স্মরণ-সীমার মাঝে অসীম তুমি by সাখাওয়াৎ আনসারী

যাঁর স্মরণে এই লেখা, তাঁর জন্ম হয়েছিল অন্যদের সময়ে, ১৯৪২ সালের পরাধীন ভারতবর্ষে, তৎকালীন কলকাতা, এমনকি ঢাকার আধা নাগরিক সভ্যতা থেকেও যোজন যোজন দূর এবং পশ্চাদবর্তী মফস্বল বরিশালের এক অশাহরিক পরিমণ্ডলে।


অথচ তিনিই পরবর্তীকালে সব দূরত্ব ও গ্রাম্যতা অতিক্রম করে সময়কে নিজের করে নিয়েছিলেন স্বীয় যোগ্যতায়। তাঁর পরিচিতি বহুল ছিল না, কিন্তু যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যধন্য হয়েছিলেন, তাঁরাই জানেন—কী অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী তিনি ছিলেন। প্রায় পাণ্ডিত্যশূন্য এই বাংলাদেশে এক অসাধারণ পণ্ডিতজন ছিলেন অধ্যাপক জাহাঙ্গীর তারেক। তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
জাহাঙ্গীর তারেক পড়াশোনা করেছেন বিস্তর। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেছেন ১৯৬৪ সালে। পরে এমএ করেছেন আরও দুটি—একটি ইংরেজিতে, অন্যটি ফরাসিতে, প্যারিস ও সরবোনের মতো দুটি বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পিএইচডি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, এবার বিষয়—তুলনামূলক সাহিত্য। কতখানি জ্ঞাননিষ্ঠ হলে মাত্র ৩৩ বছরেই করে ফেলা যায় তিন-তিনটি বিষয়ে এমএ ও পিএইচডি!
জাহাঙ্গীর তারেকের কর্মজীবন কেটেছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ করে যোগদান করেন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে। অতঃপর চট্টগ্রাম কলেজে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ হয়ে ১৯৮০ সালে চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে, সহযোগী অধ্যাপক পদে ফরাসি ভাষার শিক্ষক হয়ে। হয়েছেন এই ইনস্টিটিউটের পরিচালক, অধ্যাপক ও সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এখানেই কাটিয়েছেন শিক্ষকতা, গবেষণা, গবেষণা তত্ত্বাবধান ও নানাবিধ কর্মব্যস্ততায়।
শিক্ষা ও কর্মজীবনের যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো, তা জাহাঙ্গীর তারেকের প্রকৃত পরিচয়ের ছায়ামাত্র। বস্তুত, তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী।
জাহাঙ্গীর তারেকের প্রথম পরিচয় তিনি একজন ভাষাবিজ্ঞানী, আরও স্পষ্ট করে বললে বাগর্থবিজ্ঞানী। অথচ ভাষাবিজ্ঞান বা বাগর্থবিজ্ঞানে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিল না। তিনি এ বিষয়ে অনুরক্ত হয়েছিলেন নিজের আগ্রহে এবং বেছে নিয়েছিলেন ভাষাবিজ্ঞানের দুরূহতম বিষয়গুলোর একটি—বাগর্থবিজ্ঞানকে। ১৯৮০ সালে প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ সম্পাদিত ভাষাবিজ্ঞান পত্রিকায় তাঁর ‘সংকেতায়ন ও বাগর্থিক বৃত্তি’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটিতে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর। জাহাঙ্গীরের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অধ্যাপক চৌধুরী মত প্রকাশ করেন যে ওই প্রবন্ধটিই ছিল পত্রিকাটির শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ। স্টিফেন উলম্যানের প্রিন্সিপলস অব সিম্যালটিকস গ্রন্থটি তাঁরই অনুবাদে শব্দার্থবিজ্ঞানের মূলসূত্র নামে প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমী থেকে। শব্দার্থবিজ্ঞানের ভূমিকা শীর্ষক এ-বিষয়ক এ দেশের প্রথম গ্রন্থটিও তাঁরই রচনা। রচনা করেছেন এ-বিষয়ক প্রবন্ধও।
জাহাঙ্গীর তারেকের শ্রেষ্ঠ পরিচয়—তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ ও দক্ষ অনুবাদক। তাঁর ভাষাজ্ঞানের তালিকাটি বিস্ময়কর রূপে দীর্ঘ—বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, হিন্দি, উর্দু, ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়, স্পেনীয়, পর্তুগিজ, ডাচ ও লাতিন। এমন পারদর্শিতা বর্তমান যুগে এক কথায় বিরল। তাঁর এই বহু ভাষাজ্ঞানের স্বাক্ষর রয়েছে অজস্র অনুবাদে। বাংলা থেকে বিভিন্ন ভাষায় যেমন অনুবাদ করেছেন, তেমনি অনুবাদ করেছেন বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলায়। মূল ফরাসি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাদাম বোভারি। প্রকাশক বাংলা একাডেমী। নজরুলের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ফরাসি, স্পেনীয়, ইতালীয় ও পর্তুগিজ ভাষায় নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে। অনুবাদ এতটাই উচ্চমানসম্পন্ন যে এক পর্তুগিজ অধ্যাপক নজরুল ইনস্টিটিউটে এসে অনুবাদে প্রশংসামুখর হয়ে উঠেছিলেন। ইংরেজি আর ফরাসির যে কত অনুবাদ, প্রতি-অনুবাদ করেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বস্তুত, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অনুবাদ ও জাহাঙ্গীর তারেক নামটি হয়ে উঠেছিল প্রায় সমার্থক। তাঁর ভাষাজ্ঞানের উজ্জ্বল নিদর্শন পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধানেও। তাঁর তত্ত্বাবধানে আরবি ও জাপানি ভাষার পিএইচডি গবেষণাও সম্পন্ন হয়েছে। তিনি ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র যোগ্য উত্তরসূরি।
বাংলা একাডেমী ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে যথাক্রমে ইংরেজি-বাংলা ও বাংলা-ইংরেজির যে দুটি দ্বিভাষিক গুরুত্বপূর্ণ অভিধান প্রকাশ করে, এর দুটিতেই তাঁর ছিল ব্যাপক অবদান। প্রথমটির সম্পাদনা করেছেন দশজন; দ্বিতীয়টির তিনজন। দ্বিতীয়টির সংকলন করেছেন দুজন। জাহাঙ্গীর তারেকই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি দুটি অভিধান সম্পাদনা ও সংকলনেই জড়িত ছিলেন।
পরিসরগত সীমাবদ্ধতার কারণে অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের আরও অনেক গুণের কথা উল্লেখ করা সম্ভব হলো না। সাহিত্যতাত্ত্বিক হিসেবে তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয় প্রতীকবাদী সাহিত্য গ্রন্থটি। এটি পাঠে বোদ্ধামাত্রই অনুধাবনে সক্ষম হবেন যে কী অসীম পাণ্ডিত্যাধিকারী ছিলেন তিনি।
অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের রচনার পরিমাণ বিপুল নয়। এর কারণ, তিনি ছিলেন লেখায় পূর্ণ বিশুদ্ধতাবাদী। শতভাগ নিশ্চিত হয়েই তিনি কলম ধরতেন। এ জন্য তাঁর প্রতিটি লেখাই উচ্চমানসম্পন্ন, অধ্যাপকীয় ও গবেষকীয়। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনুপম। ধর্মিষ্ঠ, মিতভাষী, নীতিনিষ্ঠ, সময়ানুবর্তী এক পূর্ণ মানুষের প্রতিমূর্তি জাহাঙ্গীর তারেক। তিনি পণ্ডিত ছিলেন, কিন্তু পাণ্ডিত্যাভিমানী ছিলেন না কদাচ। অসাধারণ হয়েও যে যত বেশি সাধারণ, সে তত বেশিই অসাধারণ। তিনি পাণ্ডিত্যে অসাধারণ, জীবনাচারে অসাধারণের চেয়েও অসাধারণ। ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ’—এ মন্তব্য তাঁর জন্য প্রযোজ্য শতভাগ। অধ্যাপক জাহাঙ্গীর তারেকের মতো এমন শালপ্রাংশু মানুষ বর্তমান এই সমাজে বড় বেশি প্রয়োজন।
সাখাওয়াৎ আনসারী
অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.