লোকনাথের জন্মভূমিঃ হতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র by বীরেন মুখার্জি
মাগুরার শালিখা উপজেলার প্রাচীন একটি জনপদের নাম তালখড়ি। কবে, কখন এ গ্রামে জনবসতি গড়ে ওঠে তার সুনির্দিষ্ঠ কোনো তথ্য এখন আর পাওয়া যায় না। তবে গ্রামের নামকরণ নিয়ে পাওয়া যায় ভিন্নমত। ঐতিহাসিক দীনেশ সেনের 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য', নরহরি চক্রর্বতীর 'নরোত্তম বিলাস' এবং নিত্যানন্দ দাসের 'প্রেম বিলাস' গ্রনে্থ তালখড়িকে 'তালগড়ি' বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কেউ কেউ তালখড়ির আগের নাম 'তালগৈড়া' বা 'তালখ-ী'ও বলে থাকেন। তবে শিশির কুমারের 'নরোত্তম চরিত্র' এবং সতীষ মিত্রের 'যশোর-খুলনার ইতিহাস' গ্রনে্থ তালখড়িকে 'তালখড়ি'ই বলা হয়েছে। অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী 'মাগুরা জেলার গ্রামের নামের ইতিকথা' গ্রনে্থ বলেছেন, 'তালগাছের কারণে তালখড়ি নাম হয়নি। 'তালখাড়ি' থেকে 'তালখড়ি' নাম হয়েছে। এখানে এক বিষৎ পরিমাণ মাপ বা সপ্ততাল জলের নিচে অর্থে 'তাল' নামটি এসেছে। এ 'তাল' শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। আর 'খাড়ি' শব্দটি দেশি। খাড়ি শব্দের অর্থ নদীর সংকীর্ণ অংশ। তালখাড়ি এলাকায় এক সময় নদী ছিল। তার প্রমাণ হিসেবে রয়েছে তালখড়ির দক্ষিণ দিকের বিল। তালখাড়ি শুকিয়ে যাওয়ার পর সেখানে যে গ্রাম গড়ে ওঠে তার নাম হয় 'তালখাড়ি' থেকে 'তালখড়ি'। এ তালখড়ি গ্রামেরই সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন পরম প্রেমময় শ্রীরাধা-কৃষেষ্ণর ভাবের মহাসাধক শ্রী লোকনাথ গোস্বামী। এ মহাসাধকের পিতার নাম পদ্মনাভ চক্রর্বতী এবং মাতা সীতা দেবী। প্রাচীন 'ব্রাহ্মণ কুল' গ্রনে্থ তালখড়িতে বসবাস করা ভট্টাচার্যদের বংশাবলিতে পদ্মনাভ চক্রর্বতী ও লোকনাথের নাম আছে। পদ্মনাভ চক্রর্বতী তালখড়িতে বাড়ি নির্মাণের পর এ গ্রামে একটি চতুষ্পাঠী খুলেছিলেন। তিনিও একজন সুপণ্ডিত ছিলেন। শৈশবে লোকনাথ গোস্বামী এখানে পড়াশোনা করতেন। মহাভাবুক শ্রী লোকনাথ গোস্বামীর পরিচয় নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত। অনেকে এ সাধককে ঢাকার বারদী গ্রামের লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলে থাকেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চবি্বশ পরগনার চৌরাঙ্গীকলা গ্রামে (১৭৩০-১৮৯০ইং) জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার বারদীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠার কারণে তিনি বারদীর লোকনাথ ব্রহ্মচারী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। 'ব্রাহ্মণ কুল' গ্রন্থ ও বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠে জানা যায়, লোকনাথ গোস্বামীর পিতা পদ্মনাভ চক্রর্বতীর আগের পুরুষ নড়াইল জেলার তালেশ্বর গ্রামে বসবাস করতেন। চৈতন্যযুগে পদ্মনাভ চক্রর্বতী তালখড়ি গ্রামে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁর চার পুত্রের মধ্যে লোকনাথ ছিলেন তৃতীয়। এই লোকনাথ গোস্বামীই সর্বপ্রথম বৃন্দাবনে গিয়ে তীর্থোদ্ধারের কাজ শুরু করেন। এক সময় তিনি লোকপাবন লোকনাথ গোস্বামী নামে গৌড়ীর বৈষষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্যতম গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তিনি শান্তিপুরে অদৈ্বতাচাযরাউর কাছে 'কৃষষ্ণলীলামৃত শ্রী মন্দাগবত' শিক্ষা নেন। পরে ঈশ্বরের প্রকৃত তত্ত্বানুসন্ধান শিক্ষার জন্য শ্রী গৌরাঙ্গের কাছে সমপর্িত হন। লোকনাথ গোস্বামী মহাপ্রভু গৌরাঙ্গের চেয়ে দু'বছরের বড় হলেও তিনি মহাপ্রভুর কাছে শাস্ত্র শিক্ষায় অসাধারণ জ্ঞান অর্জন শেষে তালখড়ি গ্রামে ফিরে আসেন। হঠাৎ করেই একদিন মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ তালখড়ি গ্রামে এসে উপস্থিত হন। এখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর মহাপ্রভু লোকনাথকে নিয়ে তিনি পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকা ভ্রমণ করেন। পরর্বতী সময়ে তিনি লোকনাথ গোস্বামীকে তালখড়িতে রেখে নব্টীপে ফিরে যান। মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ লোকান্তরিত হওয়ার কায়েক বছর আগে শ্রীকৃষষ্ণ ভাবোল্লাসে মগ্ন শ্রী লোকনাথ গোস্বামী একরাতে কৃষষ্ণ নাম জপতে জপতে তালখড়ি ত্যাগ করে নব্টীপে গিয়ে মহাপ্রভু গৌরাঙ্গের সঙ্গে দেখা করেন। তিনিই লোকনাথকে বৃন্দাবনে নিয় গিয়ে তীর্থোদ্ধারের জন্য আজ্ঞা দেন। লোকনাথ গোস্বামী বৃন্দাবনের পথে পথে কৃষষ্ণ নামের রোমান্স জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ সময় তিনি 'সীতা চরিত্র' নামে একখানি গ্রন্থও রচনা করেন। পরে তিনি বৃন্দাবনেই দেহত্যাগ করেন। ভারতের মহাতীর্থ বৃন্দাবন থেকে শ্রী লোকনাথ গোস্বামীর অনুসারীদের অন্যতম শ্রীমৎ নিতাই রমণ দাস বাবাজী তার গুরুদেব শ্রীমৎ রামদাস বাবাজী কর্তৃক আদিষ্ঠ হয়ে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলা ১৩৫২ সালে তালখড়িতে আসেন। লোকনাথ গোস্বামীর বংশধর হিসেবে তালখড়ি গ্রামের তাৎকালীন জমিদাররা এ গ্রামে আশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য পুকুরসহ ১৬ বিঘা জমি দান করেন। এই জমি মন্দিরের বিগ্রহ রাধারমন জিউ পক্ষে সেবাইত হিসেবে শ্রীমৎ নিতাই রমণ দাস বাবাজীর অনুকূলে দানপত্র করা হয়। স্থানীয় গ্রামবাসী পুকুরটি সংস্কার কর এর পাড়েই একটি খড়ের ঘর নির্মাণ করেন। এখানেই প্রতিষ্ঠা করা হয় রাধা-বিনোদের বিগ্রহ। পরর্বতী সময়ে এর পাশে আরেকটি মন্দির নির্মাণ করে তালখড়ি লোকনাথ আশ্রম নামকরণ করা হয়। আশ্রমটি র্বতমানে সমস্যা ভারাক্রান্ত হয়ে ক্রমেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আশ্রমের র্বতমান সেবাইত গোর্বধন দাস বাবাজী এ আশ্রমের কিছু জমিজমা নিজের নামে ক্রয় করা এবং কিছু জমি বিক্রি করে ভারতের তাহিরপুরে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করছেন এমন অভিযোগের পর এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মামলা-মোকদ্দমা শুরু হয়েছে। গ্রামবাসী দুই শিবিরে ভাগ হয়ে মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ায় মাঝে মধ্যেই এখানে নানা কারণে সংঘর্ষ বাধে। আর এসব কারণে আশ্রমটি তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। দেশে-বিদেশে এ আশ্রমের খ্যাতি রয়েছে। প্রতি বছর সীতা নবমী থেকে ্টাদশী তিথি পর্যন্ত (বৈশাখ-জৈ্যষ্ঠ মাসে) এখানে ২৪ প্রহরব্যাপী মহানামযজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। লাখ লাখ ভক্ত-দর্শনার্থীর সমাগম হয় এ সময়। আশ্রমটির সংস্কার সাধনে একটি শক্তিশালী পরিচালনা কমিটি গঠন ও শ্রী লোকনাথ গোস্বামীর ওপর একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান করা গেলে তা অজানা অনেক অধ্যায় উন্মোচিত হবে বেল বোদ্ধামহল মনে করেন। এছাড়া এ আশ্রমটির ব্যাপারে সরকারিভাবে একটু নজর দেওয়া হলে এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেত।
No comments