নিজেরা কষ্ঠ করি কিন্তু সন্তানরাও করুক তা চাই না by প্রিসিলা রাজ
পশুর নদীর ঠিক ধার ঘেঁষে কেয়াবুনিয়া গ্রাম। একশো পঁয়ত্রিশ ঘর মানুষের বাস জোয়ারসিক্ত হতশ্রী কেয়াবুনিয়ায়। নদী ভাঙতে ভাঙতে ক্রমেই গ্রামের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার আরো অনেক চিংড়িজীবী পরিবারের মতো এ গ্রামের মানুষও একদা কৃষিকাজ করেই জীবন নির্বাহ করত। বাগদা চিংড়ি চাষ শুরু হওয়ার পর এখন সবাই চিংড়ির ওপর নির্ভরশীল। এলাকার যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই কেবল চিংড়ি ঘের।
গত ২৫ বছরে মংলা ও এর আশপাশ এলাকার পুরো নিসর্গটাই পাল্কেল্ট গেছে। আর সেই সঙ্গে পাল্কেল্ট গেছে জীবনের চালচিত্র। কেয়াবুনিয়া গ্রামের এক সময়ের কৃষক পরিবারের মেয়ে-বৌরা আজ নদীতে বাগদা চিংড়ির পোনা ধরেন। এ গ্রামের চপলা ম-লের সঙ্গে দেখা হয় সিঅ্যান্ডবি রোডের ওপর। খোয়া বিছানো সরকারি রাস্তা চলে গেছে চিলা থেকে জয়মুনি পর্যন্ত। চপলা ম-ল রাস্তার ধারে লাগানো গাছ দেখাশোনার কাজ করছেন আজ তিন বছর থেকে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ডিউটি। বেতন মাসে ১৫শ' টাকা। স্বামী তার ভারতে গিয়ে আর ফেরেননি কয়েক বছর হলো। চপলা বাবার বাড়িতে থাকেন বুড়ো মা, ভাই-বৌ অর্চনা আর দুই ভাতিজিকে নিয়ে। ভাইও অসুখে মারা গেছেন বছরদু'য়েক হলো। পাঁচজনের সংসারের ভার তাই চপলা আর অর্চনার ওপর। অর্চনা নদীতে পোনা ধরেন। রাতের বেলা চপলাও পোনা ধরায় শামিল হন।
ফাল্কগ্দুন থেকে জৈ্যষ্ঠ মাস নদীতে বাগদা চিংড়ির পোনা ধরার ভর মৌসুম। পূণর্িমা ও অমাবস্যার তিনদিন আগে থেকে শুরু করে তিনদিন পর পর্যন্ত সময়কে স্থানীয় ভাষায় 'গোন' বলা হয় যখন জোয়ারের সময় বেশি পরিমাণে বাগদার পোনা পাওয়া যায়। এই চার মাসের গোনগুলোতে বহু মানুষ পোনা শিকারে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এ সময় তাদের ভালোই উপার্জন হয়। আষাঢ় মাসের শেষদিকে আমার সঙ্গে যখন কথা হয় তখন পোনা ধরার মূল মৌসুম প্রায় পার হয়ে গেছে। তারপরও গত গোনে অর্চনা সাতদিনে প্রায় ৭শ' টাকা আয় করেছেন বলে জানান। মাসের বাকি সময়টা পরের বাড়িতে কাজ করেন। তবে পোনা ধরার আয় আর মানুষের বাড়িতে কাজ করে আয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফৎ। পোনা মৌসুমের বাইরে আট মাস চলে অতিকষে্ট পোনার আয়ের সঞ্চিত টাকা দিয়ে আর পরের বাড়িতে কাজ করে।
নদীতে জোয়ার এলে এসব গ্রামের মেয়েরা তিন কোনা টানা জাল নিয়ে নেমে পড়ে নদীতে। ছেলেরা সাধারণত নৌকা নিয়ে মাঝনদীতে গিয়ে পোনা ধরে। মেয়েরা টানা জাল দিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে পোনা সংগ্রহ করে। পোনা সংগ্রাহকরা বাড়ি বাড়ি এসে সেই পোনা কিনে নেয়। আরো দু'এক ধাপ পেরিয়ে তা চলে যায় বাগেরহাটসহ অন্যান্য জেলার বাগদা চাষীদের কাছে।
চপলাদের সংসারে পাঁচজনের খাওয়া-পরা, অসুখ-বিসুখ বাদে আছে দুটি বাচ্চার পড়াশোনার খরচ। গ্রাম থেকে প্রায় এক কিলোমিটারের মধ্যেই বেসরকারি সংস্থা কারিতাসের স্কুলে পড়ে তারা। স্বর্ণালি ম-ল ক্লাস টু আর মিতালী ম-ল বেবি ক্লাসে। গ্রামটির সব পরিবার থেকেই ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক ছেলেমেয়ে পোনাও ধরে। ক্লাস ফোরের ছাত্রী ডালিম ম-লও পোনা ধরে। গ্রামবাসী জানান, এ পোনা ধরেই ডালিমের বাবা-মা অল্প কিছু জমিজমাও কিনেছেন। প্রৌঢ়া লক্ষ্মী ম-ল ভাশুরের জড়বদুিব্দ ছেলে নিয়ে থাকেন। নদীতে তারও সব জমিজমা গেছে। একমাত্র মেয়েকে এ গ্রামেই বিয়ে দিয়েছেন। বিপদ-আপদ হলে মেয়ে-জামাই ভরসা। বাঁচার তাগিদে লক্ষ্মীকেও নদীতে পোনা ধরতে যেতে হয়। মৎস্য সল্ফঙ্দের নিদারুণ ক্ষতি হচ্ছে বলে বছরপাঁচেক হলো নদীতে পোনা ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। কিন্তু তারপরও উপকূলের দরিদ্র মানুষ এ কাজ করে চলেছেন। তাদের প্রশ্ন, এ না হলে তারা কী করে বাঁচবেন?
এখানে পোনা ধরার বাইরে দরিদ্র মেয়েরা মূলত মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। কেউ দিন চুক্তিতে, আবার কেউ মাস চুক্তিতে। অর্চনা দিন চুক্তিতে করেন। কারণ বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে হয়। পোনা ধরার কাজের আরেকটি সুবিধা বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য, সংসারের কাজের জন্য সময় পাওয়া যায়। খুলনা শিল্পাঞ্চল বলে পরিচিত হলেও মেয়েদের কর্মসংস্থানের খুব একটা সুবিধা এখানে এখনো তেমন নেই। আবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বলে এ এলাকার অনেক মানুষ মেয়েদের এলাকার বাইরে পাঠাতে ভয় পান। কেয়াবুনিয়া গ্রামের প্রায় অধরাউক হিন্দু ও অধরাউক মুসলমান। খ্রিস্টান পরিবার আছে পাঁচ ঘর_ বললেন হীরা বাছাড়, এ গ্রামের একমাত্র মহিলা চিংড়ি পোনা ব্যবসায়ী।
এলাকা থেকে পোনা কিনে নিয়ে তিনি বাগেরহাট, খুলনা ও যশোরের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করেন। পারিবারিক শোকে স্বামী বিবাগী হয়ে গেলে সংসার বাঁচাতেই হীরাকে এ পেশায় আসতে হয়েছিল। সম্প্রতি গ্রামের কয়েকজন মুসলমান মেয়ে ঢাকায় গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে গেছে বলে জানায় গ্রামের মেয়েরা। চিংড়ি চাষ শুরু হওয়ার আগে এ এলাকার পলিসিক্ত জমিতে প্রচুর ফসল ফলত। অনেক গাছপালা ছিল। নদীতে ছিল প্রচুর মাছ। ফলে নগদ আয় কম হলেও দরিদ্র মানুষ পুষ্টির অভাব পূরণ করতে পারত। আর এখন সবকিছুই কিনে খেতে হয়।
তাই জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। অন্যদিকে জীবনযাত্রা উন্নত করার আগ্রহও বেড়েছে। সব মিলিয়ে কাছাকাছি আয়ের বিকল্প পেশা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত উপকূলীয় এসব পরিবার পোনা ধরা থেকে বিরত হবে না বলেই মনে হয়। 'বিকল্প পেশার কথা বলেও কয়েকটি বি&চ্ছিম্ন প্রচেষ্ঠা ছাড়া এ ব্যাপারে তেমন কোনো সমনি্বত প্রচেষ্ঠা এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি'_ বলে জানান মোঃ আবু নাসির, বেসরকারি সংস্থা ডিনেটে কর্মরত মৎস্য বিশেষজ্ঞ।
সফল হবে না-কি মা-পিসির মতো একই চত্রেক্র আবর্তিত হবে তারও জীবন।
ফাল্কগ্দুন থেকে জৈ্যষ্ঠ মাস নদীতে বাগদা চিংড়ির পোনা ধরার ভর মৌসুম। পূণর্িমা ও অমাবস্যার তিনদিন আগে থেকে শুরু করে তিনদিন পর পর্যন্ত সময়কে স্থানীয় ভাষায় 'গোন' বলা হয় যখন জোয়ারের সময় বেশি পরিমাণে বাগদার পোনা পাওয়া যায়। এই চার মাসের গোনগুলোতে বহু মানুষ পোনা শিকারে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এ সময় তাদের ভালোই উপার্জন হয়। আষাঢ় মাসের শেষদিকে আমার সঙ্গে যখন কথা হয় তখন পোনা ধরার মূল মৌসুম প্রায় পার হয়ে গেছে। তারপরও গত গোনে অর্চনা সাতদিনে প্রায় ৭শ' টাকা আয় করেছেন বলে জানান। মাসের বাকি সময়টা পরের বাড়িতে কাজ করেন। তবে পোনা ধরার আয় আর মানুষের বাড়িতে কাজ করে আয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফৎ। পোনা মৌসুমের বাইরে আট মাস চলে অতিকষে্ট পোনার আয়ের সঞ্চিত টাকা দিয়ে আর পরের বাড়িতে কাজ করে।
নদীতে জোয়ার এলে এসব গ্রামের মেয়েরা তিন কোনা টানা জাল নিয়ে নেমে পড়ে নদীতে। ছেলেরা সাধারণত নৌকা নিয়ে মাঝনদীতে গিয়ে পোনা ধরে। মেয়েরা টানা জাল দিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে পোনা সংগ্রহ করে। পোনা সংগ্রাহকরা বাড়ি বাড়ি এসে সেই পোনা কিনে নেয়। আরো দু'এক ধাপ পেরিয়ে তা চলে যায় বাগেরহাটসহ অন্যান্য জেলার বাগদা চাষীদের কাছে।
চপলাদের সংসারে পাঁচজনের খাওয়া-পরা, অসুখ-বিসুখ বাদে আছে দুটি বাচ্চার পড়াশোনার খরচ। গ্রাম থেকে প্রায় এক কিলোমিটারের মধ্যেই বেসরকারি সংস্থা কারিতাসের স্কুলে পড়ে তারা। স্বর্ণালি ম-ল ক্লাস টু আর মিতালী ম-ল বেবি ক্লাসে। গ্রামটির সব পরিবার থেকেই ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক ছেলেমেয়ে পোনাও ধরে। ক্লাস ফোরের ছাত্রী ডালিম ম-লও পোনা ধরে। গ্রামবাসী জানান, এ পোনা ধরেই ডালিমের বাবা-মা অল্প কিছু জমিজমাও কিনেছেন। প্রৌঢ়া লক্ষ্মী ম-ল ভাশুরের জড়বদুিব্দ ছেলে নিয়ে থাকেন। নদীতে তারও সব জমিজমা গেছে। একমাত্র মেয়েকে এ গ্রামেই বিয়ে দিয়েছেন। বিপদ-আপদ হলে মেয়ে-জামাই ভরসা। বাঁচার তাগিদে লক্ষ্মীকেও নদীতে পোনা ধরতে যেতে হয়। মৎস্য সল্ফঙ্দের নিদারুণ ক্ষতি হচ্ছে বলে বছরপাঁচেক হলো নদীতে পোনা ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। কিন্তু তারপরও উপকূলের দরিদ্র মানুষ এ কাজ করে চলেছেন। তাদের প্রশ্ন, এ না হলে তারা কী করে বাঁচবেন?
এখানে পোনা ধরার বাইরে দরিদ্র মেয়েরা মূলত মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। কেউ দিন চুক্তিতে, আবার কেউ মাস চুক্তিতে। অর্চনা দিন চুক্তিতে করেন। কারণ বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে হয়। পোনা ধরার কাজের আরেকটি সুবিধা বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য, সংসারের কাজের জন্য সময় পাওয়া যায়। খুলনা শিল্পাঞ্চল বলে পরিচিত হলেও মেয়েদের কর্মসংস্থানের খুব একটা সুবিধা এখানে এখনো তেমন নেই। আবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বলে এ এলাকার অনেক মানুষ মেয়েদের এলাকার বাইরে পাঠাতে ভয় পান। কেয়াবুনিয়া গ্রামের প্রায় অধরাউক হিন্দু ও অধরাউক মুসলমান। খ্রিস্টান পরিবার আছে পাঁচ ঘর_ বললেন হীরা বাছাড়, এ গ্রামের একমাত্র মহিলা চিংড়ি পোনা ব্যবসায়ী।
এলাকা থেকে পোনা কিনে নিয়ে তিনি বাগেরহাট, খুলনা ও যশোরের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করেন। পারিবারিক শোকে স্বামী বিবাগী হয়ে গেলে সংসার বাঁচাতেই হীরাকে এ পেশায় আসতে হয়েছিল। সম্প্রতি গ্রামের কয়েকজন মুসলমান মেয়ে ঢাকায় গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে গেছে বলে জানায় গ্রামের মেয়েরা। চিংড়ি চাষ শুরু হওয়ার আগে এ এলাকার পলিসিক্ত জমিতে প্রচুর ফসল ফলত। অনেক গাছপালা ছিল। নদীতে ছিল প্রচুর মাছ। ফলে নগদ আয় কম হলেও দরিদ্র মানুষ পুষ্টির অভাব পূরণ করতে পারত। আর এখন সবকিছুই কিনে খেতে হয়।
তাই জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। অন্যদিকে জীবনযাত্রা উন্নত করার আগ্রহও বেড়েছে। সব মিলিয়ে কাছাকাছি আয়ের বিকল্প পেশা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত উপকূলীয় এসব পরিবার পোনা ধরা থেকে বিরত হবে না বলেই মনে হয়। 'বিকল্প পেশার কথা বলেও কয়েকটি বি&চ্ছিম্ন প্রচেষ্ঠা ছাড়া এ ব্যাপারে তেমন কোনো সমনি্বত প্রচেষ্ঠা এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি'_ বলে জানান মোঃ আবু নাসির, বেসরকারি সংস্থা ডিনেটে কর্মরত মৎস্য বিশেষজ্ঞ।
সফল হবে না-কি মা-পিসির মতো একই চত্রেক্র আবর্তিত হবে তারও জীবন।
No comments