চরাচর-ঢাকার পিঠা by পাভেল রহমান

বাঙালি লোকসংস্কৃতির সঙ্গে পিঠা জড়িয়ে আছে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। এই নাগরিক জীবনে এসেও শীতের সকালে গ্রামের বাড়িতে চুলার পাশে বসে গরম পিঠা খাওয়ার স্মৃতি হয়তো ভুলতে পারেন না অনেকেই। কিন্তু নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায় কি পিঠা খাওয়ার কথা ভুলতে বসেছে এই প্রাচীরঘেরা শহরের মানুষগুলো?


কিংবা ফাস্ট ফুড আর চায়নিজের আড়ালে পিঠা খাওয়ার মজা কি হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে? এই প্রশ্নগুলো ভাবতে ভাবতে হাইকোর্ট মাজার গেটের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ চোখে পড়ল ছোট্ট চুলায় আগুন জ্বলছে আর তার চারপাশে কিছু মানুষের জটলা। কাছে গিয়ে দেখি, চুলায় তৈরি হচ্ছে চিতই আর ভাপা পিঠা। দেখামাত্র খাওয়ার লোভ কিছুতেই সামলানো গেল না। কিন্তু বিক্রেতা জানিয়ে দিলেন অপেক্ষা করতে হবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম মানুষগুলোকে, যারা আমারই মতো পিঠা খাওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে। ভাবছিলাম, এই নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায় ঘরে বসে পিঠা বানানো এখন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হওয়ায় অনেকেই হয়তো সেই ঝামেলায় যেতে চায় না। কিন্তু পিঠা খাওয়ার লোভ যে হারিয়ে যায়নি, বিভিন্ন ফুটপাতে ছোট ছোট পিঠার দোকান দেখলে সেটা সহজেই বোঝা যায়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে গরম পিঠা খাওয়াটা অনেক মজা লাগছিল। কিন্তু ফুটপাতের এই দোকানটাতে ভাপা ও চিতই ছাড়া আর কোনো পিঠাই পাওয়া যাচ্ছে না। তাই রিকশা নিয়ে রওনা হলাম বেইলি রোডের পিঠাঘরের দিকে। পাটিসাপটা আর নারিকেল-পুলি পিঠার অর্ডার দিয়ে এই ফাঁকে কথা বলছিলাম পিঠাঘরের ম্যানেজার বাশারের সঙ্গে। বাশার ভাই, কী ধরনের পিঠা আছে আপনাদের এখানে? তিনি একে একে বলে যাচ্ছিলেন, 'আমাদের এখানে ঝাল ও মিষ্টি_দুই ধরনের পিঠাই আছে। এগুলোর মধ্যে পাটিসাপটা, মালকোয়া, নোঙ্গর লতিকা, রসফুল, নারিকেল-পুলি, চাপ পোকন, ভেজিটেবল ঝাল, নারিকেল জিলাপি, ফুলঝুরি, বিবিখানা উল্লেখযোগ্য। এখানে ৩ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪০ টাকা দামের পিঠা আছে। ফলে নিম্নআয়ের মানুষও এখানে আসে পিঠা খেতে।' তবে পিঠাঘরের ম্যানেজারের কথায় একটু হতাশ হতে হলো, যখন তিনি বললেন, এখানে নাকি তরুণদের চেয়ে বয়স্করাই বেশি আসেন। তাহলে কি তরুণ প্রজন্ম পিঠার পরিবর্তে ফাস্ট ফুডের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে? আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার পিঠা কি হারিয়ে যাবে? গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী পিঠা কি এই প্রজন্মের কাছে এসে বিলুপ্ত হয়ে যাবে? এমন প্রশ্ন নিয়ে পিঠাঘর থেকে বেরিয়ে আসছিলাম আর ভাবছিলাম, বিশ্বায়ন আর মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাবে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে আমাদের পৃথিবী। তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে পৃথিবী চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। এই পৃথিবীকে আমরা এখন বলছি 'গ্লোবাল ভিলেজ'। বিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতি জীবনকে যেমন অনেক সহজ করে দিয়েছে, তেমনি আমাদের আবেগ-অনুভূতিগুলোকে করে ফেলছে বাঙ্বন্দি।
পাভেল রহমান

No comments

Powered by Blogger.