পবিত্র পাহাড়ে রক্তরসে আতরের জন্মকথা by ফারুক ওয়াসিফ
কারো কিছু খোয়া গেলেই যেমন 'কেষ্ঠা ব্যাটাই চোর' তেমনি বোমা ফুটলেই 'মুসলমানরা সন্ত্রাসী', 'ইসলাম হত্যার ধর্ম' বলার চল দাঁড়িয়ে গেছে পাশ্চাত্যে। তার প্রতিধ্বনি যে বাংলাদেশেও ওঠে না তা নয়। মনের মর্মে যা-ই থাক, রয়ে-সয়ে আড়ভাষে্য যা বলা হয় তার মানে একটাই : ইসলামে কিছু একটা গ-গোল নিশ্চয়ই আছে। না হলে মুসলমান দেশগুলোতেই এত সমস্যা কেন? কেন তারা গরিব, কেন তারা অশিক্ষাপীড়িত, কেন তাদের দেশে যুদ্ধ চলে, কেন সেখানে গণতন্ত্র নাই, কেন তারা জঙ্গি?
যাদের সমাজ-ধর্ম-রাজনীতির জ্ঞানের বহর আঙুলে গুণে দুয়ে দুয়ে চার মেলানোতেই সমাপ্ত, তাদের কাছে 'সন্ত্রাসের' দুই আর 'দারিদ্রে্যর' দুয়ে মিলে যে চার হয় তা নির্ঘাত ইসলাম বৈ আর কি! পশ্চিমের আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফদ্ধান্স, জার্মানি ও ইতালির সরকার এবং পুবের ইসরায়েল, ভারত ও পাকিস্তানের সরকারি মহলেও এই তত্ত্ব বেশ উপাদেয়। বৈশি্বক গণমাধ্যমেও এ প্রচারকদের বেশ খাতির। আবার এ-ও সত্য যে, এই দেশগুলোর সরকারের অবস্থানের বিরোধিতাও সেসব দেশের অনেক নাগরিক ও সংগঠন করেন। বলতে বাধা নাই, ওইসব তত্ত্ব প্রচারকগণ 'চোখের আড়ে পাহাড় লুকানোয়' মজেছেন আর অন্যকেও সেই ভাবের রসে মজাতে চাইছেন। হালে এরাই হান্টিংটনের 'সভ্যতার সংঘর্ষ' তত্ত্বের খাতক ও সেবক বনেছেন।
তারা লুকাতে চাইছেন পরাশক্তি-জোটের দেশ-দখলের সন্ত্রাস। গৌণ করে দেখাতে চাইছেন অধিপতি গণমাধ্যমের সাম্প্রদায়িক প্রচার। সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হিসাবে চিহিক্রত মুসলমানরা যেসব দেশের বাসিন্দা সেসব দেশ হয় সাম্রাজ্যবাদী দখলদারিত্ব অথবা পরোক্ষ শাসন-শোষণের অধীন। ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান হলো এ রকম সরাসরি দখলাধীন দেশ। নিরন্তর ইসরায়েলি আগ্রাসন ও হুমকির মধ্যে বাস করা লেবাননও এ তালিকায় পড়ে। যে সশস্ত্র শক্তির দাপটে এসব দেশ পরাধীন তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যেহেতু ফুল ছুড়ে সফল হওয়ার নয় সেহেতু সশস্ত্র প্রতিরোধই তাদের সহায়। সেই প্রতিরোধের একটি অংশের প্রেরণা হলো ইসলাম। আর পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশগুলো দ্বিতীয় তরফের দেশ। এসব দেশে ইসলামী আন্দোলন সামাজিক পরিসর ছাড়িয়ে এখন রাজনীতি তথা রাষ্ঠ্রীয় পরিম-লেও সক্রিয়। তৃতীয় আরেক ধরনের দেশের উদাহরণ হলো তুরস্ক ও ইরান। এ দেশ দুটিতে ইসলামের নামে সংগঠিত দল সরকারি ক্ষমতায় এবং ধর্ম তাদের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুতরাং এটি বলা যায় যে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকা সব দেশে এক নয়।
আপাতত এর দুটি দিক নিয়ে আলোচনা করা যায়। একটি হচ্ছে, পরাধীন দেশে সশস্ত্র তাৎপরতা এবং অপরটি মুসলিমপ্রধান দেশে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার চাপ। নিজ সমাজ ও রাষ্ঠ্রকে বিদেশি দখলদারমুক্ত করার সংগ্রাম কিন্তু সর্বক্ষেত্রে জেহাদের নাম মাথায় নেয় নাই। হামাস ও হিজবুল্লাহ মূলত জাতীয়তাবাদী স্টে্নাগান নিয়েই দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালায়। কোরআনের দোহাই তাদের দিতে হয় নাই। ইরাকেও সুল্পিম্ন এবং শিয়াসহ অন্যান্য প্রতিরোধ গোষ্ঠীর নীতি ও আদর্শও এক নয়। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে মুক্তির সংগ্রাম প্রাথমিকভাবে ধর্মকে অবলম্বন করে থাকে। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের গোড়ার যুগের ওয়াহাবি প্রতিরোধ কিংবা আরো পরে বগ্ধিকমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'আনন্দমঠ' উপন্যাসজারিত সশস্ত্র আন্দোলনও ধর্মীয় আবেগ থেকে শক্তি ও সমর্থন নিয়েছিল। ক্ষেত্রবিশেষে তা মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িকতাও ছড়ায়। গোড়ার দিকের স্বদেশি গোষ্ঠীগুলো কেবল হিন্দু যুবক-যুবতীদেরই গ্রহণ করেছিল। ওয়াহাবিরাও অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়কে শত্রু গণ্য করেছিল। কিন্তু পরে আর তা থাকেনি। তাই স্বদেশি সশস্ত্র আন্দোলনের ইংরেজ হত্যার রাজনীতির জন্য হিন্দুধর্মকে যেমন হত্যার ধর্ম হিসাবে প্রচার করা যায় না, তেমনি আত্নঘাতী বোমারুদের জন্যই ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম বলা অর্বাচীনতার প্রমাণ। ফিলিস্তিনি বা ইরাকি আত্নঘাতী বোমারুরা তো এদিনের, শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহীরা ২০ বছর ধরে আত্নঘাতী হামলা চালিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে বিজয় অর্জনের চেষ্ঠা করছে। সেজন্য কি গোটা তামিল জাতিকে সন্ত্রাসী বলা যায়? তাদের কাছে যেমন তেমন মুসলিম জঙ্গিদের কাছেও সন্ত্রাসবাদ কেবল একটা যুদ্ধকৌশল মাত্র_ আদর্শ নয়। আধিপত্য ও প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রকৃতির কারণেই একেক দেশে তা একেক পথ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের কামিকাজি বোমারুরা আত্নঘাতের মাধ্যমে শত্রুর ধ্বংসসাধন করত। তাহলে কি জাপানি জাতি বা বৌদ্ধ ধর্মকে সন্ত্রাসবাদের সমর্থক বলা হবে? নাকি কেউ তা বলেছে? মুসলিম জঙ্গিবাদীরা যতটা না তাদের ধর্মের সৃষ্টি তার থেকে বেশি সৃষ্টি সাম্রাজ্যবাদী দখলদারিত্বের। আমেরিকা-ব্রিটেনের পররাষ্ঠ্রগ্রাসী নীতি ও পরধর্মবিবেষ থেকেই তাদের জন্ম। শুধু ইরাক-আফগানিস্তানেই নয়, নিজ নিজ দেশে অভিবাসী নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের নামে মুসলমান নাগরিকদের মনে তীব্র অপমান এবং বঞ্চনার বোধ সৃষ্টি করেছে, যে ঘা তাদের দিয়েছে তার দাগ শীঘ্রই শুকাবার নয়।
ইসলামকে অবলম্বন করে আত্নপরিচয় গঠন এবং প্রতিরোধ সংগ্রাম আগে থাকলেও মূলত তা ৯/১১ পরের পৃথিবীতেই জোরদার হয়। এ ঘটনার পরেই যেভাবে এই দুনিয়ার শাহানশাহ জর্জ বুশ জুনিয়র ত্রুক্রসেডের ডাক দিয়ে আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলা করেন, তার প্রতিক্রিয়ায় দেশ দুটির প্রতিরোধ সংগ্রাম জেহাদের নামে সংগঠিত হয়। এখন যদিও জোরালোভাবে অভিযোগ উঠছে, টুইন টাওয়ার ধ্বংস খোদ পেন্টাগনেরই কাজ। জর্জ বুশ যে এ ঘটনাকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করেছেন এ-ও আজ স্বীকৃত সত্য।
এসব সমাজের দখলদারি কিংবা বিশ্বায়নবিরোধী তাৎপরতা শুধু শারীরিকভাবেই আত্নঘাতী পথ নেয় না, ক্ষেত্রবিশেষে তা নিজ সমাজের জন্যও আত্নঘাতের জন্ম দেয়। পাকিস্তানের লাল মসজিদের ইমাম আবদুর রশিদ গাজীর মার্কিন বিরোধিতা ও পারভেজ মোশাররফের পতন কামনার মধ্যে অগণতান্ত্রিক কিছু নাই। কিন্তু তিনিই যখন আবার শরিয়া প্রতিষ্ঠার নামে নিজ ধর্মের নারী-পুরুষকে ফুটন্ত উনুন থেকে জ্বলন্ত কড়াইয়ে ফেলতে চান, তখন এ আত্নঘাতের চেহারাটি ধরা পড়ে। আবদুর রশিদ গাজীর মৃত্যু যদি বাইরের আক্রমণে জিহাদি রক্তক্ষরণ হয় তবে তার শরিয়ার সংগ্রাম তার নিজ ধর্মের মানুষদেরই রক্তাক্ত করে_ অনেকটা আতর তৈরির প্রক্রিয়ার মতো। এ মিলটা প্রতীকী কিন্তু তাৎপর্যহীন নয়।
সিলেটের পাহাড়ে এখনো আতরের চাষ হয়। স্থানীয়রা ওইসব পাহাড়কে আতর পাহাড় বলে ডাকেন। আতর পাহাড়ে সারি সারি আতর গাছ। বয়স্ক গাছে দা দিয়ে কুপিয়ে রেখে দিলে সেখান থেকে রক্তের মতো ঘনরস পড়ে। গাছের সেই রক্ত বা রস থেকেই পরে তৈরি হয় সুবাসিত আতর_ পবিত্র ও সুন্দর। আবদুর রশিদ গাজীর ইসলাম যেন এ রকমই কোনো এক আতর পাহাড়ের আতর গাছ। সাম্রাজ্যের আঘাতে তার শরীরের রক্তক্ষরণ থেকে জন্ম নেয় প্রতিরোধ। আবার ধর্মের নামে তারা নিজ সমাজের মজলুমেরও রক্তক্ষরণ ঘটায়। তা থেকে জন্ম নেওয়া আতঙ্ক মৃত্যুর আতগ্ধেকর মতো। মৃতের একমাত্র প্রসাধনও কিন্তু সেই বেহেশতি আতর।
ইসলামপন্থার লড়াই যেদিন ওই আতর পাহাড় থেকে নেমে আসবে, নিজ সমাজদেহকে পীড়ন করার 'আতর চাষ' বন্দ করবে, সেদিনই তা পথ খুঁজে পাবে মুক্তির_ নিজের ও বিশেষ খবর। অপরকে মুক্তির প্রথম শর্তই হলো নিজেকে মুক্ত করা।
তারা লুকাতে চাইছেন পরাশক্তি-জোটের দেশ-দখলের সন্ত্রাস। গৌণ করে দেখাতে চাইছেন অধিপতি গণমাধ্যমের সাম্প্রদায়িক প্রচার। সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হিসাবে চিহিক্রত মুসলমানরা যেসব দেশের বাসিন্দা সেসব দেশ হয় সাম্রাজ্যবাদী দখলদারিত্ব অথবা পরোক্ষ শাসন-শোষণের অধীন। ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান হলো এ রকম সরাসরি দখলাধীন দেশ। নিরন্তর ইসরায়েলি আগ্রাসন ও হুমকির মধ্যে বাস করা লেবাননও এ তালিকায় পড়ে। যে সশস্ত্র শক্তির দাপটে এসব দেশ পরাধীন তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যেহেতু ফুল ছুড়ে সফল হওয়ার নয় সেহেতু সশস্ত্র প্রতিরোধই তাদের সহায়। সেই প্রতিরোধের একটি অংশের প্রেরণা হলো ইসলাম। আর পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশগুলো দ্বিতীয় তরফের দেশ। এসব দেশে ইসলামী আন্দোলন সামাজিক পরিসর ছাড়িয়ে এখন রাজনীতি তথা রাষ্ঠ্রীয় পরিম-লেও সক্রিয়। তৃতীয় আরেক ধরনের দেশের উদাহরণ হলো তুরস্ক ও ইরান। এ দেশ দুটিতে ইসলামের নামে সংগঠিত দল সরকারি ক্ষমতায় এবং ধর্ম তাদের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুতরাং এটি বলা যায় যে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকা সব দেশে এক নয়।
আপাতত এর দুটি দিক নিয়ে আলোচনা করা যায়। একটি হচ্ছে, পরাধীন দেশে সশস্ত্র তাৎপরতা এবং অপরটি মুসলিমপ্রধান দেশে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার চাপ। নিজ সমাজ ও রাষ্ঠ্রকে বিদেশি দখলদারমুক্ত করার সংগ্রাম কিন্তু সর্বক্ষেত্রে জেহাদের নাম মাথায় নেয় নাই। হামাস ও হিজবুল্লাহ মূলত জাতীয়তাবাদী স্টে্নাগান নিয়েই দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালায়। কোরআনের দোহাই তাদের দিতে হয় নাই। ইরাকেও সুল্পিম্ন এবং শিয়াসহ অন্যান্য প্রতিরোধ গোষ্ঠীর নীতি ও আদর্শও এক নয়। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে মুক্তির সংগ্রাম প্রাথমিকভাবে ধর্মকে অবলম্বন করে থাকে। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের গোড়ার যুগের ওয়াহাবি প্রতিরোধ কিংবা আরো পরে বগ্ধিকমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'আনন্দমঠ' উপন্যাসজারিত সশস্ত্র আন্দোলনও ধর্মীয় আবেগ থেকে শক্তি ও সমর্থন নিয়েছিল। ক্ষেত্রবিশেষে তা মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িকতাও ছড়ায়। গোড়ার দিকের স্বদেশি গোষ্ঠীগুলো কেবল হিন্দু যুবক-যুবতীদেরই গ্রহণ করেছিল। ওয়াহাবিরাও অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়কে শত্রু গণ্য করেছিল। কিন্তু পরে আর তা থাকেনি। তাই স্বদেশি সশস্ত্র আন্দোলনের ইংরেজ হত্যার রাজনীতির জন্য হিন্দুধর্মকে যেমন হত্যার ধর্ম হিসাবে প্রচার করা যায় না, তেমনি আত্নঘাতী বোমারুদের জন্যই ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম বলা অর্বাচীনতার প্রমাণ। ফিলিস্তিনি বা ইরাকি আত্নঘাতী বোমারুরা তো এদিনের, শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহীরা ২০ বছর ধরে আত্নঘাতী হামলা চালিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে বিজয় অর্জনের চেষ্ঠা করছে। সেজন্য কি গোটা তামিল জাতিকে সন্ত্রাসী বলা যায়? তাদের কাছে যেমন তেমন মুসলিম জঙ্গিদের কাছেও সন্ত্রাসবাদ কেবল একটা যুদ্ধকৌশল মাত্র_ আদর্শ নয়। আধিপত্য ও প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রকৃতির কারণেই একেক দেশে তা একেক পথ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের কামিকাজি বোমারুরা আত্নঘাতের মাধ্যমে শত্রুর ধ্বংসসাধন করত। তাহলে কি জাপানি জাতি বা বৌদ্ধ ধর্মকে সন্ত্রাসবাদের সমর্থক বলা হবে? নাকি কেউ তা বলেছে? মুসলিম জঙ্গিবাদীরা যতটা না তাদের ধর্মের সৃষ্টি তার থেকে বেশি সৃষ্টি সাম্রাজ্যবাদী দখলদারিত্বের। আমেরিকা-ব্রিটেনের পররাষ্ঠ্রগ্রাসী নীতি ও পরধর্মবিবেষ থেকেই তাদের জন্ম। শুধু ইরাক-আফগানিস্তানেই নয়, নিজ নিজ দেশে অভিবাসী নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের নামে মুসলমান নাগরিকদের মনে তীব্র অপমান এবং বঞ্চনার বোধ সৃষ্টি করেছে, যে ঘা তাদের দিয়েছে তার দাগ শীঘ্রই শুকাবার নয়।
ইসলামকে অবলম্বন করে আত্নপরিচয় গঠন এবং প্রতিরোধ সংগ্রাম আগে থাকলেও মূলত তা ৯/১১ পরের পৃথিবীতেই জোরদার হয়। এ ঘটনার পরেই যেভাবে এই দুনিয়ার শাহানশাহ জর্জ বুশ জুনিয়র ত্রুক্রসেডের ডাক দিয়ে আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলা করেন, তার প্রতিক্রিয়ায় দেশ দুটির প্রতিরোধ সংগ্রাম জেহাদের নামে সংগঠিত হয়। এখন যদিও জোরালোভাবে অভিযোগ উঠছে, টুইন টাওয়ার ধ্বংস খোদ পেন্টাগনেরই কাজ। জর্জ বুশ যে এ ঘটনাকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করেছেন এ-ও আজ স্বীকৃত সত্য।
এসব সমাজের দখলদারি কিংবা বিশ্বায়নবিরোধী তাৎপরতা শুধু শারীরিকভাবেই আত্নঘাতী পথ নেয় না, ক্ষেত্রবিশেষে তা নিজ সমাজের জন্যও আত্নঘাতের জন্ম দেয়। পাকিস্তানের লাল মসজিদের ইমাম আবদুর রশিদ গাজীর মার্কিন বিরোধিতা ও পারভেজ মোশাররফের পতন কামনার মধ্যে অগণতান্ত্রিক কিছু নাই। কিন্তু তিনিই যখন আবার শরিয়া প্রতিষ্ঠার নামে নিজ ধর্মের নারী-পুরুষকে ফুটন্ত উনুন থেকে জ্বলন্ত কড়াইয়ে ফেলতে চান, তখন এ আত্নঘাতের চেহারাটি ধরা পড়ে। আবদুর রশিদ গাজীর মৃত্যু যদি বাইরের আক্রমণে জিহাদি রক্তক্ষরণ হয় তবে তার শরিয়ার সংগ্রাম তার নিজ ধর্মের মানুষদেরই রক্তাক্ত করে_ অনেকটা আতর তৈরির প্রক্রিয়ার মতো। এ মিলটা প্রতীকী কিন্তু তাৎপর্যহীন নয়।
সিলেটের পাহাড়ে এখনো আতরের চাষ হয়। স্থানীয়রা ওইসব পাহাড়কে আতর পাহাড় বলে ডাকেন। আতর পাহাড়ে সারি সারি আতর গাছ। বয়স্ক গাছে দা দিয়ে কুপিয়ে রেখে দিলে সেখান থেকে রক্তের মতো ঘনরস পড়ে। গাছের সেই রক্ত বা রস থেকেই পরে তৈরি হয় সুবাসিত আতর_ পবিত্র ও সুন্দর। আবদুর রশিদ গাজীর ইসলাম যেন এ রকমই কোনো এক আতর পাহাড়ের আতর গাছ। সাম্রাজ্যের আঘাতে তার শরীরের রক্তক্ষরণ থেকে জন্ম নেয় প্রতিরোধ। আবার ধর্মের নামে তারা নিজ সমাজের মজলুমেরও রক্তক্ষরণ ঘটায়। তা থেকে জন্ম নেওয়া আতঙ্ক মৃত্যুর আতগ্ধেকর মতো। মৃতের একমাত্র প্রসাধনও কিন্তু সেই বেহেশতি আতর।
ইসলামপন্থার লড়াই যেদিন ওই আতর পাহাড় থেকে নেমে আসবে, নিজ সমাজদেহকে পীড়ন করার 'আতর চাষ' বন্দ করবে, সেদিনই তা পথ খুঁজে পাবে মুক্তির_ নিজের ও বিশেষ খবর। অপরকে মুক্তির প্রথম শর্তই হলো নিজেকে মুক্ত করা।
No comments