রমজান মাস শুরুর আগেই দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা by ফখরুল ইসলাম ও আবুল হাসনাত
রমজান মাস সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর পুরোনো কৌশলই নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আর তা হলো, রমজান মাস শুরুর আগেই দাম বাড়িয়ে নেওয়া। ব্যবসায়ীদের এভাবে দাম বাড়ানোর সুযোগও করে দিচ্ছে সরকার। ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুনসহ কয়েকটি পণ্যে ১০ শতাংশের বেশি মুনাফা করবেন না বলে গত মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে কথা দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সরকারই এই নির্দেশনা দিয়েছে।
অথচ বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। যেসব পণ্যে ১০ শতাংশের বেশি মুনাফা করতে নিষেধ করা হয়েছে, বাজারে এখনই তা বিক্রি হচ্ছে ৬ থেকে সর্বোচ্চ ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দামে।
চট্টগ্রামে বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন এবং ঢাকায় অতিরিক্ত বাণিজ্যসচিব এ টি এম মূর্তজা রেজা চৌধুরীর সভাপতিত্বে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গত মঙ্গলবার এ- সংক্রান্ত দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ওই দিন বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন সাংবাদিকদের জানান, রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদে তিনি সন্তুষ্ট। অতিরিক্ত বাণিজ্যসচিবের বক্তব্যও একই ধরনের। তিনি বলেন, রমজান মাসে পণ্যমূল্য বাড়বে না। আর ব্যবসায়ীরা তাঁকে কথা দিয়েছেন খুচরা পর্যায়ে যাতে ১০ শতাংশের বেশি মুনাফা না করা হয়, সেই ব্যবস্থা তাঁরা করবেন।
ট্যারিফ কমিশনের বিশ্লেষণ অগ্রাহ্য: রমজান মাসের নিত্যপণ্য নিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বিশ্লেষণ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজারে আমদানি করা পেঁয়াজ খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি দামে। ট্যারিফ কমিশনের মতে, যে পেঁয়াজ খুচরা বিক্রি হওয়ার কথা ১৪ টাকা কেজি দরে, পাইকারি বাজারেই তা বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ টাকায়। আর খুচরা বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৪ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ, কেজিতে ছয় থেকে ১০ টাকা বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে।
পেঁয়াজের পাশাপাশি শুকনা মরিচ, রসুন, খেজুর, হলুদ, মসুর ডাল, ছোলা, আদা ইত্যাদি পণ্যের আমদানি, শুল্ক, পরিবহনসহ যাবতীয় খরচ ১০ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ মুনাফা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষণটি করা হয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি জুন মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৩১ হাজার ৬৭৭ টন। ডলারকে টাকায় রূপান্তর করলে প্রতি টনের দাম দাঁড়ায় ১১ হাজার দুই টাকা। পাঁচ শতাংশ শুল্ক ধরে দাম দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫৫২ টাকা। পরিবহন ও অন্যান্য খরচ ১০ শতাংশ ধরলে দাম ১২ হাজার ৭০৭ টাকা। এর ওপর ১০ শতাংশ মুনাফা ধরলে দাম হয় ১৩ হাজার ৯৭৮ টাকা। অর্থাৎ, পেঁয়াজের কেজি দাঁড়ায় ১৩ টাকা ৯৮ পয়সা।
এভাবে শুকনা মরিচের কেজি ১২২ টাকা, রসুন ৬৬ টাকা, খেজুর ৬৪ টাকা, হলুদ ৭৭ টাকা, মসুর ডাল ৬৮ টাকা, ছোলা ৭৪ টাকা এবং আদার দাম খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ হওয়া উচিত ৪০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা যে পথে পথে চাঁদা দেওয়ার কথা বলেন, তা-ও ট্যারিফ কমিশন বিবেচনায় নিয়েছে বলে একজন কর্মকর্তা জানান।
এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে দেখা যায়, শুকনো মরিচ কেজিতে ৪০ টাকা, মান ভেদে হলুদ ১৩ থেকে ৬৩ টাকা, আদা ২০ থেকে ৩০ টাকা, রসুন ১৪ থেকে ২৪ টাকা, খেজুর ১৬ থেকে ৫৬ টাকা, ছোলা এক থেকে ১১ টাকা এবং মসুর ডাল (তুরস্ক) ১২ থেকে ১৭ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে বাজারে।
জানা গেছে, সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যৌক্তিক দরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হওয়ার এই চিত্র তুলে ধরা হলেও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী কেউই তা আমলে নেননি।
নিজের আদেশই মানছে না মন্ত্রণালয়: নিজের তৈরি করা আদেশ নিজেই মানছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ফলে যে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে আদেশটি জারি করা হয়েছিল, তাঁরাও তা অনুসরণ করছেন না।
সরকার ২০১১ সালের ২১ মার্চ ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ’ গেজেট আকারে প্রকাশ করে। আদেশটি জারি করা হয় মূলত ভোজ্যতেল ও চিনির জন্য। আদেশে বলা হয়েছিল, জারি হওয়ার তিন মাসের মধ্যে পরিবেশক নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে। একই সময়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে চালান প্রথা (ডিও)। এক বছর তিন মাস হতে চললেও পরিবেশক নিয়োগের প্রক্রিয়াই সম্পন্ন হয়নি। আবার আদেশ অনুযায়ী, তরল পণ্য পরিমাপে একক হিসেবে লিটার ব্যবহার করতে হবে।
অর্থাৎ, ভোজ্যতেল পরিমাপে কেজির মাপ চালানো যাবে না। বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাস্তবে এটিও কার্যকর নয়।
আদেশের উদ্দেশ্য পূরণে রয়েছে জেলা কমিটি, উপজেলা কমিটি এবং ট্যারিফ কমিটির তদারক সেল। প্রতিটিরই আলাদা দায়িত্ব ও কাজ রয়েছে। কিন্তু কেউই তার দায়িত্ব পালন করছে না। প্রয়োজনে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা জাতীয় কমিটির। সূত্র জানায়, ১৫ মাসে জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়েছে মাত্র একটি।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত বাণিজ্যসচিব এ টি এম মূর্তজা রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া এখন মুশকিল।’ জাতীয় কমিটির সভা কেন হয় না, এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে তিনি বলেন, ‘শিগগির এই কমিটির সভা ডাকা হবে।’
টিসিবির পাঁচ পণ্য: রমজান মাস সামনে রেখে ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল (নেপালি), ছোলা ও খেজুর—এই পাঁচটি পণ্য কম দামে বিক্রির জন্য দুই হাজার ৯৫২ জন ডিলারের কাছে সরবরাহ করবে টিসিবি। জুলাইয়ের শুরুতে এক কিস্তি, রমজান মাসের শুরুতে এক কিস্তি ও রমজান মাসের মাঝামাঝিতে আরেক কিস্তি পণ্য তাঁদের দেওয়া হবে। প্রয়োজনে ২০ রোজার পর আরেক কিস্তি দেওয়া হবে।
তবে এই পাঁচ পণ্য কত টাকা করে বিক্রি হবে, তা এখনো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদন করেনি। বর্তমানে টিসিবির এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১২১ টাকা, খোলা সয়াবিন ১১৫, চিনি ৫০ ও মসুর ডাল ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
টিসিবির কাছে এই পাঁচ পণ্যের মোট মজুদ কত, তা জানাতে রাজি হয়নি কর্তৃপক্ষ। তবে টিসিবি সূত্র জানায়, রমজান মাস সামনে রেখে সংস্থাটি ৪০ হাজার টন চিনি, ১০ হাজার টন সয়াবিন তেল, ১১ হাজার টন মসুর ডাল, দুই হাজার টন ছোলা ও ৫০০ টন খেজুরের মজুদ গড়ে তুলবে। কিছু মজুদ বর্তমানে থাকলেও বাকিগুলো রমজান মাস শুরুর আগেই টিসিবির গুদামে পৌঁছাবে।
টিসিবির তথ্য কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘রমজান মাসে টিসিবির মজুদ বাড়ছে। গতবার ছিল চাহিদার তিন থেকে চার শতাংশ, এবার তা হবে পাঁচ শতাংশ।’ এই পণ্য দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলেও দামের ওপর প্রভাব ফেলা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
ভোজ্যতেলে নৈরাজ্য: আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। উল্টো বাড়ানো হয়েছে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেল বোতলজাত করতে ৫৯০ থেকে ৬০০ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু সেই বোতলজাত তেলের জন্য ভোক্তাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ৬৭০ টাকা। অর্থাৎ, ভোক্তাকে শুধু বোতলের দামই দিতে হচ্ছে ৮০ টাকা। বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১১৮ থেকে ১২০ টাকা এবং খোলা পাম তেল ৯৭ থেকে ৯৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করলেও তাঁরা কিছুই করতে পারছেন না। তিনি আরও জানান, ভোজ্যতেলের যৌক্তিক দামের বিষয়ে ট্যারিফ কমিশন কয়েক দফা সুপারিশ করলেও তা-ও আমলে নেওয়া হয়নি।
কমছে না লবণ ও ডিমের দাম: আমদানি উন্মুক্ত করে দিয়েও লবণ ও ডিমের দাম সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তিন মাস আগেও এক কেজি প্যাকেটজাত লবণের দাম ছিল ২০ টাকা। এখন সেই প্যাকেটের দাম ৩৩ টাকা।
এ ছাড়া বাজারে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিশোধিত লবণ ৩০ টাকা এবং সনাতনী পদ্ধতিতে ১৫ থেকে ১৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সোমবার লবণ মিল মালিকদের সমিতি লবণের দাম কেজিতে তিন টাকা করে কমানোর ঘোষণা দিলেও গতকাল বৃহস্পতিবার বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
মাছ-মাংসের দাম বেশি বলে সাধারণ মানুষ ডিম খাওয়ার চিন্তা করে। কিন্তু ডিমের হালি প্রায় ৪০ টাকায় ওঠায় মানুষের সে আশায়ও গুড়েবালি। টিসিবির হিসাবেই, ডিমের দাম এক বছরে বেড়েছে ৪৫ শতাংশ।
মিরপুর রূপনগরের আফরোজা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিন্তা করতে পারেন, একটা ডিমের দাম ১০ টাকা! বাচ্চাদের গাভির দুধ খাওয়াতে পারছি না, ছোটবেলা থেকেই অপুষ্টি নিয়ে বেড়ে উঠছে। এখন দেখছি, ডিম খাওয়ানোও বাদ দিতে হবে।’
অথচ বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। যেসব পণ্যে ১০ শতাংশের বেশি মুনাফা করতে নিষেধ করা হয়েছে, বাজারে এখনই তা বিক্রি হচ্ছে ৬ থেকে সর্বোচ্চ ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দামে।
চট্টগ্রামে বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন এবং ঢাকায় অতিরিক্ত বাণিজ্যসচিব এ টি এম মূর্তজা রেজা চৌধুরীর সভাপতিত্বে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গত মঙ্গলবার এ- সংক্রান্ত দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ওই দিন বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন সাংবাদিকদের জানান, রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদে তিনি সন্তুষ্ট। অতিরিক্ত বাণিজ্যসচিবের বক্তব্যও একই ধরনের। তিনি বলেন, রমজান মাসে পণ্যমূল্য বাড়বে না। আর ব্যবসায়ীরা তাঁকে কথা দিয়েছেন খুচরা পর্যায়ে যাতে ১০ শতাংশের বেশি মুনাফা না করা হয়, সেই ব্যবস্থা তাঁরা করবেন।
ট্যারিফ কমিশনের বিশ্লেষণ অগ্রাহ্য: রমজান মাসের নিত্যপণ্য নিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বিশ্লেষণ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজারে আমদানি করা পেঁয়াজ খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি দামে। ট্যারিফ কমিশনের মতে, যে পেঁয়াজ খুচরা বিক্রি হওয়ার কথা ১৪ টাকা কেজি দরে, পাইকারি বাজারেই তা বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ টাকায়। আর খুচরা বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৪ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ, কেজিতে ছয় থেকে ১০ টাকা বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে।
পেঁয়াজের পাশাপাশি শুকনা মরিচ, রসুন, খেজুর, হলুদ, মসুর ডাল, ছোলা, আদা ইত্যাদি পণ্যের আমদানি, শুল্ক, পরিবহনসহ যাবতীয় খরচ ১০ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ মুনাফা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষণটি করা হয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি জুন মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৩১ হাজার ৬৭৭ টন। ডলারকে টাকায় রূপান্তর করলে প্রতি টনের দাম দাঁড়ায় ১১ হাজার দুই টাকা। পাঁচ শতাংশ শুল্ক ধরে দাম দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫৫২ টাকা। পরিবহন ও অন্যান্য খরচ ১০ শতাংশ ধরলে দাম ১২ হাজার ৭০৭ টাকা। এর ওপর ১০ শতাংশ মুনাফা ধরলে দাম হয় ১৩ হাজার ৯৭৮ টাকা। অর্থাৎ, পেঁয়াজের কেজি দাঁড়ায় ১৩ টাকা ৯৮ পয়সা।
এভাবে শুকনা মরিচের কেজি ১২২ টাকা, রসুন ৬৬ টাকা, খেজুর ৬৪ টাকা, হলুদ ৭৭ টাকা, মসুর ডাল ৬৮ টাকা, ছোলা ৭৪ টাকা এবং আদার দাম খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ হওয়া উচিত ৪০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা যে পথে পথে চাঁদা দেওয়ার কথা বলেন, তা-ও ট্যারিফ কমিশন বিবেচনায় নিয়েছে বলে একজন কর্মকর্তা জানান।
এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে দেখা যায়, শুকনো মরিচ কেজিতে ৪০ টাকা, মান ভেদে হলুদ ১৩ থেকে ৬৩ টাকা, আদা ২০ থেকে ৩০ টাকা, রসুন ১৪ থেকে ২৪ টাকা, খেজুর ১৬ থেকে ৫৬ টাকা, ছোলা এক থেকে ১১ টাকা এবং মসুর ডাল (তুরস্ক) ১২ থেকে ১৭ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে বাজারে।
জানা গেছে, সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যৌক্তিক দরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হওয়ার এই চিত্র তুলে ধরা হলেও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী কেউই তা আমলে নেননি।
নিজের আদেশই মানছে না মন্ত্রণালয়: নিজের তৈরি করা আদেশ নিজেই মানছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ফলে যে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে আদেশটি জারি করা হয়েছিল, তাঁরাও তা অনুসরণ করছেন না।
সরকার ২০১১ সালের ২১ মার্চ ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ’ গেজেট আকারে প্রকাশ করে। আদেশটি জারি করা হয় মূলত ভোজ্যতেল ও চিনির জন্য। আদেশে বলা হয়েছিল, জারি হওয়ার তিন মাসের মধ্যে পরিবেশক নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে। একই সময়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে চালান প্রথা (ডিও)। এক বছর তিন মাস হতে চললেও পরিবেশক নিয়োগের প্রক্রিয়াই সম্পন্ন হয়নি। আবার আদেশ অনুযায়ী, তরল পণ্য পরিমাপে একক হিসেবে লিটার ব্যবহার করতে হবে।
অর্থাৎ, ভোজ্যতেল পরিমাপে কেজির মাপ চালানো যাবে না। বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাস্তবে এটিও কার্যকর নয়।
আদেশের উদ্দেশ্য পূরণে রয়েছে জেলা কমিটি, উপজেলা কমিটি এবং ট্যারিফ কমিটির তদারক সেল। প্রতিটিরই আলাদা দায়িত্ব ও কাজ রয়েছে। কিন্তু কেউই তার দায়িত্ব পালন করছে না। প্রয়োজনে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা জাতীয় কমিটির। সূত্র জানায়, ১৫ মাসে জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়েছে মাত্র একটি।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত বাণিজ্যসচিব এ টি এম মূর্তজা রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া এখন মুশকিল।’ জাতীয় কমিটির সভা কেন হয় না, এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে তিনি বলেন, ‘শিগগির এই কমিটির সভা ডাকা হবে।’
টিসিবির পাঁচ পণ্য: রমজান মাস সামনে রেখে ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল (নেপালি), ছোলা ও খেজুর—এই পাঁচটি পণ্য কম দামে বিক্রির জন্য দুই হাজার ৯৫২ জন ডিলারের কাছে সরবরাহ করবে টিসিবি। জুলাইয়ের শুরুতে এক কিস্তি, রমজান মাসের শুরুতে এক কিস্তি ও রমজান মাসের মাঝামাঝিতে আরেক কিস্তি পণ্য তাঁদের দেওয়া হবে। প্রয়োজনে ২০ রোজার পর আরেক কিস্তি দেওয়া হবে।
তবে এই পাঁচ পণ্য কত টাকা করে বিক্রি হবে, তা এখনো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদন করেনি। বর্তমানে টিসিবির এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১২১ টাকা, খোলা সয়াবিন ১১৫, চিনি ৫০ ও মসুর ডাল ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
টিসিবির কাছে এই পাঁচ পণ্যের মোট মজুদ কত, তা জানাতে রাজি হয়নি কর্তৃপক্ষ। তবে টিসিবি সূত্র জানায়, রমজান মাস সামনে রেখে সংস্থাটি ৪০ হাজার টন চিনি, ১০ হাজার টন সয়াবিন তেল, ১১ হাজার টন মসুর ডাল, দুই হাজার টন ছোলা ও ৫০০ টন খেজুরের মজুদ গড়ে তুলবে। কিছু মজুদ বর্তমানে থাকলেও বাকিগুলো রমজান মাস শুরুর আগেই টিসিবির গুদামে পৌঁছাবে।
টিসিবির তথ্য কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘রমজান মাসে টিসিবির মজুদ বাড়ছে। গতবার ছিল চাহিদার তিন থেকে চার শতাংশ, এবার তা হবে পাঁচ শতাংশ।’ এই পণ্য দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলেও দামের ওপর প্রভাব ফেলা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
ভোজ্যতেলে নৈরাজ্য: আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। উল্টো বাড়ানো হয়েছে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেল বোতলজাত করতে ৫৯০ থেকে ৬০০ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু সেই বোতলজাত তেলের জন্য ভোক্তাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ৬৭০ টাকা। অর্থাৎ, ভোক্তাকে শুধু বোতলের দামই দিতে হচ্ছে ৮০ টাকা। বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১১৮ থেকে ১২০ টাকা এবং খোলা পাম তেল ৯৭ থেকে ৯৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করলেও তাঁরা কিছুই করতে পারছেন না। তিনি আরও জানান, ভোজ্যতেলের যৌক্তিক দামের বিষয়ে ট্যারিফ কমিশন কয়েক দফা সুপারিশ করলেও তা-ও আমলে নেওয়া হয়নি।
কমছে না লবণ ও ডিমের দাম: আমদানি উন্মুক্ত করে দিয়েও লবণ ও ডিমের দাম সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তিন মাস আগেও এক কেজি প্যাকেটজাত লবণের দাম ছিল ২০ টাকা। এখন সেই প্যাকেটের দাম ৩৩ টাকা।
এ ছাড়া বাজারে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিশোধিত লবণ ৩০ টাকা এবং সনাতনী পদ্ধতিতে ১৫ থেকে ১৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সোমবার লবণ মিল মালিকদের সমিতি লবণের দাম কেজিতে তিন টাকা করে কমানোর ঘোষণা দিলেও গতকাল বৃহস্পতিবার বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
মাছ-মাংসের দাম বেশি বলে সাধারণ মানুষ ডিম খাওয়ার চিন্তা করে। কিন্তু ডিমের হালি প্রায় ৪০ টাকায় ওঠায় মানুষের সে আশায়ও গুড়েবালি। টিসিবির হিসাবেই, ডিমের দাম এক বছরে বেড়েছে ৪৫ শতাংশ।
মিরপুর রূপনগরের আফরোজা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিন্তা করতে পারেন, একটা ডিমের দাম ১০ টাকা! বাচ্চাদের গাভির দুধ খাওয়াতে পারছি না, ছোটবেলা থেকেই অপুষ্টি নিয়ে বেড়ে উঠছে। এখন দেখছি, ডিম খাওয়ানোও বাদ দিতে হবে।’
No comments