ভাসমান চিত্রকর্মশালা by জাফরিন গুলশান

আমি জানতাম, দারুণ একটি অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাব, যখন দি আমেরিকান সেন্টার থেকে নিমন্ত্রণপত্র পেলাম ২২ ও ২৩ তারিখ শীতলক্ষ্যা নদীতে ক্রুজে করে আড্ডা থ্রু আর্ট-২০১২ ওয়ার্কশপ প্রোগ্রামের। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম , এই সুযোগ ছাড়া যাবে না।


দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পীদের একত্র করে হবে দুই দিনব্যাপী এই আড্ডা, আনন্দ ও নদীভ্রমণ কর্মশালা।
২২ তারিখ সকালে সংসদ ভবনের সামনে থেকে এক বাসভর্তি শিল্পীরা রওনা দিলাম। আরেকটি বাসকে গুলশান থেকে আমাদের পিছু নিয়ে চলল ডেমরা ঘাট পর্যন্ত। পর্যাপ্ত পুলিশি নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে যাত্রার উদ্দেশ্য শীতলক্ষ্যা নদীতে প্রস্ত্তুত বেঙ্গল ট্যুরস লিমিটেডের এমভি ডিঙি ক্রুজার।
ডেমরা ঘাট থেকে ছোট স্পিডবোটে করে ক্রুজারে উঠার পর লেবুর শরবত দিয়ে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন আমেরিকান সেন্টারের পরিচালক লরেন লাভলেস। ক্রুজারে দুজন কিংবা তিনজনের জন্য একটি করে কক্ষ বরাদ্দ হলো। চার নম্বর কক্ষে জয়া শাহরীন হক, লায়লা শারমিন ও আমি। ছোট পরিচ্ছন্ন কক্ষ। কিছুক্ষণ পরে সবাই নিচে খাবার ঘরে মিলিত হলাম এবং লরেন আবারও স্বাগত জানিয়ে এই আয়োজনের উদ্দেশ্য খুলে বললেন: আড্ডা হবে, ছবি আঁকা হবে, প্রাণভরে বর্ষাস্নাত সুন্দরী শীতলক্ষ্যার রূপসুধা পান করা হবে।
যেকোনো সংবেদনশীল মানুষের জন্য, বিশেষ করে যখন শিল্পীদের জন্য এ রকম কর্মশালা নিবেদন করা হয়, তা নিঃসন্দেহে নান্দনিক আবেগকে প্ররোচিত করার দারুণ এক অভিজ্ঞতা। এরই মধ্যে প্রত্যেক শিল্পীর হাতে পৌঁছে গেছে ছবি আঁকার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামভর্তি একটি ব্যাগ, বোর্ড এবং উন্নতমানের কাগজ, যা সুদূর আমেরিকা থেকে কর্মশালার শিল্পীদের সম্মানে আনিয়েছে দি আমেরিকান সেন্টার।
ডিঙির ছাদে চলে গেলাম জলরং কাগজ নিয়ে। প্রাণভরে দেখতে শুরু করলাম। শহরের যান্ত্রিক কোলাহলের বাইরে এসেছি। এসেছি শীতলক্ষ্যা নামের চমৎকার এক নদীর বুকের গভীরে। ওর প্রাণোচ্ছল চলার পথ ধরে চলছে আমাদের ক্রুজার। আমরা শিল্পীরা, শিল্পপ্রেমিকেরা একত্র এখন। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন আমাদের মধ্যেই উৎসারিত হতে শুরু করেছে।
প্রথম দিন একটি ছবি এঁকেছি। শীতলক্ষ্যা নামের যৌবনবতী এক সরল রমণী এবং একটি কচ্ছপ। আবেগের গভীরে হাত বাড়িয়ে আদর করছে শীতলক্ষ্যা তার কচ্ছপটিকে। কচ্ছপ গলা লম্বা করে পৃথিবীকে জানান দিতে চায় তার এই ভালোবাসার কথা। নদীর দুধারে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানার অর্থনৈতিক লাভ-লোকসানের হিসাবনিকাশ শীতলক্ষ্যা ও কচ্ছপপ্রেমিকের বোকা ভালোবাসা হুমকির সম্মুখীন। শীতলক্ষ্যায় মাছ পাওয়া যায় না আর। কারখানার বর্জ্য ফেলার স্থান হয়েছে এই নদী। বুড়িগঙ্গার মতো অতটা না পচলেও দ্রুতই সেই মরণব্যাধি আক্রান্ত করবে এ নদীকেও।
আহ! আষাঢ়ের বৃষ্টি ঝরছে, শীতলক্ষ্যা আরও টইটুম্বুর, জলে ভরপুর। মানুষের নির্মমতাকে মুখ বুজে সয়ে বয়ে চলা এই নদী গিয়ে মিশেছে পুরোনো ব্রহ্মপুত্রে।
প্রায় পাঁচ ঘণ্টা চলল ক্রুজার। আমরা এলাম ধাঁধার চর। আমাদের সঙ্গী শিল্পী রফিকুন নবী, শিল্পী মনিরুল ইসলাম, শিল্পী হামিদুজ্জামান খান, শিল্পী শহীদ কবির, শিল্পী বিরেন সোম প্রমুখ—এঁদের সঙ্গে অনেক আড্ডা-গল্প চলছে সকাল থেকেই। ধাঁধার চরে নেমে ঘুরতে যাওয়া হলো। বেশ উন্নত গ্রাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি আর সন্ধ্যা নেমে আসায় ছবি হলো না এখানে।
লরেন লাভলেসের পরীর মতো ছোট্ট মেয়ে উনা এবং ইউএস অ্যাম্বাসির আরেক কর্মকর্তার ছোট দুই কন্যার আনন্দ দেখতে বেশ ভালো লাগছিল। ওরাও ছবি এঁকেছে আমাদের সঙ্গে। ওদের আঁকা ছবিগুলো দারুণ।
সন্ধ্যায় শুরু হলো গান। ছাপচিত্র বিভাগের তারেক, শাকিল দারুণ জমিয়ে রাখল আমাদের। সঙ্গে আছে বার-বি-কিউর আয়োজন। আমরা নাচলাম-গাইলাম। নবী স্যার, মনিরুল ইসলাম স্যাররা আমাদের উৎসাহদাতা দর্শক এবং লরেন, আমি, আনিস স্যার, শহীদ কবির—আমরা নাচছি।
রাতের খাবার শেষে মধ্যরাত অবধি আড্ডা দেওয়া, গল্প চলল। নবী স্যার, মনিরুল ইসলাম স্যার, কবির স্যারদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। অন্য সময়ে এই অগ্রজ শিল্পীদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় না। তাই তাঁদের সঙ্গে আড্ডার সুযোগ হাতছাড়া করার প্রশ্নই আসে না। রফিকুন নবী ও মনিরুল ইসলামের গল্প যেন ইতিহাস। তাঁদের সময়কে জানা, বোঝার সুযোগ। খুব আপন করে নিয়েছিলেন আমাদের। শিল্পী মনিরুল ইসলাম কথার ছলে শিল্প সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিলেন। রফিকুন নবী স্যারের রসবোধ তুলনাহীন। পরিচিত হলাম ফিরোজ মাহমুদ, আয়েশা সুলতানা, ওয়াহিদুজ্জামান প্রমুখের সঙ্গেও। প্রত্যেকের শিল্প সম্পর্কে ভিন্ন দৃষ্টি, শিল্পচর্চার মাধ্যম আলাদা কিংবা আলাদা রুচি সত্ত্বেও প্রত্যেকের শিল্পসত্তা সদাজাগ্রত উষ্ণতায় নির্মিত।
পরদিন পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে দেখা তুমুল বর্ষা ও বাতাসে। এর মধ্যেই ছবি আঁকা চলছে। জলরং করছে সবাই। এ এক অসীম সুন্দর মুহূর্তের আগমন। ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকে প্রত্যেকের ছবি আঁকা দেখছি, কথা বলছি। এখনে কোনো বড়-ছোট নেই। সবাই সমান। সবাই ছবি আঁকছি। সবাই একই সময়ে, একই স্থানে, একই প্রাকৃতিক জল-বাতাসে নান্দনিক আবেগের খেলা খেলছি।
দুপুরে খাবারের পর আমরা কাঞ্চন ব্রিজের কাছে ঘাটে ভিড়লাম। লরেন সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন। আমরা সবাই পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অপেক্ষমাণ ট্যুরিস্ট বাসে উঠলাম। উদ্দেশ্য ঘরে ফেরা (২৩ জুন)। বাংলাদেশের নদী, দুই পারের সবুজে ছাওয়া প্রাকৃতিক লোকালয়ের গল্প এই।
গ্যালারি চিত্রকে ১৩ জুলাই এই কর্মশালায় আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনী হবে। ১৪ জুলাই ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের কেনেডি সেন্টারের শোভাবর্ধনে শিল্পীদের দেওয়া একটি করে ছবি প্রদর্শিত হবে।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা হলেন—মো. রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, হামিদুজ্জামান খান, শহীদ কবির, বীরেন সোম, গোলাম ফারুক বেবুল, জয়া শাহরীন হক, মো. ওয়াহিদুজ্জামান, লায়লা শারমিন, আয়েশা সুলতানা, ফিরোজ মাহমুদ, খালেদ মাহমুদ, সুমন আহমেদ, কামালউদ্দিন, এম কে আরিফ, সাইফ কামাল, মো. মনিরুজ্জামান, জহিরুদ্দিন, লরেন ও তাঁর পরিবার, নিক ডিন ও তাঁর পরিবার, সাবরিন রাহমান, জোনাথন গোমেজ, মাইক হারবার প্রমুখ শিল্পী এবং শিল্পপ্রেমিকেরা।
কর্মশালাটি হয়েছে ২২-২৩ জুন।

No comments

Powered by Blogger.