উচ্চশিক্ষার সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে by শহিদুল ইসলাম
১২ জুলাই ২০০৭ সমকালের 'সম্পাদকীয় ও মন্তব্য' অংশে পরম শ্রদ্ধাভাজন আনিসুজ্জামানের 'উচ্চশিক্ষিতের চাহিদার চেয়ে উচ্চশিক্ষার চাহিদা বেশি' লেখাটি খুব মনোযোগের সঙ্গে কয়েকবার পড়লাম। লেখকের প্রত্যেকটি বক্তব্যের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করি। যেহেতু সংবাদপত্রের একটি কলামে স্থান সংকুলানের বড় অভাব, তাই কোনো লেখার বক্তব্যের সপক্ষে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায় না। তাই ভাবলাম, লেখকের লেখা থেকে কয়েকটি বক্তব্য বেছে নিয়ে কিছুটা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায় কি-না।
বেশ কিছু বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার স্কোপ ছিল। কিন্তু আমি তিনটি বক্তব্য নিয়ে সামান্য আলোচনা করব। সেগুলো হলো : এক. লেখক প্রথমেই এ সত্য উচ্চারণ করেছেন যে, আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার উত্তরাধিকার। সতি্য, এ সত্য অস্বীকার করা যায় না। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার আগে এ দেশে একটি প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা চলে আসছিল। টোল-চতুষ্পাঠী-মক্তব-মাদ্রাসার ধর্মভিত্তিক শিক্ষাই ছিল তখন শিক্ষার মূলধারা। এর বাইরে আর একটি লোকায়ত শিক্ষাধারাও প্রচলিত ছিল, তা হলো পাঠশালা। সেখানে মূলত বাংলা অক্ষরজ্ঞান দেওয়া হতো। লিখতে শেখানো হতো। সেই সঙ্গে প্রাথমিক পাটিগণিত, যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ। ধর্র্মীয় শিক্ষার মূলধারার বাইরে গিয়ে কলকাতার কিছু হিন্দু জমিদার ও অভিজাত শ্রেণী ১৮১৭ সালে 'হিন্দু কলেজ' নামে এশিয়া মহাদেশে পাশ্চাত্য ধারার উচ্চশিক্ষার প্রথম কেন্দ্র গড়ে তোলেন। নামে 'হিন্দু কলেজ' হলেও সেখানে কিন্তু হিন্দু ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হতো না। দেওয়া হতো আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান। তাই হিন্দু কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়ে এসে সেখানকার ছাত্ররা 'ইয়ং বেঙ্গল' নামে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জন্ম দেয়। ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা নানাভাবে হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে রক্ষণশীল হিন্দুদের 'চক্ষুশহৃল' হয়েছিলেন। ব্রজেন দাস ও বিনয় ঘোষের বইয়ে এর চমকপ্রদ সব উদাহরণ পাওয়া যায়।
যাক সে কথা। আনিসুজ্জামানের মতে_ ঔপনিবেশিক শিক্ষার মহৎ গুণ হলো 'সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে এর যোগ।' আর বড় দোষ হলো, 'জাতীয় ঐতিহে্যর সঙ্গে এর সংশ্রবহীনতা, আর এর মাধ্যম বিদেশি ভাষা।' আধুনিক শিক্ষার আগে এ দেশে যে ধর্মভিত্তিক সামন্তবাদী শিক্ষা প্রচলিত ছিল, তা থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক চালু আধুনিক বুজরাউায়া শিক্ষা যে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ব্রিটিশ অধিকার থেকে শুরু করে ১৮১৩ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষানীতি ছিল এ দেশে ধর্মভিত্তিক সামন্তবাদী শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখা। সে জন্যই ১৭৮১ সালে ওয়ারেন হেসি্টংস কলকাতায় মাদ্রাসা স্থাপন করেন সেখানকার কতিপয় মুসলমান জমিদার ও অভিজাতশ্রেণীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। মুসলমান জমিদারদের দাবিতে যখন মাদ্রাসা স্থাপন হলো, তখন কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দু অভিজাতশ্রেণীও হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার দাবি পেশ করলে ১৭৯১ সালে জোনাথন ডানকান কাশীতে সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন। এখানে আনিস ভাই সামান্য তথ্যের ভুল করেছেন। আমি এসব অতি পুরনো ইতিহাস ঘাঁটতে চাই না। লেখকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের কারণ সম্পর্কে কিছু লিখতে চাই। লেখক লিখেছেন, 'তবু এ কথা অনস্বীকার্য, এ বহুনিন্দিত ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা এমন সব মানুষ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল, নানা ক্ষেত্রে যাদের অবদানে এ দেশ সমৃদ্ধ হয়েছে। উপনিবেশ-উত্তরকালে তেমন মানুষ কমই তৈরি হয়েছেন।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস (১৯৮২) রচয়িতা আবদুর রহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের কথা লিখতে গিয়ে যে ১২ জন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষক ও গবেষকের নাম উল্লেখ করেছেন, তারা সবাই ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগের সৃষ্টি। দেশভাগের পর অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিদায়ের পর ওই মাপের কোনো পণ্ডিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে পারেনি। আনিসুজ্জামানও একই কথা বলেছেন। এর কারণ কি? এ প্রশ্নটি আমাকে দীর্ঘদিন ধরে নাড়া দেয়। উত্তর খোঁজারও সামান্য চেষ্ঠা করেছি। কিছু লেখালেখিও করেছি। আমার 'শিক্ষা ভাবনা' বইয়ের 'শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্ম : বিতর্ক ও সিদ্ধান্ত' প্রবন্দটি সবাইকে পড়ে দেখতে অনুরোধ করব। আমার মনে হয়েছে, ব্রিটিশ প্রবর্তিত ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাটি শেষদিন পর্যন্ত ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। কোনো ধর্মই শিক্ষাব্যবস্থাকে কলুষিত করতে পারেনি। ম্যাকলে ও উড সাহেব যখন তাদের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন তখন খ্রিস্টান পাদ্রি, হিন্দু পুরোহিত ও মুসলমান মাওলানা সাহেবরা শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মবিষয়ক পাঠদানের দাবি করেছিলেন। কিন্তু তারা কেউ তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি। আলেকজান্ডার ডাফের মতো জবরদস্ত পাদ্রির সুপারিশ অগ্রাহ্য করেছিলেন উড সাহেব। তারা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পক্ষেই তাদের নীতি নির্ধারণ করেছিলেন। ঔপনিবেশিক শাসনের একেবারে শেষ পবরাউ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে যখন সাজরাউন্ট কমিশন গঠিত হয়, তখনো তাদের ওপর ধর্মশিক্ষা অন্তর্ভক্তু করার চাপ ছিল। সাজরাউন্ট কমিশনও সে চাপের কাছে মাথানত করেনি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় ধর্মশিক্ষা যুক্ত করা হয়। আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার অন্তর্জলিযাত্রা শুরু হয়। তারপর শরিফ কমিশন, কাজী জাফর শিক্ষা প্রতিবেদন, মজিদ কমিশন, মফিজ উদ্দিন কমিশন, শামসুল হক কমিশন এবং শেষে মনিরুজ্জামান কমিশনের মাধ্যমে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাম্প্রদায়িকীকরণ সম্পন্ন হয়। শিক্ষা হয়ে ওঠে একটি প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাৎমুখী শিক্ষা। এ রকম শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বড়মাপের মানুষ বেরিয়ে আসতে পারে না। সে জন্য ১৯৪৭ সালের পর এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একজন সত্যেন বোস কিংবা একজন শহীদুল্লাহ সৃষ্টি করতে পারেনি। ত্রুটিটা মানুষের মেধায় বা মননে নয়, দোষটা কাঠামোগত_ শিক্ষা-দর্শনের। '৪৭-এর পর এ দেশের শিক্ষা ক্রমাগত পুনরায় ধর্মভিত্তিক সামন্তবাদী শিক্ষায় পরিণত হয়েছে। এ সত্যটা আনিসুজ্জামান ও আবদুর রহিমের লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। উচ্চশিক্ষার বাহন বিদেশি ভাষা নিয়ে আজ আর নতুন করে কিছু বলব না। দ্বিতীয়ত, আনিসুজ্জামান ম্যাকলের ফড়হিধিৎফ ভরষঃৎধঃরড়হ ঃযড়বৎু-র কথা বলেছেন। উপরের কিছু লোককে শিক্ষিত করলে তা চুইয়ে চুইয়ে সমাজের সর্বশ্রেণীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। সে তত্ত্ব যে মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কিছু কিছু জিনিস পিরামিডের চূড়ায় ছেড়ে দিলে তা চুইয়ে চুইয়ে নিচে নামতে থাকে। তার মধ্যে দুটি জিনিসের নাম মনে পড়ছে। একটা পানি আর দ্বিতীয়টি দুর্নীতি। পানি সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ না থাকলেও দুর্নীতি সম্পর্কে এতদিন মানুষের মধ্যে একটা সন্দেহের ভাব ছিল। তবে আজ সবাই বিশ্বাস করেন, পিরামিডের চূড়ায় যিনি বসে থাকেন তিনি যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন, তাহলে সমাজের কোনো স্থানই আর দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারে না। চুইয়ে চুইয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শিক্ষা সে জিনিস নয়। যারা শাসক ও শোষক, তারা চান না দেশের সব মানুষ শিক্ষিত হোক। লেখাপড়া শিখলে জ্ঞানচোখ উন্মোচিত হয়। শাসকের সব কেরামতি সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য হয়। তাই শাসকশ্রেণী শিক্ষার আলো ছড়ানোর নামে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে অশিক্ষা ও কুশিক্ষার অন্দকার ছড়ায়। প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি লেখকের পক্ষপাতিত্ব সঙ্ষ্ঠ। আমাদের সংবিধানেও সবাইকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তারপরও এ দেশের পঞ্চাশ ভাগের ওপর মানুষ নিরক্ষর। তাই এমন সিদ্ধানেস্ন আসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না যে, এ দেশে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের প্রধান শত্রু শাসকশ্রেণী। তারা নিজেদের নিয়ে আছেন। আনিসুজ্জামান ঠিকই বলেছেন, উচ্চশিক্ষা মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না। পৃথিবীর উন্নত দেশে খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্র্থী উচ্চশিক্ষার পীঠস্থানে যায়। এর কারণ আছে। উন্নত দেশে একটি শক্তিশালী বৃত্তিমূলক শিক্ষার ধারা আছে এবং অধিকাংশ উন্নত দেশে দাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও ফিদ্ধ। ১৮ বছর পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাই ১২ বছর শিক্ষা গ্রহণের পর অধিকাংশ শিক্ষার্থী চাকরি জীবনে ঢুকে পড়ে। উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। খুব মেধাবী ছাত্র, যারা গবেষণা ও শিক্ষকতা করতে চান, তারাই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাই লেখকের এ মতকে আমি জোরের সঙ্গে সমর্থন করি যে, এ দেশে ক্রমাল্প্বয়ে ১২ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা রাষ্ঠ্রকে গ্রহণ করতে হবে এবং বিজ্ঞান, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান শাখার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষার একটি শক্ত ধারা চালু করা দরকার। চারটি শাখার মান হতে হবে সমান। ১২ বছর সাধারণ শিক্ষার পর ১৮ বছরের একজন যুবক সুযোগ পেলে কর্মক্ষেত্রে ঠিকই জায়গা করে নিতে পারবে। রাষ্ঠ্রকে সে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
আনিসুজ্জামান সমকালীন একটি বিতর্কিত সিদ্ধানেস্নর ওপর তার মত ব্যক্ত করে লেখাটি শেষ করেছেন। তা হলো, 'একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যে আরেকটির অনুরূপ হতে হবে এমন ধারণা বা দাবি যুক্তিসম্মত নয়। বরং একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি নিজস্ব বৈশিষ্ঠ্য থাকে, সেখানে যদি জ্ঞানের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয়, তাহলে সব দিক দিয়ে তা সবার উপকারে আসে।' ওই একই দিনের সমকালের তৃতীয় পৃষ্ঠায় একটি খবর গুরুত্বের সঙ্গে ছাপানো হয়েছে। তা হলো, 'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিন্ন আইন : বেঁকে বসেছেন শিক্ষকরা।' শিক্ষকরা বলছেন, আমব্রেলা অ্যাক্ট ২০০৭-এর সাহায্যেয মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে সরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
আমব্রেলা অ্যাক্টের একটা ইতিহাস আছে। বিগত দুর্নীতিবাজ জামায়াত-বিএনপি সরকার বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ও আর্থিক সহায়তায় ২০ বছরের একটি 'কৌশলপত্র' তৈরি করেছিল। র্বতমান সরকার বিগত সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে চলেছে। শিক্ষার ইতিহাস নিয়ে যে সামান্য পড়াশোনা করেছি, তাতে এ রকম অদ্ভুত অ্যাক্টের কথা শুনিনি। ১৯৮২ সালে ইউনেস্কো ৩৭০ পৃষ্ঠার একটি বই ছেপেছিল। সেই বইয়ে ১৪০টি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, ডিগ্রি ও মান নিয়ে এক তুলনামূলক চার্ট তৈরি করেছিল। আফগানিস্তান থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ঠ্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, চীন কোনো দেশই বাদ যায়নি। যখনই প্রয়োজন হয় বইটির ওপর চোখ বুলাই। কোনো দেশের উচ্চশিক্ষা একটি কেন্দ্রীয় সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে এমন কোনো নজির পাইনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক হোক কিংবা প্রাইভেট, তাদের নিজস্ব আইনে চলে। সব কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়।
এখানে মঞ্জুরি কমিশনের কাজের পরিধি নির্দিষ্ঠ করে দেওয়া হয়েছে। একটি মঞ্জুরি কমিশন দেশের সব ক'টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করবে, এমন অদ্ভুত কথা কখনো শুনিনি। বিশ্ববিদ্যালয় হবে স্বায়ত্তশাসিত। শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র ভর্তি, সিলেবাস তৈরি, পরীক্ষা গ্রহণ, ফল প্রকাশের সব দায়িত্ব প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বিষয়। মঞ্জুরি কমিশন বা সরকার সেখানে নাক গলাতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, শিক্ষক। বাইরে থেকে কোনো আমলা কিংবা কোনো অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত শিল্পপতি গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় কনসেপ্ট নয়। আইয়ুব খানের শরিফ কমিশন রিপোর্ট বিশ্বব্যাংক আমব্রেলা অ্যাক্টের নামে দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিতে চলেছে। এটা একটা 'কালো আইন'_ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ মূল্যায়ন সঠিক।
যাক সে কথা। আনিসুজ্জামানের মতে_ ঔপনিবেশিক শিক্ষার মহৎ গুণ হলো 'সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে এর যোগ।' আর বড় দোষ হলো, 'জাতীয় ঐতিহে্যর সঙ্গে এর সংশ্রবহীনতা, আর এর মাধ্যম বিদেশি ভাষা।' আধুনিক শিক্ষার আগে এ দেশে যে ধর্মভিত্তিক সামন্তবাদী শিক্ষা প্রচলিত ছিল, তা থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক চালু আধুনিক বুজরাউায়া শিক্ষা যে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ব্রিটিশ অধিকার থেকে শুরু করে ১৮১৩ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষানীতি ছিল এ দেশে ধর্মভিত্তিক সামন্তবাদী শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখা। সে জন্যই ১৭৮১ সালে ওয়ারেন হেসি্টংস কলকাতায় মাদ্রাসা স্থাপন করেন সেখানকার কতিপয় মুসলমান জমিদার ও অভিজাতশ্রেণীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। মুসলমান জমিদারদের দাবিতে যখন মাদ্রাসা স্থাপন হলো, তখন কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দু অভিজাতশ্রেণীও হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার দাবি পেশ করলে ১৭৯১ সালে জোনাথন ডানকান কাশীতে সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন। এখানে আনিস ভাই সামান্য তথ্যের ভুল করেছেন। আমি এসব অতি পুরনো ইতিহাস ঘাঁটতে চাই না। লেখকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের কারণ সম্পর্কে কিছু লিখতে চাই। লেখক লিখেছেন, 'তবু এ কথা অনস্বীকার্য, এ বহুনিন্দিত ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা এমন সব মানুষ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল, নানা ক্ষেত্রে যাদের অবদানে এ দেশ সমৃদ্ধ হয়েছে। উপনিবেশ-উত্তরকালে তেমন মানুষ কমই তৈরি হয়েছেন।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস (১৯৮২) রচয়িতা আবদুর রহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের কথা লিখতে গিয়ে যে ১২ জন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষক ও গবেষকের নাম উল্লেখ করেছেন, তারা সবাই ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগের সৃষ্টি। দেশভাগের পর অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিদায়ের পর ওই মাপের কোনো পণ্ডিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে পারেনি। আনিসুজ্জামানও একই কথা বলেছেন। এর কারণ কি? এ প্রশ্নটি আমাকে দীর্ঘদিন ধরে নাড়া দেয়। উত্তর খোঁজারও সামান্য চেষ্ঠা করেছি। কিছু লেখালেখিও করেছি। আমার 'শিক্ষা ভাবনা' বইয়ের 'শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্ম : বিতর্ক ও সিদ্ধান্ত' প্রবন্দটি সবাইকে পড়ে দেখতে অনুরোধ করব। আমার মনে হয়েছে, ব্রিটিশ প্রবর্তিত ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাটি শেষদিন পর্যন্ত ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। কোনো ধর্মই শিক্ষাব্যবস্থাকে কলুষিত করতে পারেনি। ম্যাকলে ও উড সাহেব যখন তাদের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন তখন খ্রিস্টান পাদ্রি, হিন্দু পুরোহিত ও মুসলমান মাওলানা সাহেবরা শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মবিষয়ক পাঠদানের দাবি করেছিলেন। কিন্তু তারা কেউ তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি। আলেকজান্ডার ডাফের মতো জবরদস্ত পাদ্রির সুপারিশ অগ্রাহ্য করেছিলেন উড সাহেব। তারা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পক্ষেই তাদের নীতি নির্ধারণ করেছিলেন। ঔপনিবেশিক শাসনের একেবারে শেষ পবরাউ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে যখন সাজরাউন্ট কমিশন গঠিত হয়, তখনো তাদের ওপর ধর্মশিক্ষা অন্তর্ভক্তু করার চাপ ছিল। সাজরাউন্ট কমিশনও সে চাপের কাছে মাথানত করেনি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় ধর্মশিক্ষা যুক্ত করা হয়। আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার অন্তর্জলিযাত্রা শুরু হয়। তারপর শরিফ কমিশন, কাজী জাফর শিক্ষা প্রতিবেদন, মজিদ কমিশন, মফিজ উদ্দিন কমিশন, শামসুল হক কমিশন এবং শেষে মনিরুজ্জামান কমিশনের মাধ্যমে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাম্প্রদায়িকীকরণ সম্পন্ন হয়। শিক্ষা হয়ে ওঠে একটি প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাৎমুখী শিক্ষা। এ রকম শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বড়মাপের মানুষ বেরিয়ে আসতে পারে না। সে জন্য ১৯৪৭ সালের পর এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একজন সত্যেন বোস কিংবা একজন শহীদুল্লাহ সৃষ্টি করতে পারেনি। ত্রুটিটা মানুষের মেধায় বা মননে নয়, দোষটা কাঠামোগত_ শিক্ষা-দর্শনের। '৪৭-এর পর এ দেশের শিক্ষা ক্রমাগত পুনরায় ধর্মভিত্তিক সামন্তবাদী শিক্ষায় পরিণত হয়েছে। এ সত্যটা আনিসুজ্জামান ও আবদুর রহিমের লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। উচ্চশিক্ষার বাহন বিদেশি ভাষা নিয়ে আজ আর নতুন করে কিছু বলব না। দ্বিতীয়ত, আনিসুজ্জামান ম্যাকলের ফড়হিধিৎফ ভরষঃৎধঃরড়হ ঃযড়বৎু-র কথা বলেছেন। উপরের কিছু লোককে শিক্ষিত করলে তা চুইয়ে চুইয়ে সমাজের সর্বশ্রেণীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। সে তত্ত্ব যে মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কিছু কিছু জিনিস পিরামিডের চূড়ায় ছেড়ে দিলে তা চুইয়ে চুইয়ে নিচে নামতে থাকে। তার মধ্যে দুটি জিনিসের নাম মনে পড়ছে। একটা পানি আর দ্বিতীয়টি দুর্নীতি। পানি সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ না থাকলেও দুর্নীতি সম্পর্কে এতদিন মানুষের মধ্যে একটা সন্দেহের ভাব ছিল। তবে আজ সবাই বিশ্বাস করেন, পিরামিডের চূড়ায় যিনি বসে থাকেন তিনি যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন, তাহলে সমাজের কোনো স্থানই আর দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারে না। চুইয়ে চুইয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শিক্ষা সে জিনিস নয়। যারা শাসক ও শোষক, তারা চান না দেশের সব মানুষ শিক্ষিত হোক। লেখাপড়া শিখলে জ্ঞানচোখ উন্মোচিত হয়। শাসকের সব কেরামতি সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য হয়। তাই শাসকশ্রেণী শিক্ষার আলো ছড়ানোর নামে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে অশিক্ষা ও কুশিক্ষার অন্দকার ছড়ায়। প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি লেখকের পক্ষপাতিত্ব সঙ্ষ্ঠ। আমাদের সংবিধানেও সবাইকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তারপরও এ দেশের পঞ্চাশ ভাগের ওপর মানুষ নিরক্ষর। তাই এমন সিদ্ধানেস্ন আসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না যে, এ দেশে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের প্রধান শত্রু শাসকশ্রেণী। তারা নিজেদের নিয়ে আছেন। আনিসুজ্জামান ঠিকই বলেছেন, উচ্চশিক্ষা মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না। পৃথিবীর উন্নত দেশে খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্র্থী উচ্চশিক্ষার পীঠস্থানে যায়। এর কারণ আছে। উন্নত দেশে একটি শক্তিশালী বৃত্তিমূলক শিক্ষার ধারা আছে এবং অধিকাংশ উন্নত দেশে দাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও ফিদ্ধ। ১৮ বছর পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাই ১২ বছর শিক্ষা গ্রহণের পর অধিকাংশ শিক্ষার্থী চাকরি জীবনে ঢুকে পড়ে। উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। খুব মেধাবী ছাত্র, যারা গবেষণা ও শিক্ষকতা করতে চান, তারাই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাই লেখকের এ মতকে আমি জোরের সঙ্গে সমর্থন করি যে, এ দেশে ক্রমাল্প্বয়ে ১২ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা রাষ্ঠ্রকে গ্রহণ করতে হবে এবং বিজ্ঞান, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান শাখার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষার একটি শক্ত ধারা চালু করা দরকার। চারটি শাখার মান হতে হবে সমান। ১২ বছর সাধারণ শিক্ষার পর ১৮ বছরের একজন যুবক সুযোগ পেলে কর্মক্ষেত্রে ঠিকই জায়গা করে নিতে পারবে। রাষ্ঠ্রকে সে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
আনিসুজ্জামান সমকালীন একটি বিতর্কিত সিদ্ধানেস্নর ওপর তার মত ব্যক্ত করে লেখাটি শেষ করেছেন। তা হলো, 'একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যে আরেকটির অনুরূপ হতে হবে এমন ধারণা বা দাবি যুক্তিসম্মত নয়। বরং একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি নিজস্ব বৈশিষ্ঠ্য থাকে, সেখানে যদি জ্ঞানের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয়, তাহলে সব দিক দিয়ে তা সবার উপকারে আসে।' ওই একই দিনের সমকালের তৃতীয় পৃষ্ঠায় একটি খবর গুরুত্বের সঙ্গে ছাপানো হয়েছে। তা হলো, 'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিন্ন আইন : বেঁকে বসেছেন শিক্ষকরা।' শিক্ষকরা বলছেন, আমব্রেলা অ্যাক্ট ২০০৭-এর সাহায্যেয মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে সরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
আমব্রেলা অ্যাক্টের একটা ইতিহাস আছে। বিগত দুর্নীতিবাজ জামায়াত-বিএনপি সরকার বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ও আর্থিক সহায়তায় ২০ বছরের একটি 'কৌশলপত্র' তৈরি করেছিল। র্বতমান সরকার বিগত সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে চলেছে। শিক্ষার ইতিহাস নিয়ে যে সামান্য পড়াশোনা করেছি, তাতে এ রকম অদ্ভুত অ্যাক্টের কথা শুনিনি। ১৯৮২ সালে ইউনেস্কো ৩৭০ পৃষ্ঠার একটি বই ছেপেছিল। সেই বইয়ে ১৪০টি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, ডিগ্রি ও মান নিয়ে এক তুলনামূলক চার্ট তৈরি করেছিল। আফগানিস্তান থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ঠ্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, চীন কোনো দেশই বাদ যায়নি। যখনই প্রয়োজন হয় বইটির ওপর চোখ বুলাই। কোনো দেশের উচ্চশিক্ষা একটি কেন্দ্রীয় সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে এমন কোনো নজির পাইনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক হোক কিংবা প্রাইভেট, তাদের নিজস্ব আইনে চলে। সব কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়।
এখানে মঞ্জুরি কমিশনের কাজের পরিধি নির্দিষ্ঠ করে দেওয়া হয়েছে। একটি মঞ্জুরি কমিশন দেশের সব ক'টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করবে, এমন অদ্ভুত কথা কখনো শুনিনি। বিশ্ববিদ্যালয় হবে স্বায়ত্তশাসিত। শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র ভর্তি, সিলেবাস তৈরি, পরীক্ষা গ্রহণ, ফল প্রকাশের সব দায়িত্ব প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বিষয়। মঞ্জুরি কমিশন বা সরকার সেখানে নাক গলাতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, শিক্ষক। বাইরে থেকে কোনো আমলা কিংবা কোনো অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত শিল্পপতি গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় কনসেপ্ট নয়। আইয়ুব খানের শরিফ কমিশন রিপোর্ট বিশ্বব্যাংক আমব্রেলা অ্যাক্টের নামে দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিতে চলেছে। এটা একটা 'কালো আইন'_ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ মূল্যায়ন সঠিক।
No comments