জন্মশতবর্ষে কমল দাশগুপ্ত-তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি কিছু অনুভব by মোহাম্মদ আসাফউদ্দৌলাহ্

বাংলা গানের শান্ত সরোবরে অনেক ফুলের মেলা। হিমাংশু দত্ত, রাইচাঁদ বড়াল, অনিল বিশ্বাস, অনুপম ঘটক, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, রবীন চট্টোপাধ্যায়, দুর্গা সেন, সুধীর লাল চক্রবর্তী, সুবল দাশগুপ্ত, কমল দাশগুপ্ত, শচীন দেব বর্মণ, সলিল চৌধুরী এবং আরও কিছু সুরকার আধুনিক বাংলা গানের ও উর্দু গীতের শ্রোতাপ্রিয়তা সৃষ্টি ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।


এ পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলামের যুগান্ত সৃষ্টিকারী বাংলা সংগীতের ধারা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
আধুনিক বাংলা গানের জগতে যাঁরা সৃষ্টিশীলতায় অতুল্য বলে আমি মান্য করি, তাঁরা হলেন সুধীর লাল চক্রবর্তী, কমল দাশগুপ্ত, সুবল দাশগুপ্ত, শচীন দেব বর্মণ ও সলিল চৌধুরী। এঁদের সুরে একধরনের স্বকীয় চরিত্র আছে, যে জন্য তাঁদের সুর শুনলেই আমরা বলে দিতে পারি সুরস্রষ্টার নাম।
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এঁদের সুর করা গান খুব একটা শোনেনি। এই সময়ে বদলে গেছে গানের চেহারা। পাশ্চাত্যের পপ ও রক সংগীতের অন্ধ অনুকরণের ফলে বাংলা গানের বিনম্র ও শান্ত রূপ বদলে গিয়ে আসর দখল করেছে এক অসুস্থ বিনোদনের ধারা। বাংলা গানের সুরের অন্তর্মুখিতা আজ অনেকটাই হারিয়ে গেছে। সংগীত এখন বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে। গান এখন শুনতে হয় না, দেখতে হয়। সংগীত আজ বিকট চিৎকার, যৌনতা ও দৈহিক আবেদনের যৌথ উৎসব।
যাঁদের একটু বয়স হয়েছে, তাঁরা বোঝেন, কী আমরা হারিয়েছি। তাঁদের কানে ঘুরে ঘুরে বাজে হারানো দিনের গান—যার সুর ও কাব্য ছুঁয়ে যেত হূদয়। তাই যাঁরা সুর ভালোবাসেন, তাঁরা এখনো একান্তে গুন গুন করেন বাংলা গানের স্বর্ণযুগের সেই সব অবিনাশী গান।
১৯৩০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত দুই দশক ধরে যে সুরস্রষ্টা সকলকে ছাড়িয়ে বাংলা আধুনিক গান ও হিন্দি বা উর্দু গীতকে শ্রোতাপ্রিয়তার এক চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছাতে সমর্থ হয়েছিলেন, তিনি কমল দাশগুপ্ত, যাঁর জন্ম বাংলাদেশের যশোর জেলায় ১৯১২ সালে অর্থাৎ ঠিক ১০০ বছর আগে এবং যাঁর মৃত্যুও বাংলাদেশের মাটিতে, ঢাকায়, ১৯৭৪ সালে। তিনি জীবনে আট হাজার ৫০০ গানে সুরারোপ করে গেছেন, যার মধ্যে অধিকাংশ গানই জনপ্রিয়তার অতুল্য শীর্ষে স্থান করে নিয়েছিল। এর মধ্যে ৪০০টি নজরুলসংগীত রয়েছে।
কমল দাশগুপ্তের সুরের বৈচিত্র্য ছিল অবিশ্বাস্য। খেয়াল, রাগপ্রধান গান, কীর্তন, ভজন, ইসলামিসংগীত, কাওয়ালি, আধুনিক বাংলা গান, নজরুলসংগীত, উর্দু ও হিন্দি গীত, গজল, মার্চ সংগীত, লোকসংগীত ও সিনেমার গানের প্রতিটি শাখায় রয়েছে তাঁর অবিস্মরণীয় সব সুর। সংখ্যায়, বৈচিত্র্য ও গুণগত উৎকর্ষে সমগ্র উপমহাদেশের সংগীত জগতে তাঁকে অতিক্রম করার মতো অবদান আর কোনো সুরকারের নেই। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এখানে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া দরকার, যা থেকে সংগীত রাজ্যের এই সম্রাট গানের প্রতিটি ভুবনে কী সব চিরস্মরণীয় সুর রেখে গেছেন, তার কয়েকটি নমুনা পাওয়া যায়।
আধুনিক বাংলা গানের বিশাল জগতের মাত্র কয়েকটি নমুনা এখানে দিতে চাই:
১. আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে, আমি বনফুল গো। (কানন দেবী)
২. আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, তুমি যে বহ্নিশিখা। (সত্য চৌধুরী)
৩. জেগে আছি একা, জেগে আছি কারাগারে। (সত্য চৌধুরী)
৪. পৃথিবী আমারে চায়, রেখো না বেঁধে আমায়। (জগন্ময় মিত্র)
৫. ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানী। (জগন্ময় মিত্র)
৬. তুমি কি এখন দেখিছো স্বপন আমারে, আমারে, আমারে। (জগন্ময় মিত্র)
৭. চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয়, আমারি সমাধি পরে (যূথিকা রায়)
৮. ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে, এ মধুরাত নাহি বাকি (তালাত)
৯. দুটি পাখি দুটি তীরে, মাঝে নদী বহে ধীরে (তালাত)
১০. জানি জানিগো মোর শূন্য হূদয় দেবে ভরি (...)
১১. তুমি হাতখানি যবে রাখো মোর হাতের পরে (কমল দাশগুপ্ত)
১২. সেদিন নিশীথে বরিষণ শেষে চাঁদ উঠে ছিল বনে (হেমন্ত)
১৩. এমনি বরষা ছিল সেদিন (...)
১৪. তুমি মোর জীবনে আসিও ফিরে (জগন্ময় মিত্র)
১৫. মেনেছি গো, হার মেনেছি (জগন্ময় মিত্র)
১৬. এই কি গো শেষ দান, বিরহ দিয়ে গেলে
১৭. যদি ভালো না লাগে তব দিয়ো না মন (কানন দেবী)
১৮. চলে তুফান মেল (কানন দেবী)
কিছু গীত ও গজলের নমুনা:
১. চুপকে চুপকে বোল ম্যয়না (যূথিকা রায়)
২. ত্যসবীর তরী দিল মেরা ব্যহলানা স্যকেগি (তালাত)
৩. ইয়াদ দিলওয়াতে হ্যাঁয় উত্ত (তালাত)
৪. সেয়ে হুয়ে হ্যাঁয় চাঁদ ঔর তারে (তালাত)
৫. আঁচাল সে কিউ বাঁধ লিয়া মুসকো (হেমন্ত)
৬. ইয়াদ হাম কিউ আতি হো (হেমন্ত)
৭. ম্যায় সাজ বাজাউ তুম গাও (হেমন্ত)
৮. কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে (হেমন্ত)
৯. আখোমে ছুপা ম্যন মেরা (জগন্ময় মিত্র)
১০. মেরি আখে ব্যনি দিওয়ানি (জগন্ময় মিত্র)
১১. তুমি মেরে সামনে আয়া না ক্যরো (জগন্ময় মিত্র)
১২. মুঝকো না সপ্নো সে ব্যহলাও (জগন্ময় মিত্র)
১৩. ইকবার মুসকুরাদো (জগন্ময় মিত্র)
১৪. ইয়ে চাঁদ ন্যহি তেরি আরতি হ্যায় (জগন্ময় মিত্র)
১৫. উত্ত আজ ন্যহি তো কাল আয়েগা (জগন্ময় মিত্র)
১৬. ইশকা রোগ মোল ক্যর (জগন্ময় মিত্র)
১৭. ম্যায় তেলি ছ্যবি বানাউঙ্গা (তালাত)
১৮. তুম ভুলায়ে না গ্যয়ে (ফিরোজা বেগম)
১৯. রিমঝিম বাদরিয়া ব্যরসে (যূথিকা রায়)
২০. ব্যয়রন হো গ্যয়ি রাত (যূথিকা রায়)
২১. মেরি বীণা রো র্যহি হ্যায় (যূথিকা রায়)
২২. আজ মেরে ঘ্যর প্রীতম আয়ে (যূথিকা রায়)
২৩. ঘুঙ্গট কা প্যট খোল (যূথিকা রায়)
২৪. পাগ ঘুংরু বাঁদ মিরা নাচে (যূথিকা রায়)
২৫. অ্যায় চাঁদ ছুপনা যানা (কানন দেবী) (‘জওয়াব’ ফিল্ম)
২৬. ও বরষাকে প্যহলে বাদল (জগন্ময় মিত্র) (‘মেঘদূত’ ছবিতে)
ইসলামি নাত:
১. রসুলোঁকে রাজা
২. ব্যসো মোরে ন্যয়নন মে
৩. মাহবুব কে ঘ্যর যানা আল্লাহকে ঘ্যর সে
৪. তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
৫. নবীজি এসো গো
লোকসংগীত:
১. তুমি কি জানরে বন্ধু (ছায়াছবি ‘চন্দ্রশেখর’, গৌরী কেদারের গাওয়া)
২. আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই আল্লাহ
৩. এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবানি।
নজরুলসংগীত (প্রেম পর্যায়ের গান):
যবে তুলসী তলায় প্রিয় সন্ধ্যা বেলায়,
পথ হারা পাখি কেঁদে মরে একা
আমি চাঁদ নহি অভিশাপ
বলেছিলে তুমি তীর্থে আসিবে
মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে
গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙ্গে যায়
আগুন জ্বালাতে আসিনি গো, এসেছি দেয়ালি জ্বালাতে
আমার যাবার সময় হলো, দাও বিদায়
বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে।
নজরুলের দেশাত্মবোধক গান:
১. একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লীজননী।
২. ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি।
৩. ও আমার দেশের মাটি।
এ ছাড়া অল ইন্ডিয়ার বিশ্ববিখ্যাত সিগনেচার টিউনের সুরকার তিনি। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের; ‘কদ্যম ক্যদম ব্যড়হায়ে চল’ গানটিরও সুরকার তিনিই।
কমল দাশগুপ্ত খুব বেশি ব্যবহার করেছেন ‘মেলোডিক মাইনর স্কেল অর্থাৎ স র জ্ঞ ম প ধ ন স শুনতে রাগ কিরমানীর’ মতো। এই নোটসগুলোর যৌগিক রূপ দুঃখের ও বেদনার আবহ সৃষ্টি করে।
বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে পাশ্চাত্য সংগীতের বহুল ব্যবহার তাঁর মানসিক ঔদার্য ও সুরের ব্যবহারে যে একটি সুন্দর বিশ্বায়ন রচিত হতে পারে এর অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বেহালা, গিটার, স্যাক্সোফোন, পিয়ানো ছাড়াও ট্রামপেট, ওবোউ, ডাবল ব্যাস ইত্যাদি পাশ্চাত্য যন্ত্র উপমহাদেশীয়, বিশেষ করে উর্দু ও বাংলা গানে তিনি ব্যবহার করেছেন গভীর মুনশিয়ানার সঙ্গে। মেঘদূত ছবিতে তিনি ১০০ বেহালা একসঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন একটি গানে। তখন বাংলায় ছিল দুটি পেশাদার অর্কেস্ট্রা। একটি মাইহার অর্কেস্ট্রা, যাঁরা কলকাতাতেই বাজাতেন বেশি, সেটির নির্দেশনায় ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। আর দ্বিতীয়টি ছিল কমল দাশগুপ্তের, ‘সুরশ্রী’ অর্কেস্ট্রা, যেখানে কলকাতা ও ভারতের বিশিষ্ট বাদকেরা অংশগ্রহণ করতেন। পরবর্তী সময় আরেকটি স্বল্পস্থায়ী অর্কেস্ট্রা দল গড়েছিলেন তিমির বরণ।
সংগীত জগতের জন্য কমল দাশগুপ্তের আরেকটি উপহার ছিল প্রায় সবারই অজানা। সেটি ছিল ‘শর্টহ্যান্ড নোটেশন’। যেকোনো গানের হুবহু, দ্রুত ও পাশ্চাত্য নোটেশন এবং প্রাচ্য স্বরলিপির সংমিশ্রণে রচিত এক অসাধারণ আবিষ্কার। এ কাজে তিনি বিশেষ ফাইভ ইউনিট মিউজিক কোড ব্যবহার করতেন। এর ব্যবহারের সমাপ্তি তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেই। অত্যন্ত প্রচারবিমুখ এই প্রতিভার এত বড় একটি আবিষ্কার যদি আজও অব্যাহত থাকত, তাহলে গানের সুর সংগ্রহ ও সুর উদ্ধারের ক্ষেত্রে ঘটতে পারত এক বিপ্লব।
এরপর বলতে হয়, তাঁর সংগীতের সুর নির্মাণের মৌলিক পরিকাঠামোর কথা। প্রথমেই বলতে হয় যে, তাঁর সুরের সৌন্দর্য উৎসারিত হতো এক অপূর্ব সারল্য থেকে। একজন সুরকারের সত্যিকার পরীক্ষা হচ্ছে তিনি কতটা অবলীলায় প্রত্যাবর্তন করতে পারেন প্রথম চরণে। এ বিষয়ে কমল দাশগুপ্ত অনায়াসে অত্যন্ত শ্রুতিমধুর এক পদ্ধতি সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি কিছু সহজ অথচ ধ্বনিমধুর অলংকরণ সৃষ্টি করেছিলেন, যার মধ্যে তাঁর সংগীতব্যক্তিত্বের ছাপ এত গভীরভাবে গ্রথিত ছিল যে তাঁর সৃষ্ট সুর শুনলেই বোঝা যেত, এটা আর কারও নয়, তাঁরই। তাঁর সুরে এই মৌলিক সরলতা থাকার কারণেই সেগুলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করত। কেননা মানুষ সহজেই সে গানগুলো অনুকরণ করে গাইতে পারত। আমি একবার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম যে তাঁর সুর থেকে রাগ উদ্ধার করা এত কঠিন হয়ে পড়ে কেন? তিনি আমাকে বলেছিলেন যে কোনো রাগকে পুরোপুরি অবলম্বন করলে সুর করা অত্যন্ত সহজ হয়ে যায়, যেহেতু নকশাটা ওই রাগের মধ্যেই দেওয়া থাকে। সৃষ্টিশীল সুর সৃষ্টির দাবি অনেক বেশি হয়ে পড়ে, যখন রাগের নিজস্ব পরিচিতি গানের সুরের নকশায় এমনভাবে বন্দী হয়, যেখানে গান জেগে ওঠে তার নিজের এক নতুন পরিচয়ে।
যেমন ধরুন, ‘সোয়ে হুয়ে হ্যায়, চাঁদ ঔর তারে’ পিলু রাগ দ্বারা অনুপ্রাণিত, কিন্তু বোঝা দুষ্কর। ঠিক তেমনি ‘ম্যায় তেরি ছবি বানাউঙ্গা’ বিলাওয়াল রাগে অনুপ্রাণিত। কিন্তু বোঝা দুষ্কর।
তালাত—‘স্যব দিন এক সমান ন্যাহিথা’ কৌশিক ধ্বনি রাগে অনুপ্রাণিত।
তালাত—‘ত্যসবির তেরি’ রাগেশ্বরী রাগে অনুপ্রাণিত।
হেমন্ত—‘ভালা থা কিতনা আপনা ব্যচপান’ পাহাড়ি।
হেমন্ত—‘তুমনে মুযকো স্যদা জ্বালায়’ কাফি।
জগন্ময়—‘একবার মুসকুরাদো’ পিলু।
জগন্ময়—‘তুম মেরে সামনে আয়া না ক্যারো’ ঝিনযোঁটি (তুমি মোর জীবনে আসিও ফিরে)
জগন্ময়—‘দিল দেকার দ্যরদ লিয়া ম্যায়নে’ কিরওয়ানি (তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন)
এমনি লতার বিখ্যাত ‘আয়েগা আনেওয়ালার’ (সুর: খেমচাঁদ প্রকাশ) মধ্যে বিলাওয়াল খোঁজার তো প্রয়োজন নেই। অথবা লতারই আর ডি বর্মণের সুরে গাওয়া ‘র্যয়ন বিত যায়ের’ মধ্যে মিয়া কী চৌড়ি অথবা তালাতের এস ডি বর্মণের সুরে গাওয়া ‘জ্ব্যলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে’র মধ্যে জৈনপুরী কি গোলাম আলীর ‘হাঙ্গামা হ্যায় ব্যড়পা’র মধ্যে দরবারি অথবা মেহদি হাসানের ‘গুলো মে রঙ্গ ভরে’র মধ্যে ঝিঁঝিট রাগ খোঁজার প্রয়োজন নেই কোনো।
এসব অপরূপ কম্পোজিশন অন্তরালের রাগের অস্তিত্বকে ছাপিয়ে এক নিজস্ব পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।
কমল দাশগুপ্ত কেবল সাড়ে আট হাজার অমর গানেই সুরারোপ করেননি। তিনি তৈরি করে গেছেন একঝাঁক প্রতিভাদীপ্ত শিল্পীকে। যেমন কানন দেবী, যূথিকা রায়, সত্য চৌধুরী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, তালাত মাহমুদ, কল্যাণী ঘোষ, শুভলক্ষ্মী, ফিরোজা বেগমসহ ও আরও বহু শিল্পী। কেসি দে, আব্বাসউদ্দীন, কমলা মরিয়া, আঙ্গুর বালা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এঁরাও অনেক গান করেছেন কমল দাশগুপ্তের সুরে। ঠিক যেমন সুধীর লাল চক্রবর্তী তৈরি করেছিলেন উৎপলা সেন, গীতা দত্ত ও শ্যামল মিত্রকে। আজকের সুরকার শিল্পীদের ব্যবহার করেন, তৈরি করেন না।
কাজী নজরুল ইসলাম, কমল দাশগুপ্ত ও সুবল দাশগুপ্ত একত্রে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিতেন খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ জমির উদ্দীন খানের কাছ থেকে। সে অর্থে কাজী নজরুল ইসলাম ও কমল দাশগুপ্ত ছিলেন গুরুভাই। একই গুরুর শিষ্যত্বের কারণে তাঁদের মধ্যে শুধু সুন্দর বন্ধুত্ব নয়, তাঁদের সংগীত উপলব্ধির মধ্যেও একটা সাদৃশ্য সৃষ্টি করে। এ জন্যই কাজী নজরুল ইসলাম কেবল কমল দাশগুপ্তকেই দিয়েছিলেন অনুমোদন ছাড়াই তাঁর গানে সুর করার অধিকার। ১৯৫৬ সালে কলকাতায় কবির নিজ হাতে লেখা এ ছাড়পত্রটি তাঁরই লেখা গানসংবলিত একটি গানের খাতার প্রথম পাতায় আমি নিজে দেখেছিলাম। সংগীতের এই দুই দিকপালের গভীর পরিচর্যায় নজরুলসংগীতের কালজয়ী জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৩০ থেকে ১৯৫০ এই দুই দশক ধরে ফিল্ম ও বেসিক ডিস্কের যত শ্রোতানন্দিত জনপ্রিয় গান শুনবেন তার অধিকাংশই কমল দাশগুপ্তের সুরারোপিত। তার মানে এই নয় যে এই সময়কালে আর কেউ ভালো ও জনপ্রিয় গান রচনা করেননি। করেছেন, তবে তার সংখ্যা খুবই সামান্য। হিমাংশু দত্ত, সুধীর লাল চক্রবর্তী, অনিল বিশ্বাস, অনুপম ঘটক, শচীন দেব বর্মণ কয়েকটি করে সুন্দর গান কম্পোজ করেছেন। কিন্তু আগেই বলেছি যে তার সংখ্যা ও জনপ্রিয়তা কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে কোনোক্রমেই তুল্য নয়। তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে বাংলা গান ও উর্দুগীতের স্বর্ণযুগের সম্রাট ছিলেন কমল দাশগুপ্ত।
তিনি ছিলেন খুব নির্জনের মানুষ। স্বল্পভাষী, সঙ্গোপন। আমি কখনোই তাঁর মধ্যে অহংকারের লেশমাত্র লক্ষ করিনি। কোনো শিল্পীকে অথবা সুরকার সম্পর্কে সুখকর ছাড়া কোনো মন্তব্য করতেন না। কোনো সাংবাদিককে জীবনে কোনো সাক্ষাৎকার দেননি। ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ ও ওস্তাদ সালামত আলী খাঁকে অতি উচ্চাসনে স্থান দিতেন। ১৯৪৩ সালে ভারতের বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টর অব মিউজিকের সম্মানে ভূষিত করে। খেমচাঁদ প্রকাশ, নৌশাদ, সুধীর লাল চক্রবর্তী, দিলীপ কুমার রায় ও অনুজ সুবল দাশগুপ্তকেও তিনি মর্যাদার চোখে দেখতেন।
১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই তিনি পরলোক গমন করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি যখন ভারত থেকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে আসেন, তখন যশোর সীমান্তে আমিই তাঁকে অভ্যর্থনা জানাই। তখন তাঁকে কিছুটা অসুস্থ দেখেছিলাম। কেন যেন মনে হয়েছিল, তিনি জীবনকে অতি দ্রুত পুড়িয়ে ফেলছিলেন। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে যখন তাঁকে পোস্ট গেজেটেড মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়, তখন তাঁকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট অথবা একটি কেবিনে ভর্তি করার জন্য তাঁর অনুরাগী ও স্বজনেরা সরাসরি হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের অনুরোধ করতে থাকে, তখন তারা বারবার জিজ্ঞেস করছিল যে কমল দাশগুপ্ত একজন গেজেটেড প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা কি না। সবাই বলছিল, সংগীতের এই গ্র্যান্ড মাস্টারকে অবহেলা করবেন না, এখনই দ্রুত চিকিৎসা দেন। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন একই কথা, তিনি কি ক্লাস ওয়ান গেজেটেড অফিসার? সেই অসাধারণ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই কমল দাশগুপ্ত ছেড়ে গেলেন এ পৃথিবী।
এসিআইয়ের উদ্যোগে কমল দাশগুপ্ত ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এটা এ দেশের সংগীতের জন্য যে কত মহৎ ও কত বড় সূচনা, তা বলে বোঝানোর ভাষা নেই আমার কাছে। সংগীতের এই শ্রেষ্ঠতম নির্মাতাকে আমরা যেন ভুলে না যাই। তাঁর সুরের চর্চা হোক। সেগুলোর ওপর গবেষণা হোক। বছরে অন্তত একবার যেন তাঁর গান গাইতে এ দেশের সব শিল্পী একত্র হতে পারেন, সেই সুযোগটা বোধ হয় বহুদিন পর হলেও শেষ অবধি শুরু হলো।

No comments

Powered by Blogger.