হৃদয়নন্দন বনে-এসেছে আষাঢ় অবশেষে by আলী যাকের

আমি নিশ্চিত যে, সব বাঙালিরই বর্ষা নিয়ে নানারকম মন কেমন করা স্মৃতি রয়েছে। এই বাক্যটি লিখেই মনে হলো, বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে যেমন আমরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠি, ঠিক তেমনি কালো মেঘের আগমন আমাদের মনে কেমন যেন এক অম্ল-মধুর অনুভূতির সৃষ্টি করে।


সুমন চট্টোপাধ্যায়ের একটি আধুনিক গানের কথা মনে পড়ে যায় ওই দিনগুলোতে_ 'মন খারাপ করা বিকেল মানেই মেঘ করেছে/দূরে কোথাও দু'এক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে।' বর্ষার আগমন নিয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি হলো গ্রাম-বাংলায় রাত্রিযাপনের


এবার জ্যৈষ্ঠে যখন গ্রীষ্মের উষ্ণ দাপটে প্রাণ আইঢাই। যখন নিঃশ্বাসে, প্রশ্বাসে আগুনের হলকার মতো বায়ু হয় নির্গত। যখন অনুমান করি, জ্যৈষ্ঠের তাপে থরে থরে বৃক্ষের কাঁঠাল প্রায় পেকে এসেছে যেন। যখন প্রতিনিয়তই আমরা আহাজারিতে ব্যস্ত_ বর্ষা কেন এলো না এখনও? তখন হঠাৎ করেই জ্যৈষ্ঠের একত্রিশ পেরিয়ে এলো আষাঢ়ের প্রথম দিন। ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম, আকাশটা কেমন মেঘলা মেঘলা। হাওয়া কেমন ভেজা ভেজা। তখনই মনটা নেচে উঠল। মেঘ দেখলে ময়ূর যেমন পেখম তুলে নাচে, তেমনি আমার মন যেন ওই ময়ূরের রঙিন পাখা নিয়ে আনন্দ-নৃত্য শুরু করে দিল।
আমরা সবাই জানি, পরিবেশের প্রতি আমাদের দুর্বিনীত আচরণের জন্য আবহাওয়া বিমুখ হয় এখন-তখন দুরাচারী মানুষের প্রতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আবহাওয়া চেষ্টা করেই চলেছে নিরন্তর তার বরাদ্দ কাজ করে যাওয়ার। তাই বর্ষার প্রথম দিনেই মেঘের আনাগোনা দেখতে পাই আজও। হেমন্তের আগমনে ঘাসের ডগায় ডগায় শিশিরের উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের প্রাণিত করে। একেবারে পহেলা বৈশাখেই ফোটে কৃষ্ণচূড়া। অর্থাৎ ছয় ঋতুর সঙ্গে বাঙালির হৃদয়ের যোগ চিরায়ত। আমি কিছু মানুষের কাছে শুনেছি যে, এই ছয় ঋতুকে উপলব্ধি করা নাকি দুঃসাধ্য কাজ। আমি নিদ্বর্িধায় বলতে পারি যে, নিসর্গের প্রতি আগ্রহ আছে, এমন যে কোনো মানুষ প্রতিটি ঋতুর আরম্ভেই বলে দিতে পারবেন যে, ঋতুটি শুরু হলো। এ আদৌ দুঃসাধ্য নয়। পহেলা বৈশাখের বৈশাখী হাওয়া, গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা শুনিয়ে যায় আমাদের। বর্ষার প্রারম্ভে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়_ 'নাচের নেশা লাগল তালের পাতায় পাতায়/হাওয়ার দোলায় দোলায় শালের বনকে মাতায়/আকাশ হতে আকাশে কার ছুটোছুটি/বনে বনে মেঘের ছায়ায় লুটোপুটি/ভরা নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে কে দেয় নাড়া/আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া।' হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে নীল আকাশে কালো মেঘের বদলে যদি সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যেতে দেখি, অমনি বুঝতে পাই, এসেছে শরৎ। ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু আর শিউলি ফুলের আগমন হেমন্তকে প্রাঞ্জল করে তোলে আমাদের কাছে। কুয়াশাঘেরা শীতল সকাল বুঝিয়ে দেয় আমাদের যে, এসেছে শীত। যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন আমলকীর ঐ ডালে ডালে/পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।' আর বসন্তকাল যে কোনো স্পর্শকাতর মানুষকে উদ্বেলিত করে তোলে, উচ্ছ্বসিত করে তোলে। আবারও রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করতে হয়_ 'আকাশ আমায় ভরলো আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে/সুরের আবীর হানব হাওয়ায়, নাচের আবীর হাওয়ায় হানে।'
এবারে বর্ষার আগমনকে গ্রীষ্মে কাতর আমরা বড় উদার চিত্তে স্বাগত জানিয়েছি। আমরা, যারা ঢাকায় বাস করি, তারা এখন তেমনভাবে বৃষ্টিকে পাইনি। মাঝে মধ্যে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে এবং তাতেই গা ভেজাচ্ছি আমরা, মহাআনন্দে। বহুদিনের শুষ্ক, উষ্ণতাপীড়িত আত্মা শান্তি পাচ্ছে যেন।
আমি নিশ্চিত যে, সব বাঙালিরই বর্ষা নিয়ে নানারকম মন কেমন করা স্মৃতি রয়েছে। এই বাক্যটি লিখেই মনে হলো, বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে যেমন আমরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠি, ঠিক তেমনি কালো মেঘের আগমন আমাদের মনে কেমন যেন এক অম্ল-মধুর অনুভূতির সৃষ্টি করে। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের একটি আধুনিক গানের কথা মনে পড়ে যায় ওই দিনগুলোতে_ 'মন খারাপ করা বিকেল মানেই মেঘ করেছে/দূরে কোথাও দু'এক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে।' বর্ষার আগমন নিয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি হলো গ্রাম-বাংলায় রাত্রিযাপনের। সেই বাল্যকালে আমার দিদির কাছে বাদলা রাতে ভূতের গল্প শোনা, মাথার ওপরে টিনের চালে বৃষ্টির একটানা শব্দ এক অসাধারণ রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করত তখন। আরেকটু বড় হয়ে বর্ষালগ্ন মাঠে ফুটবল নিয়ে আছাড় খাওয়া। যৌবনে বর্ষা নিয়ে কবিতা লিখেনি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া বোধহয় দুষ্কর। কোনো এক বর্ষণমুখরিত অপরাহ্নে বাঙালি তরুণের মন উদ্বেলিত করে তোলে বৃষ্টির ধারা, প্রেমের আবেদন এবং তা থেকেই মন কেমন করা। তখন 'একলা বসে ঘরের কোণে কী ভাবি যে আপন মনে/সজল হাওয়া যূথির বনে কী কথা যায় কয়ে।' এবারেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। নবীন-প্রবীণ, আমি নিশ্চিত, সকলেই বর্ষার সুধারস দ্বারা সঞ্জীবিত হয়েছেন। এবারে তো আরও বেশি। কেননা, এবারে গ্রীষ্ম ছিল প্রায় অসহ্য।
সবকিছুই ভালো চলছিল। বাংলাদেশের সর্বত্র প্রায় বর্ষার এই আগমনকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু বাদ সাধল আমাদেরই দেশের কয়েকটি জায়গা। চট্টগ্রাম যেমন অথবা সিলেট। বোকার বাক্সে সচিত্র সংবাদে দেখতে পাই চট্টগ্রামের রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ বিচ্ছিন্ন। এমনকি চট্টগ্রাম বিমানবন্দরও জলমগ্ন। অতএব হাওয়াই জাহাজ সেখানে নামতে পারছে না। আজ আবার দেখলাম কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সিলেটের অবস্থাও তথৈবচ। মনটা খারাপ হয়ে গেল এবং মনে এই শঙ্কাও দেখা দিল যে, এ রকম ঘন বর্ষা ঢাকায় নামলে আমাদের এই শহরও বন্যার জলে ডুবে যাবে। এই শঙ্কাটি অমূলক নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখছি যে, ভারী বর্ষা হলে ঢাকা শহর অচল হয়ে যায়। এসব বন্যার পেছনে নানারকম কারণ কাজ করে। আবহমানকাল থেকে আমাদের বাংলাদেশের নদীগুলোতে প্রতি বর্ষায় ঢল নামে। কিন্তু আমাদের বাল্যকালে কেবল বৃষ্টির কারণে বন্যা হতে দেখেছি কদাচিৎ। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, আসামে প্রবল বৃষ্টিপাত হয় আমরা জানি। বস্তুতপক্ষে আসামের চেরাপুঞ্জীতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়, এ কথাও সর্বজনবিদিত। সেই বৃষ্টি অথবা হিমালয়ের বরফ গলা জল যখন ধেয়ে যায় আমাদের নদীগুলো দিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে, তখন আমরা দেখেছি বাংলাদেশে বন্যা হতে। সব নদীতেই পলিমাটি পড়ে, গভীরতা কমে যায়। অতএব, ভেসে আসা পানি দু'কূল ছাপিয়ে ডাঙায় ঢুকে পড়ে। এই হচ্ছে বন্যার প্রধান কারণ। তবে এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা, যা আমরা অবলীলায় নদীতে ছুড়ে দিই, তার আধিক্য, তাহলে নদীর নাব্যতা প্রায় নিশ্চিতভাবেই কমে আসে।
এ ক্ষেত্রে নদীর গহ্বরে খনন কাজ ছাড়াও নদীগুলোর আবর্জনা দূষণ ঠেকাতে হবে আমাদেরই। শহরে দিনের পর দিন আমরা অব্যয়-অক্ষয় আবর্জনা অবলীলায় নর্দমায় ফেলে আসছি। এর ফলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ব্যাহত হয়। এ থেকেও বন্যার সৃষ্টি হয়। আমরা প্রায়ই বলি কর্তৃপক্ষ কেন এসব নর্দমা পরিষ্কার করে না। ভুলেই যাই যে, এই বিষয়টিতে আমাদের মতো মানুষের অবদান (!) কত বেশি। যদি আমরা আমাদের আচরণে সংযত না হই, তাহলে আমাদের দেশটি বছরের বারো মাসই প্রায় জলমগ্ন থাকবে_ এ বিষয়ে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন পরিবেশবিদরা। চট্টগ্রামে এবারে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম। মাটির পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী বস্তিবাসীদের অনেকবার কর্তৃপক্ষ হুশিয়ার করে দেওয়ার পরও তারা ওই সকল বিপজ্জনক স্থান থেকে সরে আসেনি। ফলে পাহাড়ের মাটিচাপা পড়ে অনেক মানুষ মারা গেছে এই বর্ষায়।
আমাদেরই কৃতকর্মে, আমাদের দুর্দশায় আমার হৃদয়নন্দন বনে ঘনিয়ে আসে বিষাদের কৃষ্ণকায় ছায়া। তবে কি আমরা আমাদের প্রিয় বর্ষা ঋতুকে ফিরিয়ে দেব? প্রার্থনা করব যেন বৃষ্টির ঢল আর না নামে? তা-ই যদি করতে হয় আমাদের শেষমেশ, তবে এর চেয়ে মর্মপীড়ার আর কিছু থাকবে না। না, আমি অন্ততপক্ষে বর্ষার এমন অকল্যাণ কামনা করতে পারি না। রবীন্দ্রনাথের সুরে এই কারণেই সুর মেলাতে ইচ্ছা করে_ 'এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা/গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা/দুলিছে পবনে সনসন বনবীথিকা/গীতিময় তরুলতিকা।'

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.