লিচুর বিষক্রিয়ায় শিশুমৃত্যু-জেনেশুনে বিষপান আর নয়

জুন মাসের প্রথম ২০ দিনে দিনাজপুরের বিভিন্ন উপজেলায় আকস্মিকভাবে মারা যাওয়া ১৪ শিশু লিচুতে ছিটানো বিষক্রিয়ার শিকার_ স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই নিশ্চয়তা আমাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতেরই অশনিসংকেত। জেনেশুনে বিষপানের মাশুল কেবল ১৪টি মূল্যবান প্রাণের বিনিময়েই চুকে যাবে না।


দিনাজপুরে আক্রান্ত শিশুদের রক্তের নমুনা ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট পর্যন্ত আনা গেছে বলেই আমরা এর কারণ জানতে পারছি। এমন অনেক নীরব হত্যাকাণ্ড হয়তো সংবাদমাধ্যম ও স্বাস্থ্য বিভাগের নজর এড়িয়ে গেছে। বিষাক্ত রাসায়নিকযুক্ত ফল খেয়ে আরও কত মানুষ ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কে জানে! বিভিন্ন গবেষণায় এটা স্বীকৃত যে, এসব দ্রব্য তাৎক্ষণিক মৃত্যু ছাড়াও অকাল গর্ভপাত, শিশুর বিকলাঙ্গ হওয়াসহ নানা রোগ-ব্যাধির কারণ। অস্বীকার করা যাবে না যে, ফল পোকামুক্ত রাখতে কিংবা স্বল্প সময়ের মধ্যে পাকাতে যেভাবে কীটনাশকসহ নানা বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে বহুবারই। গত ফেব্রুয়ারিতে খোদ হাইকোর্ট বিভাগ ফলে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলাসহ চার দফা নির্দেশনা জারি করেছিলেন। সময়ে সময়ে বাজারে অভিযানও চালাতে দেখা যায় সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু দিনাজপুরের অঘটন প্রমাণ করল যে রাসায়নিক দিয়ে ফল পাকানো জাতিবিনাশী এক হিমশৈলীর দৃশ্যমান চূড়ামাত্র। আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, আনারস প্রভৃতি সুমিষ্ট ফল গাছে থাকতেই দফায় দফায় কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে তা অপ্রয়োজনে। ফল বাজারে নেওয়ার যথেষ্ট সময় আগে কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধের নিয়ম থাকলেও মানা হয় সামান্যই। চাষিদের সতর্ক করা গেলে কীটনাশকের প্রয়োগ অনেকাংশে কমানো সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এ ক্ষেত্রে কী করছে আমাদের বোধগম্য নয়। বিশেষ করে দিনাজপুরের দায়িত্বপ্রাপ্তরা লিচুচাষিদের পরামর্শ প্রদানে কতটা তৎপর ছিল খতিয়ে দেখার আহ্বান জানাই। ফল উৎপাদনকারী অন্যান্য অঞ্চলেও সংশ্লিষ্টদের সক্রিয়তা কাম্য। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোও কৃষক সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে। মিশ্র চাষাবাদের মাধ্যমে পোকা-মাকড়ের উপদ্রব কমানোর উপায় আমাদের দেশে হাজার বছর ধরে প্রচলিত ছিল। সেটা চাষিরা ভুলে যেতে বসেছেন কি রাসায়নিক কোম্পানির চটকদারিত্বে? এ ক্ষেত্রেও সরকারের নজরদারি প্রত্যাশিত। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী মুনাফার বলিতে পরিণত হতে দেওয়া যায় না। হাইকোর্টের নির্দেশনা_ ফলের আড়ত ও বাজারে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ, আমদানি পয়েন্টে ফল প্রবেশের আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা_ প্রতিপালিত হলে ফলের বাজার অনেকাংশে বিষমুক্ত হবে। এ ধরনের কাজে নাগরিক সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। কিন্তু উদ্যোগী ভূমিকা সরকারকেই পালন করতে হবে। আমরা বলছি না যে, মুক্তবাজার ব্যবস্থাতেও সরকার নাগরিকের জন্য নিরাপদ ফলের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু ফলের উৎপাদন, পরিবহন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে হচ্ছে কি-না, সেই দায়িত্ব সরকারেরই। 'পারসিসটেন্ট অরগানিক পলুট্যান্টস' কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী একটি দেশকে আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার কথাও ভুলে যাওয়া চলবে না। ফল তথা ভবিষ্যৎকে বিষমুক্ত করার জনগুরুত্বপূর্ণ কাজটি দিনাজপুর থেকেই কিন্তু সূচিত হতে পারে। সেখানকার লিচুচাষি, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী, নাগরিক সমাজ যদি আগামী মৌসুমে বিষমুক্ত লিচু উপহার দেওয়ার অঙ্গীকার করতে পারে, তার ইতিবাচক প্রভাব অন্যান্য ফলের মাঠ ও বাজারেও নিঃসন্দেহে পড়বে।
 

No comments

Powered by Blogger.