জাপানি শিশুরা ঠিক নেই by ফারজানা তাসনিম
অন্যান্য
উন্নত দেশের চেয়ে একদিক থেকে জাপানিরা বেশ আলাদা। দেশটির সরকারি
তথ্যানুযায়ী, গড়ে সাতজনে একজন শিশুকে বাবা-মা ছেড়ে ১০ বছর কাটাতে হয় ফস্টার
হোম বা তত্ত্বাবধায়ক কেন্দ্রে। কিন্তু সেই তত্ত্বাবধায়ক কেন্দ্রগুলোয়
শিশুদের ওপর মানসিক নির্যাতন হচ্ছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
পারিবারিক বন্ধনহীন এসব শিশুকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাপান সরকার।
মিওয়া মোরিয়ার বয়স তখন কেবল ছয় বছর। হঠাৎ একদিন এক সমাজকর্মী এসে জানালেন, বড়দিনের পার্টিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে। খুশিমনেই রাজি হয়ে গেল মিওয়া। তবে পার্টির কথা বলে মিওয়াকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হলো, সেটি পশ্চিম জাপানের ছোট একটি শহর। প্রায় ৬০টি শিশু একসঙ্গে থাকে সেখানে। মিওয়ার সেই ‘পার্টি’ চলল দীর্ঘ আট বছর ধরে। মাকে ছেড়ে বহুদূরে এসে নতুন জীবনে মিওয়ার সঙ্গী হলো একাকিত্ব, মানসিক নির্যাতন আর ট্রমা।
মিওয়া কখনো জানতে পারেনি, কেন তাকে ঘর ছাড়তে হলো। তাকে শুধু বলা হয়েছিল, পরিবারের চেয়ে ওই গ্রুপে ভালো থাকবে সে।
জাতিসংঘের নির্দেশনা অনুযায়ী, শিশুদের বেড়ে ওঠার কথা পরিবারের সান্নিধ্যে। জাতিসংঘের কথা বাদ দিলেও প্রকৃতির নিয়ম মেনে সারা বিশ্বে বাচ্চারা বাবা-মায়ের কোলেই বড় হচ্ছে। অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে এখানেই পার্থক্য জাপানের। শৈশবে এখানকার বেশির ভাগ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়, উপেক্ষিত হয় অথবা বাবা-মাকে ছেড়ে ভিন্ন একটি বাসায় থাকতে বাধ্য হয়। সরকারি তথ্যানুযায়ী, এ ধরনের প্রায় ৩৮ হাজার শিশুর ৮০ ভাগকে তারা আবাসিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, জাপানের সরকার সমস্যাটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আইনসভায় উপস্থাপন করেছে। নির্যাতনের কারণে উচ্চমাত্রায় শিশুমৃত্যুর হার সবার টনক নড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে আগামী মার্চ মাসের মধ্যে অবস্থার উন্নতি ঘটাতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতিম পথশিশুদের তত্ত্বাবধানের জন্য শত শত কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। তখন থেকেই রাষ্ট্র আর এই শিশুদের দায়ভার নেয়নি। বর্তমানে এমন তত্ত্বাবধান কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ৬০০। সাময়িক সমাধান হিসেবে চিন্তা করলে কেন্দ্রগুলোর কার্যকারিতা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে পারিবারিক আবহ ছাড়া শিশুদের বেড়ে ওঠা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। গত মাসে সরকারি এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইনস্টিটিউশনগুলোয় শিশুদের ওপর সহিংস যৌন নির্যাতন বিপুল পরিমাণে বেড়ে গেছে।
সম্প্রতি শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন—এমন এক আইনপ্রণেতা ইয়াসুহিসা শিওজাকি বলেন, মুখে মুখে সবাই বলে বাচ্চারা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কাজে তার কোনো প্রতিফলন নেই। প্রাপ্তবয়স্কদের হাতের খেলনায় পরিণত হওয়া জাপানে শিশুরা উপেক্ষিত। এই মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে।
পালানোর সুযোগ নেই
বর্তমানে ২৩ বছর বয়সী মিওয়া জানান, প্রথম যে ইনস্টিটিউশনে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল, তার নাম কোবাতো গাকুয়েন। দিনের পর দিন চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়ে রাত কাটিয়েছে ছোট্ট মিওয়া। মায়ের কথা মনে পড়ে খুব কষ্ট হতো। একসময় সে বুঝতে পারল চোখের পানি তাকে বাড়িতে ফিরতে দেবে না। সেই থেকে হাল ছেড়ে দিয়ে একদম চুপ হয়ে যায় সে।
ইনস্টিটিউশনের সবাই যে খারাপ ছিল, তা নয়। তবে অধিকাংশ লোকই কোনো সতর্কবার্তা না দিয়ে চলাচল করত। বাচ্চারা অপমানিত হওয়ার ভয়ে সারাক্ষণ কুঁকড়ে থাকত। মিয়া বলেন, ‘ওখানে শত্রুদের হাত থেকে পালানোর কোনো সুযোগ নেই।’ এমন পরিবেশে অনেক শিশু ডেভেলপমেন্টাল ট্রমা ডিসঅর্ডার নামে মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে বলে জানান ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞানী সাতোরু নিশিযাওয়া।
৪০ বছর ধরে তত্ত্বাবধায়ক কেন্দ্রের শিশুদের নিয়ে কাজ করা সাতোরু বলেন, ‘বাচ্চারা নিজেদের একেবারেই সুরক্ষিত বা নিরাপদ মনে করে না। নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা থেকে ছোটখাটো ব্যাপারে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। এসব কারণেই অনেক শিশু নিজেই নিজেকে আহত করে এবং পরবর্তী সময়ে কোনো সম্পর্কে জড়াতে ভয় পায়।’
নির্ঘুম রজনী
ডেভেলপমেন্টাল ট্রমা ডিসঅর্ডারের জলজ্যান্ত উদাহরণ মিওয়ার হাতের ক্ষতচিহ্নগুলো। অন্য কেউ নয়, নিজেই নিজের এমন ক্ষতি করেছে সে। রেগে গেলে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙা তার অভ্যাস। ঘন ঘন ফোন নম্বর বদলে নিজেকে মানসিক সুরক্ষা দিতে চায় মিওয়া। বহু বছর পর পরিবারের কাছে ফিরে আসা মিওয়া নিজের কেসস্টাডি নিয়েই কাজ করছে। কোবাতো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ২৭৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন আদায় করে সে।
সবকিছু পড়ে মিওয়া বুঝতে পেরেছে, সমাজকর্মীরা তার মাকে বুঝিয়েছেন, একটি ভালো চাকরিসন্ধানী মায়ের ক্যারিয়ারের প্রধান বাধা তাঁর বাচ্চা। কাজেই বাচ্চার দায়িত্ব নিয়ে মিওয়ার মাকে একটি নিশ্চিন্ত জীবনের পথ দেখিয়েছিলেন তাঁরা। খুব শিগগির আবার মা-মেয়ে মিলে যেতে পারবে বলে আশ্বাস দেন তাঁরা। তবে প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, এমন কোনো উদ্যোগ সমাজকর্মীরা নেননি।
এই এক প্রতিবেদন থেকে গোটা সিস্টেমের অবস্থা ফুটে উঠেছে। শিশুকল্যাণকর্মীরা তীব্র সমালোচনার শিকার হচ্ছেন। যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই একের পর এক বাচ্চাকে ইনস্টিটিউশনে এনে তুলছেন তাঁরা। বহুদিন পার হয়ে গেলেও পরিবারের কাছে তাদের ফেরত দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। মিওয়া যখন মায়ের কাছে ফিরে আসে, তত দিনে তার বয়স ১৫ ছুঁয়েছে।
আইনপ্রণেতা শিওজাকি এই কর্মীদের মানোন্নয়নের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে প্রয়োজনীয় অর্থ আর লোকবল না থাকায় খুব একটা লাভ হচ্ছে না।
মিওয়ার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার কথা খুব একটা লেখা হয়নি প্রতিবেদনে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে জানায়, রাতে ঘুম আসে না তার। চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হলে জানা যায়, ধীরে ধীরে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হচ্ছে মিওয়া। এক বছর ধরে চিকিৎসা চলছে তার।
কোবাতো গাকুয়েনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে গোপনীয়তা নীতির দোহাই দিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তাঁরা।
সামাজিক পথ্য
সরকারি জরিপ অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়সে বাচ্চারা যখন ইনস্টিটিউশন ছেড়ে ‘সত্যিকারের দুনিয়ায়’ পা রাখে, তখন একাকিত্বের পাশাপাশি অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাও তাদের গ্রাস করে ফেলে। এমন শিশুদের মধ্যে তিনজনে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। বাকিরা উচ্চবিদ্যালয় পর্যায় থেকেই ঝরে পড়ে। এদের মধ্যে চাকরি করছে—এমন মানুষের সংখ্যাও খুব কম। প্রতি দশজনে একজন সমাজসেবী হয়ে ওঠে। বাকিদের মধ্যে গৃহহীনের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
পারিবারিক বন্ধনহীনতার এই চিত্র পাল্টাতে আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত স্থানীয় সরকারগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। একান্ত বাধ্য হয়ে যদি কাউকে ফস্টার হোম বা তত্ত্বাবধায়ক কেন্দ্রে থাকতেই হয়, সে ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৬০ জন নয়, বরং ছোট পরিবারের আদলে সদস্যসংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। ইনস্টিটিউটের পরিচালকেরা অবশ্য বলছেন, কাজটি খুব একটা সহজ হবে না।
শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে জোর দিতে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার আহ্বান জানিয়েছে জাপান সরকার। বাচ্চাকে নিজ পরিবারের সংস্কৃতি মেনে বড় করতে পরিবারগুলোকে উৎসাহ দিচ্ছে তারা।
মিওয়া মোরিয়ার বয়স তখন কেবল ছয় বছর। হঠাৎ একদিন এক সমাজকর্মী এসে জানালেন, বড়দিনের পার্টিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে। খুশিমনেই রাজি হয়ে গেল মিওয়া। তবে পার্টির কথা বলে মিওয়াকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হলো, সেটি পশ্চিম জাপানের ছোট একটি শহর। প্রায় ৬০টি শিশু একসঙ্গে থাকে সেখানে। মিওয়ার সেই ‘পার্টি’ চলল দীর্ঘ আট বছর ধরে। মাকে ছেড়ে বহুদূরে এসে নতুন জীবনে মিওয়ার সঙ্গী হলো একাকিত্ব, মানসিক নির্যাতন আর ট্রমা।
মিওয়া কখনো জানতে পারেনি, কেন তাকে ঘর ছাড়তে হলো। তাকে শুধু বলা হয়েছিল, পরিবারের চেয়ে ওই গ্রুপে ভালো থাকবে সে।
জাতিসংঘের নির্দেশনা অনুযায়ী, শিশুদের বেড়ে ওঠার কথা পরিবারের সান্নিধ্যে। জাতিসংঘের কথা বাদ দিলেও প্রকৃতির নিয়ম মেনে সারা বিশ্বে বাচ্চারা বাবা-মায়ের কোলেই বড় হচ্ছে। অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে এখানেই পার্থক্য জাপানের। শৈশবে এখানকার বেশির ভাগ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়, উপেক্ষিত হয় অথবা বাবা-মাকে ছেড়ে ভিন্ন একটি বাসায় থাকতে বাধ্য হয়। সরকারি তথ্যানুযায়ী, এ ধরনের প্রায় ৩৮ হাজার শিশুর ৮০ ভাগকে তারা আবাসিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, জাপানের সরকার সমস্যাটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আইনসভায় উপস্থাপন করেছে। নির্যাতনের কারণে উচ্চমাত্রায় শিশুমৃত্যুর হার সবার টনক নড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে আগামী মার্চ মাসের মধ্যে অবস্থার উন্নতি ঘটাতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতিম পথশিশুদের তত্ত্বাবধানের জন্য শত শত কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। তখন থেকেই রাষ্ট্র আর এই শিশুদের দায়ভার নেয়নি। বর্তমানে এমন তত্ত্বাবধান কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ৬০০। সাময়িক সমাধান হিসেবে চিন্তা করলে কেন্দ্রগুলোর কার্যকারিতা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে পারিবারিক আবহ ছাড়া শিশুদের বেড়ে ওঠা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। গত মাসে সরকারি এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইনস্টিটিউশনগুলোয় শিশুদের ওপর সহিংস যৌন নির্যাতন বিপুল পরিমাণে বেড়ে গেছে।
সম্প্রতি শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন—এমন এক আইনপ্রণেতা ইয়াসুহিসা শিওজাকি বলেন, মুখে মুখে সবাই বলে বাচ্চারা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কাজে তার কোনো প্রতিফলন নেই। প্রাপ্তবয়স্কদের হাতের খেলনায় পরিণত হওয়া জাপানে শিশুরা উপেক্ষিত। এই মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে।
পালানোর সুযোগ নেই
বর্তমানে ২৩ বছর বয়সী মিওয়া জানান, প্রথম যে ইনস্টিটিউশনে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল, তার নাম কোবাতো গাকুয়েন। দিনের পর দিন চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়ে রাত কাটিয়েছে ছোট্ট মিওয়া। মায়ের কথা মনে পড়ে খুব কষ্ট হতো। একসময় সে বুঝতে পারল চোখের পানি তাকে বাড়িতে ফিরতে দেবে না। সেই থেকে হাল ছেড়ে দিয়ে একদম চুপ হয়ে যায় সে।
ইনস্টিটিউশনের সবাই যে খারাপ ছিল, তা নয়। তবে অধিকাংশ লোকই কোনো সতর্কবার্তা না দিয়ে চলাচল করত। বাচ্চারা অপমানিত হওয়ার ভয়ে সারাক্ষণ কুঁকড়ে থাকত। মিয়া বলেন, ‘ওখানে শত্রুদের হাত থেকে পালানোর কোনো সুযোগ নেই।’ এমন পরিবেশে অনেক শিশু ডেভেলপমেন্টাল ট্রমা ডিসঅর্ডার নামে মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে বলে জানান ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞানী সাতোরু নিশিযাওয়া।
৪০ বছর ধরে তত্ত্বাবধায়ক কেন্দ্রের শিশুদের নিয়ে কাজ করা সাতোরু বলেন, ‘বাচ্চারা নিজেদের একেবারেই সুরক্ষিত বা নিরাপদ মনে করে না। নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা থেকে ছোটখাটো ব্যাপারে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। এসব কারণেই অনেক শিশু নিজেই নিজেকে আহত করে এবং পরবর্তী সময়ে কোনো সম্পর্কে জড়াতে ভয় পায়।’
নির্ঘুম রজনী
ডেভেলপমেন্টাল ট্রমা ডিসঅর্ডারের জলজ্যান্ত উদাহরণ মিওয়ার হাতের ক্ষতচিহ্নগুলো। অন্য কেউ নয়, নিজেই নিজের এমন ক্ষতি করেছে সে। রেগে গেলে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙা তার অভ্যাস। ঘন ঘন ফোন নম্বর বদলে নিজেকে মানসিক সুরক্ষা দিতে চায় মিওয়া। বহু বছর পর পরিবারের কাছে ফিরে আসা মিওয়া নিজের কেসস্টাডি নিয়েই কাজ করছে। কোবাতো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ২৭৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন আদায় করে সে।
সবকিছু পড়ে মিওয়া বুঝতে পেরেছে, সমাজকর্মীরা তার মাকে বুঝিয়েছেন, একটি ভালো চাকরিসন্ধানী মায়ের ক্যারিয়ারের প্রধান বাধা তাঁর বাচ্চা। কাজেই বাচ্চার দায়িত্ব নিয়ে মিওয়ার মাকে একটি নিশ্চিন্ত জীবনের পথ দেখিয়েছিলেন তাঁরা। খুব শিগগির আবার মা-মেয়ে মিলে যেতে পারবে বলে আশ্বাস দেন তাঁরা। তবে প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, এমন কোনো উদ্যোগ সমাজকর্মীরা নেননি।
এই এক প্রতিবেদন থেকে গোটা সিস্টেমের অবস্থা ফুটে উঠেছে। শিশুকল্যাণকর্মীরা তীব্র সমালোচনার শিকার হচ্ছেন। যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই একের পর এক বাচ্চাকে ইনস্টিটিউশনে এনে তুলছেন তাঁরা। বহুদিন পার হয়ে গেলেও পরিবারের কাছে তাদের ফেরত দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। মিওয়া যখন মায়ের কাছে ফিরে আসে, তত দিনে তার বয়স ১৫ ছুঁয়েছে।
আইনপ্রণেতা শিওজাকি এই কর্মীদের মানোন্নয়নের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে প্রয়োজনীয় অর্থ আর লোকবল না থাকায় খুব একটা লাভ হচ্ছে না।
মিওয়ার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার কথা খুব একটা লেখা হয়নি প্রতিবেদনে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে জানায়, রাতে ঘুম আসে না তার। চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হলে জানা যায়, ধীরে ধীরে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হচ্ছে মিওয়া। এক বছর ধরে চিকিৎসা চলছে তার।
কোবাতো গাকুয়েনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে গোপনীয়তা নীতির দোহাই দিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তাঁরা।
সামাজিক পথ্য
সরকারি জরিপ অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়সে বাচ্চারা যখন ইনস্টিটিউশন ছেড়ে ‘সত্যিকারের দুনিয়ায়’ পা রাখে, তখন একাকিত্বের পাশাপাশি অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাও তাদের গ্রাস করে ফেলে। এমন শিশুদের মধ্যে তিনজনে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। বাকিরা উচ্চবিদ্যালয় পর্যায় থেকেই ঝরে পড়ে। এদের মধ্যে চাকরি করছে—এমন মানুষের সংখ্যাও খুব কম। প্রতি দশজনে একজন সমাজসেবী হয়ে ওঠে। বাকিদের মধ্যে গৃহহীনের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
পারিবারিক বন্ধনহীনতার এই চিত্র পাল্টাতে আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত স্থানীয় সরকারগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। একান্ত বাধ্য হয়ে যদি কাউকে ফস্টার হোম বা তত্ত্বাবধায়ক কেন্দ্রে থাকতেই হয়, সে ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৬০ জন নয়, বরং ছোট পরিবারের আদলে সদস্যসংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। ইনস্টিটিউটের পরিচালকেরা অবশ্য বলছেন, কাজটি খুব একটা সহজ হবে না।
শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে জোর দিতে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার আহ্বান জানিয়েছে জাপান সরকার। বাচ্চাকে নিজ পরিবারের সংস্কৃতি মেনে বড় করতে পরিবারগুলোকে উৎসাহ দিচ্ছে তারা।
পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে হোমে দিন কাটাতে কাটাতে মানসিক সমস্যায় ভুগছে জাপানি শিশুরা। ছবি: রয়টার্স |
No comments