এ কী বর্বরতা!
শিরশ্ছেদের মাধ্যমে আট বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সৌদি সরকার। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর প্রকাশ্যে ওই শিরশ্ছেদকরণের নির্মম আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এই বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে সৌদি আরবে কর্মরত এক মিসরীয়কে হত্যার অভিযোগ ছিল। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই শিরশ্ছেদের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এটা একটি বীভৎস ঘটনা। সৌদি আরবের বিচারব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের নয়। অভিযুক্ত অভিবাসীরা আরবি ভাষায় আদালতের যুক্তিতর্ক বুঝতে পারেন না। প্রায়ই তাঁরা তাঁদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগেরও সুযোগ পান না।
ঢাকায় প্রবাসী কল্যাণসচিব ড. জাফর আহমেদ খান বলেছেন, 'বাংলাদেশ সরকার এই বাংলাদেশি কর্মীদের রক্ষায় সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এমনকি রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে তাদের ক্ষমা করার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের রক্ষা করা যায়নি।' সৌদি আরবে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে বর্বর কায়দায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা রীতি হলেও একই দিনে আটজন বিদেশির শিরশ্ছেদ করার ঘটনা নজিরবিহীন বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে সৌদি আরবে কর্মরত এক মিসরীয় নিরাপত্তাকর্মীকে হত্যার অভিযোগে আট বাংলাদেশিকে সৌদি আদালত মৃত্যুদণ্ড দেন। অভিযোগ রয়েছে, ওই বাংলাদেশিরা কাজ করতেন এমন এক স্থানে একটি চক্র বৈদ্যুতিক তার চুরির চেষ্টার সময় বাংলাদেশি কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এতে সেখানে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কর্মরত মিসরীয় নাগরিকটি নিহত হন।
অ্যামনেস্টি বলেছে, বিদেশি ও সৌদি নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা শিরশ্ছেদের শিকার হয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই সরকারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বা গোত্রপ্রধানদের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তাই তাঁদের মাধ্যমে শাস্তি কমানো বা খুনের ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের জরিমানা দিয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তির সুযোগ অভিযুক্তরা পাননি। আটক অবস্থায় জোর করে অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়ের মাধ্যমেও দেশটিতে অনেককে দোষী সাব্যস্ত করা যায়।
সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রয়টার্স ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম গত শুক্রবার শিরশ্ছেদ হওয়া আট বাংলাদেশির নাম প্রকাশ করেছে। রিয়াদে বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমের কাছে শিরশ্ছেদ হওয়া বাংলাদেশিদের বিস্তারিত পরিচয় জানাতে প্রথমে অনীহা প্রকাশ করেন। পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর হারুন অর রশিদ কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, এই বাংলাদেশিরা হলেন টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার আবদুল্লাহপাড়ার আবদুল মান্নানের ছেলে মামুন মিয়া (২৭), কালিহাতীর কসতুরিপাড়ার শামসুল হকের ছেলে মাসুদ (২১), দেলদুয়ারের মিলন মিয়ার ছেলে সুমন মিয়া (২০), সখীপুরের খোয়াজ মিয়ার ছেলে শফিকুল ইসলাম (২৫), কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার আবদুল হাইয়ের ছেলে মোহাম্মদ সুমন (২০), কুমিল্লার দাউদকান্দির জামাল উদ্দিনের ছেলে ফারুক (২৫), ফরিদপুরের সৈয়দ খানের ছেলে মতিয়ার রহমান (২৫) ও আহমেদ বিশ্বাসের ছেলে আবুল হোসেন (২৫)।
এ ছাড়া একই মামলায় গাজীপুরের আবদুল হামিদের ছেলে আলমগীর হোসেনকে (২৫) যাবজ্জীবন ও কফিল উদ্দিনের ছেলে আবদুস সালামকে (২৫) ১৫ বছর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবদুল মোতালিবের ছেলে মাসুদ রানাকে (৪০) পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন সৌদি আদালত।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ হওয়ার খবর সম্পর্কে জানতে গতকাল শনিবার সকালে প্রবাসী কল্যাণসচিব ড. জাফর আহমেদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে সরকার ও সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস অবগত আছে। তাদের দণ্ড মওকুফের জন্য সরকার করণীয় সবই করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও তাঁদের প্রাণভিক্ষার জন্য সৌদি সরকারকে অনুরোধ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের রক্ষা করা যায়নি।
শিরশ্ছেদ হওয়া ব্যক্তিদের দেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হবে কি না জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণসচিব বলেন, দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য দূতাবাসকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু শিরশ্ছেদ হওয়া ব্যক্তিদের দেহ দেশে ফিরিয়ে আনা কঠিন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরব প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদের মতো বর্বর কায়দায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলেও একই সঙ্গে আট বিদেশির শিরশ্ছেদ করার ঘটনার নজির তেমন একটা নেই। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, সৌদি আরবে সাম্প্রতিক সময়ে শিরশ্ছেদের শিকার হওয়া বিদেশিদের বেশির ভাগই দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিবাসী কর্মী। অভিযুক্তরা প্রায় ক্ষেত্রেই তাঁদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন না। এমনকি আদালতে আরবি ভাষার শুনানিও তাঁরা বুঝতে পারেন না। খুব কম ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষের আইনজীবীকে সশরীরে উপস্থিতির সুযোগ দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিচারপ্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে অভিযুক্তদের জানানো হয় না।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আরো জানায়, সৌদি আরবে নানাবিধ অপরাধের জন্য শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে সৌদি আরবে কমপক্ষে ৭৬ বিদেশিসহ মোট ১৫৮ জনের শিরশ্ছেদ করা হয়। ২০০৮ সালে শিরশ্ছেদের শিকার হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ১০২। এর মধ্যে প্রায় ৪০ জন বিদেশি। ২০০৯ সালে ১৯ জন বিদেশিসহ মোট ৬৯ জন এবং গত বছর কমপক্ষে ছয়জন বিদেশিসহ মোট ২৭ জনের শিরশ্ছেদ করা হয়। গত শুক্রবার রিয়াদে ওই আট বাংলাদেশি ছাড়াও সৌদি আরবের উত্তরাঞ্চলীয় তাবুক শহরে দুজন সৌদি নাগরিকের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সৌদি সরকার এ বছর এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৮ জনকে শিরশ্ছেদ করার মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। বছরওয়ারি হিসাবে এ সংখ্যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। অন্যদিকে এ বছর শিরশ্ছেদের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ২০ জন বিদেশি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গভীর উদ্বেগ : অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উদ্বেগের সঙ্গে জানিয়েছে, আরবি রমজান মাস শেষ হওয়ার পর থেকে সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ করার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। গত শুক্রবার আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ করার পর এ বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা শাখার উপপরিচালক হাসিবা হাজ শাহরাওয়ি বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক শিরশ্ছেদের খবর অত্যন্ত উদ্বেগের। সৌদি আরবের আদালতের বিচারব্যবস্থা ন্যায়বিচারের আন্তর্জাতিক মানসম্মত নয়। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ডবিরোধী মনোভাব থাকলেও দৃশ্যত সৌদি কর্তৃপক্ষ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রবণতা বাড়িয়েছে। তিনি দেশটির প্রতি অবিলম্বে মৃত্যুদণ্ডবিরোধী আইন প্রণয়নের তাগিদ দেন।
সৌদিতে বাংলাদেশিদের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব : একই দিনে আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ করার প্রভাব কি সৌদি আরবে অবস্থানরত ২৫ লাখেরও বেশি বাংলাদেশির ওপর পড়তে পারে_এমন প্রশ্নের উত্তরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, এ দেশের নাগরিকরা বিদেশে যেখানেই থাকেন না কেন, সে স্থানের আইন মেনে চলবেন_এটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিদেশের কারাগারে বাংলাদেশিদের আইনি ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও যে সব সময় তাঁদের রক্ষা করা সম্ভব হয় না, সৌদি আরবে গত শুক্রবারের ঘটনা তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, 'ওই ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশিরা স্থানীয় আইনকানুন মেনে চলার ব্যাপারে আরো সচেতন হবে বলে আমরা আশা করছি।'
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ নিয়ে একাধিক দেশের সঙ্গে দেশটির কূটনৈতিক টানাপড়েনও দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গত জুন মাসে সৌদি আরবে ইন্দোনেশীয় এক নারী কর্মীর শিরশ্ছেদ কার্যকর হওয়ার পর জাকার্তায় সৌদি দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে। এরপর ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুসিলো বাবমাং ইয়োদোনো রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ভাষণ দিয়ে তাঁর দেশ থেকে সৌদিতে আপাতত আর কোনো কর্মী না পাঠানোর ঘোষণা দেন। শিরশ্ছেদের শিকার হওয়া ইন্দোনেশীয় নারী কর্মী রুয়াতি বিনতে সাতুবি সৌদি আরবের আদালতে তাঁকে নিয়োগকারী গৃহকর্ত্রীকে হত্যার কথা স্বীকার করে বলেন, প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হলেও সে দেশে তাঁর অভিযোগ জানানোর ও প্রতিকার পাওয়ার উপায় ছিল না। শেষে বাধ্য হয়েই হত্যার মাধ্যমে তিনি তাঁর ওপর দৈনন্দিন নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছিলেন। কিন্তু আদালত এই পটভূমিকে গুরুত্ব না দিয়ে হত্যার বিষয়টিকেই কেবল প্রাধান্য দিয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্র বলেছে, বাংলাদেশের মতো ইন্দোনেশিয়ার সরকারও রুয়াতি বিনতে সাতুবির প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিল। কিন্তু সৌদি সরকার সে আবেদনে কর্ণপাত না করে সাতুবির শিরশ্ছেদ করে। এরপর ইন্দোনেশিয়ার সরকার সৌদি আরবে আপাতত আর কোনো কর্মী না পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে এ বার্তাই দিয়েছে যে আরবের এ দেশটি বিদেশিদের সঙ্গে এমন বর্বর আচরণ করতে পারে না।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সৌদি আরব বিদেশে বাংলাদেশি কর্মীদের প্রধান শ্রমবাজার। বাংলাদেশ সরকার তার নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষায় যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা বিদেশে আইন মেনে চলার মাধ্যমেই সরকারকে সহযোগিতা করতে পারতেন।
বিদেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদেরও ফিরিয়ে আনার নজির : ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকার গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে 'রক্তমূল্য' দিয়ে ছয় বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে এনেছে। শারজায় এক পাকিস্তানিকে হত্যার দায়ে তাঁদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়ার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট আদালতের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে আইন অনুযায়ী নিহত ব্যক্তির পরিবারকে আদালত নির্ধারিত এক কোটি টাকা রক্তমূল্য দেওয়ার পর ওই ছয় বাংলাদেশি মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুদান হিসেবে তাঁদের এক কোটি টাকা দিয়েছিলেন।
জানা গেছে, সৌদি আরবেও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশিদের দণ্ড হ্রাস করার নজির আছে। গত শতকের আশির দশকে সৌদি আরবে এক অপরাধের জন্য হাত কাটার অবস্থা হয়েছিল বাংলাদেশি এক শিল্পপতির (বর্তমানে প্রয়াত)। পরে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সৌদি সরকার তাঁর হাতের বদলে শাস্তি হিসেবে আঙুল কেটে দেয়। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলেছে, দেশ ও অপরাধভেদে শাস্তির মাত্রাও ভিন্ন। তাই নাগরিকদের অপরাধের দণ্ড মওকুফ বা কমানোর প্রচেষ্টা সব সময় সফল হয় না।
মেনে নেওয়া যায় না
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে সৌদি আরবে কর্মরত এক মিসরীয় নিরাপত্তাকর্মীকে হত্যার অভিযোগে আট বাংলাদেশিকে সৌদি আদালত মৃত্যুদণ্ড দেন। অভিযোগ রয়েছে, ওই বাংলাদেশিরা কাজ করতেন এমন এক স্থানে একটি চক্র বৈদ্যুতিক তার চুরির চেষ্টার সময় বাংলাদেশি কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এতে সেখানে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কর্মরত মিসরীয় নাগরিকটি নিহত হন।
অ্যামনেস্টি বলেছে, বিদেশি ও সৌদি নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা শিরশ্ছেদের শিকার হয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই সরকারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বা গোত্রপ্রধানদের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তাই তাঁদের মাধ্যমে শাস্তি কমানো বা খুনের ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের জরিমানা দিয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তির সুযোগ অভিযুক্তরা পাননি। আটক অবস্থায় জোর করে অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়ের মাধ্যমেও দেশটিতে অনেককে দোষী সাব্যস্ত করা যায়।
সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রয়টার্স ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম গত শুক্রবার শিরশ্ছেদ হওয়া আট বাংলাদেশির নাম প্রকাশ করেছে। রিয়াদে বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমের কাছে শিরশ্ছেদ হওয়া বাংলাদেশিদের বিস্তারিত পরিচয় জানাতে প্রথমে অনীহা প্রকাশ করেন। পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর হারুন অর রশিদ কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, এই বাংলাদেশিরা হলেন টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার আবদুল্লাহপাড়ার আবদুল মান্নানের ছেলে মামুন মিয়া (২৭), কালিহাতীর কসতুরিপাড়ার শামসুল হকের ছেলে মাসুদ (২১), দেলদুয়ারের মিলন মিয়ার ছেলে সুমন মিয়া (২০), সখীপুরের খোয়াজ মিয়ার ছেলে শফিকুল ইসলাম (২৫), কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার আবদুল হাইয়ের ছেলে মোহাম্মদ সুমন (২০), কুমিল্লার দাউদকান্দির জামাল উদ্দিনের ছেলে ফারুক (২৫), ফরিদপুরের সৈয়দ খানের ছেলে মতিয়ার রহমান (২৫) ও আহমেদ বিশ্বাসের ছেলে আবুল হোসেন (২৫)।
এ ছাড়া একই মামলায় গাজীপুরের আবদুল হামিদের ছেলে আলমগীর হোসেনকে (২৫) যাবজ্জীবন ও কফিল উদ্দিনের ছেলে আবদুস সালামকে (২৫) ১৫ বছর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবদুল মোতালিবের ছেলে মাসুদ রানাকে (৪০) পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন সৌদি আদালত।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ হওয়ার খবর সম্পর্কে জানতে গতকাল শনিবার সকালে প্রবাসী কল্যাণসচিব ড. জাফর আহমেদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে সরকার ও সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস অবগত আছে। তাদের দণ্ড মওকুফের জন্য সরকার করণীয় সবই করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও তাঁদের প্রাণভিক্ষার জন্য সৌদি সরকারকে অনুরোধ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের রক্ষা করা যায়নি।
শিরশ্ছেদ হওয়া ব্যক্তিদের দেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হবে কি না জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণসচিব বলেন, দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য দূতাবাসকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু শিরশ্ছেদ হওয়া ব্যক্তিদের দেহ দেশে ফিরিয়ে আনা কঠিন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরব প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদের মতো বর্বর কায়দায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলেও একই সঙ্গে আট বিদেশির শিরশ্ছেদ করার ঘটনার নজির তেমন একটা নেই। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, সৌদি আরবে সাম্প্রতিক সময়ে শিরশ্ছেদের শিকার হওয়া বিদেশিদের বেশির ভাগই দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিবাসী কর্মী। অভিযুক্তরা প্রায় ক্ষেত্রেই তাঁদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন না। এমনকি আদালতে আরবি ভাষার শুনানিও তাঁরা বুঝতে পারেন না। খুব কম ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষের আইনজীবীকে সশরীরে উপস্থিতির সুযোগ দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিচারপ্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে অভিযুক্তদের জানানো হয় না।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আরো জানায়, সৌদি আরবে নানাবিধ অপরাধের জন্য শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে সৌদি আরবে কমপক্ষে ৭৬ বিদেশিসহ মোট ১৫৮ জনের শিরশ্ছেদ করা হয়। ২০০৮ সালে শিরশ্ছেদের শিকার হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ১০২। এর মধ্যে প্রায় ৪০ জন বিদেশি। ২০০৯ সালে ১৯ জন বিদেশিসহ মোট ৬৯ জন এবং গত বছর কমপক্ষে ছয়জন বিদেশিসহ মোট ২৭ জনের শিরশ্ছেদ করা হয়। গত শুক্রবার রিয়াদে ওই আট বাংলাদেশি ছাড়াও সৌদি আরবের উত্তরাঞ্চলীয় তাবুক শহরে দুজন সৌদি নাগরিকের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সৌদি সরকার এ বছর এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৮ জনকে শিরশ্ছেদ করার মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। বছরওয়ারি হিসাবে এ সংখ্যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। অন্যদিকে এ বছর শিরশ্ছেদের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ২০ জন বিদেশি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গভীর উদ্বেগ : অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উদ্বেগের সঙ্গে জানিয়েছে, আরবি রমজান মাস শেষ হওয়ার পর থেকে সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ করার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। গত শুক্রবার আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ করার পর এ বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা শাখার উপপরিচালক হাসিবা হাজ শাহরাওয়ি বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক শিরশ্ছেদের খবর অত্যন্ত উদ্বেগের। সৌদি আরবের আদালতের বিচারব্যবস্থা ন্যায়বিচারের আন্তর্জাতিক মানসম্মত নয়। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ডবিরোধী মনোভাব থাকলেও দৃশ্যত সৌদি কর্তৃপক্ষ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রবণতা বাড়িয়েছে। তিনি দেশটির প্রতি অবিলম্বে মৃত্যুদণ্ডবিরোধী আইন প্রণয়নের তাগিদ দেন।
সৌদিতে বাংলাদেশিদের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব : একই দিনে আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ করার প্রভাব কি সৌদি আরবে অবস্থানরত ২৫ লাখেরও বেশি বাংলাদেশির ওপর পড়তে পারে_এমন প্রশ্নের উত্তরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, এ দেশের নাগরিকরা বিদেশে যেখানেই থাকেন না কেন, সে স্থানের আইন মেনে চলবেন_এটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিদেশের কারাগারে বাংলাদেশিদের আইনি ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও যে সব সময় তাঁদের রক্ষা করা সম্ভব হয় না, সৌদি আরবে গত শুক্রবারের ঘটনা তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, 'ওই ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশিরা স্থানীয় আইনকানুন মেনে চলার ব্যাপারে আরো সচেতন হবে বলে আমরা আশা করছি।'
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ নিয়ে একাধিক দেশের সঙ্গে দেশটির কূটনৈতিক টানাপড়েনও দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গত জুন মাসে সৌদি আরবে ইন্দোনেশীয় এক নারী কর্মীর শিরশ্ছেদ কার্যকর হওয়ার পর জাকার্তায় সৌদি দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে। এরপর ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুসিলো বাবমাং ইয়োদোনো রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ভাষণ দিয়ে তাঁর দেশ থেকে সৌদিতে আপাতত আর কোনো কর্মী না পাঠানোর ঘোষণা দেন। শিরশ্ছেদের শিকার হওয়া ইন্দোনেশীয় নারী কর্মী রুয়াতি বিনতে সাতুবি সৌদি আরবের আদালতে তাঁকে নিয়োগকারী গৃহকর্ত্রীকে হত্যার কথা স্বীকার করে বলেন, প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হলেও সে দেশে তাঁর অভিযোগ জানানোর ও প্রতিকার পাওয়ার উপায় ছিল না। শেষে বাধ্য হয়েই হত্যার মাধ্যমে তিনি তাঁর ওপর দৈনন্দিন নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছিলেন। কিন্তু আদালত এই পটভূমিকে গুরুত্ব না দিয়ে হত্যার বিষয়টিকেই কেবল প্রাধান্য দিয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্র বলেছে, বাংলাদেশের মতো ইন্দোনেশিয়ার সরকারও রুয়াতি বিনতে সাতুবির প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিল। কিন্তু সৌদি সরকার সে আবেদনে কর্ণপাত না করে সাতুবির শিরশ্ছেদ করে। এরপর ইন্দোনেশিয়ার সরকার সৌদি আরবে আপাতত আর কোনো কর্মী না পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে এ বার্তাই দিয়েছে যে আরবের এ দেশটি বিদেশিদের সঙ্গে এমন বর্বর আচরণ করতে পারে না।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সৌদি আরব বিদেশে বাংলাদেশি কর্মীদের প্রধান শ্রমবাজার। বাংলাদেশ সরকার তার নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষায় যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা বিদেশে আইন মেনে চলার মাধ্যমেই সরকারকে সহযোগিতা করতে পারতেন।
বিদেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদেরও ফিরিয়ে আনার নজির : ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকার গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে 'রক্তমূল্য' দিয়ে ছয় বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে এনেছে। শারজায় এক পাকিস্তানিকে হত্যার দায়ে তাঁদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়ার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট আদালতের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে আইন অনুযায়ী নিহত ব্যক্তির পরিবারকে আদালত নির্ধারিত এক কোটি টাকা রক্তমূল্য দেওয়ার পর ওই ছয় বাংলাদেশি মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুদান হিসেবে তাঁদের এক কোটি টাকা দিয়েছিলেন।
জানা গেছে, সৌদি আরবেও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশিদের দণ্ড হ্রাস করার নজির আছে। গত শতকের আশির দশকে সৌদি আরবে এক অপরাধের জন্য হাত কাটার অবস্থা হয়েছিল বাংলাদেশি এক শিল্পপতির (বর্তমানে প্রয়াত)। পরে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সৌদি সরকার তাঁর হাতের বদলে শাস্তি হিসেবে আঙুল কেটে দেয়। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলেছে, দেশ ও অপরাধভেদে শাস্তির মাত্রাও ভিন্ন। তাই নাগরিকদের অপরাধের দণ্ড মওকুফ বা কমানোর প্রচেষ্টা সব সময় সফল হয় না।
মেনে নেওয়া যায় না
No comments