ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাম্যঃ সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনসহ সংবিধান সংশোধনের ঘোষণা দিয়ে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ রাজনীতির মাঠে বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন। গত বৃহসপতিবার তিনি '৭৫-পরবর্তী সময়ে সংবিধানে কাটাছেঁড়ার উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রবিরোধী বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন কমিশনে চিঠি দেয়ার কথা বলেছেন।
একই দিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, জাতীয় সংসদের মেয়াদ ও স্থানীয় সরকার পদ্ধতি সংশোধনের জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো পরিবর্তনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কিছু না করার কথাও জানিয়েছেন। জাতীয় সংসদকে কার্যকর করে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে না পারলে আবারও ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন তিনি। অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সরকারি উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন। তিনি আগামীতে আবারও ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে কারচুপির নির্বাচনের পথ পরিষ্কার করতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপসহ সংবিধান সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি জাতীয় সংসদে আলোচনা না করে আইন কমিশনে পাঠানোরও সমালোচনা করেছেন তিনি। তবে তিনিও সৈয়দ আশরাফের মতোই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনে সম্মতি জানিয়েছেন। বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী তার দল ভোট কারচুপিতে বিশ্বাস করে না, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে উল্লেখ করে বলেছেন, একমাত্র আওয়ামী লীগের হাতেই সংবিধান নিরাপদ। কথাটি শুনে কপালে ভাঁজ পড়া স্বাভাবিক। এত সহজে ইতিহাস ভুলে যাওয়া কি সম্ভব? স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব সরকারের হাতে সংবিধান প্রণয়ন ও জাতীয় সংসদে গৃহীত হওয়ার পর '৭৫ সাল পর্যন্ত চারটি সংশোধনী হয়েছে। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাতিল করে দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ সরকারই জাতীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কীভাবে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করেছিল সে দুঃস্বপ্নের দিনগুলো মানুষ কোনোদিন ভুলতে পারবে না। তখন ক্ষমতার জোরে জনগণের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে মাত্র চারটি সরকারি পত্রিকা টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। সবাইকে বাকশালের সদস্য হতে বাধ্য করা হয়েছিল। এ সবই 'সংবিধান রক্ষার' আওয়ামী দৃষ্টান্ত হিসেবেই ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। অবশ্য এর মূল্যও দিতে হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। সে দুঃখজনক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। বিএনপিই দেশে আবার বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনে। তাই আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে যত কথাই শোনা যাক না কেন সংবিধান ও গণতন্ত্র তাদের হাতে নিরাপদ-এ কথায় আস্থা রাখা কঠিন বৈকি। বিশেষ করে এবার জাতীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর বিরোধী দলের প্রতি তাদের আচরণ এ সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তারপরও সৈয়দ আশরাফের কথায় আমরা ভরসা রাখতে চাই। জাতীয় সংসদে আলোচনার মাধ্যমেই সংবিধান সংশোধনসহ সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে-এটাই সবার কাম্য। তবে এ জন্য জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য অবশ্য সরকারি দলকেই কার্যকরভাবে এগিয়ে আসতে হবে। প্রথম সারিতে আসন বণ্টন সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতা দিয়েই প্রমাণ হবে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে চায় কি-না। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণও নির্ভর করছে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের পদক্ষেপের ওপর। শুধু মুখের কথায় যে চিড়ে ভিজে না সেটা কে না জানে।
No comments