পাহাড়ধসে মৃত্যু এবং অপ্রতিরোধ্য পাহাড় কাটা by ধরিত্রী সরকার সবুজ
কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষণের ফলে পানিবন্দি হয়ে ২৬ জুন কার্যত অচল হয়ে পড়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে নগর জীবন। নগরীর বেশির ভাগ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যায়। বেশির ভাগ আবাসিক এলাকার বাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে পড়ে। অনেক মানুষকেই পরিচিত আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়।
মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত পুরো নগরী অবর্ণনীয় জলাবদ্ধতায় আটকা পড়ে। চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে পাহাড়ধসে মাটিচাপা পড়ে শতাধিত মানুষের মৃত্যু ঘটে।
পত্রিকার খবরে জানা যায়, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে দুর্গতদের সহায়তায় নগদ এক কোটি টাকা ও এক হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ধসের কারণ অনুসন্ধানে একটি বিশেষজ্ঞ দল দুর্গত এলাকায় রওনা হয়েছে বলে জানা যায়। তবে এমন পাহাড়ধসও নতুন নয়, বিশেষজ্ঞ দলের কারণ অনুসন্ধানও নতুন নয়। এ দেশে যখন কোনো দুর্যোগ ঘটে, তখন সবাই নড়েচড়ে ওঠে, আবার কিছুদিন পর সবই স্তিমিত হয়ে যায়।
পাহাড়ধসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৭ সালে। সে বছরের ১১ জুন পাহাড়ি ভূমিধসে চট্টগ্রামে মাটিচাপা পড়ে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। মাত্র এক দিনের ভারি বৃষ্টিপাতে এত মানুষের মৃত্যু পুরো দেশবাসীকেই ভাবিয়ে তোলে সে সময়। প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে বছর না ঘুরতেই। ২০০৮-এর ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের মতিঝর্ণা পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড়ধসে নিহত হয় ১১ জন। গত বছরের ১ জুলাই বাটালিহিলের প্রতিরোধ দেয়ালসহ পাহাড়ধসে মারা যায় ১৭ জন। প্রতিবছর বর্ষাকালেই পাহাড়ধসে কিছু মানুষের অবধারিত মৃত্যুই মনে হয় আমাদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছে।
দেশের ছিন্নমূল মানুষগুলোর আবাসন সমস্যাও প্রকট। সঠিক বাসস্থানের অভাবে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলাগুলোতে পাহাড়ের পাদদেশে মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রতিবছর বর্ষার আগে চট্টগ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোর পাদদেশ থেকে বসতি সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সে উদ্যোগ কোনো সুফল বয়ে আনে না। নিম্ন আয়ের মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা থেকে সরিয়ে দিলেও কিছুদিনের মধ্যেই আবার তারা পুরনো স্থানেই ফিরে আসে।
২০০৭ সালের পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর ঘটনার পর বিভাগীয় কমিশনারকে আহ্বায়ক করে একটি শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিল। স্বল্পমেয়াদি সিদ্ধান্ত হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তের মধ্যে আছে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপনকারীদের স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। এ জন্য কিছু জায়গাও নির্ধারণ করা হয়েছিল। গত ৯ মে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির নবম সভায়ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী পরিবারগুলোকে বর্ষার আগে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগেই ঝরে গেল আরো অনেক ছিন্নমূল তাজা প্রাণ। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো রয়েছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। বৃষ্টির মৌসুমে প্রতিবছরই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পাহাড়ি এলাকায় মাইকিং করে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য বলা হয়। কিন্তু অনেকেই সে আহ্বান উপেক্ষা করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে বসে থাকে।
কিন্তু এসব পাহাড়ধসের যে মূল কারণ পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গাছপালা নিধন, তার প্রতিকার হলো না এত বছরেও। পাহাড় কেটে খাড়া পাড় তৈরি করে রাখা হচ্ছে শুষ্ক মৌসুমেই। দিনদুপুরে অবৈধভাবে পাহাড় কেটে সে মাটি দিয়ে কেউ নিচু জায়গা ভরাট করছেন, আবার কেউ পাহাড় কেটে সমতল করছেন শহরের অতি উচ্চমূল্যের জমিতে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য। পাহাড়ের গাছ কেটে অবৈধভাবে বিক্রি করার খবর তো নতুন কিছু নয়। অনেকেই পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কেটে তৈরি করেছেন পাকা বা আধা পাকা বাড়ি। এত অত্যাচারের পর পাহাড়গুলো বর্ষা প্রতিরোধ করে নিজেকে ধরে রাখার ক্ষমতাই বা পাবে কোথায়? সে কারণেই বর্ষার কাছে পাহাড়ের এই আত্মসমর্পণ, ফলে এতগুলো তাজা প্রাণের অকালে ঝরে যাওয়া।
আমাদের তিন পার্বত্য জেলায় রয়েছে পাহাড়। চট্টগ্রামে রয়েছে সাগর-পাহাড়-নদীর এক অপূর্ব সম্মিলন। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ আরো কয়েকটি জেলায় রয়েছে ছোট-বড় পাহাড়। কিন্তু প্রায় সব পাহাড়ই আজ অস্তিত্ব রক্ষার হুমকির মুখে। অতীতেও দেখা গেছে, পাহাড়ধসে যখন কোনো বড় বিপর্যয় ঘটে, তখন এগুলো সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে কিছুদিনের জন্য। পদক্ষেপগুলো ত্বরান্বিত হয়, আবার কিছুদিনের মধ্যে ঝিমিয়ে পড়ার দুর্ভোগ কাঁধে নিয়েই।
পাহাড়ধসের কারণে তো এত অধিক প্রাণহানি হওয়ার কথা নয়। কারণ পাহাড়ের পাদদেশে মানুষের বসতি স্থাপন করার কথা নয়। দেশে বাস্তুহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ও ধনী মানুষই পাহাড় কেটে নেওয়ার পর পাহাড়ের ঢালে বিপজ্জনক স্থানে ঘরবাড়ি তুলে গরিব মানুষের কাছে ভাড়া দিচ্ছেন, যারা পাহাড়ের গতিপ্রকৃতি বা পাহাড় ব্যবহারের নিয়মকানুন সম্পর্কে মোটেই অবগত নয়। 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হিসেবে দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে প্রবেশ এবং টেকনাফ অঞ্চলের পাহাড়ের যেখানে-সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন। একটি লক্ষণীয় বিষয়, বাংলাদেশের আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে বসবাস করলেও পাহাড়ধসে আদিবাসী মানুষের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা অনেক কম। কারণ তারা পাহাড়কে উত্তরাধিকার সূত্রেই জানে এবং বোঝে। অর্থাৎ পাহাড়ের ঢালে বসবাসকারী জনগণের এক ধরনের সচেতনতার অভাবও অধিক ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানির জন্য দায়ী। আমাদের দেশের পাহাড়গুলো মূলত মাটির এবং পাহাড়ের ভূমিরূপে রয়েছে দুই ধরনের মাটি_বালুমাটি ও আঠালো মাটি বা ক্লে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেটের পাহাড়গুলো তৈরি হয়েছে এসব বালু ও আঠালো মাটি জমাট বেঁধে। বালুমাটি থাকে পাথর বা স্যান্ডস্টোন হিসেবে। এই বালুমাটি বেশি সময়ের জন্য পানির সংস্পর্শে এলে এর স্থিতিস্থাপকতা কমে যায় এবং জমাটবদ্ধ থাকার সক্ষমতা কমতে থাকে। তাই বৃষ্টির পানি বেড়ে গেলে এবং একাধারে কয়েক দিন বৃষ্টি হলে পাহাড় নিজেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।
একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য যে পরিমাণ বনভূমি দরকার, তার চেয়ে অনেক কম বনভূমি রয়েছে আমাদের। দেশের সমতল অংশের গাছপালা প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে চাষযোগ্য জমি খুঁজে বের করতে এবং বিপুল জনগোষ্ঠীর আবাসন সংকুলান করতে। জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি আমাদের যেভাবে শঙ্কিত করে তুলছে, সেখানে পাহাড় কাটার ফলে বনভূমির অনিবার্য ধ্বংস আমাদেরও অনিবার্য ধ্বংসের দিকেই ধাবিত করে। পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে বনভূমি এবং এর সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু ও পশুপাখি। পাহাড় কাটার ফলে ভূমিবৈচিত্র্য এবং জীববৈচিত্র্য যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি সে এলাকার প্রতিবেশব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাবও পড়ছে। পাহাড়ি এলাকার মাটির আর্দ্রতা রক্ষায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখে পাহাড়গুলো। পাহাড়ের মধ্যে সংরক্ষিত হয়ে থাকা পানি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মাটির আর্দ্রতা রক্ষা করে। সে কারণে পাহাড় কাটার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে সে অঞ্চলের মাটির আর্দ্রতা কমে যেতে পারে। ফলে কৃষির ওপর বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
কিন্তু কিভাবে এবং কেন কাটা পড়ছে পাহাড়? পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশগত মানোন্নয়ন এবং পরিবেশদূষণ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এবং ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২-এর আওতায় পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ রয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? দুর্বৃত্তদের হিংস্র থাবা থেকে নিরীহ পাহাড়গুলো তো রেহাই পাচ্ছে না। একের পর এক চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের মৃত্যুই কি এর বড় প্রমাণ নয়?
লাখ লাখ বছর আগে পৃথিবীর ভূমিরূপ গঠনের প্রক্রিয়ায় পাহাড় তৈরি হয়েছে। এগুলো আমাদের প্রতিবেশের গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তাদের অর্থনৈতিক লোভ চরিতার্থ করার জন্য অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকৃতির গড়া পাহাড় ও টিলা কেটে ধ্বংস করছে। ফলে একদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ভূমি ও পাহাড়ধসের মতো প্রাণহারী ও সম্পদ বিনষ্টকারী প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে।
লেখক : প্রকৌশলী, বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ের লেখক
পত্রিকার খবরে জানা যায়, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে দুর্গতদের সহায়তায় নগদ এক কোটি টাকা ও এক হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ধসের কারণ অনুসন্ধানে একটি বিশেষজ্ঞ দল দুর্গত এলাকায় রওনা হয়েছে বলে জানা যায়। তবে এমন পাহাড়ধসও নতুন নয়, বিশেষজ্ঞ দলের কারণ অনুসন্ধানও নতুন নয়। এ দেশে যখন কোনো দুর্যোগ ঘটে, তখন সবাই নড়েচড়ে ওঠে, আবার কিছুদিন পর সবই স্তিমিত হয়ে যায়।
পাহাড়ধসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৭ সালে। সে বছরের ১১ জুন পাহাড়ি ভূমিধসে চট্টগ্রামে মাটিচাপা পড়ে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। মাত্র এক দিনের ভারি বৃষ্টিপাতে এত মানুষের মৃত্যু পুরো দেশবাসীকেই ভাবিয়ে তোলে সে সময়। প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে বছর না ঘুরতেই। ২০০৮-এর ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের মতিঝর্ণা পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড়ধসে নিহত হয় ১১ জন। গত বছরের ১ জুলাই বাটালিহিলের প্রতিরোধ দেয়ালসহ পাহাড়ধসে মারা যায় ১৭ জন। প্রতিবছর বর্ষাকালেই পাহাড়ধসে কিছু মানুষের অবধারিত মৃত্যুই মনে হয় আমাদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছে।
দেশের ছিন্নমূল মানুষগুলোর আবাসন সমস্যাও প্রকট। সঠিক বাসস্থানের অভাবে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলাগুলোতে পাহাড়ের পাদদেশে মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রতিবছর বর্ষার আগে চট্টগ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোর পাদদেশ থেকে বসতি সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সে উদ্যোগ কোনো সুফল বয়ে আনে না। নিম্ন আয়ের মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা থেকে সরিয়ে দিলেও কিছুদিনের মধ্যেই আবার তারা পুরনো স্থানেই ফিরে আসে।
২০০৭ সালের পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর ঘটনার পর বিভাগীয় কমিশনারকে আহ্বায়ক করে একটি শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিল। স্বল্পমেয়াদি সিদ্ধান্ত হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তের মধ্যে আছে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপনকারীদের স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। এ জন্য কিছু জায়গাও নির্ধারণ করা হয়েছিল। গত ৯ মে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির নবম সভায়ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী পরিবারগুলোকে বর্ষার আগে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগেই ঝরে গেল আরো অনেক ছিন্নমূল তাজা প্রাণ। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো রয়েছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। বৃষ্টির মৌসুমে প্রতিবছরই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পাহাড়ি এলাকায় মাইকিং করে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য বলা হয়। কিন্তু অনেকেই সে আহ্বান উপেক্ষা করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে বসে থাকে।
কিন্তু এসব পাহাড়ধসের যে মূল কারণ পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গাছপালা নিধন, তার প্রতিকার হলো না এত বছরেও। পাহাড় কেটে খাড়া পাড় তৈরি করে রাখা হচ্ছে শুষ্ক মৌসুমেই। দিনদুপুরে অবৈধভাবে পাহাড় কেটে সে মাটি দিয়ে কেউ নিচু জায়গা ভরাট করছেন, আবার কেউ পাহাড় কেটে সমতল করছেন শহরের অতি উচ্চমূল্যের জমিতে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য। পাহাড়ের গাছ কেটে অবৈধভাবে বিক্রি করার খবর তো নতুন কিছু নয়। অনেকেই পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কেটে তৈরি করেছেন পাকা বা আধা পাকা বাড়ি। এত অত্যাচারের পর পাহাড়গুলো বর্ষা প্রতিরোধ করে নিজেকে ধরে রাখার ক্ষমতাই বা পাবে কোথায়? সে কারণেই বর্ষার কাছে পাহাড়ের এই আত্মসমর্পণ, ফলে এতগুলো তাজা প্রাণের অকালে ঝরে যাওয়া।
আমাদের তিন পার্বত্য জেলায় রয়েছে পাহাড়। চট্টগ্রামে রয়েছে সাগর-পাহাড়-নদীর এক অপূর্ব সম্মিলন। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ আরো কয়েকটি জেলায় রয়েছে ছোট-বড় পাহাড়। কিন্তু প্রায় সব পাহাড়ই আজ অস্তিত্ব রক্ষার হুমকির মুখে। অতীতেও দেখা গেছে, পাহাড়ধসে যখন কোনো বড় বিপর্যয় ঘটে, তখন এগুলো সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে কিছুদিনের জন্য। পদক্ষেপগুলো ত্বরান্বিত হয়, আবার কিছুদিনের মধ্যে ঝিমিয়ে পড়ার দুর্ভোগ কাঁধে নিয়েই।
পাহাড়ধসের কারণে তো এত অধিক প্রাণহানি হওয়ার কথা নয়। কারণ পাহাড়ের পাদদেশে মানুষের বসতি স্থাপন করার কথা নয়। দেশে বাস্তুহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ও ধনী মানুষই পাহাড় কেটে নেওয়ার পর পাহাড়ের ঢালে বিপজ্জনক স্থানে ঘরবাড়ি তুলে গরিব মানুষের কাছে ভাড়া দিচ্ছেন, যারা পাহাড়ের গতিপ্রকৃতি বা পাহাড় ব্যবহারের নিয়মকানুন সম্পর্কে মোটেই অবগত নয়। 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হিসেবে দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে প্রবেশ এবং টেকনাফ অঞ্চলের পাহাড়ের যেখানে-সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন। একটি লক্ষণীয় বিষয়, বাংলাদেশের আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে বসবাস করলেও পাহাড়ধসে আদিবাসী মানুষের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা অনেক কম। কারণ তারা পাহাড়কে উত্তরাধিকার সূত্রেই জানে এবং বোঝে। অর্থাৎ পাহাড়ের ঢালে বসবাসকারী জনগণের এক ধরনের সচেতনতার অভাবও অধিক ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানির জন্য দায়ী। আমাদের দেশের পাহাড়গুলো মূলত মাটির এবং পাহাড়ের ভূমিরূপে রয়েছে দুই ধরনের মাটি_বালুমাটি ও আঠালো মাটি বা ক্লে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেটের পাহাড়গুলো তৈরি হয়েছে এসব বালু ও আঠালো মাটি জমাট বেঁধে। বালুমাটি থাকে পাথর বা স্যান্ডস্টোন হিসেবে। এই বালুমাটি বেশি সময়ের জন্য পানির সংস্পর্শে এলে এর স্থিতিস্থাপকতা কমে যায় এবং জমাটবদ্ধ থাকার সক্ষমতা কমতে থাকে। তাই বৃষ্টির পানি বেড়ে গেলে এবং একাধারে কয়েক দিন বৃষ্টি হলে পাহাড় নিজেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।
একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য যে পরিমাণ বনভূমি দরকার, তার চেয়ে অনেক কম বনভূমি রয়েছে আমাদের। দেশের সমতল অংশের গাছপালা প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে চাষযোগ্য জমি খুঁজে বের করতে এবং বিপুল জনগোষ্ঠীর আবাসন সংকুলান করতে। জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি আমাদের যেভাবে শঙ্কিত করে তুলছে, সেখানে পাহাড় কাটার ফলে বনভূমির অনিবার্য ধ্বংস আমাদেরও অনিবার্য ধ্বংসের দিকেই ধাবিত করে। পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে বনভূমি এবং এর সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু ও পশুপাখি। পাহাড় কাটার ফলে ভূমিবৈচিত্র্য এবং জীববৈচিত্র্য যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি সে এলাকার প্রতিবেশব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাবও পড়ছে। পাহাড়ি এলাকার মাটির আর্দ্রতা রক্ষায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখে পাহাড়গুলো। পাহাড়ের মধ্যে সংরক্ষিত হয়ে থাকা পানি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মাটির আর্দ্রতা রক্ষা করে। সে কারণে পাহাড় কাটার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে সে অঞ্চলের মাটির আর্দ্রতা কমে যেতে পারে। ফলে কৃষির ওপর বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
কিন্তু কিভাবে এবং কেন কাটা পড়ছে পাহাড়? পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশগত মানোন্নয়ন এবং পরিবেশদূষণ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এবং ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২-এর আওতায় পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ রয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? দুর্বৃত্তদের হিংস্র থাবা থেকে নিরীহ পাহাড়গুলো তো রেহাই পাচ্ছে না। একের পর এক চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের মৃত্যুই কি এর বড় প্রমাণ নয়?
লাখ লাখ বছর আগে পৃথিবীর ভূমিরূপ গঠনের প্রক্রিয়ায় পাহাড় তৈরি হয়েছে। এগুলো আমাদের প্রতিবেশের গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তাদের অর্থনৈতিক লোভ চরিতার্থ করার জন্য অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকৃতির গড়া পাহাড় ও টিলা কেটে ধ্বংস করছে। ফলে একদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ভূমি ও পাহাড়ধসের মতো প্রাণহারী ও সম্পদ বিনষ্টকারী প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে।
লেখক : প্রকৌশলী, বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ের লেখক
No comments