থাকায় মাটি সরানোয় বিঘ্ন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, খালের মুখে স্লুইসগেট না থাকা, পূর্ণাঙ্গ শহর রক্ষা বাঁধ না থাকা এবং বিদ্যমান খাল-নালার পানিধারণের ক্ষমতা কম থাকা।
নগরের একেক অংশ একেক কারণে জলাবদ্ধ হচ্ছে। যেমন: বাকলিয়া-চকবাজার-কাতালগঞ্জ অংশে মূল খাল চাক্তাই। কিন্তু খালের সব অংশ সমান প্রশস্ত না হওয়া, বাকলিয়া এলাকায় খালের ওপর সেতুর নির্মাণকাজ চলা এবং খাল ও সংলগ্ন নালা পরিষ্কার না থাকায় এখানে অল্প বৃষ্টিতে পানি জমে যায়।
আবার কালুরঘাট-বহদ্দারহাট-মুরাদপুর এলাকার মূল সড়ক সিডিএ এভিনিউতেও এ বছর জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণ উত্তর-দক্ষিণে কোনো প্রাকৃতিক খাল না থাকা। বহদ্দারহাট মোড়ে চলমান ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ এবং চশমা খাল পরিষ্কার না থাকাও বড় কারণ।
আগ্রাবাদ-হালিশহর এলাকা অন্য অংশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত নিচু। এ অংশে একমাত্র পানিপ্রবাহের পথ মহেশখাল। এখানকার নিচু জমি ভরাট করে সড়ক-অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। আবার মহেশখালে স্লুইসগেট না থাকায় জোয়ারের সময় সাগরের পানি এলাকায় ঢুকে পড়ছে।
উত্তর আগ্রাবাদের ওয়ার্ড কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, পার্শ্ববর্তী তিনটি ওয়ার্ডের সব এলাকার পানি এই ওয়ার্ডের ওপর দিয়ে সাগরে নামে। কিন্তু এখানে বড় নালাগুলো দখলের কারণে অপ্রশস্ত হয়ে গেছে। জোয়ারের সময় মহেশখালের মুখে পৌঁছে সব পানি আটকে থাকে।

No comments

Powered by Blogger.