পাহাড় কাটা ও গাছ নিধন অপরাধ by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

আবারও পাহাড় ধসে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। প্রতি বছর ভারী বর্ষণ শুরু হলে পাহাড় ধসে মৃত্যুর খবর শিরোনাম হয় সংবাদমাধ্যমে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভারী বর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়ি ঢল নেমে মাটি ধসে এ পর্যন্ত কতজন মারা গেছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান জানা নেই।


তবে গত কয়েকদিনে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানে প্রায় ১০২ জনের মৃত্যুর খবরে এসেছে। কিন্তু স্থানীয়দের হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। মৃতদের অধিকাংশই নিম্নআয়ের। সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই দরিদ্র মানুষগুলো অল্প টাকায় থাকতেন পাহাড়তলিতে। অব্যাহত বর্ষণে পাহাড়ি ঢলে মৃত্যুর পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকারও হতে হয়েছে এই অসহায় দরিদ্রদের।
গত কয়েকদিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পাহাড়ধস, নৌকাডুবি, দেয়ালধস, বজ্রপাত ও বন্যাসহ অন্যান্য কারণে মারা গেছে প্রচুর মানুষ। আমরা দুর্যোগে নিহত প্রত্যেকের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। সে সঙ্গে আশা করি, দুর্যোগকবলিত এলাকায় দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী বিতরণে সরকার, বিভিন্ন সেবা সংস্থা ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা এগিয়ে আসবেন।
পাহাড় ধসের মূল কারণ হিসেবে পাহাড়ের মাটি কাটা ও গাছ নিধনকেই দায়ী করেছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। আমরা জানি, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অবাধে অবৈধভাবে পাহাড়ের মাটি ও গাছ কাটা হচ্ছে। এমনকি পাহাড় কেটে হাউজিংও করা হয়েছে। পাহাড়-পর্বত, নদীনালা ও গাছপালা আল্লাহতায়ালার সৃষ্টির অন্যতম নিদর্শন। বলা হয়েছে, পাহাড়-পর্বত হলো জমিনের খিলস্বরূপ। পাহাড়-পর্বত জমিনকে স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে, 'আমি কি করিনি জমিনকে বিছানা এবং পর্বতকে পেরেক?'-সূরা আন নাবা : ৬-৭
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিনা কারণে গাছ কাটা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়ে কঠোর হুশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন। এমনকি যুদ্ধের সময়ও গাছ কাটতে নিষেধ করা হয়েছে। উপরন্তু গাছ লাগানোকে সদকা ও প্রচুর সওয়াবের কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, 'যে ব্যক্তি (প্রয়োজন ছাড়া) গাছ কাটবে আল্লাহ তার মাথাকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।'-আবু দাউদ
ভূতাত্তি্বকদের মতে, পাহাড় থেকে মাটি ও গাছ কেটে ফেলা হলে পাহাড়ের মজবুত গাঁথুনি দুর্বল হয়ে যায়। ফলে প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে থাকে। মূলত মানুষের অনাচারের ফলেই এমন দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনে দোষীদের বিচারের আওতায় আনাটাও জরুরি। আমরা আশা করব, সরকার দ্রুত পাহাড় ও গাছ কাটা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। সে সঙ্গে স্থানীয় লোকজনও বিপদের বিষয়টি মাথায় রেখে পাহাড় কাটা বন্ধ করবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত প্রতিটি পরিবারের প্রতি রইল আমাদের সমবেদনা।
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) ভালোবাসা সবুজ প্রকৃতি, পাহাড়-পর্বত, নদীনালা ও গাছপালার প্রতিও ছিল। তাবুকের যুদ্ধ থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তনকালে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) উহুদ পাহাড়ের কাছ দিয়ে গমনকালে বলেন, 'এই হলো উহুদ পাহাড়। এটা এমন একটি পাহাড় যা আমাদের ভালোবাসে এবং আমরাও তাকে ভালোবাসি।'-বুখারি ও মুসলিম
উহুদ পাহাড়ের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করে মূলত হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সৃষ্টিকুলের প্রতিই ভালোবাসা প্রদর্শন করেছেন। কোনো সৃষ্টি যে অনর্থক নয় এটাই বুঝিয়েছেন। ইসলাম দুনিয়াতে সব ধরনের অনাচারের বিরুদ্ধে। অবাধে পাহাড় কাটা ও বনের গাছ নিধনসহ প্রকৃতিকে সৌন্দর্যহীন করা বিরাট অনাচারই বটে। কারণ এসবের দরুন বিভিন্ন বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। যারা এসব করবে তারা নিঃসন্দেহে দুনিয়াতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। আর কোনো বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বিশৃঙ্খলকে আল্লাহতায়ালা ভালোবাসেন না। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী সর্বদা আল্লাহতায়ালার রহমত থেকে দূরে থাকবে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে, 'আর যখন সে ফিরে যায়, তখন জমিনে প্রচেষ্টা চালায় তাতে ফাসাদ করতে এবং ধ্বংস করতে শস্য ও প্রাণী। আর আল্লাহ ফাসাদ ভালোবাসেন না।'-সূরা বাকারা : ২০৫
কারও বিপদে সমবেদনা জানানো, তার দুঃখে দুঃখী হওয়া ইমানেরই অংশ। সে সঙ্গে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াও নৈতিক দায়িত্ব ও অসীম সওয়াবের কাজ। কারও বিপদে সমবেদনা জানানো প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি কোনো বিপদগ্রস্তের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে, তাহলে স্বয়ং ওই বিপন্ন ব্যক্তি সবর করলে যে সওয়াব পায়, সেও অনুরূপ সওয়াব পাবে।'-তিরমিজি
অন্য আরেক হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, হজরত ওমর ইবন হাযম (রা.) হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, 'মুমিন তার কোনো ভাইয়ের বিপদের সময় সহানুভূতি জানায়, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সম্মানজনক জান্নাতি পোশাক পরিধান করাবেন।'-ইবনে মাজা
বিপদে যারা ধৈর্যধারণ করে আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করে, তাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ। এর বিপরীতে যদি কেউ বিপদে পতিত হয়ে ধৈর্যহীন, অস্থির হয়ে আপন মৃত্যু ও ধ্বংস কামনা করে এবং এ সংক্রান্ত অস্থিরতা প্রদর্শন করে, তাহলে তার প্রতি আল্লাহ অবশ্যই বিরাগ হন, পরিণামে তার রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। কোনো কোনো বর্ণনায় রয়েছে, বিপদের সময় যে রান চাপড়ায় আল্লাহ তার সৎ কর্মগুলো ব্যর্থ করে দেন। ব্যথিত হৃদয়ে নীরবে অশ্রুপাত করা দূষণীয় নয়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর সন্তুষ্ট থাকা মানুষের নেককার হওয়ার নিদর্শন। আর আল্লাহর সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করা বদকার ও পাপাচারী হওয়ার নিদর্শন।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.