ঢাকায় বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয় কাবু মধ্যবিত্ত by মরিয়ম চম্পা
জীবন
চলছে না। চালিয়ে নিতে হচ্ছে। সংসার যেন এক মহাসমুদ্র। পাড়ি দিতে গিয়ে
হাবুডুবু খেতে হচ্ছে। কি করব বলুন? দিন দিন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। বছর
শেষে বাড়িভাড়া বাড়ছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল বাড়ছে। সন্তানদের পড়াশোনায় চলে
যাচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।
যে টাকা বেতন পাই মাসের অর্ধেকও চলে না। এরপর দ্বারস্থ হতে হয় দোকানির। বাকিতে মাল আনা। ধার করে বাকি দিন চলা। বেতন পেয়ে আবার ধার পরিশোধ করা। দোকান বাকি দেয়া। বাড়ি ভাড়া দেয়া। এভাবেই চলছে জীবন সংসার। বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি করা আব্দুল করিম আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলেন। কেমন চলছে সংসার? এ প্রশ্নে তার এ বক্তব্য। করিম বলেন, মনে কষ্ট নিয়ে দিন পার করছি। মন খুলে হাসতে পারিনা অনেক দিন। জানিনা এভাবে কতদিন চলতে পারব। বলতে পারেন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছি।
ঢাকার মিরপুরে তিন কক্ষের একটি বাসায় বসবাস করেন রওশন আরা দম্পতি। স্বামী ও দুই সন্তানসহ তাদের সংসারে সদস্য সংখ্যা চার। স্বামী-স্ত্রী দুজন চাকরি করেও পরিবারের ব্যয় সামলাতে পারছেন না তারা। রওশন আরা বলেন, সব খাতেই ব্যয়ের পরিমান দ্রুতগতিতে বাড়ছে। কিন্তু বাড়ছে না শুধু আয়। সংসার চালানো এখন রীতিমত কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বাড়তি ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে মাংস মাসে তিন চার দিন কিনতাম। এখন বাধ্য হয়ে কমিয়ে দিয়েছি। আগে রিকশায় যাতায়াত করলেও, এখন হেঁটে যাই। আগে নিউমার্কেটে মাসে দুই থেকে তিনবার ছোটখাটো শপিং করা হতো- এখন দুই মাসে একবার শপিংয়ে যাওয়া হয়। সপ্তাহের ছুটির দিনে ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাইরে খেতে যেতাম, এখন বাসায় বসে পছন্দের খাবার তৈরি করে দেই।
গ্রীনরোডের বাসিন্দা রুমিন কবির একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গত দুই বছরে তার বাসাভাড়া বেড়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। বিদ্যুৎ বিল আগে আসতো সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা, এখন ১২শ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আসে। গ্যাসের বিল বেড়েছে। ডিশ সংযোগ ও ইন্টারনেট বাবদ বিল বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এক বস্তা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১ হাজার টাকা। ভালো মাছ কেজিপ্রতি ৫০০ টাকার নিচে মেলে না। তিনি বলেন, যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি, সেখানে গত দুই বছরে কারও বেতন বাড়েনি। খরচ কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ছেলে-মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে মাসে দু-একবার রেস্তোরাঁয় খেতে যেতাম। এখন সেটা বাদ দিয়েছি। ছেলে-মেয়ের জন্য মৌসুমি ফল কিনলেও সেটা এখন অর্ধেকে চলে এসেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি পরিবারে স্থির ব্যয় বেড়েছে বাসাভাড়া, শিক্ষার খরচ, পরিবহন ব্যয় এবং গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল। ডিশ সংযোগ বিল, গৃহকর্মীর মজুরিও বেড়েছে। ময়লা পরিষ্কার ওয়ালাকে দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। আর মাসের শুরুতে বেতন পেয়েই এসব ব্যয় মেটাতে হয় তাই এ ক্ষেত্রে সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ নেই।
এদিকে, কাঁচাবাজারেও ব্যয় বেড়ে চলছে। কোনো কারন ছাড়াই ২৫ টাকার পিয়াজ এখন ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় কিনতে হয়। আদার কেজি ১৯০ থেকে ২শ টাকা। চালের দাম এখন সবচেয়ে বেশি। বেশির ভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। গরু কিংবা খাশির মাংসতো এখন বিলাসিতার খাবারে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরে মাংসের দাম হয়েছে দ্বিগুন। ভোজ্যতেল, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, চিনি, লবন ইত্যাদির দাম বেড়ে যাচ্ছে। ফলে, প্রতিনিয়ত ব্যয় বাড়তে থাকায় ব্যয়বহুল নগরীতে পরিণত হচ্ছে ঢাকা। যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট-এর গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ২০১৭ সালের মার্চে প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরীর তালিকায় শীর্ষ শহর ঢাকা। ‘কস্ট অব লিভিং সার্ভে’ শীর্ষক এ জরিপ খাবার, পোশাক, বাড়িভাড়া, গৃহস্থালি পণ্য, প্রসাধন, পরিবহন, শিক্ষা, বিনোদন ব্যয়সহ ১৬০ ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়। জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক দিয়ে বিশ্বের মোট ১৩০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৬২তম।
শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, গ্রামের মানুষ আছেন আরও বিপাকে। ২০১০ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা গিয়েছিল, তাদের গড় আয়ের পরিমাণ মোট ব্যয়ের চেয়ে বেশি। তারা মাসে ৩৬ টাকা সাশ্রয় করতে পারতেন। ২০১৬ সালে দেখা যাচ্ছে তাদের মাসিক ব্যয়-আয়ের চেয়ে ২৮৮ টাকা বেশি।
চলতি বছরের শুরুতে রাজধানীর খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার দাম বিশ্লেষণ করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলেছে, বিদায়ী বছরে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য্য সামগ্রী ও ১৪টি সেবাখাতের তথ্য পর্যালোচনা করে ক্যাব এই হিসাব দিয়েছে। পণ্যমূল্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৫.১৯ শতাংশ। এর আগে ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৮.৪৪ শতাংশ, পণ্যমূল্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছিল ৭.১৭ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে গত বছর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যয় বৃদ্ধির এই হার ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন রকম ফল বয়ে আনতে পারে। ব্যয় অনুপাতে একজন ব্যক্তির আয় বৃদ্ধি না পেলে সেটা স্বস্তিদায়ক হবে না। আয় বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। যদি ব্যয় বৃদ্ধির তুলনায় মানুষের আয় বৃদ্ধি হয় তাহলে সেটাই হবে স্বস্তিদায়ক।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও পিপিআরসি’র নির্বাহী সভাপতি (পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার) ড. হোসেন জিল্লুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কয়েকটি কারন রয়েছে। প্রথমত, যাতায়াত খরচের বিষয়ে যদি চিন্তা করি এক্ষেত্রে যাতায়াতের উপর বিশেষ করে গণপরিবহণের ওপর যে ধরনের ইনভেস্টমেন্ট হওয়া দরকার ছিল ওই ধরনের ইনভেস্টমেন্ট কিন্তু করা হয়নি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, নগরের বিনিয়োগগুলো যে সকল খাতে হওয়া দরকার বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবন মানের সঙ্গে যেগুলো জড়িত সেগুলোর ওপর ওই ধরনের বিনিয়োগের অগ্রাধিকার নেই। যেমন স্বল্প আয়ের আবাসনের ওপর বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো অত্যন্ত সিমিত। জমিজমা বা রিয়েলএস্টেট কোম্পানির আগ্রহ এবং সরকারেরও উৎসাহিত করার জায়গাগুলোতে বড় ধরনের ঘাটতি আছে।
এর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবনমানের জায়গাগুলোতে আমাদের যে বিনিয়োগ হওয়া দরকার সেখানে বিনিয়োগ অপর্যাপ্ততা আছে। সেজন্য ঘরভাড়া অথবা যাতায়াত খরচাবলি বেড়েই চলেছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের জীবনযাত্রার খরচটা বাড়ে কেন? খরচের মধ্যে একটি উপাদান হচ্ছে প্রয়োজনীয় উপকরন। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যয় আমরা যেটাকে চাঁদা বলতে অভ্যস্ত। অর্থাৎ শুধুমাত্র উপকরণ নয় বরং অন্যান্য খরচের বোঝাটাও বেশ বেশি। এসব খরচের ধাক্কাগুলো ভোক্তার উপর চলে যায়। উৎপাদনের খরচটা শুধু উৎপাদনের জন্য হচ্ছে না। এটা নানা ধরনের নন ইকোনোমিক খরচগুলো বেশি বলে চূড়ান্তভাবে ভোক্তার কাছে যে দামটা যায় সেটা একটু বেশি হয়ে যায়। তৃতীয়ত, বিদ্যুৎসহ এই সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়গুলোর সাশ্রয়ী উৎপাদনের দিকে নজর কম। চতুর্থ কারন হচ্ছে, দেশে কর’এর বিন্যাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রত্যক্ষ কর-এর চেয়ে পরোক্ষ করের বোঝা অনেক বেশি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্ণর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এটা শুধু ঢাকায় না গ্রামেও এর প্রভাব আছে। মূল ব্যপারটা হলো, আমাদের দেশে আয় বৈষম্যটা বেড়ে গেছে। একদিকে সরকার বলছে উন্নয়ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে শতকরা ৫ ভাগ থেকে ১০ ভাগের। বাকী ৯০ ভাগ জনগনের কোনো অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে না। ।
প্রকৃত আয় না বাড়াতে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এবং আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এটার সমাধান শুধু দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনলে হবে না। আয় বৈষম্য কমাতে হবে। আয় বৈষম্য কমানোর প্রধান হাতিয়ার হবে যারা অত্যন্ত ধনী তাদের কাছ থেকে প্রপারলি ট্যাক্স সংগ্রহ করে জনগনের জন্য ব্যয় করা।
যে টাকা বেতন পাই মাসের অর্ধেকও চলে না। এরপর দ্বারস্থ হতে হয় দোকানির। বাকিতে মাল আনা। ধার করে বাকি দিন চলা। বেতন পেয়ে আবার ধার পরিশোধ করা। দোকান বাকি দেয়া। বাড়ি ভাড়া দেয়া। এভাবেই চলছে জীবন সংসার। বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি করা আব্দুল করিম আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলেন। কেমন চলছে সংসার? এ প্রশ্নে তার এ বক্তব্য। করিম বলেন, মনে কষ্ট নিয়ে দিন পার করছি। মন খুলে হাসতে পারিনা অনেক দিন। জানিনা এভাবে কতদিন চলতে পারব। বলতে পারেন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছি।
ঢাকার মিরপুরে তিন কক্ষের একটি বাসায় বসবাস করেন রওশন আরা দম্পতি। স্বামী ও দুই সন্তানসহ তাদের সংসারে সদস্য সংখ্যা চার। স্বামী-স্ত্রী দুজন চাকরি করেও পরিবারের ব্যয় সামলাতে পারছেন না তারা। রওশন আরা বলেন, সব খাতেই ব্যয়ের পরিমান দ্রুতগতিতে বাড়ছে। কিন্তু বাড়ছে না শুধু আয়। সংসার চালানো এখন রীতিমত কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বাড়তি ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে মাংস মাসে তিন চার দিন কিনতাম। এখন বাধ্য হয়ে কমিয়ে দিয়েছি। আগে রিকশায় যাতায়াত করলেও, এখন হেঁটে যাই। আগে নিউমার্কেটে মাসে দুই থেকে তিনবার ছোটখাটো শপিং করা হতো- এখন দুই মাসে একবার শপিংয়ে যাওয়া হয়। সপ্তাহের ছুটির দিনে ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাইরে খেতে যেতাম, এখন বাসায় বসে পছন্দের খাবার তৈরি করে দেই।
গ্রীনরোডের বাসিন্দা রুমিন কবির একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গত দুই বছরে তার বাসাভাড়া বেড়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। বিদ্যুৎ বিল আগে আসতো সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা, এখন ১২শ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আসে। গ্যাসের বিল বেড়েছে। ডিশ সংযোগ ও ইন্টারনেট বাবদ বিল বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এক বস্তা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১ হাজার টাকা। ভালো মাছ কেজিপ্রতি ৫০০ টাকার নিচে মেলে না। তিনি বলেন, যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি, সেখানে গত দুই বছরে কারও বেতন বাড়েনি। খরচ কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ছেলে-মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে মাসে দু-একবার রেস্তোরাঁয় খেতে যেতাম। এখন সেটা বাদ দিয়েছি। ছেলে-মেয়ের জন্য মৌসুমি ফল কিনলেও সেটা এখন অর্ধেকে চলে এসেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি পরিবারে স্থির ব্যয় বেড়েছে বাসাভাড়া, শিক্ষার খরচ, পরিবহন ব্যয় এবং গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল। ডিশ সংযোগ বিল, গৃহকর্মীর মজুরিও বেড়েছে। ময়লা পরিষ্কার ওয়ালাকে দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। আর মাসের শুরুতে বেতন পেয়েই এসব ব্যয় মেটাতে হয় তাই এ ক্ষেত্রে সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ নেই।
এদিকে, কাঁচাবাজারেও ব্যয় বেড়ে চলছে। কোনো কারন ছাড়াই ২৫ টাকার পিয়াজ এখন ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় কিনতে হয়। আদার কেজি ১৯০ থেকে ২শ টাকা। চালের দাম এখন সবচেয়ে বেশি। বেশির ভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। গরু কিংবা খাশির মাংসতো এখন বিলাসিতার খাবারে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরে মাংসের দাম হয়েছে দ্বিগুন। ভোজ্যতেল, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, চিনি, লবন ইত্যাদির দাম বেড়ে যাচ্ছে। ফলে, প্রতিনিয়ত ব্যয় বাড়তে থাকায় ব্যয়বহুল নগরীতে পরিণত হচ্ছে ঢাকা। যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট-এর গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ২০১৭ সালের মার্চে প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরীর তালিকায় শীর্ষ শহর ঢাকা। ‘কস্ট অব লিভিং সার্ভে’ শীর্ষক এ জরিপ খাবার, পোশাক, বাড়িভাড়া, গৃহস্থালি পণ্য, প্রসাধন, পরিবহন, শিক্ষা, বিনোদন ব্যয়সহ ১৬০ ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়। জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক দিয়ে বিশ্বের মোট ১৩০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৬২তম।
শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, গ্রামের মানুষ আছেন আরও বিপাকে। ২০১০ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা গিয়েছিল, তাদের গড় আয়ের পরিমাণ মোট ব্যয়ের চেয়ে বেশি। তারা মাসে ৩৬ টাকা সাশ্রয় করতে পারতেন। ২০১৬ সালে দেখা যাচ্ছে তাদের মাসিক ব্যয়-আয়ের চেয়ে ২৮৮ টাকা বেশি।
চলতি বছরের শুরুতে রাজধানীর খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার দাম বিশ্লেষণ করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলেছে, বিদায়ী বছরে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য্য সামগ্রী ও ১৪টি সেবাখাতের তথ্য পর্যালোচনা করে ক্যাব এই হিসাব দিয়েছে। পণ্যমূল্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৫.১৯ শতাংশ। এর আগে ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৮.৪৪ শতাংশ, পণ্যমূল্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছিল ৭.১৭ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে গত বছর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যয় বৃদ্ধির এই হার ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন রকম ফল বয়ে আনতে পারে। ব্যয় অনুপাতে একজন ব্যক্তির আয় বৃদ্ধি না পেলে সেটা স্বস্তিদায়ক হবে না। আয় বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। যদি ব্যয় বৃদ্ধির তুলনায় মানুষের আয় বৃদ্ধি হয় তাহলে সেটাই হবে স্বস্তিদায়ক।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও পিপিআরসি’র নির্বাহী সভাপতি (পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার) ড. হোসেন জিল্লুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কয়েকটি কারন রয়েছে। প্রথমত, যাতায়াত খরচের বিষয়ে যদি চিন্তা করি এক্ষেত্রে যাতায়াতের উপর বিশেষ করে গণপরিবহণের ওপর যে ধরনের ইনভেস্টমেন্ট হওয়া দরকার ছিল ওই ধরনের ইনভেস্টমেন্ট কিন্তু করা হয়নি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, নগরের বিনিয়োগগুলো যে সকল খাতে হওয়া দরকার বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবন মানের সঙ্গে যেগুলো জড়িত সেগুলোর ওপর ওই ধরনের বিনিয়োগের অগ্রাধিকার নেই। যেমন স্বল্প আয়ের আবাসনের ওপর বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো অত্যন্ত সিমিত। জমিজমা বা রিয়েলএস্টেট কোম্পানির আগ্রহ এবং সরকারেরও উৎসাহিত করার জায়গাগুলোতে বড় ধরনের ঘাটতি আছে।
এর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবনমানের জায়গাগুলোতে আমাদের যে বিনিয়োগ হওয়া দরকার সেখানে বিনিয়োগ অপর্যাপ্ততা আছে। সেজন্য ঘরভাড়া অথবা যাতায়াত খরচাবলি বেড়েই চলেছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের জীবনযাত্রার খরচটা বাড়ে কেন? খরচের মধ্যে একটি উপাদান হচ্ছে প্রয়োজনীয় উপকরন। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যয় আমরা যেটাকে চাঁদা বলতে অভ্যস্ত। অর্থাৎ শুধুমাত্র উপকরণ নয় বরং অন্যান্য খরচের বোঝাটাও বেশ বেশি। এসব খরচের ধাক্কাগুলো ভোক্তার উপর চলে যায়। উৎপাদনের খরচটা শুধু উৎপাদনের জন্য হচ্ছে না। এটা নানা ধরনের নন ইকোনোমিক খরচগুলো বেশি বলে চূড়ান্তভাবে ভোক্তার কাছে যে দামটা যায় সেটা একটু বেশি হয়ে যায়। তৃতীয়ত, বিদ্যুৎসহ এই সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়গুলোর সাশ্রয়ী উৎপাদনের দিকে নজর কম। চতুর্থ কারন হচ্ছে, দেশে কর’এর বিন্যাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রত্যক্ষ কর-এর চেয়ে পরোক্ষ করের বোঝা অনেক বেশি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্ণর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এটা শুধু ঢাকায় না গ্রামেও এর প্রভাব আছে। মূল ব্যপারটা হলো, আমাদের দেশে আয় বৈষম্যটা বেড়ে গেছে। একদিকে সরকার বলছে উন্নয়ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে শতকরা ৫ ভাগ থেকে ১০ ভাগের। বাকী ৯০ ভাগ জনগনের কোনো অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে না। ।
প্রকৃত আয় না বাড়াতে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এবং আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এটার সমাধান শুধু দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনলে হবে না। আয় বৈষম্য কমাতে হবে। আয় বৈষম্য কমানোর প্রধান হাতিয়ার হবে যারা অত্যন্ত ধনী তাদের কাছ থেকে প্রপারলি ট্যাক্স সংগ্রহ করে জনগনের জন্য ব্যয় করা।
No comments