মন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দেয়নি চরমপন্হীরাঃ আস্থার অভাব পূরণ করতে হবে আগে
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে সশসত্র চরমপন্হীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো চরমপন্হী সন্ত্রাসী আত্মসমর্পণ করেনি। প্রতিমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, আত্মসমর্পণ করলে চরমপন্হীদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করবে। কিন্তু এ আহ্বানকে আস্থায় না নিয়ে অনেকেই এখন আত্মগোপনে চলে গেছে।
কেউ পালিয়ে গেছে দেশের বাইরে, কেউ গা ঢাকা দিয়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। একাধিকবার আত্মসমর্পণের কথা বলা হলেও বর্তমানে এমন কোনো দিন নেই, যেদিন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের্ যাব-পুলিশের ক্রসফায়ারে চরমপন্হী ক্যাডার মারা পড়ছে না। এমনকি গত ২৫ সেপ্টেম্বরওর্ যাবের ক্রসফায়ারে কুষ্টিয়ায় নিহত হয়েছে দুই চরমপন্হী। একজন কথিত নিউ বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা, অন্যজন গণমুক্তিফৌজের ক্যাডার। এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর আহ্বানে আস্থা রাখতে ভরসা না পেয়েই চরমপন্হীরা আত্মসমর্পণের বদলে আত্মগোপনে চলে গিয়েছে। তবে তাদের তৎপরতা বন্ধ রয়েছে এমন ভাবার অবকাশ নেই। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, রাজধানীতে গা ঢাকা দিয়ে থাকা অনেক চরমপন্হী সদস্য বিভিন্ন ধরনের ইতর পেশায় নিয়োজিত আছে এবং সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে নিজ এলাকার সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৬ জেলায় সশসত্র চরমপন্হীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। খুন-খারাবি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জবরদখল এবং নিরীহ জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতন চলতেই থাকে। একের পর এক লাশ পড়তে থাকে বিভিন্ন দল-উপদলের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে। এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সরকারের নির্দেশে বিশেষ অভিযান শুরু করের্ যাব ও পুলিশ। ক্রসফায়ারে নিহত হয় আঞ্চলিক নেতা ও দুর্ধর্ষ ক্যাডাররা। এসব চরমপন্হী দলের মধ্যে রয়েছে সর্বহারা পার্টি, জনযুদ্ধ, গণবাহিনী, জাসদ গণবাহিনী, গণমুক্তিফৌজ, পূর্ববাংলা কমিউনিষ্ট পার্টি, পূর্ব বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টি (লাল পতাকা), নিউ বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টি ও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে পরিচিত বাহিনী। উল্লেখ্য, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চরমপন্হীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ফলে ১৯৯৯ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেছিল আড়াই হাজারের বেশি চরমপন্হী। অসত্র জমা পড়েছিল ৭৭টি। তাদের ৭৮০ জনকে পুনর্বাসনের আওতায় চাকরি দেয়া হয়েছিল আনসার বাহিনীতে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাদের অনেকে পালিয়ে যায় অসত্রসহ, কেউ চাকরি ছেড়ে ফের শুরু করে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। নিঃসন্দেহে উদ্যোগটি ভালো ছিল। কিন্তু সফল হয়নি। তার প্রমাণ বর্তমানে চরমপন্হীদের নতুন উদ্যমে আবির্ভাব। তখন সরকার মনে করেছিল চাকরি দিলেই সব চুকেবুকে যাবে। বিষয়টিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে না রাখায় শেষ পর্যন্ত আসল উদ্দেশ্যটাই মার খেয়েছে। সরকার যদি আন্তরিকভাবে এ সমস্যার সমাধান চায় তাহলে সাধারণ ক্ষমার পাশাপাশি আরও কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে। এক সময় শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য চরমপন্হীরা যে অঙ্গীকার করেছিল পরে তা স্রেফ চাঁদাবাজি ও লুণ্ঠনের রাজনীতিতে পর্যবসিত হয়। পরে দেশের বড় বড় দলগুলোর অনেক নেতা এই বিপথগামীদের ব্যবহার করতে শুরু করে। নির্বাচনে জিততে, নিজ এলাকায় প্রাধান্য ধরে রাখতে গোপনে তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন তারা-এমন অভিযোগ আছে। রাজনৈতিকভাবে এই ব্যবহারের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, তাদের দলে এ ধরনের কোনো নেতা নেই। তাহলে চরমপন্হীদের দমন বা তাদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সহজ হবে। তাছাড়া আত্মসমর্পণের আহ্বান এবং ক্রসফায়ার একই সঙ্গে চললে কোনো সুফল না পাওয়াই স্বাভাবিক। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড অর্থাৎ ক্রসফায়ার যে স্থায়ী কোনো সমাধান নয় তা এর আগেই প্রমাণিত। আত্মসমর্পণের কথা বললে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আর আগের অবস্থানে ফেরত না যায়। গোটা বিষয়টিকে বিবেচনা করতে হবে নিবিড় রাজনৈতিক-মানবিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে। তাহলে হয়তো এ ধরনের উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখতে পারে।
No comments