একটি পণ্ডিতি সারা জীবনের কান্না by সিমু নাসের
আমাদের স্কুলের একটা বাজে নিয়ম ছিল। সবাইকে সাদা কেডস পরে যেতে হবে। সাদা মানে সাদাই। সাদার আশপাশের অন্য কোনো কালার, যেমন অফহোয়াইট বা এই জাতীয় কিছু হলে চলবে না। অন্যথা হলে স্পেশাল শাস্তি। যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি।
প্রায়ই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি আর ভাবি, কবে এই স্কুল থেকে মুক্তি পাব আর আমাকেও বাংলা সিনেমার নায়কের মতো সাদা কেডস পরে স্কুলে যেতে হবে না। তেমনই একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে টান দিয়ে ডান পায়ের কেডস খুলে সবে বাম পায়েরটায় হাত দিয়েছি, তখন আম্মু রুমে ঢুকলেন। বিরক্ত মুখে হলুদ রঙের একটা খাম বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এই নে তোর চিঠি এসেছে।’
‘চিঠি! আমার নামে!’ আমি অবাক হয়ে আম্মুর হাত থেকে খামটা নিলাম। কে, কেন, কিসের চিঠি—এই সব ভাবতে ভাবতে চিঠি খুলে আমার বিস্ময়ে পাথর হওয়ার অবস্থা। প্রায় আট-নয় মাস আগে নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে টিনটিন আর অ্যাসটেরিক্স কেনার সময় কয়েকটা ম্যাগাজিন কিনেছিলাম। সেগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে চোখে পড়ে না এমন ছোট একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গিয়েছিল। ‘ভূত সংস্কৃতি ও অন্ধকারে ভয়’ বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ভূতরাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেছে। সত্যিকারের ভূত বিশ্বাসীরাই কেবল আবেদন করতে পারবে।
ছোট থেকেই আমি পোকা ছিলাম ভূতের গল্পের। তখনই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলাম, একদিন আমি ভূতের রাজ্যে যাব, সেখানে পড়াশোনা করব, ঘুমাব, খেলব। হঠাৎ আমার সামনে এমন একটা সুযোগ এসে যাবে কল্পনায়ও ভাবিনি। তাই অনেক খাটাখাটনি করে গোপনে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম একটা আবেদনপত্র। ‘ভূত সম্পর্কে তোমার মূল্যায়ন কী?’ এই অংশে আমি লিখেছিলাম, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, মানবশিশুরা মাতৃক্রোড়ে আর ভূতেরা অবাক করা চাঁদের আলোয়।’
আমার এই মূল্যায়নে তারা খুব খুশি হয়েছিল। ভূত-মানব মৈত্রী বিদ্যালয়ের কালো কাগজের প্যাডে সাদা গোটা গোটা অক্ষরের চিঠিটাতে লেখা ছিল:
প্রিয় আন্নি, মৈত্রী স্কুলের পক্ষ থেকে তোমাকে অভিনন্দন। আবেদনপত্র পাওয়ার পর থেকে আমরা তোমার ওপর নজর রাখছিলাম। তাতে প্রমাণ পেয়েছি যে ভূতের ওপর তোমার বিশ্বাস শতকরা এক শ ভাগ। আর আবেদনপত্রের সঙ্গে ভূত নিয়ে তোমার মূল্যায়নটিতে আমরা মুগ্ধ। এ বছর আমরা পৃথিবীসহ সৌরজগতের ২০৯টি গ্রহ থেকে স্কলারশিপের জন্য ১৭ জনকে নির্বাচন করেছি। আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে তুমি তাদের একজন।
চিঠিতে নানান নিয়ম-কানুনের মধ্যে একটা পরামর্শও দেওয়া হয়েছে, নির্দিষ্ট একটা ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করতে এবং তাদের পাঠিয়ে দেওয়া সহজ ভৌতিক ভাষাশিক্ষা বইটা মুখস্থ করে ফেলতে। আর ব্যাপারটি নিয়ে ভুলেও যেন কারও সঙ্গে আলোচনা না করি।
এরপর কয়েকটা দিন আমার কাটল দারুণ ব্যস্ততায়। রাতে ভূতের ভাষাশিক্ষার বইটা পড়ি আর দিন গুনি কবে যাব, কবে যাব সেখানে। এর ভেতর স্কুল ফাঁকি দিয়ে একদিন ভূত এম্বাসিতে গিয়ে ভিসা নিয়ে এলাম। তবে চিঠিতে উল্লেখ করে দেওয়া ট্রাভেল এজেন্সিটা উত্তরা হওয়ায় একটু মুশকিলে পড়লাম। এত দূর যাব কীভাবে? তাই পণ্ডিতি করে অন্য একটা ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিমানের টিকিট কেটে ফেললাম।
দেখতে দেখতে বিমানে ওড়ার দিন চলে এল। ভূতং এয়ারলাইনসের ফ্লাইট সকাল ১১টায়। সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়েউঠল।ছোট বোনটার জন্য খারাপ লাগছিল খুব। আর জীবনেও বোধহয় দেখা হবে না তাদের সঙ্গে। আব্বুর পকেট থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে রেখেছিলাম অনেক আগেই। সকালবেলা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলাম বিমানবন্দরে। ইমিগ্রেশন শেষ করে এগিয়ে গেলাম রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল সাদা রঙের বিমানটার দিকে। সর্বশেষ চেকিংটা বাকি আছে শুধু। আমার ভিসা দেখে সিকিউরিটির লোকটা অনেক দূর হাঁটিয়ে আমাকেঅন্য একটা ডেস্কে নিয়ে গেলেন। সেখানে ঝলমলে একটা মেয়ে বসে আছে। আমি উঁকি দিয়ে তার পিঠে ছোট্ট একটা ডানাও দেখতে পেলাম। মেয়েটা আমার কাগজপত্র ভালো করে পরীক্ষা করতে করতে আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার তো জাল টিকিট, নিশ্চয়ই আমাদের অনুমোদিত ট্রাভেল এজেন্টের দ্বারা করাওনি। দুঃখিত, তোমাকে নিতে পারছি না।’
তার পরের ইতিহাস বড় করুণ। অনেক অনুনয় করেও কোনো লাভ হলো না। এই সুযোগ একজনকে জীবনে নাকি একবারই দেওয়া হয়। তবে এই লেখা যারা পড়ছ তারা জেনে রাখো, যদি কখনো কোনো পত্রিকায় এ রকম স্কলারশিপের আবেদন দেখ তবে কখনো আমার মতো পণ্ডিতি করে অননুমোদিত ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। তাহলে আমার মতো ব্যর্থ হবে, স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। আর ভুলেও বড়দের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করবে না। কারণ, বাজি ধরে বলতে পারি, ব্যাপারটা তারা বিশ্বাসই করবে না। প্রমাণ চাও? তাহলে এক্ষুনি এই লেখাটা বড়দের পড়তে দাও। পড়া শেষে তারা নিশ্চিত কী বলবে জান? ধুর, এ কি সত্যি নাকি, এ তো একটা আজগুবি ভূতের গল্প।
‘চিঠি! আমার নামে!’ আমি অবাক হয়ে আম্মুর হাত থেকে খামটা নিলাম। কে, কেন, কিসের চিঠি—এই সব ভাবতে ভাবতে চিঠি খুলে আমার বিস্ময়ে পাথর হওয়ার অবস্থা। প্রায় আট-নয় মাস আগে নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে টিনটিন আর অ্যাসটেরিক্স কেনার সময় কয়েকটা ম্যাগাজিন কিনেছিলাম। সেগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে চোখে পড়ে না এমন ছোট একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গিয়েছিল। ‘ভূত সংস্কৃতি ও অন্ধকারে ভয়’ বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ভূতরাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেছে। সত্যিকারের ভূত বিশ্বাসীরাই কেবল আবেদন করতে পারবে।
ছোট থেকেই আমি পোকা ছিলাম ভূতের গল্পের। তখনই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলাম, একদিন আমি ভূতের রাজ্যে যাব, সেখানে পড়াশোনা করব, ঘুমাব, খেলব। হঠাৎ আমার সামনে এমন একটা সুযোগ এসে যাবে কল্পনায়ও ভাবিনি। তাই অনেক খাটাখাটনি করে গোপনে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম একটা আবেদনপত্র। ‘ভূত সম্পর্কে তোমার মূল্যায়ন কী?’ এই অংশে আমি লিখেছিলাম, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, মানবশিশুরা মাতৃক্রোড়ে আর ভূতেরা অবাক করা চাঁদের আলোয়।’
আমার এই মূল্যায়নে তারা খুব খুশি হয়েছিল। ভূত-মানব মৈত্রী বিদ্যালয়ের কালো কাগজের প্যাডে সাদা গোটা গোটা অক্ষরের চিঠিটাতে লেখা ছিল:
প্রিয় আন্নি, মৈত্রী স্কুলের পক্ষ থেকে তোমাকে অভিনন্দন। আবেদনপত্র পাওয়ার পর থেকে আমরা তোমার ওপর নজর রাখছিলাম। তাতে প্রমাণ পেয়েছি যে ভূতের ওপর তোমার বিশ্বাস শতকরা এক শ ভাগ। আর আবেদনপত্রের সঙ্গে ভূত নিয়ে তোমার মূল্যায়নটিতে আমরা মুগ্ধ। এ বছর আমরা পৃথিবীসহ সৌরজগতের ২০৯টি গ্রহ থেকে স্কলারশিপের জন্য ১৭ জনকে নির্বাচন করেছি। আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে তুমি তাদের একজন।
চিঠিতে নানান নিয়ম-কানুনের মধ্যে একটা পরামর্শও দেওয়া হয়েছে, নির্দিষ্ট একটা ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করতে এবং তাদের পাঠিয়ে দেওয়া সহজ ভৌতিক ভাষাশিক্ষা বইটা মুখস্থ করে ফেলতে। আর ব্যাপারটি নিয়ে ভুলেও যেন কারও সঙ্গে আলোচনা না করি।
এরপর কয়েকটা দিন আমার কাটল দারুণ ব্যস্ততায়। রাতে ভূতের ভাষাশিক্ষার বইটা পড়ি আর দিন গুনি কবে যাব, কবে যাব সেখানে। এর ভেতর স্কুল ফাঁকি দিয়ে একদিন ভূত এম্বাসিতে গিয়ে ভিসা নিয়ে এলাম। তবে চিঠিতে উল্লেখ করে দেওয়া ট্রাভেল এজেন্সিটা উত্তরা হওয়ায় একটু মুশকিলে পড়লাম। এত দূর যাব কীভাবে? তাই পণ্ডিতি করে অন্য একটা ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিমানের টিকিট কেটে ফেললাম।
দেখতে দেখতে বিমানে ওড়ার দিন চলে এল। ভূতং এয়ারলাইনসের ফ্লাইট সকাল ১১টায়। সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়েউঠল।ছোট বোনটার জন্য খারাপ লাগছিল খুব। আর জীবনেও বোধহয় দেখা হবে না তাদের সঙ্গে। আব্বুর পকেট থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে রেখেছিলাম অনেক আগেই। সকালবেলা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলাম বিমানবন্দরে। ইমিগ্রেশন শেষ করে এগিয়ে গেলাম রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল সাদা রঙের বিমানটার দিকে। সর্বশেষ চেকিংটা বাকি আছে শুধু। আমার ভিসা দেখে সিকিউরিটির লোকটা অনেক দূর হাঁটিয়ে আমাকেঅন্য একটা ডেস্কে নিয়ে গেলেন। সেখানে ঝলমলে একটা মেয়ে বসে আছে। আমি উঁকি দিয়ে তার পিঠে ছোট্ট একটা ডানাও দেখতে পেলাম। মেয়েটা আমার কাগজপত্র ভালো করে পরীক্ষা করতে করতে আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার তো জাল টিকিট, নিশ্চয়ই আমাদের অনুমোদিত ট্রাভেল এজেন্টের দ্বারা করাওনি। দুঃখিত, তোমাকে নিতে পারছি না।’
তার পরের ইতিহাস বড় করুণ। অনেক অনুনয় করেও কোনো লাভ হলো না। এই সুযোগ একজনকে জীবনে নাকি একবারই দেওয়া হয়। তবে এই লেখা যারা পড়ছ তারা জেনে রাখো, যদি কখনো কোনো পত্রিকায় এ রকম স্কলারশিপের আবেদন দেখ তবে কখনো আমার মতো পণ্ডিতি করে অননুমোদিত ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। তাহলে আমার মতো ব্যর্থ হবে, স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। আর ভুলেও বড়দের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করবে না। কারণ, বাজি ধরে বলতে পারি, ব্যাপারটা তারা বিশ্বাসই করবে না। প্রমাণ চাও? তাহলে এক্ষুনি এই লেখাটা বড়দের পড়তে দাও। পড়া শেষে তারা নিশ্চিত কী বলবে জান? ধুর, এ কি সত্যি নাকি, এ তো একটা আজগুবি ভূতের গল্প।
No comments