আমার বাবা আর কার্লোস ফুয়েন্তেসের বন্ধুত্ব by লরেঞ্জা মুনোস
নিউজউইক ও লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের নিয়মিত লেখক লরেঞ্জা মুনোসের বাবা সার্খিও বাতা মুনোস ছিলেন মেক্সিকোর খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক কার্লোস ফুয়েন্তেসের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। পারিবারিক বন্ধু হওয়ায় ছোটবেলায় কাছ থেকে ফুয়েন্তেসকে দেখেছেন লরেঞ্জা।
সম্প্রতি ফুয়েন্তেসের প্রয়াণের পর নিজের বাবার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব নিয়ে নিউজউইকে এই স্মৃতিচারণা করেছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসে ১৪ বছর প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন লরেঞ্জা মুনোস। তিনি একজন লেখকও। প্রথম উপন্যাস দি ওয়েট অব ফ্লাইট লেখা শেষ করতে চাকরি ছাড়েন ২০০৮ সালে। লরেঞ্জা ইউএসসির আনেনবার্গ স্কুল ফর কমিউনিকেশনে সাংবাদিকতার অধ্যাপক।
কার্লোস ফুয়েন্তেস ছিলেন অনেক কিছুই: খ্যাতনামা লেখক, উজ্জ্বল মনীষা, রাষ্ট্রদূত, সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী, ফ্রান্সের লিজিঅন অব অনার এবং স্পেনের প্রিন্স অব আস্তুরিয়াস পুরস্কারজয়ী।
কিন্তু আমাদের পরিবারে কার্লোস ছিলেন এসব ছাপিয়ে আরও বেশি কিছু। তিনি সম্ভবত আমার বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাঁদের সম্পর্ক ছিল চার দশক ধরে। একসঙ্গে চলচ্চিত্র দেখেছেন, আলোচনা করেছেন শিল্প-সাহিত্য-সংগীত ও রাজনীতি নিয়ে। মেতেছেন রসনা বিলাসেও। এককথায়, একসঙ্গে উপভোগ করেছেন জীবনকে।
আমি ও আমার ভাই অনেক সময় বাবাকে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড নিয়ে খোঁচাই। এগুলো সাধারণত আমাদের দুজনের উপলব্ধির অনেক বাইরের ব্যাপার। কিন্তু কার্লোস ছিলেন ঠিক তাঁর নিজের জগতের মানুষ। ভিনটেজ শাতো মাগু পান করতে করতে তাঁরা স্টিফেন ডেডলাস ও বাক মালিগানের সম্পর্ক কিংবা কান্টের ‘ক্রিটিক অব পিওর রিজন’ নিয়ে গল্পে মাততেন। তারপর হয়তো মগ্ন হতেন রুবেন মামুলিয়ানের চলচ্চিত্রের ছয় ঘণ্টার দীর্ঘ রেট্রোস্পেকটিভে। সেখান থেকে যেতেন সুন্দরী নারীদের সঙ্গে কিউবান নাচ নাচতে।
কার্লোস ফুয়েন্তেস ও আমার বাবার বন্ধুত্বটা সত্যিই ছিল বিশেষ ধরনের। এ সম্পর্কের সঙ্গে কার্লোসের শেষ উপন্যাস ডেসটিনি অ্যান্ড ডিজায়ার-এর হোসুয়ে ও হেরিকোর ছোটবেলার বন্ধুত্বের অনেক মিল আছে। কোনো ধরনের তিক্ততা এতে ছায়া ফেলেনি কখনো।
‘আমরা ঠিক করেছিলাম, নিজেদের পছন্দ নয় বা অন্তত নিজেদের বিবেচনাবোধ দিয়ে পরীক্ষিত নয় এমন কোনো মতামত আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ দেব না কাউকে।’ ডেসটিনি অ্যান্ড ডিজায়ার-এ বলেছিল হোসুয়ে।... ‘তা ছাড়া আমরা মনে করতাম, আমাদের মতামত কেবল অভিমতমাত্র নয়, তা সংশয়ও। আমাদের বন্ধুত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি ছিল এটাই।’
সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম কার্লোসের। আচার-আচরণেই প্রকাশ পেত তাঁর এই আভিজাত্যের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার ব্যাপারটি। সব সময়ই রুচিশীল। পরতেন নিখুঁত ছাঁটের স্যুট। বিশুদ্ধ ইংরেজি, স্প্যানিশ আর ফরাসি বলতেন। একই সঙ্গে ছিলেন কেতাদুরস্ত ও যৌনাবেদনময়। মেয়েরা তাঁর জন্য পাগল ছিল।
কার্লোস ফুয়েন্তেসের সঙ্গে আমার বাবার পরিচয় হয় তাঁর প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী রিটা মাচেদোর মাধ্যমে। সেটা ষাটের দশকের কথা। বাবা তখন রিটার মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছেন। বালজাকের একটা উপন্যাসের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা করতে করতে খুব জমে যায় কার্লোস আর আমার বাবার। বাবা বলে ফেললেন, তাঁর কাছে উপন্যাসটা একঘেয়ে লেগেছে। কার্লোস কিন্তু দারুণ ভক্ত ছিলেন বালজাকের। বাবার মন্তব্যের জবাবে তিনি ফরাসি দার্শনিক মিশেল ব্যুতর উদ্ধৃতি দিলেন: বালজাককে একটামাত্র উপন্যাস দিয়ে বিচার করা হচ্ছে ফ্রান্সের ভিজলে মনাস্ট্রিকে একটা পাথর দিয়ে বিচার করা।
বালজাক ফ্রান্সের বাস্তববাদী নাগরিক হলে, কার্লোস মেক্সিকোর বাস্তববাদী নাগরিক।
কার্লোস তাঁর প্রথম উপন্যাস হোয়ার দি এয়ার ইজ ক্লিয়ার লেখার জন্য গৃহহীন ও দরিদ্রদের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। তখন তাঁর বয়স ২৯। প্রথম উপন্যাসটাই তাঁকে সাফল্য এনে দেয়। এ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র মেক্সিকো সিটি শহর নিজেই। এটি রহস্যময়, বিশাল ও মনোমুগ্ধকর আর একই সঙ্গে দুর্বোধ্যতায় ঘেরা একটি স্থান, যা সত্যিকারের আধুনিক একটি উপন্যাসের প্রেক্ষাপট জুগিয়েছে।
কার্লোসের পরবর্তী উপন্যাস দি ডেথ অব আর্তেমিও ক্রুজ বিপ্লবী ধাঁচের উপন্যাস সম্পর্কে পুরোনো ধারণা গুঁড়িয়ে দেয়। মৃত্যুশয্যায় শায়িত এক আঞ্চলিক নেতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাহিনি বলা হয়েছে এতে। কার্লোসের গদ্য সব সময়ই শক্তিশালী, বাস্তবতার নির্মম আগুনে ঝলসানো। আর এ উপন্যাসের শুরুতে জরাজীর্ণ মানুষটিকে ঘিরে আসন্ন মৃত্যুকে যেন সব ইন্দ্রিয় দিয়ে স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারে পাঠক।
‘আমি জেগে উঠলাম।... পুরুষাঙ্গে ওই শীতল বস্তুটির স্পর্শ জাগিয়ে দিয়েছিল আমাকে। জানতাম না যে বিষয়টা খেয়াল না করেও প্রস্রাব করতে পারব আমি। চোখ বন্ধ করে রইলাম। খুব কাছের কণ্ঠস্বরগুলোও শুনতে পাচ্ছিলাম না আমি। চোখ মেলে চাইলে কি তা শুনতে পারব? কিন্তু আমার চোখের পাতা দুটো যে কী ভারী হয়ে উঠেছে! সেগুলো যেন দুটো সিসার পাত। জিহ্বার ওপর রাখা হয়েছে যেন একগাদা ধাতব মুদ্রা, কানে বাজছে হাতুড়িপেটার শব্দ আর নিঃশ্বাসেও...কী বলব...।’
কার্লোসের মেক্সিকো সিটির বাড়ি ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের কেউকেটাদের প্রথম গন্তব্য। তখন মেক্সিকোর সুদিন। দেশের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, চারদিকে আশাবাদ আর সম্ভাবনা। প্রতি রোববার বিকেল চারটায় কার্লোসের বাড়িতে বসত সাহিত্যের আসর। এখানে আসতেন উইলিয়াম স্টাইরন ও নাট্যকার জ্যাক গেলবার ও আর্থার কোপিটের মতো খ্যাতনামা সাহিত্যব্যক্তিত্বরা। আরও আসতেন কবি এলিনা গারো (অক্টাভিও পাজের স্ত্রী), পরিচালক আর্টুরো রিপস্টাইন এবং অবশ্যই আরেক ঔপন্যাসিক ‘লাতিন আমেরিকান বুম জেনারেশন’-এর কলাম্বীয় সদস্য গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস।
বাবা একবার বলেছিলেন, ‘ফুয়েন্তেস ছিলেন সেই দরজা, যা মেক্সিকোকে বিশ্বের কাছে মেলে ধরেছে।’
বাবা লন্ডনে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলে কার্লোস তাঁকে ডিনারের দাওয়াত দিয়েছিলেন। বাবা তাঁর ওখানে থেকে যান তিন মাস। শুনেছি, কার্লোস সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠতেন। আটটার মধ্যে বসে যেতেন কাজের টেবিলে। চার থেকে ছয় ঘণ্টা লেখার পর দুপুরের খাবার খেতেন তিনি। বিকেলে পড়তেন। প্রতিদিন এতটাই নিয়ম করে তিনি এটা করতেন যে বাবা বলতেন, ‘ফুয়েন্তেস প্রোটেস্ট্যান্ট আদর্শ মানা একমাত্র মেক্সিকান।’
কার্লোস খুব দরাজ দিলেরও ছিলেন। আমার প্রথম উপন্যাস পড়ে মন্তব্য লিখে ফ্যাক্স পাঠিয়েছিলেন। কার্লোস ই-মেইল করতেন না। কখনো শর্টহ্যান্ডেও লেখেননি। যা-ই হোক, তিনি এতটাই উৎসাহ দিয়েছিলেন যে আমি লেখা চালিয়ে গেলাম। অনেকের প্রত্যাখ্যান ও নিজের তরফে আত্মসমালোচনার পরও। কার্লোস তাঁর শেষ উপন্যাসটি আমাকে যে কথা লিখে পাঠিয়েছিলেন তা হচ্ছে এই: ‘আমার সহকর্মী ও বন্ধু লরেঞ্জার জন্য, কার্লোস’।
আমি অনেক সময় নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর লেখা পড়ি। ‘দ্য সিগাল’-এ নিনা যেমন কস্তিয়াকে বলে, ‘আমাদের এই কর্মক্ষেত্রটিতে—আমরা লেখক বা অভিনয়শিল্পী যা-ই হই না কেন, খ্যাতি বা গৌরব গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সয়ে টিকে থাকতে শেখা।’
আমার বাবা ও কার্লোসের মধ্যে আরেকটা মিল ছিল। সেটা হচ্ছে দুজনই ভাবালুতা অপছন্দ করতেন। তাঁরা কখনোই কার্লোসের দুই সন্তান কার্লোস ও নাতাশার মৃত্যু নিয়ে কথা বলেননি। এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে কী-ই বা বলার থাকে? তাই বিষয়টা নিয়ে কেউ কিছু বলেননি। দুজনই বুঝে নিয়েছিলেন পরস্পরের অনুভূতি।
কার্লোস আর তাঁর সুন্দরী স্ত্রী সিলভিয়া লেমুস লস অ্যাঞ্জেলেসে এলেই আমার মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতেন। একসঙ্গে খেতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খোশগল্পে কাটিয়ে দিতেন তাঁরা।
কার্লোস যেদিন মারা যান, বাবা সেদিন চীনে। আমি তাঁকে রাত চারটায় ঘুম থেকে জাগিয়ে দুঃসংবাদটা দিলাম। তখনো বাবার ঘুমের ঘোর ভালো করে কাটেনি। কিন্তু একটু পরই শোকটা চেপে বসার আভাস পেলাম।
‘তুমি কি ঠিক আছ বাবা?’, জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘হ্যাঁ মা, আমি ঠিক আছি।’ জবাব দিলেন তিনি। তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। বাবা আবার কথা বললেন...
‘হয়তো এটা তাঁর প্রজন্মের ব্যাপার। কিন্তু জানো, আসলেই তাঁর মতো আর কেউ নেই। ওই ঔজ্জ্বল্য ও মানবিক উষ্ণতা আর মিলবে না’... বাবার কণ্ঠ মিলিয়ে এল। একটু থেমে বললেন, ‘বাক্যালাপ করার জন্য কার্লোসের মতো একজন আর হবে না। সত্যিকার বন্ধু বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন ঠিক তা-ই।’
ভাষান্তর করেছেন: সুমন কায়সার
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসে ১৪ বছর প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন লরেঞ্জা মুনোস। তিনি একজন লেখকও। প্রথম উপন্যাস দি ওয়েট অব ফ্লাইট লেখা শেষ করতে চাকরি ছাড়েন ২০০৮ সালে। লরেঞ্জা ইউএসসির আনেনবার্গ স্কুল ফর কমিউনিকেশনে সাংবাদিকতার অধ্যাপক।
কার্লোস ফুয়েন্তেস ছিলেন অনেক কিছুই: খ্যাতনামা লেখক, উজ্জ্বল মনীষা, রাষ্ট্রদূত, সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী, ফ্রান্সের লিজিঅন অব অনার এবং স্পেনের প্রিন্স অব আস্তুরিয়াস পুরস্কারজয়ী।
কিন্তু আমাদের পরিবারে কার্লোস ছিলেন এসব ছাপিয়ে আরও বেশি কিছু। তিনি সম্ভবত আমার বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাঁদের সম্পর্ক ছিল চার দশক ধরে। একসঙ্গে চলচ্চিত্র দেখেছেন, আলোচনা করেছেন শিল্প-সাহিত্য-সংগীত ও রাজনীতি নিয়ে। মেতেছেন রসনা বিলাসেও। এককথায়, একসঙ্গে উপভোগ করেছেন জীবনকে।
আমি ও আমার ভাই অনেক সময় বাবাকে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড নিয়ে খোঁচাই। এগুলো সাধারণত আমাদের দুজনের উপলব্ধির অনেক বাইরের ব্যাপার। কিন্তু কার্লোস ছিলেন ঠিক তাঁর নিজের জগতের মানুষ। ভিনটেজ শাতো মাগু পান করতে করতে তাঁরা স্টিফেন ডেডলাস ও বাক মালিগানের সম্পর্ক কিংবা কান্টের ‘ক্রিটিক অব পিওর রিজন’ নিয়ে গল্পে মাততেন। তারপর হয়তো মগ্ন হতেন রুবেন মামুলিয়ানের চলচ্চিত্রের ছয় ঘণ্টার দীর্ঘ রেট্রোস্পেকটিভে। সেখান থেকে যেতেন সুন্দরী নারীদের সঙ্গে কিউবান নাচ নাচতে।
কার্লোস ফুয়েন্তেস ও আমার বাবার বন্ধুত্বটা সত্যিই ছিল বিশেষ ধরনের। এ সম্পর্কের সঙ্গে কার্লোসের শেষ উপন্যাস ডেসটিনি অ্যান্ড ডিজায়ার-এর হোসুয়ে ও হেরিকোর ছোটবেলার বন্ধুত্বের অনেক মিল আছে। কোনো ধরনের তিক্ততা এতে ছায়া ফেলেনি কখনো।
‘আমরা ঠিক করেছিলাম, নিজেদের পছন্দ নয় বা অন্তত নিজেদের বিবেচনাবোধ দিয়ে পরীক্ষিত নয় এমন কোনো মতামত আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ দেব না কাউকে।’ ডেসটিনি অ্যান্ড ডিজায়ার-এ বলেছিল হোসুয়ে।... ‘তা ছাড়া আমরা মনে করতাম, আমাদের মতামত কেবল অভিমতমাত্র নয়, তা সংশয়ও। আমাদের বন্ধুত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি ছিল এটাই।’
সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম কার্লোসের। আচার-আচরণেই প্রকাশ পেত তাঁর এই আভিজাত্যের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার ব্যাপারটি। সব সময়ই রুচিশীল। পরতেন নিখুঁত ছাঁটের স্যুট। বিশুদ্ধ ইংরেজি, স্প্যানিশ আর ফরাসি বলতেন। একই সঙ্গে ছিলেন কেতাদুরস্ত ও যৌনাবেদনময়। মেয়েরা তাঁর জন্য পাগল ছিল।
কার্লোস ফুয়েন্তেসের সঙ্গে আমার বাবার পরিচয় হয় তাঁর প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী রিটা মাচেদোর মাধ্যমে। সেটা ষাটের দশকের কথা। বাবা তখন রিটার মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছেন। বালজাকের একটা উপন্যাসের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা করতে করতে খুব জমে যায় কার্লোস আর আমার বাবার। বাবা বলে ফেললেন, তাঁর কাছে উপন্যাসটা একঘেয়ে লেগেছে। কার্লোস কিন্তু দারুণ ভক্ত ছিলেন বালজাকের। বাবার মন্তব্যের জবাবে তিনি ফরাসি দার্শনিক মিশেল ব্যুতর উদ্ধৃতি দিলেন: বালজাককে একটামাত্র উপন্যাস দিয়ে বিচার করা হচ্ছে ফ্রান্সের ভিজলে মনাস্ট্রিকে একটা পাথর দিয়ে বিচার করা।
বালজাক ফ্রান্সের বাস্তববাদী নাগরিক হলে, কার্লোস মেক্সিকোর বাস্তববাদী নাগরিক।
কার্লোস তাঁর প্রথম উপন্যাস হোয়ার দি এয়ার ইজ ক্লিয়ার লেখার জন্য গৃহহীন ও দরিদ্রদের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। তখন তাঁর বয়স ২৯। প্রথম উপন্যাসটাই তাঁকে সাফল্য এনে দেয়। এ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র মেক্সিকো সিটি শহর নিজেই। এটি রহস্যময়, বিশাল ও মনোমুগ্ধকর আর একই সঙ্গে দুর্বোধ্যতায় ঘেরা একটি স্থান, যা সত্যিকারের আধুনিক একটি উপন্যাসের প্রেক্ষাপট জুগিয়েছে।
কার্লোসের পরবর্তী উপন্যাস দি ডেথ অব আর্তেমিও ক্রুজ বিপ্লবী ধাঁচের উপন্যাস সম্পর্কে পুরোনো ধারণা গুঁড়িয়ে দেয়। মৃত্যুশয্যায় শায়িত এক আঞ্চলিক নেতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাহিনি বলা হয়েছে এতে। কার্লোসের গদ্য সব সময়ই শক্তিশালী, বাস্তবতার নির্মম আগুনে ঝলসানো। আর এ উপন্যাসের শুরুতে জরাজীর্ণ মানুষটিকে ঘিরে আসন্ন মৃত্যুকে যেন সব ইন্দ্রিয় দিয়ে স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারে পাঠক।
‘আমি জেগে উঠলাম।... পুরুষাঙ্গে ওই শীতল বস্তুটির স্পর্শ জাগিয়ে দিয়েছিল আমাকে। জানতাম না যে বিষয়টা খেয়াল না করেও প্রস্রাব করতে পারব আমি। চোখ বন্ধ করে রইলাম। খুব কাছের কণ্ঠস্বরগুলোও শুনতে পাচ্ছিলাম না আমি। চোখ মেলে চাইলে কি তা শুনতে পারব? কিন্তু আমার চোখের পাতা দুটো যে কী ভারী হয়ে উঠেছে! সেগুলো যেন দুটো সিসার পাত। জিহ্বার ওপর রাখা হয়েছে যেন একগাদা ধাতব মুদ্রা, কানে বাজছে হাতুড়িপেটার শব্দ আর নিঃশ্বাসেও...কী বলব...।’
কার্লোসের মেক্সিকো সিটির বাড়ি ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের কেউকেটাদের প্রথম গন্তব্য। তখন মেক্সিকোর সুদিন। দেশের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, চারদিকে আশাবাদ আর সম্ভাবনা। প্রতি রোববার বিকেল চারটায় কার্লোসের বাড়িতে বসত সাহিত্যের আসর। এখানে আসতেন উইলিয়াম স্টাইরন ও নাট্যকার জ্যাক গেলবার ও আর্থার কোপিটের মতো খ্যাতনামা সাহিত্যব্যক্তিত্বরা। আরও আসতেন কবি এলিনা গারো (অক্টাভিও পাজের স্ত্রী), পরিচালক আর্টুরো রিপস্টাইন এবং অবশ্যই আরেক ঔপন্যাসিক ‘লাতিন আমেরিকান বুম জেনারেশন’-এর কলাম্বীয় সদস্য গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস।
বাবা একবার বলেছিলেন, ‘ফুয়েন্তেস ছিলেন সেই দরজা, যা মেক্সিকোকে বিশ্বের কাছে মেলে ধরেছে।’
বাবা লন্ডনে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলে কার্লোস তাঁকে ডিনারের দাওয়াত দিয়েছিলেন। বাবা তাঁর ওখানে থেকে যান তিন মাস। শুনেছি, কার্লোস সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠতেন। আটটার মধ্যে বসে যেতেন কাজের টেবিলে। চার থেকে ছয় ঘণ্টা লেখার পর দুপুরের খাবার খেতেন তিনি। বিকেলে পড়তেন। প্রতিদিন এতটাই নিয়ম করে তিনি এটা করতেন যে বাবা বলতেন, ‘ফুয়েন্তেস প্রোটেস্ট্যান্ট আদর্শ মানা একমাত্র মেক্সিকান।’
কার্লোস খুব দরাজ দিলেরও ছিলেন। আমার প্রথম উপন্যাস পড়ে মন্তব্য লিখে ফ্যাক্স পাঠিয়েছিলেন। কার্লোস ই-মেইল করতেন না। কখনো শর্টহ্যান্ডেও লেখেননি। যা-ই হোক, তিনি এতটাই উৎসাহ দিয়েছিলেন যে আমি লেখা চালিয়ে গেলাম। অনেকের প্রত্যাখ্যান ও নিজের তরফে আত্মসমালোচনার পরও। কার্লোস তাঁর শেষ উপন্যাসটি আমাকে যে কথা লিখে পাঠিয়েছিলেন তা হচ্ছে এই: ‘আমার সহকর্মী ও বন্ধু লরেঞ্জার জন্য, কার্লোস’।
আমি অনেক সময় নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর লেখা পড়ি। ‘দ্য সিগাল’-এ নিনা যেমন কস্তিয়াকে বলে, ‘আমাদের এই কর্মক্ষেত্রটিতে—আমরা লেখক বা অভিনয়শিল্পী যা-ই হই না কেন, খ্যাতি বা গৌরব গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সয়ে টিকে থাকতে শেখা।’
আমার বাবা ও কার্লোসের মধ্যে আরেকটা মিল ছিল। সেটা হচ্ছে দুজনই ভাবালুতা অপছন্দ করতেন। তাঁরা কখনোই কার্লোসের দুই সন্তান কার্লোস ও নাতাশার মৃত্যু নিয়ে কথা বলেননি। এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে কী-ই বা বলার থাকে? তাই বিষয়টা নিয়ে কেউ কিছু বলেননি। দুজনই বুঝে নিয়েছিলেন পরস্পরের অনুভূতি।
কার্লোস আর তাঁর সুন্দরী স্ত্রী সিলভিয়া লেমুস লস অ্যাঞ্জেলেসে এলেই আমার মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতেন। একসঙ্গে খেতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খোশগল্পে কাটিয়ে দিতেন তাঁরা।
কার্লোস যেদিন মারা যান, বাবা সেদিন চীনে। আমি তাঁকে রাত চারটায় ঘুম থেকে জাগিয়ে দুঃসংবাদটা দিলাম। তখনো বাবার ঘুমের ঘোর ভালো করে কাটেনি। কিন্তু একটু পরই শোকটা চেপে বসার আভাস পেলাম।
‘তুমি কি ঠিক আছ বাবা?’, জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘হ্যাঁ মা, আমি ঠিক আছি।’ জবাব দিলেন তিনি। তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। বাবা আবার কথা বললেন...
‘হয়তো এটা তাঁর প্রজন্মের ব্যাপার। কিন্তু জানো, আসলেই তাঁর মতো আর কেউ নেই। ওই ঔজ্জ্বল্য ও মানবিক উষ্ণতা আর মিলবে না’... বাবার কণ্ঠ মিলিয়ে এল। একটু থেমে বললেন, ‘বাক্যালাপ করার জন্য কার্লোসের মতো একজন আর হবে না। সত্যিকার বন্ধু বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন ঠিক তা-ই।’
ভাষান্তর করেছেন: সুমন কায়সার
No comments