আবদুল জলিলের বিসেফারক সাক্ষাৎকার
আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, কিছু লোককে চিরদিনের জন্য বোকা বানানো যায়, সবাইকে কিছুদিনের জন্য বোকা বানানো যায়, কিন্তু সবাইকে চিরদিন বোকা বানিয়ে রাখা যায় না। লিংকনের এই অমর উক্তির সূত্র ধরে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষরা প্রায় বিরামহীনভাবে বলে আসছে যে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আসলে জাতিকে বোকা বানানো হয়েছে।
এটা ছিল এক পাতানো নির্বাচন। নির্বাচন হওয়ার আগেই দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগের সঙ্গে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং এ সরকারের নেপথ্য নায়কদের গোপন সমঝোতা হয়ে গিয়েছিল। সেই সমঝোতার ফল হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট জাতীয় নির্বাচনে 'বিপুল বিজয়' লাভ করে। নির্বাচনের পর মহাজোটের উল্লাস, দেশ-বিদেশে বাহবা দেয়ার প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এই গোপন সমঝোতা তত্ত্ব তখন তেমন একটা হালে পানি পায়নি। বরং কেউ কেউ এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপনকে পরাজিতের মর্মবেদনার বহিঃপ্রকাশ বলে উপহাস করেছিলেন। অবশ্য নির্বাচিত সরকারের কাজকারবার দেখে দেশবাসীর ভ্রূকুঞ্চিত হতে বেশি সময় লাগেনি। এই পটভূমিতে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য আবদুল জলিল এমপি ইংল্যান্ডে দেয়া দুই সাক্ষাৎকারে যেসব বিসেফারক মন্তব্য করেছেন, তাতে এতদিন ধরে উঠে আসা অভিযোগগুলোর সত্যতাই শুধু প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং আরও এমনসব তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে, যেগুলো আগে এভাবে সরাসরি উচ্চারিত হয়নি। আবদুল জলিলের বলা কথাগুলো বিলেতি ও বাংলাদেশী মিডিয়ায় এমন ফলাও প্রচার পেয়েছে যে, রাজনীতি-সচেতন কোনো মানুষের আর এ ব্যাপারে কিছু জানতে বাকি নেই। তদুপরি যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে যুবলীগের ক্যাডাররা জলিল সাহেবকে পিটিয়ে বেগুনভর্তা বানিয়ে গোটা দুনিয়াকে জানিয়ে দিয়েছে যে, তিনি আসলে মিথ্যা কথা বলেননি। এতদিন ধরে উত্থাপিত হরেকরকমের অভিযোগ এবং জলিল সাহেবের সর্বশেষ বক্তব্য থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে, আমরা প্রকাশ্যে যা দেখছি তা এখন আর আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ামক শক্তি নয়। গোপন সমঝোতা, আরও পরিষ্কার করে বললে এক ধরনের অধীনতামূলক মিত্রতার ভিত্তিতে এখন দেশ চলছে, সরকার চলছে, দেশে গণতন্ত্র গণতন্ত্র খেলা চলছে। আবদুল জলিল এই খেলার একটা দিক সম্পর্কে মুখ খুলেছেন। তাতেই আমাদের মনে হচ্ছে, এ সরকার আসলে কিছুই না। সরকার চলছে সুতার টানে। কিন্তু যারা এই সুতা টানছেন তাদের নাকেও যে দড়ি পড়ানো আছে, সে কথা জলিল সাহেব বলেননি। আমরা আশা করছি, বাস্তবতা যত কঠিন এবং কুৎসিতই হোক তার পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রকাশ পেতে খুব বেশি দেরি হবে না। ভালো হোক মন্দ হোক, আওয়ামী লীগ আর বিএনপি দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল। এই দল দুটিকে কেন্দ্র করেই মূলধারার রাজনীতি আবর্তিত হয়ে আসছে। উত্থাপিত তথ্যগুলো সত্য হলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসার জন্য গোপনে জাতকুল সব খোয়াতে হয়েছে। ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির অবস্থাও যে ভালো, সে কথা বলা যাচ্ছে না। বরং উভয় দলের নানাজনের আচার-আচরণ দেখে আমাদের মনে এ ধারণাই বদ্ধমূল হতে বাধ্য যে, অধীনতামূলক গোপন মিত্রতার চোরাবালি আমাদের আজ সমূলে গ্রাস করতে উদ্যত। তাই আবদুল জলিলের বক্তব্যে জাতীয় পর্যায়ে বিপদের যে আভাস পাওয়া গেছে, বাস্তব পরিস্থিতি সম্ভবত তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। এমনকি জলিল সাহেবের বিবেক যে হঠাৎ মুখর হয়ে উঠল তাও কোনো গোপন সমঝোতার ফল কিনা-সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে সত্য যত কঠিনই হোক, বাঙালির গণঐক্য যে তার মোকাবিলায় সক্ষম-এমন একাধিক দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে। আমাদের ভরসা এখানেই।
No comments